- মাকে মিস করা নিয়ে স্ট্যাটাস
- মাকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস।
- মৃত মাকে নিয়ে স্ট্যাটাস।
- মাকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস।
১.মাকে মিস করা নিয়ে স্ট্যাটাস
মা কে একটা চিঠি লিখেছিলাম,
যথোপযুক্ত পিয়নের অভাবে পোস্ট করা হয়নি।
মা যেখানে থাকেন সেখান টায় কোন ঠিকানা আছে কী না জানা নেই আমার ;
রোড নাম্বার, বাড়ি নাম্বার, গলি নাম্বার কিছুই কি নেই সেখানে?
আগে চিৎকার করে কাঁদলেই মা বুক পেতে দিতেন __
এখন বর্ষার জলে কেঁদে নেই যদি কেউ দেখে ফেলে।
এই বয়সে এইভাবে কেউ কাঁদতে পারে!
মাকে লিখেছিলাম চিঠিতে, “মা তুমি না আমাকে কখনও একা ছাড়তে না, হারিয়ে যাব বলে।”
এক গ্লাস পানিও দিতে মুখে তুলে, কষ্ট হবে বলে;
এই যে এখন এই জটিল শহরটায় একাই হেঁটে চলেছি একাই লড়ছি;
আবার ভেঙেও পড়ছি কিন্তু একটা স্বস্তি মাখা হাত নেই,
যে হাত আমায় ভরসা যুগিয়ে, এগিয়ে দিবে।
আজ কোথায় আছো তুমি? কীভাবে আছো একা আমায় ফেলে?
বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, মায়ের সাথে দেখা করিয়ে দেবার কি কোন ম্যাজিক আছে?
আমায় শিখিয়ে দিবে?
বাবা উত্তর দেননি, কীভাবে যেন তাকিয়েছিলেন! মানুষটারও বোধহয় আমার মতই কষ্ট হয়,
কেমন করে একলা তাকিয়ে রয়!
দেখেছো মা আগে কীভাবেই যেন জ্বরটা আমার অল্পে যেতো সেরে,
তখন কী আর জানতাম, তুমি সকাল হলেই হারিয়ে যাবে।
এখনও জ্বর আসে, তুমি আসো না কাছে, বসো না পাশে, দুগাল ভরে দেও না চুমু এঁকে।
ডাইনিং টা কেমন যেন এঁটোই পড়ে থাকে,
তোমার যত্ন করা খাবার গুলো কেমন যেন চুপসে গেছে মা;
ওদেরও বুঝি তোমায় মনে পড়ে।
কীভাবে সব সামলে আমি শক্ত হয়ে আছি তুমি যদি তা জানতে!
মনে পড়ে মা,বজ্রপাতের শব্দে যখন ভীত হতো চোখ!
তুমি কেমন জড়িয়ে ধরতে বাড়িয়ে দিতে আঁচল
এই শান্তি সুধা আর কোথায় পাওয়া যায় মা, তুমি বলতে পারো?
কোথায় আমার মায়ের শাড়ি? কোথায় আমার মা?
কোথায় গেলো ঘরের আলো? কোথায় বা সাজসজ্জা?
চিঠিটার বুঝি বাড়ছে বয়স মাও কি তবে বৃদ্ধা এখন
রেশমি চুলেও কি ধরেছে পাক?
______কোথায় আছো মা?
______সুলতানা পারভীন সুমি
২.মাকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস
জানো মা,
এখানে রোজ রাতে মনে করে আমার এলার্ম দিয়ে ঘুমোতে হয়,
তবুও যদি কোনোদিন আমার ঘুম না ভাঙে,
আমার ক্লাসটা সেদিন ঠিকই ছুটে যায়!
আমি মনটা ভার করে বসে থাকি,
মনে মনে শুধু এটুকুই বলি;
‘মা এখন তুমি যদি কাছে থাকতে!’
মা জানো,
রোজ সন্ধ্যায় পড়তে বসতে বলার কেউ নেই এখানে,
আমার না তোমার ঐ রোজকার একঘেয়ে কথাগুলোই এখন তাই ভীষণ মনে পড়ে!
আমি রোজ পড়তে বসার আগে চা বানাতে ভুলে যাই মা!
তুমি তো জানো মা চায়ের কাপে চুমুক না দেয়া অব্দি আমার পড়ায় মনই বসে না!
কি করে তুমি রোজ আমি পড়তে বসার আগেই আমার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিতে মা?
তোমার এই রোজকার নিয়ম করা কাজগুলো আমার যে ভীষণ মনে পড়ে মা!
মাঝরাতে ঘুম না আসলে তোমার গা ঘেঁষে,
তোমায় জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে কত বলতাম,
মা জানো,এখনও আমার রোজ রাতে ভীষণ বলতে ইচ্ছে হয়,
আমার ঘুম আসছে না মা,
ঘুম পাড়িয়ে দাও না একটু আমায়।
জীবনের সবগুলো কঠিন পরীক্ষার আগের রাতে
আমি যখন ভয়ে,দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে যেতাম!
তুমি কি পরম ভালোবাসায় আমায় সাহস দিয়ে যেতে,
এখানে আমার কদিন পর পরেই অনেক কঠিন পরীক্ষা থাকে মা,
আগের রাতে দুশ্চিন্তায় আমার ঘুম আসে না,
মাথার উপরে তোমার হাতটার শূন্যতা খুব কষ্ট দেয় তখন মা।
এখানের জীবনটা আমার ভীষণ কঠিন লাগে মা!
মাঝে মাঝে এই অচেনা শহরটায় অনেক একা লাগে,
এ শহরে যে আমার কী ভীষণ দমবন্ধ লাগে
তোমাকে একটু দেখার জন্য,
একটু ছোঁয়ার জন্য,
তোমার গা এর গন্ধ নেবার জন্য,
রোজ কোটি কোটি হাহাকার এ বুকটায় জন্মে।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই তোমায় ফোন দিই না মা,
কথা বলতে যেয়ে রোজ গলা ধরে আসাটা যদি তুমি বুঝে ফেলো,
যখন কান্নাটা দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে ঠেকে,
আমি তখনই হুট করে ফোনটা রেখে দিই!
তুমিও হয়তে এগুলো বুঝতে পারো তাই না মা?
মাঝেমাঝে সত্যি মনে হয় সব ছেড়ে ছুঁড়ে তোমার কাছে চলে যাই মা।
কী হবে এত কষ্ট করে যদি দিন শেষে তোমার কোলে একটু মাথাটাই না রাখা যায়!
জন্ম হতে তুমি তো আমার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অভ্যাসে মিশে আছো মা,
এতদূরে তোমায় ফেলে আমি ক্যামনে তবে ভালো থাকি মা?
___’তোমায় ফেলে ক্যামনে ভালো থাকি মা?’
__©বুশরা হাবিবা
[ মাকে নিয়ে লেখার জন্য দিবস লাগে না। অনেক আগের লেখা আবারো পোস্ট করতে ইচ্ছে হলো। ]
৩.মৃত মাকে নিয়ে স্ট্যাটাস
মা
মাকে হারিয়েছি সেই ১৯৭০ সালে। আজ থেকে প্রায় ৫৩ বছর আগে। বয়স কতো আর! মাত্র দশ বছর। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। শেষ দেখা চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। মা বাড়ী যাবেন তাই মাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে গিয়েছিলাম চাচার সাথে। বাড়ীতে ধান চলে এসেছে। মাকে যেতেই হবে। আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা সামনে তাই আমরা মায়ের সাথে যেতে পারিনি। কথা ছিলো পরীক্ষা শেষ হলে আমরা বাড়ী যাবো। বাড়ী গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু পরীক্ষা শেষ করে নয়। পরীক্ষার আগেই। মা ছিলেন তখন সন্তানসম্ভবা। সাথে ছিলো উচ্চ রক্তচাপ। বাড়ীতে থাকাকালীন এক রাতে মায়ের শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। গ্রামীণ চিকিৎসক দিয়ে মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। মা আমার ছয়টি নাবালক সন্তান রেখে পরপারে পাড়ি জমালেন। চট্টগ্রাম লোক মারফত খবর পাঠানো হলে আমরা রাতের ট্রেনেই চাচার সাথে বাড়ীর পথে রওয়ানা হই। আমাদেরকে বলা হয়েছিলো মা খুব বেশি অসুস্থ তাই বাড়ীতে যেতে হবে। অল্প বয়সের কারণে আসল বিষটা বুঝতে পারিনি। সারা রাত ট্রেন জার্নি করে সকাল বেলা বাড়ীতে পৌঁছে যখন সবার করুন চাহনি দেখতে পেলাম তখনই বুঝতে পারলাম কী ঘটে গেছে আমাদের জীবনে। আত্মীয়স্বজন সবাই আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কাঁদছিলেন। ঘরে ঢুকে বেড়ায় শুকাতে দেয়া মায়ের একটা সবুজ শাড়ী জড়িয়ে ধরে মা মা বলে আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম।
মায়ের স্মৃতি বলতে এই দশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর সান্নিধ্য সাহচর্য ছিটেফোঁটা যেটুকু পেয়েছিলাম কেবলমাত্র সেটুকু নিয়েই বেঁচে আছি। আল্লাহ্ আমার মাকে জান্নাতবাসী করুন।
মায়ের হঠাৎ চলে যাবার পর ছয়টি অবুঝ সন্তান নিয়ে বাবা অকুল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। একদিকে আমাদের লেখাপড়া অন্যদিকে মায়ের সাজানো সংসারের কথা চিন্তা করে বাবা ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। অবশেষে আমার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাবা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। অল্প বয়স থাকায় আমরা প্রথম দিকে একটু কান্নাকাটি করলেও পরে রাজি হলাম।
আমার এই মা হলেন আমার আপন খালার ননদ। উনি তখনো কুমারী। আমার খালার শ্বশুর আমার মাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনিই আমাদের কথা ভেবে এই মাকে বাবার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেন। মা’র তখন বয়স কতো? বিশ বাইশ। বাবার বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ। এই অসম বয়সে বিয়ে করে বাবা নতুন মাকে নিয়ে আমাদেরকে সহ চট্টগ্রাম চলে আসলেন। উনার বিয়ের আগেই বড়ো বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। প্রথমদিকে মাকে বেশ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিলো। একদিকে আমরা পাঁচ ভাই অন্যদিকে মাঝবয়সী স্বামী। এসব কিছু সামাল দিতে গিয়ে উনাকে প্রায় হিমশিম খেতে দেখেছি। কিন্তু কোনোদিন এসব নিয়ে কোনোরূপ রূঢ় আচরণ উনি আমাদের সাথে করেন নি। আস্তে আস্তে উনি আমাদের সংসারের হাল অত্যন্ত শক্ত হাতে ধরে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলেন। আমরা আমাদের লেখাপড়া ঠিকঠাকমতো চালিয়ে যাচ্ছি। আমার এই মায়ের ঘরে চার বোন জন্ম নিয়েছে। ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা সবাই ভালো আছে।
আমার এই মায়ের অবদান আমরা জীবনেও ভুলতে পারবো না। আমার বাবা ঐ সময় উনাকে বিয়ে করে না আনলে আজ আমাদের অস্তিত্বও থাকতো কি না সন্দেহ আছে। উনি আমাদেরকে মানুষ করার জন্য উনার জীবনের সকল সাধ আহ্লাদ ত্যাগ করেছেন। আজ আমরা সব ভাইয়েরা বিয়েসাদী করে সংসারী হয়েছি। আমাদের সন্তানেরা কিছুদিন আগেও জানতো না উনি আমাদের সৎ মা। আমাদের আচার আচরণে বোঝার কোনো সুযোগ ছিলো না। আমরাও বুঝতে দিতাম না। এখন অবশ্য তারা জানে। তাতেও কিছু যায় আসে না। তারা ঠিকই আমাদের মতো উনাকে আপন দাদীর আসনেই দেখে। উনি বাড়ীতে আছেন বলেই এখনো আমরা নিশ্চিন্তমনে যখন ইচ্ছে তখন সপরিবারে বাড়ীতে যেতে পারি। আমরা আমাদের এই মায়ের জীবনের অপূর্ণ সাধ গুলো পুরণের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে যাচ্ছি এবং যাবো ইনশাআল্লাহ্।
পরিশেষে আমি আমার এই দুই মায়ের জন্য সকলের নিকট দোয়ার দরখাস্ত রাখছি। একজন প্রয়াত অন্যজনকে আল্লাহ্ আজো আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সাথে সাথে জগতের সকল মায়েরা যারা আজো বেঁচে আছেন তারা সকলে ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন আর যারা চলে গেছেন তারা যেনো পরপারে ভালো থাকেন এই কামনা করি।
মোঃ মশিউর রহমান ভূঁইয়া
৪.মাকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস
আমার মা হারিয়ে গিয়েছিলেন হঠাৎ করেই। আমি তখন খুব ছোট।
সেদিন বৃষ্টি ছিলো। মা গিয়েছিলেন মামার বাসায়। আমি পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিলাম।
‘সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো,
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো-‘
মা যাবার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি একটুক্ষণ পরেই চলে আসছি। তুই কবিতাটা মুখস্থ করে ফেলিস।’ আমি তাই কবিতাটা মুখস্থ করছিলাম। সকাল, দুপুর। কাজলা দিদি আমার মুখস্থ হয়ে গেল। কিন্তু মা তখনও ফিরলেন না।
বাবা ফিরলেন সন্ধ্যায়। আমি কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে গিয়ে মায়ের না ফেরার কথা জানালাম। বাবা মামার কাছে গেলেন। মামা জানালেন, মা আসেননি তাদের বাড়ি। বাবা আর কিছু না বলে চুপচাপ বাসায় এসে শুয়ে পড়লেন।
আমি সারারাত মায়ের অপেক্ষায় জেগে রইলাম। মা ফিরলেন না।
পরদিনও মা ফিরলেন না। তার পরদিনও। তার পরদিনও। মা যেন হারিয়ে গেছেন পৃথিবীর বুক থেকে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, মা যেন সবার মন থেকেও হারিয়ে গেলেন।
বাবা দুতিনদিন মাকে খুব খুঁজলেন, এরপর হাল ছেড়ে দিলেন। কেন যে দিলেন, বুঝলাম না। মায়ের প্রতি তার মমতা কি ঐ ক’দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো, না অন্যকিছু? জানতে পারিনি তখন।
জানলাম তিন মাস পর। এক সন্ধ্যায় বাবা এক অচেনা মহিলাকে নিয়ে এসে বললেন, ‘ইনি তোমার নতুন মা। ইনাকে সালাম করো।’
আমি তাকে সালাম না করে সোজা ঘরে গিয়ে দরজা আটকে কাঁদতে লাগলাম। বাবা অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালেন, কিন্তু দরজা খুললাম না। যখন খুললাম, বাবা তখন প্রচন্ড মারলেন। এতো মারলেন যে, শেষমেষ অচেনা মহিলাটি বাবার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘এই কি করছেন? মেরে ফেলবেন নাকি ছেলেটাকে?’
বাবার সাথে সেদিন থেকে আমি কথা বলি না।
বাড়িটা আমার কাছে নরকের মতো হয়ে গেল। এখানে কাউকেই যেন চিনি না। যতক্ষণ বাড়ি থাকি, নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকি। বাইরে বের হলে সোজা মামার বাসায় চলে যাই।
মামা-মামি দু’জনেই আমাকে অনেক আদর করেন। মামা খুব দুঃখ করেন তার বোনটির জন্য। মাঝেমাঝে আমার সামনেই কেঁদে ফেলেন। মামীও কাঁদেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ এতো সুন্দর ছেলেটাকে ফেলে কই যে আমার বোনটা হারায় গেলো? কই যে চলে গেল? কত সুন্দর করে ভাবি বলে ডাকতো মেয়েটা। আর ডাকবে না।’
মামা-মামীর কান্না দেখে আমারও কান্না পায়। আমার কাঁদতে ভালো লাগে না। আমি তখন রিংকুর সাথে খেলি। রিংকু আমার মামাতো বোন। আমার সমবয়সী প্রায়।
ছোট থেকেই আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম। মা হারিয়ে যাবার পর আরো কাছাকাছি হলাম দুজন। আমি সারাদিন খেলি রিংকুর সাথে। ধানক্ষেতে ছুটে বেড়াই। দিঘীতে নেমে শালুক তুলি। প্রচন্ড বৃষ্টির পর মাটির ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে ব্যাঙ ধরতে বেরোই। আমাদের সারাদিন এমন ভাবেই কাটে।
এক দুপুরবেলা। আমি আর রিংকু মামার বাড়ির পিছে সুপুরি বাগানে নতুন ঢিবিটার উপর বসে খেলছি। মায়াবী নির্জন দুপুর, সূর্যের কড়া রোদ বাগানের ফাঁক গলে এধারে ওধারে পড়ে অদ্ভুত এক কল্পলোক তৈরি করেছে। আশেপাশে কেউ নেই।
খেলতে খেলতে রিংকু হঠাৎ বললো, ‘একটা জিনিস দিবো তোকে। নিবি?’
আমি বললাম, ‘কি জিনিস?’
‘চোখ বন্ধ কর।’
আমি চোখ বুজলাম। রিংকু কি দেয়, তা দেখতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। হঠাৎই, ঠোঁটে অদ্ভুত এক স্পর্শ পেলাম। আমার সর্ব ইন্দ্রিয় যেন কেঁপে উঠলো সে স্পর্শে।
আমি চোখ মেলে বললাম, ‘রিংকু। এটা কি?’
রিংকু কিছু বললো না। চোখ নামিয়ে কেবল লাজুক মুখে মুখ টিপে হাসতে লাগলো।
পরদিন, মামা ভীষণ জোরে চড় মারলেন আমার গালে। চিৎকার করে বললেন, ‘বেয়াদব। এই বয়সেই এসব। কাল বাড়ি ফেরার পথে তোদের দেখে লজ্জায় তো আমার মাথা কাটা গেলো। আর যেন কোনোদিন তোকে আমার বাড়ি আসতে না দেখি।’
আমি মাথা নামিয়ে ভেজা চোখে মামার বাড়ি থেকে চলে এলাম। রিংকুর দিকে ফিরেও তাকালাম না।
তারপর কিছুদিন আমি বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। সারাদিন নিজের ঘরে থাকি। নতুন মহিলাটা আমার খাবার দিয়ে যায়, পানি দিয়ে যায়। মাঝেমাঝে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার কি হয়েছে, বলোতো?’
আমি উনাকে কিচ্ছু বলি না। উনাকে আমার অসহ্য লাগে।
কিছুদিন পর বাবা জানালেন আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকার এক রেসিডেনসিয়াল স্কুলে আমার পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। নতুন মহিলাটি সাথে সাথে বললেন, ‘দরকার কি? এতো ছোট মানুষ। ঢাকায় গিয়ে একা একা থাকবে কিভাবে?’
বাবা বললেন, ‘থাকতে পারবে। সারাজীবন আমরা ওকে কোলে নিয়ে বেড়াবো নাকি? একা থাকা শিখতে হবে না?’
পরদিন আমি ট্রেনে চেপে ঢাকায় রওনা দিলাম। যদিও বাড়িটা আমার নরকের মতো লাগতো, তবুও যাবার সময় খুব খারাপ লাগছিলো আমার। এ বাড়িতে আমার সব ছিলো। আমার মা ছিলো, বাবা ছিলো। ছুটির দিনের খুনসুটি ছিলো, একসাথে বসে গল্প করা ছিলো। বৃষ্টির দিনের খিচুড়ি ছিলো, ঈদের দিনের আনন্দ ছিলো।
এখন যদিও কিচ্ছু নেই। তবু, মায়ের ঘ্রাণ ছিলো। আজ থেকে তাও পাবো না।
ট্রেনে বসে খুব কান্না পাচ্ছিলো। মায়ের কথা মনে পড়ছিলো, বাবার কথাও মনে পড়ছিলো। আমি ঠোঁট চেপে কান্না আটকাচ্ছিলাম। রিংকুর কথাও মনে উঁকি দিচ্ছিলো। আমি জোর করে রিংকুর মুখটা সরিয়ে দিলাম মন থেকে।
এরপর, ঢাকা। টানা দশ বছর রইলাম ঢাকায়। এরমধ্যে একবারও বাড়ি আসিনি। ছুটির দিনগুলোতে ঢাকাতেই থাকতাম, নইলে কোনো বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে চলে যেতাম। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করতো না একবারও, ইচ্ছে করলেও সে ইচ্ছেটাকে পাত্তা দিতাম না।
বাড়ি ফিরলাম দশ বছর পর।
এই দশবছরে কত কি যে বদলে গেছে। আমার নিজের বাড়ি, নিজের এলাকাকেই যেন আমি চিনতে পারছিলাম না। শুধু একটা জায়গা একইরকম আছে, রিংকুদের বাড়ির পিছে সুপুড়ির বাগানটা। আমি যেমন দেখেছিলাম ছোটবেলায়, ঠিক যেন তেমনই আছে বাগানটা।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। রাত নেমেছে ততক্ষণে। জায়গাটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল, এখানে ওখানে দু’চারটে জোনাকি আলো জ্বালিয়ে উড়তে লাগলো। ঝিঁঝিঁদের অবিরাম সঙ্গীত বাজতে লাগলো চারদিকে।
আমি অপেক্ষা করি রিংকুর।
রিংকু ফেরে দশটা নাগাদ। আমার ডাক শুনে সে ভীষণ চমকে যায়। ভীত হরিণীর মতো সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি আবার বলি, ‘আমিরে রিংকু। চিনতে পারিস নি?’
রিংকু এবার আমাকে চিনতে পারে। অবাক হয়, ভয়ও পায়। ভয় পাওয়া গলায় আমাকে বলে,’তুই? কখন আসলি? এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
আমি হাসিমুখে বলি, ‘ভয় পাসনা। আমি জানি, তোর বিয়ে। তোর বদনাম করে বিয়ে ভাঙার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। শুধু কয়েকটা কথা জানাতে এসেছিলাম তোকে।’
রিংকুর ভয় তবুও কাটে না। বলে, ‘এখানে কেন? বাসায় এসে বল।’
‘না, বাসায় না। এখানেই বলতে হবে।’
‘তাহলে তাড়াতাড়ি বল। যেতে হবে আমায়।’
‘আচ্ছা, বলছি। তুই তো জানিস আমার মা হারিয়ে গেছে। কেমনে হারিয়ে গেছে, জানিস?’
‘না, জানি না।’
‘তবে বলি, শোন। এই দশ বছর অনেক খোঁজ-খবর নিয়েছি আমি, অনেক কিছু জানতে পেরেছি। সবকিছুই এখন পরিষ্কার আমার কাছে। আজ এখানে এসেছি সবকিছুর হিসেব চুকাতে।’
রিংকু ভয় পায়, ‘মানে?’
‘বলছি। মা হারিয়ে যায় কবে, জানিস তো?’
‘হু।’
‘আমি ভেবেছিলাম মা মারা যাবার পরই বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু না। বাবা আর নতুন মায়ের বিয়ের সার্টিফিকেট আমি দেখেছি। উনাদের বিয়ে হয়েছিলো মা হারিয়ে যাওয়ার এক মাস আগে। বাবা লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। নতুন মায়ের কিছু করবার ছিলো না। গরীব ঘরে মানুষ তিনি, চাচাদের কাছে মানুষ হয়েছেন। উনাদের গ্রামে গিয়ে উনাকে বাবার পছন্দ হয়, বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আপদ বিদেয় করতে পেরেছে ভেবে উনার চাচারাও তড়িঘড়ি করে নতুন মায়ের সাথে বাবার বিয়ে দিয়ে দেয় কোনো খোঁজখবর না নিয়েই। বাবা এই বিয়ের কথা মায়ের কাছে গোপন রাখে।
কিন্তু মা কোনোভাবে টের পেয়ে যায়। মা ঠিক করেন, বাবাকে ডিভোর্স দিবেন, আর মামলা করবেন বাবার নামে। বাবা ভয় পেয়ে যান। এমনিতে জেলে যাবার ভয়, তার উপর তার চাকরি হারাবার ব্যাপারটাও নিশ্চিত। তিনি ঠিক করেন, মায়ের মুখ বন্ধ করা লাগবে, যেকোনভাবেই হোক।
যেদিন মা হারিয়ে যায়, সেদিন আমরা জানতাম বাবা বাসায় ছিলেন না, অফিসে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা ভুল। বাবা ঐদিন ছুটি নিয়েছিলেন অফিস থেকে। অনেকেই তাকে এলাকাতেও দেখেছে। মা বাড়ি থেকে বের হতেই বাবা তার পিছু নেয়। পিছু নিয়ে এই সুপারির বাগান পর্যন্ত আসেন।’
রিংকু শিউরে ওঠে। ফিসফিস করে বলে, ‘ফুফাই তাহলে খুন করেছেন ফুফুমণিকে?’
আমি বলি, ‘না।’
‘না?’
‘হু। বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে মামলা চালানো, আমাকে নিয়ে আলাদা থাকা, এসব কিছুর জন্যই মায়ের অনেক টাকার দরকার ছিলো। তুই হয়তো জানিস না, নানা মারা যাবার সময় দক্ষিণ পাড়ার ধানী জমিটা মাকে দিতে বলেছিলেন। মামাই ঐ জমিটা ভোগদখল করতেন। পরে, টাকার দরকার হওয়ায় মা মামাকে বলেন জমিটা তাকে দিয়ে দিতে। মামা রাজি হলেন না। ঐ জমি থেকে অনেক টাকার ধান আসে মামার। মামা এর বদলে কিছু টাকা দিতে চাইলেন মাকে। মা ঐ টাকা নিতেই সেদিন এই বাগানে আসেন।
কিন্তু এখানে এসে টাকার অংক দেখে মা রেগে যান। মামা যে টাকা মাকে দিতে চেয়েছিলেন, তার চাইতেও কম টাকা নিয়ে এসেছিলেন। জমিটার দাম ছিলো এর থেকে অনেক অনেক বেশি। এই নিয়ে মা আর মামার ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়া চলতে চলতেই মামা এখানে পড়ে থাকা একটা কাঠ দিয়ে মায়ের মাথায় জোরে বাড়ি মারে। মা তখনই মারা যায়।’
রিংকু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, ‘তুই মিথ্যা বলছিস। আব্বা এমন কাজ করতেই পারেন না।’
‘নারে। আমি মিথ্যা বলি নাই। তিনি এটা করেছেন, এবং তিনি নিজের মুখেই এটা স্বীকার করেছেন। আর তাছাড়া, এ ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলো। কে জানিস?’
‘ফুপা?’
‘হ্যাঁ। বাবা মার পিছুপিছু এখানে এসে পুরো ঘটনাটি দেখেন। কিন্তু কাউকে কিছু না বলেই খুশিমনে বাড়ি ফিরে যান। তার আর চিন্তা কি? আপদ তো বিদেয় হয়েছে। মামাও মায়ের লাশটা এ বাগানে পুঁতে ফেলেন।’
আমি নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলে গেলাম। গলাটা একটুও কাঁপলো না। আমি তো এখন আর দশ বছর আগের সেই ছোট ছেলেটা নই, এখন রক্ত টগবগে তরুণ, খুনের নেশায় রক্ত কিলবিল করতে থাকে…
রিংকু হঠাৎ কান্না থামালো। কিছু যেন বুঝতে পেরেছে। ভয় পাওয়া গলায় ফিসফিসিয়ে বললো, ‘তুই এ গ্রামে কেন এসেছিস?’
‘বলেছি না, হিসেব চুকাতে।’
‘কি হিসাব?’
‘প্রথমে বাবার হিসাব। নতুন মাকে বিয়ে করবার সময় বাবার প্রচুর টাকার দরকার ছিলো। সংসারের হিসেব থেকেও সেই টাকা নিতে পারছিলেন না, মা টের পেয়ে যাবেন বলে। শেষে ঘুষ খেয়ে তার অফিসের একটা প্রোজেক্ট পাস করে দেন। এই প্রোজেক্টের কথা মনে হয় তুই শুনেছিস। গত সপ্তাহে এক জায়গায় মাটি ডেবে গিয়ে অনেক মানুষ মারা গেলো না, এটা ছিলো সেখানে আবাসন তৈরির প্রোজেক্ট। এটা নিয়ে এখন বেশ তুলকালাম হচ্ছে। আমি বাবার বিরুদ্ধে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ তার অফিসে দাখিল করে এসেছি। এখন তদন্ত হচ্ছে বাবাকে নিয়ে। তার চাকরিটা যাবে শিগগির। মামলা হবে, জেলও হয়ে যেতে পারে। এই বৃদ্ধ বয়সে এতো ধকল তিনি কিভাবে সামলান, তা দেখা যাবে।’
রিংকু চোখের জল মুছে বললো, ‘আর আমার বাবা?’
আমি কিছু বলি না।
‘বল। আমর বাবার সাথে কি করেছিস।’
আমি শুধু বলি, ‘দক্ষিণ পাড়ার ধানী জমিটা আছে না? ওটার নিচে কাল খুঁজে দেখিস।’
রিংকু চিৎকার করে ওঠে। আমি দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি, রিংকুর দিকে ফিরেও তাকাই না। দশবছর আগে যেভাবে এসেছিলাম।
এতো প্ল্যান করেও শেষমেষ রিংকুকে সব বলে দিলাম কেন? কি জানি! মনে হয় মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছিলো, তাই। যদিও, এতে কোনো সমস্যা হবে না। কাগজে-কলমে আমি আছি শরীয়তপুর। আমি যে এখানে এসেছিলাম, কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।
রিংকুকে একটা কথা বলা হয়নি। সেই নির্জন দুপুরবেলায় আমরা যে ঢিবিটার উপর বসে খেলছিলাম, সেটা কি ছিলো তখন বুঝতে পারিনি। ওটা ছিলো আমার মায়ের কবর। মামা মাকে খুন করে ঐখানেই তাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর মা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন, চিরদিনের জন্য।
গল্প- নিরুদ্দেশ
লেখা- সোয়েব বাশার