নয়নে লাগিল নেশা ১২
#WriterঃMousumi_Akter.
প্রিয়তার অভিমান হয়েছে। আকাশ সমান অভিমান। সে শ্রাবণের দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। আর কখনো এই কেয়ারলেস ছেলেটার সাথে সে কথাও বলবে না। মেয়েরা ভালোবাসলে যেমন জীবন দিতে পারে তেমনি অভিমানে মুখ ফিরিয়েও নিতে পারে।প্রিয়তা বাড়ি থেকে বের হলেই শ্রাবণও বের হলো। প্রিয়তার পিছু পিছু হাঁটছে শ্রাবণ। হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তার কাছে চলে গেল।পাশাপাশি হাঁটছে। প্রিয়তা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে একটু জোরে হাঁটা দিল। যতই হোক মেয়ে মানুষ কি আর ছেলেদের সাথে হেঁটে পারে? শ্রাবণ একটু বড়ো করে পা ফেলেই আবার প্রিয়তার সমতায় চলে গেল। প্রিয়তা ভয়ানক রাগী চোখে শ্রাবণের দিকে তাকাতেই শ্রাবণ অন্য দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাল। প্রিয়তা কোমরে হাত বেঁধে একভাবে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে রইল।শ্রাবণ আড়চোখে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “ওভাবে তাকাবেন না সম্বন্ধীর বোন। আমি ভয় পাচ্ছি।”
প্রিয়তা রেগে গিয়ে বলল, “তুই আমার পিছ পিছে আইছোস ক্যান?”
শ্রাবণ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে দুই কান ধরে বলল, “আর এমন হবে না সোনা। এইবার লাস্ট চান্স দেন।”
“এইবার লাস্ট চান্স দিব? এই মিথ্যুক। এই কথা আর কতবার বলবি? এই নিয়ে এক হাজার বার বললি লাস্ট চান্স দেন!”
“এটাই লাস্ট বার। আর এমন হবে না। মাফ করে দেন ম্যাডাম।”
“এই আমি রেগে গেলে তুই আপনি আপনি করিস ক্যান?”
“কারণ, আপনি রেগে গেলে আমাকে ‘তুই’ ‘তুই’ করে বলেন এইজন্য।”
“যে অন্যায় করেছিস তুই! এর থেকে নিচু কিছু থাকলে তাই বলতাম।”
“আচ্ছা বলেন, তা-ও মাফ করে দেন।”
“তোর কোনো মাফ নেই। আর যদি আমার পিছু নিস, খবর আছে।”
“খবর তো দেখাচ্ছেনই। কথা বলছেন না, ব্রেকাপের হুমকি দিচ্ছেন। এসব কি কম খবর?”
“কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
শ্রাবণ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হুম, খুব বেবি।”
“একদিনে হাঁপিয়ে গিয়েছিস? বিগত সাতদিন আমি কীভাবে থেকেছি? কীভাবে আমার সময় কেটেছে আইডিয়া আছে কোনো? যন্ত্রণায় ছটফট করেছি আমি। যদি আমি মরে যেতাম কী হতো?”
শ্রাবণের মুখটা সাথে সাথে মলিন হয়ে গেল।প্রেমিকার মৃত্যু কথাটা কানে আসাতেই যেন শ্রাবণ ভয় পেয়ে গেল। তার আত্মা কেঁপে উঠল। খুব মলিন সুরে বলল, “এমন দিন আসার আগে আমিই মরে যাব প্রিয়তা।”
“এসব আজেবাজে কথা বলার জন্য আসা হয়েছে?”
“আমি অসুস্থ তাই বলতে এসেছি। ডাক্তার দেখিয়েছি বলল, রিপোর্ট খুব খারাপ। কী জানি বাঁচব না মরব!”
“রিপোর্ট খারাপ মানে? কখন অসুস্থ হলে, আর কোথায় ডাক্তার দেখালে? কী হয়েছে তোমার?”
প্রিয়তার অস্থিরতা দেখে শ্রাবণের কেমন কান্না পাচ্ছে। মেয়েটা তাকে কত ভালোবাসে। অথচ তার বারবারই কষ্ট দেওয়া হয়ে যায়। এই যে এখন প্রিয়তার প্রয়োরিটি পেতেই বাজেভাবে মিথ্যা বলতে হলো। প্রিয়তা এখনি কেঁদে দেবে দেবে ভাব।শ্রাবণ বলল, “মনে হচ্ছে– বহুযুগ তোমায় কাছে থেকে দেখিনি। একটু মন ভরে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে। রিসোর্টে যাবে? জাস্ট কিচ্ছু না।শুধু নির্ভয়ে চোখ মেলে তোমাকে একটু দেখতাম।”
মেয়েদের নরম মন। প্রিয় মানুষের ব্যথিত হৃদয়ের আকুল আবেদন ফেলে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।
প্রিয়তা শ্রাবণের সাথে একটা রিসোর্টে গেল।সামনাসামনি দু’জনে বসল। প্রিয়তার হাতের উপর শ্রাবণের হাত। শ্রাবণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ভেজা কণ্ঠে বলল, “কী হয়েছে তোমার, শ্রাবণ?”
শ্রাবণ ম্লান হেসে বলল, “কিছু না জান। তুমি কথা না বললে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। এই যে কথা বলছ– সুস্থ হয়ে গিয়েছি। তুমি পাশে থাকলে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছা দ্বিগুণ হয়ে যায়।”
“বলো ডাক্তার কী বলেছে? আমি আর কখনো রাগ অভিমান করব না তোমার সাথে। তুমিতো জানোই আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। কথা না বলতে পারলে দম বন্ধ হয়ে যায়।”
“আমার কিছুই হয়নি। তোমার প্রয়োরিটি পেতে মিথ্যা বলেছি। এগেইন স্যরি জান।”
“এমন মিথ্যা আর বলবা না তুমি।”
শ্রাবণ উঠে দাঁড়াল। প্রিয়তার পায়ের সামনে বসে পড়ল। প্রিয়তার পা নিজের হাঁটুর উপর রাখল। পকেট থেকে ঝিনুকের পায়েল বের করে প্রিয়তার পায়ে পরিয়ে দিতে দিতে বলল, “যোগাযোগ নেই বলে যে আমি আমার প্রিয়তার কথা ভুলে গিয়েছিলাম তা কিন্তু নয়।”
প্রিয়তার কাছে মনে হলো কয়েক কোটি টাকা দামের কোনো উপহার তার পায়ে।খুশিতে দুই হাতে মুখ ঢেকে বলল,
“এত্ত এত্ত খুশি হয়েছি আমি। এত সুন্দর উপহার আমি আগে পায়নি।”
শ্রাবণের সামান্য উপহারে প্রিয়তার খুশি দেখে শ্রাবণের মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব দামি উপহার প্রিয়তার হাতে এনে দিতে।
____________
প্রান্তিকের মন ছুটেছে রজনীকে দেখার জন্য। এভাবে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না।জীবনে কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি অপেক্ষা করাটা প্রান্তিকের ভালো লাগে না। আজ গিয়ে স্রেফ রজনীর আম্মাকে সে জানিয়ে দিবে তার মেয়েকে সে বিয়ে করতে চায়।আঞ্জুমান রান্নায় ব্যস্ত আছে। প্রান্তিকের পরনে ব্লু জিন্স, সাদা শার্ট। হাত ঘড়ি পরতে পরতে রুম থেকে বের হলো। আঞ্জুমান বলল, “কোথায় যাচ্ছো প্রান্তিক? খাবে না?”
প্রান্তিক তার আম্মার কাছে গিয়ে বলল, “একটু বাইরে যাব আম্মু।”
“তোমার কি কিছু হয়েছে? তুমি কিন্তু আগের মতো নেই। কী হয়েছে বলবা?”
প্রান্তিক লাজ-লজ্জা ফেলে বলল, “আমি বিয়ে করব আম্মু।”
আঞ্জুমান ছেলের এমন কথায় খুব খুশি হলো সাথে চিন্তিতও। তার ছেলে তো বিয়ে করতে চাইত না। হঠাৎ চাইছে কেন? এর পেছনে কি কোনো কারণ আছে?
আঞ্জুমান বলল, “বেশ তো বাবা। তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও?”
“আগের দিন বললাম না?”
“তুমি কি সত্যি মন থেকে বিয়ে করতে চাইছ?”
“মন না সায় দিলে তোমার ছেলে কিছু করে না তুমি তো জানোই আম্মু।” – বলেই প্রান্তিক বেরিয়ে গেল। বাইক নিয়ে ছুটল তার রজনীগন্ধার বাড়িতে। ৩০ মিনিটের মাঝে প্রান্তিকের বাইক গিয়ে থামল রজনীদের উঠানে। আর তখনি রজনী গোসল করে উঠানে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে চুল মুছছে।রজনীর পাশে গিয়েই প্রান্তিকের বাইক থামল। রজনী সাথে সাথে চমকে উঠল।প্রান্তিক মাথার হেলমেট খুলে চুল ঠিক করতে করতে রজনীর দিকে তাকাল।প্রান্তিক রজনীর আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে দুষ্টু হেসে তাকাল। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “উফফ! এমনিই ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে তার উপর এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কী দেখলাম এটা!”
রজনী এতদিন পর প্রান্তিককে দেখে ভীষণ অবাক হলো। এই মানুষটা তাকে ভোলেনি।এতদিন কোথায় ছিল? রজনীকে প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রান্তিক ভ্রু নাচিয়ে বলল, “এইভাবে তাকিয়ে কী দেখছ, ভেজা রজনীগন্ধা? ক্রাশ খাচ্ছ আমাকে দেখে? যদিও আমি ক্রাশ খাওয়ার মতোই ছেলে। তুমি একটু লেট করছ ক্রাশ খেতে।এত স্লো কেন মেয়ে তুমি?”
রজনী এবার হুঁশে ফিরে এসে বলল, “কী বলছেন এসব?”
“কী আর বলব? তোমাকে যা লাগছে না! ইচ্ছে হচ্ছে…… থাক বলব না।”
“কী লাগছে আমাকে?”
প্রান্তিক রজনীর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল, “সো হট।”
কথাটা রজনীকে রাগাতেই বলল।
রজনী রেগে তাকাল প্রান্তিকের দিকে।তাকিয়ে বলল, “অসভ্য!”
“ইচ্ছে হচ্ছে অসভ্যতার লিমিট ক্রস করতে।একবার কবুল বলে দাও শুধু। দেখবে আমি কেমন লিমিট ছাড়া অসভ্য।”
“ছি! ছি! ছি!”– বলেই রেগে হনহন করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগাল। ভেজা চোখের পাপড়িতে চোখ দুটো যেন আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে রজনীর।
রজনীর আম্মা বাইকের শব্দ শুনে এগিয়ে এলো। প্রান্তিককে দেখে বেশ অবাক হয়ে মাথায় কাপড় টেনে বলল, “আরে বাবা তুমি? এসো এসো বোসো।”
প্রান্তিক বাইক থেকে নেমে সালাম দিয়ে বলল, “আন্টি, আমি একটা কথা বলতে এসেছি। জোর করব না আপনাদের। তবে ভেবে দেখবেন।”
“কী কথা বাবা?”
“আমার মা-বাবা এসে বলবে আপনাদের।কিন্তু আপনাদের যদি আপত্তি থাকে তাই আগে আমিই কথাটা জানাতে চাই। আমার মা-বাবা এসে অপমানিত হোক সেটা চাই না।”
“কী হইছে বাবা?”
“আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি। আমি বিয়ে করতে চাই। কথা দিচ্ছি ভালো রাখব।আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও ভাল রাখব।”
রজনীর মা এত বেশি অবাক হয়েছে যে কি বলবে বুঝতে পারছে না। প্রান্তিক বুঝতে পারল– রজনীর আম্মা অবাক হয়েছে। তাই বলল, “চিন্তা করবেন না। এখনি কিছু বলতে হবে না। পরে বললেও হবে। এখন আমি আসি আন্টি।”
“দাঁড়াও বাবা। খালি মুখে যাইতেই পারবা না। এক মিনিট দাঁড়াও। এক গ্লাস পানি হইলেও খাইয়া যাও।”
রজনীর চেঞ্জ করা হয়ে গিয়েছে। রজনীর আম্মা খুশিতে পা’গ’ল হওয়ার উপক্রম। ঘরে গিয়ে চানাচুর আর মুড়ি এক প্লেটে দিয়ে রজনীর হাতে দিয়ে বলল, “যা পোলাডারে দিয়ে আয়।”
“আমি পারব না।”
“যাও আমি আছি তো। পানি নিয়ে আসি।তুমি প্লেটটা দিয়ে এসো।”
রজনী রাগী মুডেই আছে। অন্যদিকে মুখ করে প্রান্তিকের সামনে প্লেটটা ধরল। আর মনে মনে ভাবছে– কত্ত বড় নির্লজ্জ হলে তার মায়ের কাছে এসব বলতে পারে!
প্রান্তিক বলল, “আমার দিকে না তাকিয়ে দিলে খাবো না। ওই চোখ না দেখলে পেট ভরবে না।”
রজনী বিরক্ত চোখে তাকাল।
প্রান্তিক দুষ্টি হাসি হেসে ডান চোখ টিপে বলল, “বাসর ঘরের প্রস্তুতি নাও। প্রয়োজনে পাড়ার ভাবিদের থেকে শিখে নিয়ো
“আপনার সাথে বিয়ে মরে গেলেও করব না।”
“রজনীগন্ধা, আমি কি দেখতে অসুন্দর তুমি, আমাকে একসেপ্ট করছ না কেন?”
“দেখতে সুন্দর হওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভদ্র হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, চেহারা আল্লাহর দান আর ভদ্রতা নিজেকে অর্জন করতে হয়।”
“আমি কি তাহলে অভদ্র?”
“অবশ্যই অভদ্র। আপনি বড়ো-ছোটো মানেন না, যা ইচ্ছা হয় তাই বলেন।”
“খারাপ কিছু তো করিনি। শাশুড়ি আম্মাকে বলেছি– তার মেয়েকে আমার লাগবে।“
“আপনার লজ্জা করল না– এইভাবে আমার আম্মাকে বলতে?”
“তাহলে কি আমি ভীতু প্রেমিকের মতো মুখ বুজে থাকব? শোনো, রিলেশন করলে এমন ছেলের সাথেই করবা। যে শুধু ফ্যামিলি কেন সারা দুনিয়ার সামনে বলতে পারে যে, তোমাকেই লাগবে তার। আর হ্যাঁ এটাই শুদ্ধতম ভালোবাসার উদাহরণ।”
চলবে…..