রাত ১২.৩৩ মিনিট।
অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিলো আমাকে। তারপর প্রতিদিনের মতো এলাকার ৩ জন সিকিউরিটি মামার সাথে চা আর টা খেলাম। তাদের সারাদিনের গল্প শুনলাম। এর মধ্যে এক রিক্সওয়ালা মামাও যোগ দিলো। বিল দেয়ার পর দেখলাম পকেট ফাঁকা।
কাল অফিস যাওয়া লাগবে তাই ATM বুথে গেলাম। বুথের মামাও ঘুম। টাকা তোলার সময় হটাৎ একটা ভাইব্রেশন শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। এই রাতে যদি আমার কার্ড আটকায় যায় তাহলে আমি শেষ। তাই শব্দের উৎস খুঁজতে লাগলাম। ইতিমধ্যে শব্দটা অফ। কার্ড বের করতেই আবার শব্দ।
এবার ভালো করে খুঁজতেই দুই বুথের চিপায় একটা ফোন দেখতে পেলাম। হাতে নিয়ে দেখি হালিমা ফোন। বুথের মামাকে ডেকে তুললাম যে এটা উনার ফোন কি না। উনি ঘুম ঘুম চোখে বালিশের নিচে চেক করে দেখলেন যে উনার ফোন উনার কাছেই আছে। আবার ফোন আসলো। নাম্বার আননোন। আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে একজন কথা বলে উঠলেন। তার কথার টোনে টেনশন আর উৎকণ্ঠা।
হ্যালো? হ্যালো?
-হ্যালো…
আপনি কে বলতেছেন? এইটা আমার ফোন? আপনি কই পাইছেন? কেমনে পাইলেন? আপনি কই এখন?
-ভাই থামেন, শান্ত হয়ে কথা বলেন।
ভাই, ভাই আমি তাড়াহুড়া কইরা টাকা তুলে চলে আসছি মেডিকেলে। খেয়াল ছিলো না। মেডিকেলে আসার পর মনে হইছে ফোন আমার পকেটে নাই।
-আচ্ছা সমস্যা নাই। আপনি আছেন কই?
ঢাকা মেডিকেল।
-আপনার বাসা কই?
রাজারবাগ কালীবাড়ি। আপনার?
বাসাবো। আচ্ছা আমাকে বাসায় যেতে হবে। আপনি ফোন কীভাবে নিবেন? আমি এই বুথের সিকিউরিটি মামার কাছে রেখে যাই। আপনি এসে নিয়ে যান।
-ভাই ভাই শুনেন না।
হ্যাঁ, বলেন না।
-আসলে আজকে আমার মায়ের অপারেশন হইছে। আর আমি ছাড়া তো আমার মায়ের কেউ নাই। আমি একাই সব সামলাইছি, মাথার ঠিক আছিলো না। এখন মায়েরা ছাইড়া কীভাবে যাই। আবার আমার ফোন ছাড়াও কারো সাথে যোগাযোগ করার উপায় নাই।
আচ্ছা। বুঝলাম। কিন্তু ভাই আমি সারাদিন অফিস করে আসছি। আমার বাসায় যাওয়া দরকার। সকালে আবার অফিস আছে। কাছে থাকলে দিয়ে আসা যেতো। ঢাকা মেডিকেল কলেজ বেশ দূরে। আচ্ছা আমি আপনাকে ৫ মিনিট পরে ফোন দিচ্ছি।
-ভাই ভাই… শুনেন…
আমি আপনার ফোন মেরে দিবো না, চিন্তার কিছু নাই। ৫টা মিনিট সময় দেন।
আমি ভাবতে লাগলাম কী করা যায়। এতো রাতে রাইড নিয়ে ঐদিকে যাওয়াটা সেফ না। আবার ঐ মানুষটার সিচুয়েশান চিন্তা করেও মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। পড়লাম উভয় সংকটে।
আবার চা আর টা নিলাম আর ভাবতে থাকলাম। এসময় একজন পুলিশ আসলেন আমার মতোই চা আর টা খেতে। হুট করেই একটা চিন্তা মাথায় আসলো।
রিয়াজ ভাই এই মধ্য রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা আর টা খেতে অন্যরকম একটা মজা আছে তাই না? (উনার ব্যাজ দেখে নাম বলেছিলাম) উনি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন।
তার চোখে মুখে পাইছি তোরে আজকে টাইপ এক্সপ্রেশন দেখে আমি মনে মনে ভাবলাম যে আমারে হিমু ভাইবা বাঁশ ডলা না দিলেই হয়, ডিম থেরাপি দিবে না কারণ ডিমের অনেক দাম। তবে আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি নরমালি কথা বলতে শুরু করলেন।
হ্যাঁ, প্রতিদিন খান নাকি?
আমি উত্তর দেয়ার আগেই চা মামা উত্তর দিয়ে দিলেন।
-হ, উনিও প্রত্যেকদিন আসে আপনার মতো। তবে আপনার আগে।
আরে বাহ। তা কী করেন? কোথায় থাকেন।
আমি বিস্তারিত বললাম।
আরে তুমি দেখি আমার ইউনিভার্সিটির ছোট ভাই।
আবার ফোন আসা শুরু হলো।
-কি প্রেমিকা ফোন করতেছে নাকি?
আমি ফোনটা সাইললেন্ট করে সব বললাম।
উনি একটু ভেবে বাইকের পিছে উঠতে বলল।
আমি বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আল্লার নামে উঠে পড়লাম।
আর মাথায় বাজতে লাগলো-
“সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোতা দাও দিয়ে কাইট্টালা
পুলিশের খেতা দিয়া যাইত্তা ধইরা মায়রালা”
যাইহোক, মেডিকেলের সামনে গিয়ে নামলাম। ইতিমধ্যে ৫০ বার ফোন দেয়া শেষ, ফোনের চার্জের মায়রে বাপ হবার আগেই আমার ফোনে নাম্বারটা নিয়ে ফোন দিয়ে গেটে আসতে বললাম। ছেলে ভাবছে আমি মজা নিচ্ছি। সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে আমি আসছি। আমি সুন্দর করে বললাম আসার জন্য।
ফাইনালি ৫মিনিট পর আসলো। আমি ভ্যারিফাই করে তাকে ফোনটা দিতেই সে আমাকে জড়ায় ধরলো। এমনভাবে আমার মনে হয় আমার কোনো প্রেমিকাও কখনো ধরে নাই।
চলে আসবো এসময় শুরু হলো তার ড্রামা। সে কোনোভাবেই তার মায়ের সাথে দেখা না করে আসতে দিবে না। আমি আর পুলিশ ভাই মিলেও তাকে কনভিন্স করতে পারলাম না। উপায় না দেখে তার পিছে পিছে গেলাম।
ওয়ার্ডে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলো।
পুলিশ ভাই বলল তুমি ভেতরে যাও। আমি বাইরে দাঁড়াই। এত রাতে পুলিশ দেখলে ভয় পাইতে পারে। আমি একাই গেলাম। ছেলেটা তার মা’কে দেখায় দিতেই সালাম দিলাম। নিচু স্বরে সালাম নিলেন। শোয়া অবস্থায় আমার একটা হাত ধরলে ইশারায় মাথা নিচু করতে বললেন। আমি মাথা নিচু করতেই মাথায় হাত বুলায় দিলেন।
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপচাপ উনার দিকে কিছুক্ষণ তাকায় থেকে হাঁটা দিলাম। ছেলেটা ওয়ার্ডের গেট পর্যন্ত আগায় দিলো। আমি গেট থেকে বের হয়ে হাঁটা দিলাম। পুলিশ ভাই আমার দিকে তাকায় বলে তোমার চোখে পানি কেন। আমিও খেয়াল করলাম আমার চোখ ভিজে গেছে।
ভাবতে লাগলাম পৃথিবীর সব মায়েদের মাঝে কী এমন আছে যে তারা এত সহজেই কাছে টেনে নিতে পারে। প্রত্যেকেটা মায়ের গায়ে কেমন যেন অদ্ভুত একটা গন্ধ থাকে। তাদের ভালোবাসা টের পাওয়া যায় গায়ের গন্ধে। আমি ভাবতে থাকি আজকে আমার ‘মা’ থাকলে কি খুশিটাই না হতো এই ঘটনা শুনে।
আমি চোখ না মুছেই বাইকের পেছনে উঠি।
মাথায় বেজে উঠে-
“রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস?
কোথায় আছে কেমন আছে মা?”
পৃথিবীর সব মা-বাবারা ভালো থাকুক।