নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ১০
#WriterঃMousumi_Akter.
গভীর রাত। নিস্তব্ধ-ঘুমন্ত শহরে জেগে আছে প্রান্তিক চৌধুরী। খালি গায়ে, থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। দু’চোখের পাতায় ঘুম নেই তার। ভেতরটা অস্থিরতায় জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে । ইশ! কী ভয়ংকর যন্ত্রণা! প্রেয়সীর অবহেলা বুঝি এত পীড়াদায়ক আগে জানা ছিল না তার। প্রেয়সীর ঘৃণাভরা দৃষ্টি তার ভেতর চৈত্রর খরার মতো হৃদয়ের সমস্ত উল্লাস শুকিয়ে ফেলেছে। হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটা কখন যে অসাবধানতার জন্য পায়ের উপর পড়ল– খেয়াল করতে পারেনি। ধবধবে ফরসা পা সিগারেটের আগুনে পুড়ে কালো বৃত্তের মতো হয়ে গেল। পা জ্বলে উঠতেই সেদিকে চোখে ফেরাল প্রান্তিক। ভয়ংকর জেদের দরুণ পায়ের উপর থেকে জলন্ত সিগারেট সরালো না ।
প্রান্তিক বোঝার চেষ্টা করল তার পা পুড়ছে বেশি না কি মন পুড়ছে বেশি। অনুভব করল– মনের যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির কাছে পায়ের এই সামান্য জ্বলা-পোড়া যেন কিছুই না। তাহলে জ্ব’ লে যাক পা, পু’ ড়ে যাক মন, ছাই হয়ে যাক সব। আবারও লাইটার জালালো। লাইটারের আগুনের সম্মুখে ভেসে উঠল রজনীর সেই ঘৃণাভরা দৃষ্টি। এই দৃষ্টি সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না।লাইটা টা দূরে ছুড়ে মেরে দাঁত কিড়মিড় করে খানিকটা পেছনে সরে এলো। পায়ের উপর থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা পড়ে গেল। গর্জে উঠে বলল,
“হুয়াই রজনীগন্ধা, হুয়াই? হুয়াই আর ইউ হার্টিং মি? কী আছে তোমার ওই চোখে? আমি উন্মাদ হয়ে যাব, পা’গ’ল হয়ে যাব তোমার ওই দৃষ্টির জন্য।”
শ্রাবণ বাইরে অপেক্ষা করছিল। আজ শ্রাবণ ঘুমায়নি। আজ প্রান্তিকের মুড খারাপ।প্রান্তিকের যেদিন মুড অফ থাকে প্রান্তিক ঘুমোতে পারে না। সেদিন শ্রাবণও ঘুমায় না।প্রান্তিক কী থেকে কী করে হুঁশ থাকে না।শ্রাবণ প্রান্তিকের পাশে পাশেই থাকে।পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক থাকে একদম নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। শ্রাবণও তেমন।প্রান্তিকের প্রতি ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই। শ্রাবণ প্রান্তিকের রুমে প্রবেশ করে বলল, “ভাই, প্লিজ শান্ত হন।”
“শ্রাবণ, গাড়ি বের কর।”
“এত রাতে কোথায় যাবেন ভাই?”
“কুয়াকাটা। হোটেল বুকিং দিয়ে দে সাতদিনের জন্য।”
প্রান্তিকের অভ্যাস আছে গভীর রাতে হুট করে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার। মধ্য রাতে গাড়ি নিয়ে প্রকৃতির খোলা হাওয়ায় মিশে যেতে তার ভালো লাগে। জাস্ট একটা থ্রী কোয়ার্টার আর সাদা গোল গলা টি-শার্ট পরে ব্যাগে কয়েকটা ড্রেস নিয়েই বের হয়ে গেল প্রান্তিক। সাথে শ্রাবণও আছে। রাতের নিস্তব্ধতায় গাড়ি চলছে। কালো কালারের একটা কার। জানালা খোলা। ড্রাইভ করছে প্রান্তিক। বেশ গম্ভীর মুডে আছে। সাথে সিগারেটও আছেই। শ্রাবণ বলল,
“ভাই, ভাবি ছোটো মানুষ না বুঝে আপনাকে ভুল বুঝছে। একটু সময় দিন ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রান্তিক গম্ভীর মুডেই বলল,
“আমার কাছে এক সেকেন্ড সময়ও এক যুগ সমান মনে হচ্ছে, শ্রাবণ।”
“ভাই, ভাবির মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে কোথাও একটা। আর ওই টাইমে ওই মেয়ে কল দিয়েই তো আরও প্রব্লেম করল।”
“এইসব শালিরা আমাকে পেয়েছে কী? এদের জন্য আমার ঘরে আগুন লাগছে। আমি যাকে চাচ্ছি তাকে পাচ্ছি না। আর এদের চাচ্ছি না এরা আমার পিছুই ছাড়ছে না। অঘটন কিছু না কিছু একটা ঘটেই চলেছে। যখনি রজনীগন্ধা সামনে আসে এইসব আপদ-বিপদ তখনই ফোন দেয়।”
“ভাই এদের ব্লক দিয়ে দেন।”
প্রান্তিক শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কয়জনকে ব্লক দেব?”
শ্রাবণ গাল চেপে হাসল। হেসে বলল, “ভাই, ভাবি আপনার হোয়াটসঅ্যাপ আর মেসেঞ্জার দেখলে কী হবে?”
“তার আগে বাটন ফোন কিনে চালাতে হবে।”
“এদের সাথে তো আপনার কিছুই না, কাউকে ভালোও বাসেন না তাহলে এরা ফোন দেয় কেন?”
“এরা সবাই আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড। আমি কাউকেই ভালোবাসতে পারিনি। দু’একবার ডেট করেছি তারপর আর ভালো লাগেনি।যদিও আমি কাউকে সেধে ডেটে ডাকিনি।ওরাই প্রপোজ করেছে। রাজি না হলে বলেছে একদিন ডেট করে দেখো ভালো না লাগলে ছেড়ে যেয়ো। ভালো লাগেনি ছেড়ে এসেছি। দুই ঘণ্টা, এক ঘণ্টা, দুই দিন, একদিনের গার্লফ্রেন্ড এরা।”
“ভুলেও যেন ভাবি এসব না জানে ভাই।জানলে খবর আছে আপনার।”
“না জানানো কি ঠিক হবে? আমি রিলেশন এ লয়্যাল থাকতে চাই।”
“লয়্যালই থাকবেন, বাট মাঝে মাঝে অজানা জিনিস না জানানোই ভালো। এটা সম্পর্কের জন্যই ভাই। মাঝে মাঝে ভালোর জন্য মিথ্যা বললেও সমস্যা নেই।”
______________
কেটে গিয়েছে সাতদিন। রজনী এর মাঝে ৫ দিন কলেজ গিয়েছে; অথচ প্রান্তিককে দেখতে পায়নি একদিনও। মানুষটা কি হারিয়ে গেল? অদ্ভুত কোনো কারণে রজনীর আঁখিযুগল খুঁজে চলেছে দুই আঙুলের মাঝে জলন্ত সিগারেট চেপে রাখা ভয়ঙ্কর ছেলেটাকে। যার চোখে কখনো অগ্নি থাকে আবার কখনো দুষ্টুমি থাকে। সেদিন হসপিটালের ব্যবহারটা কি অনেক খারাপ হয়ে গেছিল? অস্থিরতায় ভুগছে রজনী। যে মানুষটা সারাক্ষণ তার পিছে লেগে থাকে বিগত সাতদিন তার দেখা নেই।
আনমনেই প্রান্তিকের উপর অভিমান হলো রজনীর। এই হলো ছেলেদের ভয়ঙ্কর ভালোবাসা।ইহকাল-পরকাল সব কালেই পিছু ছাড়বে না! একদিন কয়টা কথা শোনানো হয়েছে অমনি ভেগে গিয়েছে। অদ্ভুত! আমি কেন ভাবছি ওই খারাপ মানুষটার কথা? নিজ থেকে আপদ বিদায় হয়েছে এটাই আলহামদুলিল্লাহ। মাথা ঝাড়া দিয়ে প্রান্তিকের চিন্তা বের করে দিল রজনী।কলেজ থেকে ফেরার সময় শ্যামলা বর্ণের একটা ছেলে রজনীর দিকে ফোন ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে ছবি তুলছে।আজকালকার ছেলেদের উদ্দেশ্য ভালো না।এই ছবি কি ইন্টারনেটে খারাপভাবে ছেড়ে দেবে? রজনী কী করবে ভেবে না পেয়ে চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি উদয় করল। সোজা ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনি আমার ছবি তুলছেন?”
ছেলেটা কোনো কথা বলল না। কী বলবে ভাবছে। রজনী চট করে বলে উঠল, “আমার ছবি তুললে কিন্তু খুব খারাপ হবে। আমার বয়ফ্রেন্ড কে জানেন?”
ছেলেটা বলল, “কে?
ছেলেটার নাম অন্তু। সে প্রান্তিকের সাথেই থাকে। অন্তুর হাতের ফোনে ভিডিয়ো কল চলছে। ফোনের ওপাশে প্রান্তিক রয়েছে।“আমার বয়ফ্রেন্ডকে” কথাটা শুনে প্রান্তিকের হার্টবিট বেড়ে গেল। তার মানে– তার রজনীগন্ধার বয়ফ্রেন্ড আছে! প্রান্তিকের চোখ-মুখ শুকিয়ে এসেছে। তখনি রজনী বলে উঠল, “আমার বয়ফ্রেন্ডের নাম প্রান্তিক চৌধুরী। নিশ্চয়ই ওই নামটা আপনার জানার কথা। আপনি প্রান্তিক চৌধুরীর গার্লফ্রেন্ডের ছবি তুলছেন। কী হবে বুঝতে পারছেন? আপনার এক হাত আর হাত থাকবে না। এই হাত তুষ তুষ করে দিবে প্রান্তিক।”
অন্ত হা করে তাকিয়ে আছে। ভীষণ অবাক হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল, “কী হন আপনি প্রান্তিক ভাইয়ের?”
“ওর হবু বউ আমি।”– বলেই রজনী বেশ ভাবসাব নিয়ে হাঁটা দিল।
প্রান্তিক সমুদ্র পারে দাঁড়িয়ে মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি দিয়ে বলল, “উফফ! রজনীগন্ধা, ইউ আর রিয়েলি কি “ল মি!”
চলবে…..