#ফাবিয়াহ্_মমো.
#উপসংহার .
অংশ-০১.
প্রচণ্ড ভয় নিয়ে আকাশে তাকালো সৌভিক। রাতের আকাশটা অসম্ভব রূপে শান্ত। আগামীদিনের দূর্ভোগ সংকেতটা রণাঙ্গনের মতো লাগছে। ঢাকজাতীয় রণবাদ্য যেনো বিপদের সংকেত দিচ্ছে। সামনে যেই অপ্রস্তুত অবস্থা আসছে, সেটার কবলে পরলে ভারী বিপদ। সৌভিক বুঝতে পারলো এই মূহুর্তে সে নিরুপায়। দুটো শান্ত মানুষ পরিস্থিতির খপ্পরে প্রচণ্ড জেদি হয়ে গেছে। তাদের ঠান্ডা স্বভাবের নিচে একরোখা তেজটা আগুনের মতো জ্বলছে। তাদের থামানো-দমানো অনেকটা দুষ্প্রাপ্য ব্যাপার। জানতে-অজান্তে বড় ভুলের দিকে পা বাড়িয়েছে তারা। সৌভিক কল্পনার চোখে সব যেনো ঠিকঠাক মতো দেখতে পেলো। মজবুত দড়িটা দুদিকের অসম্ভব টানে মাঝ বরাবার ছিঁড়ে গেলো। সৌভিক তৎক্ষণাৎ চোখ বুজে ফেললো। কল্পনার চিত্রটা সাথে-সাথে মুছে ফেলতে চাইলো, কিন্তু সে পারলো না। শত চেষ্টা করেও মন থেকে ঘুচলো না। এই নিঝুম রাতে সৌভিকের পাশাপাশি আরো দুটো মানুষ নির্ঘুম মূহুর্ত কাটাচ্ছে। একজন ছাদের ঘরে নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, অপরজন অন্ধকার রুমে নিজের ভাগ্যের খেলা চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। পরদিন সকাল বেলাটা আশ্চর্যভাবে শুরু হলো। শুরু হলো সৌভিক ও শানাজের বিয়ের আমেজ দিয়ে। শুরু হলো নিজেদের নিরব সংঘর্ষ সকলের চোখে ধূলো দিয়ে। মেহনূর সেই রাতের কথাগুলো ভুলতে পারেনি। আর হয়তো সে ভুলবে না। মাহতিম কোন্ প্রেক্ষিতে কথাগুলো বুঝিয়েছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। যা বুঝার ছিলো, তা সম্পূর্ণ রূপে বুঝে ফেলেছে মেহনূর। হোক ভুল বুঝাবুঝি, এবার কি আদৌ মেহনূরের দোষ ছিলো? একদম না! মেহনূর তাই বলে বারবার নিজেকে ছোট করতে যাবে না। এমন মতের উপর অটল থেকে বিয়ের দায়-দায়িত্ব দেখছে সে। হঠাৎ মাহতিমের মুখোমুখি হয়ে গেলে মুখ ফিরিয়ে নেয় মেহনূর। যদি মাহতিম নিজ থেকে না আগায়, তাহলে মেহনূর নিজেও আশকারা দিবে না। যা যেমন আছে, তেমনি থাকুক। মানুষ ওকে পেয়েছে কি? চুপ করে থাকে বলে ইচ্ছামতো মর্জি খাটাবে? এবার এই মর্জিগুলো অমান্য করে দেখাবে। সেও দেখতে ইচ্ছুক জল কতদূর আগায়। কাউকে পরোয়া করবে না। কোনোকিচ্ছু আমলে নিবে না। দেখা যাক পরিস্থিতি তাকে কোথায় নিয়ে যায়।
ধুমধামের বিয়ে মানেই নানা কাজের ঝামেলা। এটা দেখো, ওটা দেখো এরকম করতে-করতে সময় যায়। ডেকোরেশনের ব্যাপারটা সিয়ামের হাতে সপে মাহতিম আপাতত ক্যাটেরিং দিকটা দেখছে। সবকিছু যেনো ফার্স্ট ক্লাস চাই, এরকম একটা জিদ কাজ করছে। কানে ফোন এঁটে খুবই শান্ত ভঙ্গিতে আপডেট শুনছে। বাঁ হাতের কবজিটা চোখের সামনে এনে সময়টা একবার দেখলো। দুপুর বারোটা বেজে পনের মিনিট চলছে। ঠিক সন্ধ্যার দিকে হলুদ ছোঁয়ার অনুষ্ঠান হবে। এখনো হাতে পাঁচ-ছয় ঘন্টার মতো সময় আছে। সময়ের হিসাবটা কাটায়-কাটায় ক্যালকুলেট করে বাড়তি কাজের চিন্তা করলো। মধ্য গগনের গোলাকার চাকাটা ভালোই গরম বাড়িয়েছে। অসহ্য তাপদাহে বাড়ির ভেতরটাও বেশ গরম। মাহতিম একটুখানি ঠান্ডা বাতাসের আশায় জানালার কাছে গেলো। ফোনে কথা বলতে থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে ডাকলো,
– মাহতিম ভাইয়া,
নিজের নামটা শুনতে পেয়ে ওই অবস্থায় ঘুরলো মাহতিম। ঠিক পেছনে হাসিমুখে সুরাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় সৌজন্যতা এবং সরল ভঙ্গিতে কিছু বলতে চাচ্ছে। ‘ দুই মিনিট পর কল দিচ্ছি। ‘ বলে কলটা কাটলো মাহতিম। সুরাইয়ার হঠাৎ আগমন দেখে একটু অদ্ভুত-অদ্ভুত লাগছিলো। পুরোনো ব্যাপার-স্যাপার ভুলে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য গলায় বললো,
– কিছু বলতে চাচ্ছো?
মাথাটা ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে নাড়িয়ে স্বাভাবিক হলো সুরাইয়া। সহজ ভঙ্গিতে বললো,
– আমার পুরোনো ভুলগুলোর জন্য দুঃখিত ভাইয়া। একসময় আপনাকে প্রচুর বিরক্ত করেছি। আপনাকে, মেহনূরকে কম জ্বালাতন করিনি। এখানে আসার পর থেকে আপনার কাছে কথাগুলো বলতে চাইছিলাম, কিন্তু আপনি শানাজ বুবুর জন্য ব্যস্ত হয়ে আছেন। সবার সামনে এই কথাগুলো বলতে আমার অস্বস্তি লাখতো। এজন্য এই ফাঁকে আপনাকে বলতে এলাম।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হাসলো মাহতিম। ফোনটা বাঁ পকেটে ফেলে নির্ভার কন্ঠে বললো,
– আগে কি করেছো, না-করেছো ওসব কথায় মাটি দাও। এখন যেমন আছো, সবসময় তেমনই থাকো। ক্ষমাটা ওর কাছে চাইলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে খুশি হবো। ওকে বলা মানেই আমাকে বলা।
অনেকটা আক্ষেপমুক্ত হয়ে হাসি দিলো সুরাইয়া। এতোদিন ভয়ে ছিলো কথাগুলো কিভাবে পেশ করবে। কিন্তু এখন সবকিছু বলতে পেরে বুকের পাথর সরে গেছে। এক অদ্ভুত অপরাধে মন খচখচ করছিলো। যেটা এখন নেই। মাহতিমের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, এটা চিন্তা করলেই ভয়ে বুক কাঁপতো! এখন কেনো জানি জড়তা কেটে গেছে। মাহতিম কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে তৎক্ষণাৎ ট্রাউজারের রাইট পকেটে হাত ঢুকালো। কালো ওয়ালেটটা মুঠোয় নিয়ে বাহির করতেই ভেতর থেকে কার্ড টেনে নিলো। ওয়ালেটটা পুনরায় বন্ধ করে পকেটে রাখলে কার্ডটা সুরাইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো। দু’আঙ্গুলের ফাঁকে ধরা রাখা কার্ডটায় উজবুক ভাবে তাকালো সুরাইয়া। প্রশ্ন গলায় বললো,
– এটা কি ভাইয়া?
মাহতিম ওর হাত টেনে কার্ড গুঁজে বললো,
– এটা রাখো। তোমার বোনকে সঙ্গে নিয়ে শপিংয়ে যাও। ও যা-যা কিনতে চায়, কিনে দিও। আর তুমিও নিজের জন্য কিছু কেনো। আমার তো সময় নেই, আমি শপিংয়ে যেতে পারবো না। তোমরা যাও কেমন?
মাহতিম অজুহাত দেখিয়ে খুব সুন্দর কেটে পরলো। সুরাইয়া পুরোপুরি অবাক! তার মানে সত্যি-সত্যিই দুজনের ভেতর দ্বন্দ্ব চলছে? মাহতিম তাহলে কৌশলের সাথে মেহনূরকে দূরে ঠেললো? সুরাইয়া চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে ছাদের রুমে ঢুকলো। মেহনূরের কাছে গিয়ে শান্ত ভাবে বললো,
– মেহনূর, ভাইয়া তোকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে বলেছে। তুই একটু সময় বের করে আসতে পারবি? এই দ্যাখ কার্ড। কার্ডটাও ধরিয়ে দিলো।
মেহনূর একনজর কার্ডের উপর ফেললো। এরপর দৃষ্টি সরিয়ে শুকনো শাড়ি ভাঁজ করতে-করতে বললো,
– কার্ডটা যার থেকে নিয়েছো, তাকে ফেরত দিয়ে আসো। আমি কোনো শপিং-টপিংয়ে যাবো না বুবু।
ভাঁজকৃত শাড়িটা নিয়ে আলমারি খুললো মেহনূর। কোনো বিশেষ ভাবাবেগ না দেখিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। পেছনে থাকা সুরাইয়া অবুঝের মতো একবার কার্ডের দিকে তাকালো, এরপর মেহনূরের দিকে দৃষ্টি রাখলো। মেহনূর ক্লথ-হ্যাঙ্কারে শাড়ি ঝুলাতেই বললো,
– দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট কোরো না বুবু। কার্ডটা ফেরত দিয়ে আসো। নিচে প্রচুর কাজ পরে আছে। আমি একা-একা পারবো না।
সুরাইয়া ছোট্ট স্বরে ‘ ঠিক আছে ‘ বলে বেরিয়ে গেলো। ও যেতেই শূন্য দরজার দিকে ফিরলো মেহনূর। হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সবার শাড়ি কেনা শেষ। শুধু মেহনূর বাকি আছে। মারজা যখন মেহনূরের জন্য শাড়ি কিনে দিতে চাইলেন, মেহনূর তখন বাধা দিয়েছিলো। ওর গায়ের প্রতিটি শাড়ি মাহতিমের কিনে দেয়া। এ যাবৎ যতো পোশাক-আশাক দরকার পরতো, সবই মাহতিম বলার আগে নিজেই হাজির করতো। অথচ আজ সুরাইয়াকে দিয়ে কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছে। কি নিষ্ঠুর আচরণ! ছিঃ! নূন্যতম বিবেকও কি কাজ করেনি? মাহতিম কি জানেনা, মেহনূর কিসে অভ্যস্ত? নিজে গিয়ে কি শাড়ি আনতে পারলো না? সে যদি সুরাইয়ার হাতে কার্ড না দিয়ে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিতো, তাহলে মেহনূর সেটা ফিরিয়ে দিতো? কক্ষনো না! মেহনূর তখনই সমস্ত রাগ-জেদ-অভিমান পানি করে শাড়িটা বুকে জড়িয়ে নিতো। তার মাহতিমের দেওয়া শাড়িটা পরতে বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ করতো না। পদে-পদে এমন নিষ্ঠুর ব্যবহার সহ্য করা সহজ? প্রচণ্ড জোরে আলমারির দ্বারটা বন্ধ করলো মেহনূর। শব্দের তীব্রতা রুমের বাইরে গিয়ে সুরাইয়ার কানেও পৌঁছলো। চমকে গিয়ে সিঁড়িতে ভয় পেলো সুরাইয়া। মুখ ফিরিয়ে ছাদের দরজার দিকে তাকালো।
.
জলন্ত অগ্নিপিণ্ডটা পশ্চিমাকাশে হেলে পরেছে। আকাশের বুকে কেউ যেনো কমলা রঙের তুলি টেনেছে। কি চমৎকার সে দৃশ্য! আকাশের পানে মুখ তুললে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে হয়। পড়ন্ত বিকেলের মিঠে আলোয় লন সাইডটা জমজমাট। আকাশে যখন সাঁঝের মায়ায় বেগুনি আঁচড় গাড়বে, তখনই চর্তুপাশ রাঙিয়ে মরিচবাতির আলো জ্বলবে। আস্তে-আস্তে বাড়ির লনে অতিথিবৃন্দের সমাগম হচ্ছে। লনটার একপাশে ছোট্ট একটা প্যান্ডেল করা। পুরো প্যান্ডেলটা হলুদ রঙে মুড়ে দেওয়া। দূর থেকে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো আলোকসজ্জা। সবকিছু প্ল্যানমাফিক করতে পেরে স্বস্তি পেয়েছে মাহতিম। একটু পরেই শানাজকে প্যান্ডেল তোলা হবে। ফটোগ্রাফারের দলটা আসতে একটু দেরি আছে। শেষ বিকেলের আভাটা মুছে গিয়ে সাঁঝের মায়ায় ডুবলো। আকাশের রঙটা ফিকে হয়ে গাঢ় বেগুনি রঙে পরলো। নীতির রুমে সব মেয়েরা একত্র হয়ে সাজছে। তিনটা বিউটিশিয়ান মেয়ে জনে-জনে সবাইকে সাজিয়ে দিচ্ছে। শানাজের পড়নে হলুদ রঙের জামদানী কাপড়ের শাড়ি। লাল রঙের মোটা পাড়টা দারুণ চমৎকার! শাড়ির আঁচলটা টকটকে লাল। লালের উপর সোনালী বুননের কারুকাজটা ঝিকমিক করে জ্বলছে। সঙ্গে লাল রঙের ব্লাউজ। যার হাতাটা কনুই পযর্ন্ত এসেছে। মাথায় ঘোমটা রেখে বাঙালি স্টাইলে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। শানাজকে হলুদ সন্ধ্যার হলুদ পরী লাগছিলো। গ্রামের ছাপ ধুয়ে শহুরের চাকচিক্যে মারাত্মক মানিয়ে গেছে। যেনো শানাজ শহরের মেয়ে, শহরের কাতারেই বেড়েছে। সবার আগে রেডি হলো ফারিন। সাজসজ্জা ও শাড়ির বেশ নিয়ে নিচে নামতে নিলো, দু’হাতে শাড়ি ধরে নিচে নামতে নিলে হঠাৎ মেহনূরের কথা মনে পরলো। ‘ কি সাংঘাতিক! ভাবী কোথায়? ভাবী না আমাদের সাথে ছিলো? ‘ কথাগুলো বলতে গিয়ে দ্রুত মেহনূরকে খুঁজতে লাগলো। সোজাসুজি ছাদের দিকে পা বাড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমের কাছে পৌঁছলো। রুমের স্লাইডিং ডোরটা বামে টেনে পা বাড়ালো ফারিন। আশ্চর্য হয়ে বিছানার দিকে চোখ বড় করে তাকালো। চরম বিষ্ময় নিয়ে বিছানার কাছে এগুতে-এগুতে বললো,
– ভাবী তুমি রেডি হওনি কেন? নীতি আপুরা সবাই রেডি হয়ে যাচ্ছে। তুমি কাউকে না বলে এখানে এসেছো কেন? কি হয়েছে তোমার?
ফারিন দু’হাতে শাড়ি ধরে বিছানায় এসে বসলো। মেহনূর বিছানার হেডসাইডের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বই পড়ছিলো। ফারিনকে পাশে বসতে দেখে বই বন্ধ করে বললো,
– কিছু হয়নি ছোটকু ননদিনী। তুমি নিচে যাও। সবাই তোমাকে খুঁজবে। আমি একটু পরেই তোমাদের সাথে দেখা করছি।
ফারিন ভ্রঁ কুঁচকে বিষ্ময় নিয়ে বললো,
– তুমি কি ভাইয়ার উপর কোনো কারণে রেগে আছো?
ঠোঁটের দু’কোণে হাসির ভাঁজ ফেলে ‘ না ‘ করলো মেহনূর। ফারিনের হাতদুটো আদর দিয়ে ধরলো। মুখে হাসি টেনে বললো,
– কোনো রাগ নেই গো। আমি যে তোমাদের মতো কোলাহল পছন্দ করি না, এজন্য একটু আলাদা হয়ে বসে আছি। তুমি যাও, আমি একটু পরেই নিচে আসবো।
ফারিন কোনো কথা বললো না। মেহনূরের হাবভাব দেখে যা বুঝার ছিলো, সব বুঝে গেছে। যেভাবে ব্যস্ত পায়ে ছাদে উঠেছিলো, তার বিপরীত ভাবে নিরস্ত পায়ে নেমে এলো। দোতলার কাছে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলো সে। কয়েক মিনিট চিন্তাভাবনা করে বামের সেই আধ ভেজানো রুমটার দিকে তাকালো। সেদিক বরাবর পা ফেলে সাদা দরজার কাছে পৌঁছলো ফারিন। চুড়ির ঝিনঝিন শব্দযোগে আস্তে করে দরজা ঠেলে দিলো। বিনম্র কন্ঠে বললো,
– ভাইয়া আছো?
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম। গায়ে জলপাই রঙের পান্ঞ্জাবী। হাতে পারফিউমের বোতলটা নিয়ে কড়া স্প্রে করছে সে। এটা তার শক্ত অভ্যাস। বদলানো মুশকিল। স্প্রের মুখটা বন্ধ করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
– বল,
ফারিন দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকে পরলো। মাহতিমের কাছে এসে বিমর্ষ কন্ঠে বললো,
– তুমি ভাবীকে কিছু বলেছো?
স্লিভটা গুটাতে গিয়ে মাহতিম স্থির হয়ে গেলো। মুখটা ডানে ঘুরিয়ে ফারিনের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করে বললো,
– কি বলতে যাবো?
ফারিন কোনোপ্রকার ভণিতা না করে বললো,
– এদিকে সবাই রেডি হয়ে যাচ্ছে। ভাবী এখনো শাড়িই পরেনি! এটা কি কোনো কথা?
মাহতিম কথাটা শুনে শক্ত হয়ে গেলো। সে কি আবারও কোনো ভুল করে ফেললো? সবাই রেডি হচ্ছে, ও কেনো ভঙ ধরে আছে? চিন্তার চাকাটা ঘুরাতে লাগলো সে। কোন্ ভুলটা করেছে সেটা নিয়ে ভাবতেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো মাহতিম। দাঁত শক্ত করে তৎক্ষণাৎ চেঁচিয়ে উঠলো,
– ওহহো শিট! আমিতো ভুলেই গেছি..
দ্রুত স্প্রের বোতলটা ফেলে গাড়ির চাবি খুঁজতে লাগলো। অস্থির হয়ে তন্নতন্ন করে চাবি খুঁজছিলো মাহতিম। ভাইয়ের অবস্থা দেখে কাহিনী বুঝলো না ফারিন। বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে মাহতিম ততক্ষণ চাবি পেয়ে গেছে। ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরুনোর সময় গলা উঁচিয়ে বললো সে,
– খবরদার! আমি না আসা পযর্ন্ত অনুষ্ঠান শুরু করবি না!
আর দাঁড়ালো না মাহতিম। দ্রুতবেগে দৌঁড় লাগিয়ে একছুটে গ্যারেজে আসলো। লন সাইড থেকে দৌঁড়ানোর দৃশ্যটা তৌফ দেখতে পেলো। ‘ মাহতিম কই যাস? ‘ বলার আগেই চোখের সামনে দিয়ে জিপ ছুটিয়ে বেরুলো। মাহতিমকে উন্মত্ত ভঙ্গিতে বেরুতে দেখে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হলো। একটু পরে অনুষ্ঠান শুরু হবে, মাহতিম এখন কোথায় গেলো? ওমন তড়িঘড়ি ভঙ্গিতে কোথায় ছুটলো?
প্রচণ্ড অসহনীয় গরম। ভ্যাপসা গরমের জ্বালায় পুরো শহরটা ছটফট করছে। গ্রীষ্মের খরতপ্ত আবহাওয়াটা সন্ধ্যার দিকেও তাপ দিচ্ছে। আধাঘন্টার রাস্তাটা শর্টকাট মেরে দশ মিনিটে ফিরলো মাহতিম। গায়ের পাণ্ঞ্জাবীটা হুলস্থুল অবস্থার জন্য পুরোপুরি ভিজে গেছে। মাথার চুলগুলো ঘেমে নাস্তানাবুদ। কপালের কাছে চুলগুলো থেকে টুপ-টুপ পানি ঝরছে। গ্যারেজের কাছে জিপ ঢুকিয়ে দৌঁড় লাগালো মাহতিম। লনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো, অনুষ্ঠান এখনো শুরু করেনি। এক দৌঁড় দিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছলো সে। তিনধাপ সিঁড়ি একসঙ্গে পেরিয়ে ছাদের রুমটায় পৌঁছে গেলো। স্লাইডিং ডোরটা খুলে ভেতরে তাকাতেই থমকে গেলো মাহতিম। দৌঁড়ের কারণে প্রচণ্ড হাপাচ্ছে সে। মুখ খুলে হাপাতে থাকলে তার দিকে দু’জোড়া দৃষ্টি পরলো। মাহতিমের অবস্থা ঘেমে-নেয়ে একদম জঘন্য! পুরো মুখ লাল হয়ে আছে, চুলগুলো ভিজে গেছে। মুখ দিয়ে অবিশ্রামভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার ডানহাতে একটা সাদা রঙের ব্যাগ। মাহতিমকে জোরে-জোরে হাপাতে দেখে কপাল কুঁচকালো শানাজ। অবাক কন্ঠে বললো,
– একি অবস্থা! আপনি কোথা থেকে এলেন? আপনি না রেডি হচ্ছিলেন?
অস্বাভাবিক নিশ্বাসের জন্য মাহতিম কথাই বলতে পারছে না। ঢোক গিলে ঠান্ডা হওয়ার জন্য মাথাটা নিচে ঝুঁকালো। মেহনূরকে রেডি করার জন্য একটু আগে এসেছে শানাজ। এসেই দেখে মেহনূর রেডি হয়নি। মেহনূরকে জোরপূর্বক নিজের কেনা শাড়ি ধরিয়ে রেডি হতে বললো। মেহনূর নিরুপায় হয়ে সেই শাড়িটাই হলুদের জন্য পরলো। এই অবস্থায় মাহতিমকে দেখে শানাজ কি করবে ভেবে পেলো না। মেহনূর একবারও পিছু ফিরে দরজার দিকে তাকালো না। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা চুল আঁচড়াচ্ছে। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার জন্য মাহতিম ঢোক গিলে বললো,
– এই প্যাকেটটা বিছানায় রেখো শানাজ। নিচে কাজ আছে, আসছি।
চলে গেলো মাহতিম। হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বিছানায় রাখলো শানাজ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যবর্তী ফ্যাসাদে ঢুকা অনতিচর্চার বিষয়। তাই চুপচাপ মেহনূরকে নিচে আসতে বলে সেও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। চুল আঁচড়ে ঘাড়ের কাছে খোঁপা করলো। সবুজ রঙের শাড়ির সাথে ঝুমকা জোড়া পরলো। সবুজ রেশমি চুড়িতে দু’হাত ভর্তি করলো। সম্পূর্ণ রেডি হয়ে রুম থেকে বেরুতে নিলো সে, যেতে ধরেই বিছানার দিকে সাদা ব্যাগটার উপর চোখ পরলো। স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকতেই ব্যাগটার দিকে এগিয়ে গেলো। কৌতুহলের বশেই সাদা ব্যাগটার ভেতর ডানহাত গলিয়ে দিলো সে। ভেতর থেকে খচখচ করা প্যাকেটটা টান দিতেই স্তম্ভ দৃষ্টিতে তাকালো। বুকটা আচানক ধড়ফড়-ধড়ফড় করতে লাগলো। গলা শুকালো, রক্তের স্রোত বাড়লো, মাথাটা ফাঁকা-ফাঁকা অনুভব হলো। স্বচ্ছ প্যাকেটটার ভেতর একটা চমৎকার হলুদ শাড়ি। রঙটা গাঢ় হলুদ, পাড়টা গাঢ় সবুজ। হলুদ-সবুজের মাঝে অদ্ভুত সুন্দর শাড়িটা দেখে অভিভূত হয়ে গেলো। এই শাড়িটা আনার জন্যই ওমন করে হাপাচ্ছিলো? ঘামে ভিজে জবজবা হয়ে ফিরলো? পুরো অনুষ্ঠানে নিজেকে মাটি করে মেহনূরের জন্য ছুটলো? উদাস চাহনিতে চোখ বুজলো মেহনূর। দু’হাতে শাড়িটা বুকে চেপে ধরলো। তখনই প্যাকেটের নিচ থেকে আঠা আলগা হয়ে গেলো, ছোট্ট হলুদ রঙের নোটচিটটা অজান্তেই ফ্লোরে পরে রইলো।
‘ I’m SORRY ‘
Yours Ansari.
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, শেষ পর্বটা অতিমাত্রায় বড় হয়ে গেছে। এই বড় হবার ফলে ‘ তোকে ঘিরে ‘ উপন্যাসেও শেষ পর্বটা সমস্যা করতো। আমি বাধ্য হয়ে আমার বিশাল পর্বটার প্রথম অংশ তুলে দিচ্ছি। বাকিটুকু আগামীকাল পেয়ে যাবেন। ফেসবুকের এমন লিমিটেড শব্দের জন্য আমি বড় লিখেও শান্তি পাই না। দুঃখিত।
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_৬৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
#উপসংহার .
অংশ-০২.
বিয়েবাড়ির চেহারাটা এক লহমায় বিধ্বস্ত হলো! কেউ আন্দাজও করতে পারলো না এই মূহুর্তে কি হচ্ছে! সবার মূখের অবস্থা পাণ্ডুর হয়ে গেছে। চেহারার সবটুকু আনন্দ গ্লানিতে পরিণত হয়েছে। কেউ স্বাভাবিক হতে পারছে না! মারজা থমকানো দৃষ্টিতে চুপ হয়ে গেছে, মাহমুদার অবস্থা বোবা। সুজলা ভয়কাতুরে দৃষ্টি দিয়ে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে, মাহতিমের মুখ থেকে সঠিক তথ্য জানার ইচ্ছা পোষণ করছে। মাহতিম কিছু বলছে না। শানাজ ভয়-ভয় চাহনি দিয়ে বারবার ঢোক গিলছে, থুতনিটা থরথরিয়ে কাঁপছে, মাথা কাজ করছে না। হঠাৎ কাধের উপর স্পর্শ পেলে বামে তাকায় শানাজ। চোখ একবার বন্ধ করে শান্ত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে মেহনূর। মেহনূরের অভয় চেতনা দেখে চোখ ঝাপসা হয় শানাজের। সাথে-সাথে ঠোঁট কামড়ায় সে। তা দেখে ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়ায় মেহনূর, ঠোঁট নাড়িয়ে বিনা শব্দে বলে, ‘ ঠান্ডা হও বুবু ‘। শানাজ একটু শক্ত হয়, বড় একটা ঢোক গিলে নিজেকে আঁটকায়। তখনই পরিস্থিত মহলের সামনে নিরবতা ভাঙে মাহতিম। কান থেকে ফোন নামিয়ে একে-একে সবার দিকে তাকায়। কয়েক জোড়া তার দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে। উৎসুক চাহনিতে আসল ঘটনা জানার আকাঙ্ক্ষায় আছে। ফোনটা পকেটে রাখতে-রাখতে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– মাইনর ইন্ঞ্জুরি। টেনশনের কোনো কারণ নেই। বামহাতের এ্যালবোতে সামান্য ব্যথা পেয়েছে। স্টিচের আশঙ্কা নেই। ওনারা আসছে। আপনারা রেডি থাকুন।
একসঙ্গে সবাই চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো। বুকের উপর থেকে কয়েক টনের পাথর যেনো নেমে গেলো। অনেকক্ষণ পর শান্ত হলো সবাই। একটু আগে সৌভিকের কাকা এক্সিডেন্টের খবর পাঠিয়েছে। সৌভিকের গাড়িটা বায়পাস রোডের কাছে প্রাইভেট কারের সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছে। খবরটা শোনার পর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছিলো। তৌফ-সামিক খবর শোনার সাথে-সাথেই সৌভিকের কাছে চলে গেছে। এখন সৌভিকের কাছ থেকে সবটুকু তথ্য জানার পর শান্ত হয়েছে মাহতিম। বাড়ির সবাইকে তখন যার-যার কাজে ব্যস্ত হতে বললো। শানাজ, মেহনূর, নীতি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সব শুনতে পাচ্ছিলো। বিয়ের ভারী সাজে পরিপূর্ণ শানাজকে নিয়ে রুমে ফিরলো তারা। বিউটিশিয়ান মেয়েরা বাকিদের সাজিয়ে দিচ্ছে তখন। নীতি ও মেহনূর শুধু রেডি হতে বাকি ছিলো। এবার সবকিছু ঠিকঠাক শুনে ননদ-ভাবী রেডি হতে লাগলো। মেহনূর যখন শাড়ি ও ব্লাউজ নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলো, তখন পেছন থেকে টিটকারি মারলো নীতি। হাসি দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– সাবধান ভাবী। আজকে কিন্তু সাবধানে থেকো।তোমাকে এই স্টাইলে দেখলে কিন্তু সর্বনাশ! ভাইয়া ডেফিনেটলি কন্ট্রোল হারাবে।
নীতির কথা শুনে লজ্জায় অবাক হলো মেহনূর। কপট রাগ দেখিয়ে নীতির মাথায় আলতো একটা চাপড় মা:রলো। নীতি মৃদ্যু ব্যথায় ঠোঁট গোল করলে ওয়াশরুমে ঢুকলো মেহনূর। দরজা লাগাতে-লাগাতে মেহনূর বললো,
– খুব পাঁজি হয়েছো। যেমন ভাই, তেমনই বোন। দুটোই এক নাম্বার ফাজিল!
মেহনূর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলে হাসতে লাগলো নীতি। কাল হলুদ পর্ব শেষ হওয়ার পর মেহনূরকে ডেকে পাঠিয়েছিলো মাহতিম। মনে-মনে বিষয়টা নিয়ে বড় ভাইকে জ্বালাবে বলে নীতি আর মেহনূরকে বলেনি। নীতি জানতো না, ভাই-ভাবীর মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছে। নীতির মজা করার উছিলায় মাহতিমের ক্ষোভ যেনো একধাপ বেড়েছে। মেহনূরকে ডাকা সত্ত্বেও মেহনূর যখন আসলো না, সেই জিদে খাবারটা পযর্ন্ত ছোঁয়নি। অপেক্ষা করতে-করতে রাত দুটো বাজলো, তিনটা বাজলো, একসময় চারটা পেরিয়ে ফজরের আযান দিলো। তাও মেহনূর আসলো না। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সারারাত অপেক্ষা করেছে মাহতিম। তবুও একটা সেকেন্ডের জন্য মেহনূর আসলো না। অন্ধকার রুমে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিলো সে। এই বুঝি মেহনূর চুপিচুপি আসছে, গুটি-গুটি পায়ে টুপ করে রুমে ঢুকছে। কিন্তু মেহনূর সত্যিই আসেনি। তার সবটুকু চিন্তাকে জলান্ঞ্জলি দিয়ে মেহনূর তাকে কুৎসিত ভাবে অবজ্ঞা করলো। এই অবজ্ঞা পেয়ে নিরবে চুপ হয় মাহতিম। এই অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ, শক্ত অভিমান, তুমুল জেদ দেখে মুখের কথা হারিয়ে ফেললো। এ কি সেই মেহনূর? যে একটা ডাক শুনলেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে মাহতিমের কাছে ছুটে চলে আসতো! সেই মেহনূর কি তাকে বাজে ভাবে উপেক্ষা করলো? ফজরের আযানটা দেওয়ার পর চোখ বুজলো মাহতিম। কি এমন দোষ করেছিলো? কেনো ডাকার পরও এলোনা? পাগলের মতো জিপ ছুটিয়ে বেরুলো, গরমে অস্থির হয়ে শাড়ি কিনে আনলো, শেষপর্যন্ত শাড়িটাও গায়ে দিলো না। আর কতো? চোখ খুললো মাহতিম। ডানে মুখ ফিরালো সে, খোলা জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে দিলো। রাতের সবটুকু অন্ধকার শুষে উদীয়মান সূর্যটা পূব আকাশে উঠছে। দারুণ তেজ, প্রখর লালিমা নিয়ে পৃথিবীর বুকে উদয় হচ্ছে। সূর্যোদয়ের দৃশ্যটা শান্ত মনে ব্যথিত হৃদয়ে চুপচাপ দেখলো মাহতিম। মনের ভেতর থেকে ধরা গলায় সুর এলো, আমি কি তোমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেলাম? আমার সাথে কি করলে মেহনূর? আমাকে একবারও মানুষ মনে হলো না? অপেক্ষার যন্ত্রণা তবুও সহ্য করতাম, তবুও সবকিছু ভুলে যেতাম, কিন্তু এতো অপেক্ষার পরও তুমি এলে না।
.
বরযাত্রীর আসতে এখনো বিশ মিনিটের মতো লাগবে। এই ফাঁকে মুখে একটা পান পুড়লেন সুজলা। পানটা চিবোতে-চিবোতে মাহমুদার উদ্দেশ্যে বললেন,
– বুঝলি ছোটবউ, ওরা আমাদের সাথে কাজটা ভালো করলো না। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে বল? বসে-বসে সবার কাজ দেখবো, এটা কি হলো?
মাহমুদা ফিচেল হেসে বললো,
– জামাইর কথা অমান্য করার উপায় আছে? জামাইর তো এক কথাই সই। এইযে বুঝালাম, বললাম, বাবা আমার হাতেও কিছু একটা দেও। সবার দেখাদেখি আমিও কিছু করি। কে শোনে কার কথা। পাত্তাই দিলো না। মারজা আপাও আমাদের সাথে দূর্নীতিটা করলো। এখন কাকে ধরে-ধরে বোঝাবো?
কথা শুনে একগাল হাসলেন সুজলা। টকটকে লাল ঠোঁটে বললেন,
– আল্লাহর রহমতে মেয়েগুলা ভালো থাকলেই শান্তি। আমার কিচ্ছু চাই না ছোটবউ। সুরাইয়া, সাবা যতদিন ইচ্ছা আমাদের সাথে থাকুক। আমি ওই দুইটাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাই না। বাড়িটা খালি হয়ে গেলে কিভাবে দিন চলবে? মেহনূরকে বিদায় দেওয়ার পর যেই খারাপ লাগতো, এখন শানাজও ….। ভাবলেই বুকটা ছ্যাৎ করে জ্বলে। মেয়ে বিদায় দেওয়া কতো যে কষ্টের! এটা যদি মানুষকে বুঝাতে পারতাম। আহারে, জীবন। বুকের মানিককে আরেক বাড়িতে তুলে দেওয়া লাগে। পাললাম, বড় করলাম, এখন ওরা আরেক বাড়ির সম্পদ।
চাপা নিশ্বাস ছেড়ে আঁচলে চোখ মুছলেন সুজলা। পাশ থেকে মাহমুদা মাথা নুইয়ে আছে। অশ্রু ভারাক্রান্ত সজল নয়নজোড়া ঢেকে রেখেছে। আজ সন্ধ্যার দিকে বাড়ির আরেক টুকরোকে বিদায় করে দিবেন। বাড়িটা আরো শূন্য হয়ে যাবে। চারবোনের যেই হৈহৈ সমাগম ছিলো, আস্তে-আস্তে অন্যবাড়ির জৌলুস বাড়াবে। কি নিষ্ঠুর নিয়ম!
– আপনেরা দুইজন এহনি কান্দিতাছেন? এই অবস্থা যদি মাইয়াটায় দেখে ওয় টিকতে পারবো?
কথা শুনে দুজনই মুখ তুলে তাকালো। সামনে শেফালি দাঁড়িয়ে আছে। সুজলা চোখ মুছে ফিকে হাসি দিয়ে শেফালির হাত ধরে বসালো। মুখে বললো,
– বসো। আমরা কাঁদছি, তুমি বাদ যাবে কেন? কাঁদলে একসাথেই কাঁদি। মেয়ে তো এখনো বিদায় দেওয়া বাকি।
মূহুর্তের মধ্যে শেফালির হাসিমাখা মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। চোখদুটো ছলছল করে উঠতেই ভেজা গলায় বললো,
– আমি থাকবার পারুম না। আমি আপনেগো মতোন থাকবার পারুম না। আমি কাউরে বিয়া দিতাম না ভাবী। বাড়িডা খালি হই যাবো। আমি ক্যামনে থাকুম? আমার তো পুলাও নাই।
সুজলা ও মাহমুদা একে-অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। শেফালির জীবনটা দুঃসহ। স্বামীর ভালোবাসা বলতে কোনোদিনই ওইটুকু সুখ পায়নি। যার হাত ধরে এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়েছিলো, লোকটা দিনশেষে এক নম্বরের ফাপড়বাজ। কোথায়-কোথায় আছে, ম:রে গেছে না পচে গেছে, কেউ জানে না। ওই বদমা:শের জন্য এখন দুঃখ করে না শেফালি। ওই লোক কোনোদিন শান্তি দেয়নি। আজ শেফালি নিঃস্ব। নিজের কৃতকর্মের জন্য প্রায়ই বিলাপের শোকে কাঁদে। শেফালির তো কেউ নেই। বাবা নেই, মা নেই, আত্মীয় বলতে তেমন কেউই নেই। যার হাতে মানুষ হয়েছিলো, ওই খালাও ছিলো বা:টপার। ধুকে-ধুকে জীবনের এটুকু পর্যায়ে এসে একদম নেতিয়ে গেছে সে। একমাত্র ছেলেটার জন্য গালমন্দ শুনেও কতকিছু করলো, বিদেশের মাটিতে পাঠালো, নিজের সব সম্বল বেচে দিলো, আজ সেই ছেলেরও খোঁজ নেই। নিজ থেকেই মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। মূর্খ মায়ের সাথে কিসের যোগাযোগ? গ্রামের গেঁয়োভূতের সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই। ফটর-ফটর ইংলিশ বলা ছেলেটা এখন বাংলা বলতে বিব্রত হয়। শেফালি জানে, তার জীবনের সমস্ত কৃতকর্মের ফল পাই-পাই করে পাচ্ছে। স্বামীর সুখ ও ছেলের ভালোবাসা থেকে আজ কঠিনভাবে বন্ঞ্চিত। এ কি তার প্রাপ্য না? অন্যকে জ্বালিয়ে-মা:রিয়ে যে হক আদায় করতো, সেই হক আজ তাকেই পুড়িয়ে মা:রছে, এ কি বিচার না? সুরাইয়া-সুজলা-মাহমুদা ছাড়া তার এখন আপন বলতে আজ কেউ নেই। শেফালি সেটা কড়ায়-গণ্ডায় ভালোভাবেই বুঝে গেছে। যা আপন, যত আপন, এখন শুধু তারাই। শুধু তাদের ঘিরে, তাদের নিয়ে।
.
খয়েরী রঙটা ঐশ্বর্যের মতো ফুটে আছে। যেনো ঝলমলে আলোর মাঝে মনোরম কোনো অপ্সরী। শাড়িটা চমৎকার ভাবে পরেছে মেহনূর, আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ রকম সেজেছে। চোখের কোলদুটো গাঢ় কাজলের ছোঁয়ায় রহস্যময়ী লাগছে। নরম ঠোঁটদুটোর উপর খয়েরী রঙের ছোঁয়া। হালকা বুরুজের স্পর্শে গালদুটো অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। মাথার মধ্যভাগে সিঁথি তুলে চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। দুপাশ থেকে কিছু চুল পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে মাথার পেছনে আঁটকে দিয়েছে। অসংখ্য বড়-বড় লাল গোলাপ দিয়ে মাথার পেছনটা সারিবদ্ধ ভাবে এঁটে দিয়েছে। কানে ঝুলছে খয়েরী রঙের দুল। কাঁচ-কাটা রেশমি চুড়িতে দুহাত পরিপূর্ণ। মেহনূরের সাজ-রূপ-লাবণ্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেছে নীতি। চোখে আশ্চর্যজনক চাহনি রেখে তাকিয়ে আছে। নিজের সোনালি লেহেঙ্গাটা দুহাতে ধরে মেহনূরের সামনে আসলো সে। মেহনূরকে আপাদমস্তক দেখতে-দেখতে মুগ্ধ গলায় বললো,
– তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো, তোমাকে সবচাইতে সুন্দর দেখাচ্ছে ভাবী। আমি নিজে মেয়ে হয়েও তোমার উপর ইম্প্রেসড্। তুমি বেয়ার ফেসে যতটা সুন্দরী, তোমাকে মেক-ওভারের পর আরো মারাত্মক লাগছে। একটা কথাও মিথ্যে বলছি না।
লজ্জায় চোখ নামালো মেহনূর। তাকে আসলেই সুন্দর লাগছে? একবার কি মাহতিমের কাছে যাবে? বুবুর যেদিন আংটি বদল হলো, সেদিন রাতে অন্ধকার মূহুর্তে মাহতিম গলায় চুমু খেয়েছিলো। মাদক কন্ঠে অদ্ভুত নেশার মতো বলেছিলো, ‘ তোমাকে রাণীনগরের রাণী লাগছে। তোমার পাশে আমাকে মানাচ্ছে না। নিজেকে ক্ষুদ্র প্রজার মতো লাগছে। এই সামান্য প্রজা তোমাকে চুমু খাচ্ছে। ইশ! এটাতো ঠিক হলো না। ‘ হঠাৎ চিন্তার দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরলো মেহনূর। নীতি তার ডানহাত ধরে ‘ ভাবী, ভাবী ‘ বলে ডাকছে। সংবিৎ ফিরে পেতেই একটু অপ্রস্তুত হলো মেহনূর। পরক্ষণে শান্ত গলায় বললো,
– ঠিক আছি, ঠিক আছি। আমি হাতের কাজটা শেষ করে এখুনি নিচে আসছি। ঠিক আছে?
নীতি হাসি দিয়ে বললো,
– আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আসো।
নীতি রুম থেকে চলে যেতেই মেহনূর রুম থেকে বেরুলো। বুকভর্তি নিশ্বাস নিয়ে ডানে-বামে তাকালো। নীতি বা ফারিন কেউ নেই। বুকে সাহস জুগিয়ে পায়ে-পায়ে সাদা দরজার কাছে আসলো। দরজাটা আজ বন্ধ। নব্ মোচড় দিতে গিয়ে আচমকা থামলো মেহনূর। কানে জোরে-জোরে সেই কথাগুলো বেজে উঠলো, ‘ কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কথা চললে সবসময় নক করে ঢুকতে হয়। কথাটা মাথায় রাখবে, দ্বিতীয় বার রিপিট করবো না ‘। নব্ থেকে হাত সরালো। নিজের রুম হওয়া সত্ত্বেও আজ বাইরের মানুষের মতো দরজায় নক করলো। টুকটুক শব্দ করার পর যখন ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না, তখন নব্ মোচড়ে দরজা খুললো মেহনূর। ভেতরে দৃষ্টি ফেলে দেখলো, রুম খালি। মাহতিম নেই।
.
তিন কবুলে আবদ্ধ হয়ে বিদায় হলো শানাজ। সবটুকু স্মৃতি মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে, নিজের ছোট্ট গ্রামের কাছে ফেলে গেলো। চিরদিনের জন্য অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিলো সে। বুক উজাড় করা অশ্রু নিয়ে নতুন সংসারের দিকে ভিড়লো। শাফায়াত ইসলাম সৌভিকের হাত ধরে নতুন জীবনের দিকে পাড়ি দিলো। পুরোনো জীবনকে ফেলে নতুনত্বকে হাত বাড়িয়ে ছুঁলো। বিদায়ের পর অতিথির গমগমে ভাবটা কেটে যেতে লাগলো, একপর্যায়ে বাড়ির মানুষ ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট রইলো না। শানাজের বিদায়ের পর সাবার মনটা নুয়ে গেছে। এবার গ্রামে ফিরলে আর শানাজ পাশে থাকবে না। দু’বোন একসাথে কলেজে যাবে না। সাবার কাঁদো-কাঁদো চেহারা দেখে সুরাইয়াও মুখ ভার করে আছে। বিদায়ের সময় সব বোনেরা হাউমাউ করে কেঁদেছে। একসাথে বড় হলো, সবকিছুই একসাথে করলো, কিন্তু বড় হবার সাথে-সাথে সব বন্ধন কেটে গেলো। শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যেতে মন চায়। যেই স্মৃতিতে শুধু অবুঝপনার দিন ছিলো, আনন্দদায়ক মূহুর্ত ছিলো। এরকম বিচ্ছেদের অধ্যায় ছিলো না। গুমোটপূর্ণ পরিবেশটা অনুকূল করার জন্য সিয়াম একটু আয়োজন করলো। বাড়ির লন সাইডে কাঠ-লাকড়ি এনে আগুনের ব্যবস্থা করে ফেললো। সবুজ-সবুজ ঘাসের উপর মাদুর পেড়ে সবাইকে উপস্থিত করলো। ঘোষণা দিলো, আজ রাতটা একটু আড্ডায় কাটুক। সব মন খারাপের কারণগুলো ভষ্ম হোক। এমন চমৎকার সিদ্ধান্ত শুনে সবাই আগুনের চারপাশে গোল করে বসলো। সাবিরের পাশে প্রীতি, প্রীতির পাশে সাবা, সাবার পাশে ফারিন, ফারিনের পাশে সুরাইয়া, সুরাইয়ার পাশে তৌফ, তৌফের পর সামিক, সামিকের পাশে সিয়াম। সিয়াম যেয়ে মাহতিমকে খুঁজে না পেয়ে মেহনূরকে ধরে-বেঁধে বসিয়েছে। নীতির প্রচন্ড মাইগ্রেনের সমস্যা হচ্ছে বলে আসতে পারেনি। ঔষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় আছে। এদিকে আলোচনার প্রথম বার্তাটা আজ সামিক শুরু করলো,
– আজকে জোৎস্না রাত দেখছো সবাই? কি বিউটিফুল লাগছে! আচ্ছা, একটু মিউজিক হলে কেমন হয়? আমি বাজাই?
সামিকের কথায় মেয়েরা কেউ সাড়া দিলো না। তাদের গম্ভীর ভাব দেখে তৌফ ফট করে বললো,
– একেকটার চেহারা দেখলে মনটা চায় ঝাড়ু আইনা পিটাই! ওই তোদের কি হইছে রে? ওইদিকে সৌভিক হালায় তো বউ পাইয়া ফূর্তি করতেছে। তোরা ক্যান কচুর মতো থপথপ করতাছোস?
তৌফের অবস্থা দেখে ফারিন চোখ গরম করলো। তীব্র রাগে খেঁকিয়ে উঠলো,
– তোমার মুখে কি লাগাম লাগাতে পারো না? এখানে যে ভাবী বসে আছে, সেটা কি চিল্লিয়ে বোঝাতে হবে?
ব্যাপারটা খেয়াল করতেই জিহবায় কামড় দিলো তৌফ। ডান কানটা ধরে আফসোসের সুরে বললো,
– তওবা, তওবা। এহেহেহে, ছিঃ, আমি খেয়াল করিনাই। ভাবী কিছু মনে করছেন নাকি?
মেহনূর অন্যমনষ্ক হয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। তৌফ ওকে কি বলছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মেহনূরকে খামোশ দেখে তৌফ সিয়ামের দিকে তাকালো। ইশারা করলো,
– কি হইছে?
ইশারার উত্তরটা সিয়াম ঠোঁট উল্টে বুঝালো,
– জানি না মামা।
এবার সিয়াম ও তৌফ দুজনই বাকিদের দিকে তাকালো। এখন মেহনূর বাদে সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করছে। নীতি মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, সে কিছু জানে না। সাবা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বললো, সেও কিছু জানে না। একে-একে সবার উত্তর যখন একই হয়ে দাঁড়ালো, তখন তৌফ কন্ঠ নামিয়ে ভদ্রভাবে ডাকলো,
– ভাবী? ভাবী শুনেন, ভাবী?
কিন্ঞ্চিৎ কেঁপে উঠে তৌফের দিকে তাকালো মেহনূর। দেখতে পেলো সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে। মেহনূর বিব্রত হয়ে কোনোমতে হাসি দিয়ে বললো,
– জ্বী ভাইয়া,
তৌফ গলা ভিজিয়ে বললো,
– মাহতিম আপনারে কিছু বলছে?
এক মিনিটের মতো নিরব রইলো মেহনূর। কি উত্তর দিবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পরলে শেষে আমতা-আমতা করে বললো,
– নাতো, কিছু বলেননি। কিছু কি বলার ছিলো?
তৌফ বহুদিনের কথাটা আজ সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলো,
– মাইন্ড না করলে একটা কথা বলবো। এই প্রশ্নটা অনেকদিন থেকেই মাথায় ঘুরঘুর করতাছিলো, বাট আমি আপনারে জিজ্ঞাসা করিনাই। বিয়ের সময় মাহতিমের প্রোফেশনটা আমরা সিক্রেট রাখছিলাম। বলতে পারেন, আমরা আপনারে ইচ্ছা করে জানাই নাই। আপনি কি এই ম্যাটার নিয়া মাহতিমের উপর ফ্যাড-আপ?
কথাটা পুরোপুরি বুঝলো না মেহনূর। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বলে দিলো,
– আপনার কথাটা বুঝলাম না তৌফ ভাইয়া। যদি বুঝিয়ে বলতেন..
গলা খাঁকাড়ি দিলো তৌফ। যতটুকু নম্র হওয়া যায়, ততটুকু নম্রভাবে বললো,
– দেখেন ভাবী, কথাটা আপনারে ছোট করে বলতাছি না। কিন্তু কথাটার হেতু একটু বুঝিয়েন। হাজবেন্ড নিয়ে প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনে আলাদা-আলাদা চিন্তা থাকে। সবাই চায় তার পার্টনার একটু মন মতো হোক। এখন কথা হলো গিয়ে, মাহতিমের ব্যাপারটা আপনি অন্যভাবে নিতাছেন। যেটা আপনাদের সম্পর্কে ফাটল আনতাছে। আপনি রাগ করিয়েন না। কথাগুলো সবার সামনে বলতাছি কারণ, এখানে সব আমরা-আমরাই আছি। যদি কোনো প্রবলেম হয়, আমরা সল্যুশন দিতে পারবো।
তৌফের কথা শেষ হতেই ফারিন বলে উঠলো,
– প্লিজ ভাবী, তোমার সমস্যাটা আমাদের বলো। আমরাতো বাইরের লোক না। তুমি আমাদের সবাইকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো, আমরা কখনো কথা পাচার করবো না। ভাইয়াকে অনেক জিজ্ঞেস করেছি, অনেক বলেছি কেনো সে তোমাকে ইগনোর করে। ভাইয়া বলেনি। প্লিজ তুমি বলো, চুপ করে থাকলে সবকিছু নষ্ট হয় ভাবী। সামান্য এ্যাপ্রোচের জন্য বিরাট ক্ল্যাশ হয়ে যায়।
ফারিনকে থামিয়ে পাশ থেকে সুরাইয়া কথা টেনে বললো,
– তুই একটা মূর্খের মতো কাজ করছিস। আজীবন তো হাবলা-ক্যাবলার মতো থাকলি, এখনতো একটু চালাক হ। ছাগলের মতো বুদ্ধি নিয়ে থাকলে চলতে পারবি? ভাইয়ার কার্ডটা যেভাবে ফিরিয়ে দিলি, মন চাইতেছিলো হাত ঘুরিয়ে এক চড় লাগাই।
জনে-জনে সবার কথা শোনার পর চুপ থাকলো মেহনূর। নিজের আসল কথাটা সাজিয়ে-গুছিয়ে স্পষ্ট আকারে বললো,
– রাত তিনটা বাজে। ভয়ে আমি অস্থির। ইদানিং উনাকে কি নিয়ে যেনো খালি টেনশন করতে দেখি। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেন না। কথা ঘুরান। ওই রাতের বেলা যখন একা-একা উনাকে খুঁজতে বের হলাম, আমার অবস্থা তখন কেমন ছিলো আমিই জানি। ভয় নিয়েই ছাদে গেলাম। উনি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বলছেন, উনি আমাকে বিয়ে করে বড় ভুল করে ফেলেছেন। আমাকে যদি বিয়ে না করতেন, তাহলে আমি অভিশাপ টুকিয়ে আনতাম না। আমার মন্দ কপালের জন্য মাহদি মারা গেছে। উনি চাইলে শহরের একজন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। করেননি। অনামিকার মতো চরিত্রহীনাও আমার চেয়ে বহুগুণে যোগ্য। আমি তোমাদের মাহতিম ভাইয়ের ঘাড়ে বোঝা হয়ে গেছি। যেই বোঝার জন্য উনি টেনশনে বাঁচেন না। উনাকে আমাদের গ্রামে এনেছেন দেখে মা’কে সম্পূর্ণ দোষী বানিয়ে দিলেন। উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন আমি একটা গাধা! আমি শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজন মিটাতে পারি। আমি যদি সুন্দরী না হতাম, যদি উনাকে বশ না করতাম, তাহলে উনি ভুলেও তাকাতেন না। উনার মতো নেভির স্পেশাল ফোর্সের মানুষ গণ্ডদেশের মেয়েকে বিয়ে করে আফসোস করছেন।
এটুকু বলতেই সুরাইয়ার দিকে তাকালো মেহনূর। সংযত গলায় বলে উঠলো,
– সুরাইয়া বুবু, আমি আসলেই একটা মূর্খ। পড়াশোনাই বা কতদূর করেছি? মানুষ শুনলে হাসতে-হাসতে মরেই যাবে। এখনো মেট্রিক পাশ করিনি, অথচ বড় পদের মানুষকে পটিয়ে একেবারে বিয়ে ফেলেছি।
দীর্ঘদিন পর এক অদেখা সত্যের মুখোমুখি হলো সবাই। লজ্জায়-আক্রোশে-কাঁচুমাচু করে মুখ নামিয়ে ফেললো। মেহনূরের একেকটা কথা, বাক্য, শব্দ সঠিক। কোনো অংশেই অযৌক্তিকতা নেই। মাহতিমকে বিয়ের পর মেহনূর সবকিছু বদলে ফেলেছে। নিজের পড়াশোনাটা নিয়ে ভুলেও মাহতিমের আবদার করেনি। তার বয়স অল্প ছিলো, নানা বিষয় নিয়ে সমস্যায় পড়তো, তখনও মাহতিম পাশে ছিলো না। গ্রাম থেকে শহরে ফেরার পর স্বাভাবিক ছিলো মেহনূর। সে যে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর যুদ্ধ করছিলো, এগুলো কেউ বুঝেনি। একটা ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসার পর সহজভাবে নিজেকে জড়ানো যায় না। তবুও নিজেকে গুটিয়ে-মুড়িয়ে-ভাঙচুর করে, যেভাবে সবকিছুর সাথে মানানো যায়, একদম খাপে-খাপ মিলিয়েছে মেহনূর। যেই মোবাইল ফোনের সংস্পর্শে সে ছিলো না, সেই ফোনকে সে টুকে-টুকে আয়ত্ত করেছে। শিখেছে নানা কিছু। মেহনূরের কথা শোনার পর সবাই যেনো মুখ থুবড়ে পরেছে। সেখান থেকে মুখ তুলার ক্ষমতা তাদের নেই। মেহনূর সবাইকে নিরব দেখে নিজেই বলে উঠলো,
– আপনাদের ভাই স্বভাবে-গুণে-কাজে সবকিছুতে পটু। তার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই। আমি এটাও বলবো সে যথেষ্ট অমায়িক। তার বুদ্ধি, কাজ দারুণ চৌকশ। কিন্তু এই বুদ্ধিমান মানুষটা আমার মতো মূর্খকে বিয়ে করে বড্ড পস্তাচ্ছে। সম্ভবত আমাকে নিয়ে তার সাময়িক মোহ ছিলো, সেই মোহ আর নেই। নইলে এমন ধরনের কথা তিনি বলতেন না। আমি কখনোই উনার জন্য পাগল ছিলাম না। আমার দাদা যদি ওইদিনই বিয়েতে অমত করতো, আমি সেটাই মাথা পেতে মেনে নিতাম। আমি আমার দাদাকে আমার অভিভাবকের মতো সম্মান করতাম। আজ সে নেই, তা নিয়েও আমার কষ্ট নেই। আমার দাদা আমাকে কোনোদিন কষ্ট দেননি। বিয়ের পর তোমাদের ভাইকে চিনলাম। উনাকে আমার দাদার চাইতেও বেশি সম্মান করতাম। সম্মানটা আপনা-আপনি উনার প্রতি চলে আসতো। উনি আমাকে অযত্ন করেননি। বটগাছের ছায়ার মতো আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, পরিস্থিতির জন্য আমাকে শক্ত হতে বলেছেন। আমি চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টা এখনো করে যাচ্ছি। আমি থামিনি। কিন্তু উনার কাছ থেকে ওই কথাগুলো ধারালো ছুঁড়ির মতো লেগেছে। বাইরের আঘাতটা সবাই দেখতে পায়, ভেতরের ক্ষতটা কজন বুঝে? আমাকে শান্ত দেখাচ্ছে না? আমি শান্ত নই! সোজা ভাষায় বলে দিলাম, আমি শান্ত নই!
সবাইকে মুখের উপর কথা শুনিয়ে উঠে পরলো মেহনূর। এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে সেখান থেকে হনহন করে চলে গেলো। আগুনের পাশ থেকে সবাই ওর যাওয়াটা দেখলো। যেতে-যেতে হাত উঠিয়ে চোখ ডলার দৃশ্যটা সবার নজরেই পরলো। সিঁড়ি পেরিয়ে দরজা ডিঙিয়ে মিলিয়ে গেলো মেহনূর। নিস্তব্ধ পরিবেশের ভেতর হঠাৎ সাবা মুখ খুললো। বহুদিন পুরোনো কথাটা চোখ নিচু করে বলতে থাকলো,
– যাদের হাতে পিস্তুল-বন্দুক থাকে, মেহনূর ওদের ছোট থেকেই দেখতে পারতো না। ও ভাবতো, যারা মানুষ মা:রতে জানে, তাদের ভেতরে মন নেই। ওরা ভালোবাসতে জানে না। ওরা আজীবন পাষাণ থাকে। মানুষের মূল্য দিতে জানে না। হয়তো এই কারণে মাহতিম ভাইয়ার প্রতি প্রথম-প্রথম ক্ষোভ ছিলো। কিন্তু, এখন যা শুনলাম, তাতে আমার বোনের কোনো দোষ নেই। দোষ তোমাদের ভা…
মুখ ফসকে বেফাঁস কথাটা আঁটকালো সাবা। গরম মূহুর্তে অপ্রীতিকর কথা বলা উচিত না।
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#নোটবার্তা : শব্দসংখ্যার লিমিট ক্রস করার জন্য আমি পর্বটার দ্বিতীয় অংশ এখন দিচ্ছি। আজ রাত দশটায় এটার চূড়ান্ত অংশটা পেয়ে যাবেন। ফেসবুকের সমস্যার জন্য দুঃখিত।
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)