আমাদের মা একটা ব্যাংকের মালিক। রান্নঘরের তাকের পাশে রাখা হয় সেই ব্যাংকটা।
ভোরবেলা যখন মায়ের কাছে ঘুরঘুর করলাম মা ছুটে গেলেন তার ব্যাংকের কাছে। ব্যাংক থেকে বিশ টাকার একটা নোট দেয়। দুই ভাই বোন যা ভাগ করে নেই।
রান্নাঘরের বামদিকের সবার উপরের তাকে একটা হরলিক্সের কৌটা। যে কৌটার ভিতরে হরলিক্স নেই তবে কিছু খুচরা টাকা থাকে। যা মায়ের জমানো। সংসারের খরচ থেকে জমায়, মামারা আসলে যখন মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে যায় সেই টাকা এখানে থাকে।
আর যখনই আমি কিংবা আমার ছোটো বোন মারিয়া মায়ের কাছে আবদার করি তখন হরলিক্সের কৌটা খুলে আমাদের অল্প কিছু টাকা দেয়।
বাবা সামান্য একটা চাকরি করেন, একটা কলেজের অফিস সহকারী। কলেজের পাশেই পুরাতন একটা ভবনের নিচতলায় আমরা থাকি, তিন হাজার টাকা দিতে হয় ঘরভাড়া। অবশ্য তারা বেশকিছু দিন ধরে চাইছেন বাড়িটা ভেঙে নতুন বাড়ি করবে, তবে একসময় বাবা মায়ের স্মৃতি ধরে রাখতে বাড়িটা ভাঙবার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই দেশের বাহিরে থাকে, বাবা ঘরভাড়া তাদের ব্যাংক একাউন্টে প্রতি মাসে জমা দিয়ে আসেন।
বাবা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই কেমন চোখেমুখে ক্লান্তি নিয়ে মাকে ডাক দেন। মা এসে বলেন, কিছু হয়েছে তোমার? বাবা বলেন, একটা খারাপ খবর আছে।
মা বলেন, খারাপ খবর শুনেই যে দিন যায়। আজকে আবার নতুন কি খারাপ খবর? যাক এসব পরে শুনবো এখন খাবার খেতে বসো।
বাবা বলেন, আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আগে খবরটা শুনো। মানসুর সাহেবের বড় ছেলের সাথে কথা হয়েছে, তারা এই জমিটা বাড়ি সহ বিক্রি করে দিবেন।
বাবার মুখে কথাটা শুনে মায়েরও মুখ মলিন হয়ে যায়।
বাবা বলেন, আগামী মাসেই জমির দলিল হবে। এখন বাসা খুঁজতে হবে। আগামী মাসেই এই ঘর ছাড়তে হবে। যারা জমিটা কিনবেন তারা এখানে আটতলা বিল্ডিং করবে।
সে রাতে আমরা খাবার টেবিলে সবাই চুপচাপ বসি। রাতে ঘর থেকে পড়বার শব্দ না আসায় মা আর ডেকে বলে না শব্দ করে পড়তে।
শুরু হয় মায়ের ঘরের জিনিসপত্র গুছানো। অবশ্য আমাদের ঘরে একটা খাট আছে যে খাটে বাবা মা ঘুমায়। মারিয়া আর আমার জন্যে দুটো চৌকি, দুটো পড়বার টেবিল, চারটা কাঠের চেয়ার, একটা চেয়ার অবশ্য ভেঙে গেছে।
বাবা একটা বাসার খোঁজ পায়। একটা রুম, সামনে ডাইনিং আছে, রান্নাঘর আছে, একটা ওয়াশরুম। ভাড়া পাঁচ হাজার। ডাইনিংয়ের দুই পাশে আমাদের দুই ভাই বোনের চৌকি পেতে দেওয়া হয়। রুমের ভিতরে বাবা মায়ের খাট রাখবার পরে অল্প একটু জায়গা ছিলো, রুমটা ভীষণ ছোটো। সেই ঘরের কোনায় ঘরের বাকি জিনিসপত্র রাখা হয়।
একটা পড়বার টেবিল বাবা মায়ের ঘরে রাখা হয় আরেকটা টেবিল ডাইনিং রুমে।
মা আবার সাজিয়ে রাখেন রান্নাঘরে একটা হরলিক্সের কৌটা। যে কৌটায় কিছু খুচরা টাকা আছে।
একদিন রান্নাঘরের জানালা খোলা রেখে মা ছাদে যায়, আমি আর ছোটো বোন তখন স্কুলে ছিলাম। বাবা তখন কলেজে। মা ছাদ থেকে এসে দেখে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে হরলিক্সের কৌটা চুরি হয়ে গেছে। মা একটা হরলিক্সের কৌটার জন্যে বারবার কাঁদেন। বাবা জিজ্ঞেস করেন, কয় টাকা ছিলো। মা বলেন সব মিলিয়ে তিনশো বিশ টাকার মতো।
বাবা মাকে থামান, তিনশো বিশ টাকা অনেকের কাছে হয়তো কিছু না তবে মায়ের এই টাকা জমাতে বহুদিন সময় নিয়েছেন। পাঁচ টাকা দশ টাকা এমন করে জমিয়েছে।
বাবা পরদিন একটা হরলিক্স কিনে নিয়ে আসে। আমরা দুই ভাই বোনের যদিও এখন কারো হরলিক্স খাবার মতো বয়স নেই। মারিয়া এবার ক্লাস টেনে পড়ে আর আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। তারপরও নতুন হরলিক্সের কৌটা দেখে খুশি হই।
মা অপেক্ষা করে যান কখন হরলিক্স খাওয়া শেষ হবে। মা শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেননি। সেদিন মামা আসেন, মামা যাবার সময় মায়ের হাতে পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে যায়।
মামা চলে যাবার পরেই মা হরলিক্সের কৌটায় যে হরলিক্স ছিলো তা একটা বিস্কুটের খালি বয়ামের ভিতরে রাখে। হরলিক্সের কৌটা ধুয়ে রোদে শুকা দেয়। সন্ধ্যা বেলা সেই কৌটার ভিতরে পাঁচশো টাকার নোট রাখে। এবার আর রান্নাঘরে রাখবার মতো ভুল করেননি, খাটের নিচে রেখে দেয়।
দুদিন পরেই মারিয়ার জ্বর হয়, মারিয়ার জ্বরের একদিন পরেই আমারও রাতে জ্বর উঠে। মাসের শেষ দিকে দুই ভাই বোনের জ্বর, বাবার হাতেও তেমন টাকা পয়সা নেই। মা হরলিক্সের কৌটা থেকে মামার দেওয়া পাঁচশো টাকা বাবার হাতে দিয়ে দেয়।
মা পাঁচ টাকার কয়েন, দশ টাকা এসব হরলিক্সের কৌটায় রাখতেন। অল্প অল্প করে টাকা জমাতেন সেই টাকা আবার সংসারে একসাথে খরচ হয়ে যেতো। তবে মাকে এসব নিয়ে কখনো মন খারাপ করতে দেখিনি।
আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করবার পরে ভার্সিটি কোচিং শুরু করি তখন মায়ের গহনা বন্ধক রেখে কোচিং ফি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তির সুযোগ হলেও একসময় জানতে পারি মায়ের গহনা আর ছাড়ানো হয়নি, যার কাছে বন্ধক রাখা হয়েছিলো সে বিক্রি করে দিয়েছে।
শহর থেকে প্রথমবার আমি অন্য শহরে যাই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাছে আমার ছোটো খালার বাসা। প্রথম একবছর ছোটো খালার বাসায় ছিলাম, একবছর পরে হলে উঠে যাই। আমার খালু রাজশাহীর স্থানীয়, এখানে তাদের বাড়িও আছে। খালু কয়েকটা টিউশন খুুঁজে দেয়। পড়াশোনার টাকা টিউশন করেই সামলে নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় ছুটিতে বাসায় গেলে মায়ের যত্ন করে রাখা হরলিক্সের কৌটার দিকে চোখ যায়, মা এখনো এই ব্যাংকে খুচরা টাকা রাখেন।
মারিয়ার বিয়ে ঠিক হয় হুট করে, তখন আমি তৃতীয় বর্ষে পড়ি। যে ছেলেটার সাথে বিয়ে ঠিক হয় ছেলে ব্যাংকার। বাবা মা তাই রাজি হয়ে যায়, মারিয়ার বিয়ের সময় প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। বাবা পঞ্চাশ হাজার ব্যাংক থেকে লোন নেয় আর বাকি পঞ্চাশ হাজার ছোটো খালু ধার দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করবার পরে আমি আবার ঢাকাতেই চলে আসি বাবা মায়ের কাছে। এখানে দুটো টিউশন পড়াই আর একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেই। সাথে আমার চাকরির জন্যে পড়াশোনা চলে।
দুবার বিসিএস দেই তবে প্রথমবার প্রিলিতে টিকলেও রিটেনে আটকে যাই, পরেরবার প্রিলিতেই পাশ করতে পারিনি।
বিসিএসের আশা ছেড়েই দিলাম। ব্যাংকের জন্যে চেষ্টা করলাম সাথে তবে কোনো ব্যাংকে হলো না।
শেষবারের মতো বিসিএসের ফর্ম তুলি। টিউশন দুটোও ছেড়ে দেই। ঘরবন্দী জীবন শুরু হয়, সন্ধ্যা বেলা মাগরিবের নামাজ পড়ে আসবার সময় কেবল গলির মুখে চায়ের দোকানে পাঁচ মিনিট বসতাম। খাওয়া আর নামাজের সময় ছাড়া বাকি সময় টেবিল চেয়ারই ছিলো আমার বন্ধু। মা মধ্যরাতে কখনো এসে বলতেন ঘুমিয়ে যা এখন।
প্রিলি এবং রিটেনে আমি টিকে যাই। ভাইবার জন্যে ডাক আসে। তবে আমার ভালো কোনো পোশাক ছিলো না পড়বার মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইবার সময় বন্ধুদের থেকে শার্ট প্যান্ট ধার করে নিয়েছি৷
মারিয়া সেবার সন্ধ্যায় আসে, মারিয়ার যে ছেলেটার সাথে বিয়ে হয়েছে সেই ছেলেটার নাম সৈকত। সৈকত মানুষ হিসেবে দুর্দান্ত। রাতের খাবার খেয়েই সৈকত আবার মারিয়াকে নিয়ে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরেই মারিয়া ফোন করেই আমার সাথে বলে, ভাইয়া তোরে একটা কথা বলি কিছু মনে করবি না। সৈকত তোর বইয়ের ভিতরে পাঁচ হাজার টাকা রেখে আসছে, টাকাটা তোর হাতে দিতে সংকোচ লাগছিলো তাই এমন করে রেখে আসছে। তুই এই টাকা দিয়ে ভাইবার জন্যে ভালো একটা পোশাক পরে যাবি।
আমি টেবিলের উপরের বইটা খুলে দেখি পাঁচ হাজার টাকা ভাজ করে রাখা।
এতো এতো মানুষের ঋণ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি জানি না এবারও কিছু একটা হবে কিনা। তবে যদি কিছু না হয় মনে হয় আমার চেয়ে এই মানুষগুলো বেশি কষ্ট পাবে।
ভাইবা দিয়ে আসবার পরে আমি দুদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। তিনদিন পরে বাসা থেকে বের হই। ভাইবার রেজাল্ট কবে দিবে ঠিক নেই। ঠিক করি আপাতত কিছু একটা করতে হবে। একটা কোচিং সেন্টারে আবার ক্লাস নেওয়া শুরু করি।
কয়েমাস পরের ঘটনা। সেদিন ক্লাস শেষে ফোন হাতে নিয়ে দেখি মারিয়ার বারোটা কল, সৈকতেরও চারটা কল। মারিয়াকে কল দেই, মারিয়া বলে ভাইয়া তোর রেজাল্ট দেখছিস? আমি বলি না, এখনো দেখিনি।
মারিয়া কল কাটলে কোচিং সেন্টারের কম্পিউটার থেকেই রেজাল্ট দেখি, কম্পিউটারের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছি কয়েক মিনিট ধরে। দুই চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে, আমার রোল দেখা যাচ্ছে। মারিয়াকে কল দেই, সৈকতকেও কল দিয়ে জানাই।
সাথে সাথেই বাসায় চলে যাই। মারিয়াকে বলি বাবা মাকে কিছু না জানাতে।
বাসায় ফিরে দেখি মা বিছানার উপরে হরলিক্সের কৌটা রেখে খুচরা টাকা হিসেব করছেন। মায়ের পাশে দাঁড়াতেই চোখ ভিজে উঠে, আমার কথা বলবার শক্তি হারিয়ে গেছে। আমার চাকরির খবর পাওয়ার পরে মা নিজেও কাঁদছেন।
চাকরির প্রথম বেতনের প্রথম টাকাটা নিয়ে আমার মায়ের হরলিক্সের কৌটায় রাখি। আমার ইচ্ছে ছিলো একদিন মায়ের এই ব্যাংকটা টাকা দিয়ে ভর্তি করে দিবো। একটা হরলিক্সের কৌটা ভর্তি টাকা, মা যা দেখে সেই থেকে কাঁদছেন।
একটা হরলিক্সের কৌটা
-মুস্তাকিম বিল্লাহ