নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ২৮
#WriterঃMousumi_Akter
ফোনের ওপাস থেকে ভেসে এল ফুপিয়ে কাঁন্নার আওয়াজ। রজনীর বাবা কাদতে কাদতে বললেন,
” মা তোমার ভাই এর অবস্থা ভালা না। ক্যাডা যেন আ-জ-রা-ই-ল হইয়া আইছিল। তয় জা-ন ডা নিতে পারে নাই। কোন রকম জা-নে বাঁইচা আছে। বাঁচব বলে মনে অইতাছে না। যতই খারাপ হোক নিজের পোলা তো। তার ম’র’ণ হোক এইডাও তো চাই নাই আমি মা। গালি গালাজ দিছি যেন ভালা হইয়া যায়। ভালা তো হইলো ই না। শেষ মেষ অকালে ম-র-ণ হইবো।তোমার ভাই রে শেষ দেখা দ্যাখতে চাইলে হাসপাতালে আসো। প্রান্তিক বাবারে বইলা দুইজনে এক সাথে আসো।”
রজনীর চোখ ছলছল করে উঠল। ছোট বেলা ভাই এর সাথে কত শত স্মৃতি ছিল তার। বড় হয়ে খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়ে বাজে ভাবে বিগড়ে গেল। সেই যে বিগড়ে গেল আর ভাল হলনা। যত খারাপ ই হোক নিজের ভাই এর মৃত্যু তো মেনে নেওয়ার মত নয়। রজনীর চোখ ছলছল দেখে প্রান্তিক ফোনটা কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই রজনীর কাঁন্নার কারণ বুঝতে পারল। অজানা ভ’য় বাসা বাঁধল প্রান্তিকের মনে। যদি রজনী জেনে যায়। তাহলে কি হবে? রজনী তো ক্ষমা করবে না। রজনী কে ই বা কীভাবে বুঝাবে তাকে বাজে কথা বলার জন্যই তার ভাই এর গায়ে সে হাত দিয়েছে। গভীর ভাবে চিন্তা করে প্রান্তিক রজনীর কাঁধে হাত রেখে বলল, ” চলো হসপিটালে যায়। “
রজনী একটা সুতি শাড়ি পরে প্রান্তিকের সাথে বের হল। ঘরের দরজা খুলতেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা, শ্রাবণ,অন্ত আর মাহবুব চৌধুরী। প্রান্তিক আর রজনীকে বের হতে দেখেই সবাই বুঝল ওরা বাইরে যাচ্ছে। মাহবুব চৌধুরী রিতীমত ভ-য় পেয়ে গেলেন। তার ছেলে কি বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাহবুব চৌধুরী প্রান্তিকের হাত টেনে ধরে বললেন,
“কোথায় যাচ্ছো বাবা?”
প্রান্তিক গম্ভীর মুডে বলল, “বাহিরে যাচ্ছি।”
“খেয়ে যাবে না। বৌমাকে না খাইয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো।”
“আম্মুর ব্যবহারে ওর পেট ভরে গিয়েছে। না খেলেও চলবে।”
“তোমার আম্মুর কথায় কিছু মনে করোনা। জানোই তো তোমার আম্মুর মনে নেগেটিভ কিছু ঢুকলে আর বের হতে চায়না।”
আঞ্জুমান নিজের ঘর থেকে বলে উঠল,
“তোমার ছেলের কাছে জিজ্ঞেস করো কাকে বেশী ভালবাসে। মা নাকি বউ। এক দিনেই মায়ের বিরুদ্ধে চলে গেল।”
প্রান্তিক মাহবুবের তাকিয়ে বলল, ” বাবা আপনি কাকে বেশী ভালবাসেন? আম্মু নাকি দাদি?”
মাহবুব ছেলের এমন প্রশ্নে লজ্জায় পড়ে গেল।আমতা আমতা করে বলল,
“তোমার আম্মু তোমাকে অনেক ভালবাসে। মাথা ঠান্ডা হলে দেখবে রজনি মামনিকে আগলে রাখবে।”
“বাবা আমাকে যদি বউ পা-গ -ল ভাবেন কিছুই বলার নেই আমার। আমি আমার মা-বাবাকে পৃথিবীতে সব থেকে বেশী ভালবাসি। মা-বাবার জায়গা পৃথিবীতে কেউ নিতে পারবে না। আমার বউ যদি আমার মা-বাবাকে অসম্মান করে কষ্ট দিয়ে কথা বলে আমি এক সেকেন্ড ও তার সাথে থাকব না। কিন্তু আমি যাকে বিয়ে করেছি তার প্রতি ও আমার দায়িত্ব আছে। আমি মা-বাবাকে ভালবাসি বলে অন্য একটা মেয়েকে এনে মানসিক টর্চার করতে পারিনা। তাকে যদি যোগ্য সম্মান দিতে না পারি তাহলে আমার পরিচয় হবে কা-পুরুষ। মা -বাবাকে অধিক ভালবাসার সাথে বউকে টর্চার করার কোনো সম্পর্ক নেই। বাড়ির বউ এর সাথে খারাপ ব্যবহার করে যদি বুঝাতে হয় আমি আমার মা -বাবাকে বেশী ভালবাসি তাহলে আই আম সরি বাবা। আমি ওই নোংরা ভালবাসায় বিশ্বাসি নই। ভালবাসার বিশ্লেষণ যদি এমন ই হবে ছেলে কাকে বেশী ভালবাসে মা নাকি বউকে তাহলে সেইসব মা-বাবার উচিৎ নয় তাদের ছেলেকে বিয়ে করানো।মা -বাবার জায়গা অনেক উপরে। সেই ভালবাসার সাথে বউ এর ভালবাসার তুলনা করার কোনো মানেই হয়না। এই তুলনা করা মানে আমাকে অপমান করা।আমি রজনিকে আজ রেখে আসব। “
কথা গুলো বলেই প্রান্তিক রজনির হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের গাড়ি বের করল। প্রান্তিক গম্ভীর মুখে গাড়ি ড্রাইভ করছে। রজনির ভাইয়ের জন্য মন খারাপ। এইদিকে প্রান্তিকের ও মুড অফ। চারদিক ভেবে আরো মন খারাপ হচ্ছে। প্রান্তিকের হাতের উপর রজনি হাত রাখল।প্রান্তিক সাথে সাথে রজনির দিকে ঘুরে তাকাল।রজনি মিহি কন্ঠে বলল,
“গাড়ি টা একটু থামাবেন?”
সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে প্রান্তিক বলল, “কি হয়েছে?”
রজনি প্রান্তিকের একটা হাত তার মাথার উপর রেখে বলল,
“একটা কথা দিতে হবে আপনাকে।”
প্রান্তিক সাথে সাথে হাত সরিয়ে বলল,
“মাথা ছুঁয়ে কেনো কথা দিতে হবে? আমি তোমাকে বাজি ধরে কোনো গেম খেলব না রজনিগন্ধ্যা।আমি মাথা গরম মানুষ। মাথা গরম হলে হুঁশ থাকে না।পরে তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়া কথা রাখতে পারব না।এর ফলে তোমার একটা ক্ষতি হয়ে যাবে। নিজের ক্ষতি মেনে নিতে পারব কিন্তু আমার প্রিয়তমার কোনো ক্ষতি আমি মেনে নিতে পারব না।”
“কেমন ভালবাসেন আমাকে? আমাকে ছুঁয়ে কথা দিলে সেটা মনে থাকবে না।”
“আমি নায়ক শাকিব খান নই-যে ভালবাসার মানুষকে কথা দেওয়ার বিনিময়ে ভিলেনের হাতে মা- র খেতে খেতে র–ক্তা–ক্ত হয়ে যাবো তবুও পাল্টা আঘাত করতে পারব না।”
“আমি কি বলতে চাই না শুনেই এসব বলছেন।”
“ওকে ফাইন বলো বাট মা-রা-মা-রি করা,সিগারেট খাওয়া,আর তোমার ব্যাপারে কোনো স্যাক্রিফাইস, কম্প্রোমাইজ এসবে নিষেধ করতে পারবে না।”
“তাহলে কি পারব? সেটার লিস্ট দিন।”
“আর একটা সে হল- সিনেমার নায়িকাদের মত বলতে পারব না আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে স্পর্শ করতে পারবেন না। কোনো এগ্রিমেন্ট এ সাইন করাতে পারবা না।আমি ও সিনেমার নায়ক দের মত নাটক করিনি। তুমি আমাকে যে থা*প্প*ড় টা দিয়েছিলে ভাইরে ভাই। সিনেমার নায়ক হলে তোমাকে বাসর ঘরে কয়েক টা থা*প্প*ড় মে’ রে বলত সেইজ একটা থা* প্প* ড় এর প্রতিশোধ নিতেই বিয়ে করেছি। ওরা কেমনে পারে বাসর ঘরে সুন্দরী বউ দেখে আদর না করে গায়ে হাত তুলতে। মেয়েদের নরম তুলতুলে হাতের একড়া চ* ড়ে কি হয়। “
“আমি বলব ই না। “
” এগুলা বাদে থাকলে বলো।”
” আপনি আমার জন্য মা-বাবার সাথে তর্ক করবেন না। এতে আমাকে আরো খারাপ ভাববে। মায়ের রা-গ মিটে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তুমি ছোট মানুষ এসবে কান দিওনা। কোথায় কি বলতে হবে আমি ভাল জানি।”
প্রান্তিক আর রজনি কিছুক্ষণ পরে হসপিটালে পৌছাল। প্রান্তিক আগে থেকেই জানে বাবু কোথায় আছে। জেনেও না জানার ভান করে রজনির বাবাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে নিল।কেবিনে রজনির ভাই বাবু সুয়ে আছে। অক্সিজেন চলছে। অবস্থা খুব একটা ভাল না। রজনি গিয়ে মা বাবার পাশে বসল। রজনি ওর মা বাবা সবাই কাদছে। প্রান্তিক রজনির মা বাবাকে বলল,
” চিন্তা করবেন না। দেশের বাহিরে পাঠাতে হলেও আমি পাঠাব। যত টাকা লাগে ভাইয়া সুস্থ হয়ে যাবে। আমি সুস্থ করে তুলব। আপনারা শান্ত হন।”
প্রান্তিক ফোন নিয়ে বাইরে গিয়ে শ্রাবণ কে ফোন দিয়ে বলল,
” আরে ভাই রজনির জন্য ওর কুলাঙ্গার ভাইকে এখন আমার ভাইয়া ডাকা লাগছে। ওহ শিট! ভাবা যায়। আমি ওই বাবু কে ভাইয়া ডাকছি।”
শ্রাবণ হো হো করে হেসে দিয়ে বলল, ” ভাই এইটা সেরা ছিল।”
“আরে শালা তুই হাসছিস।”
“আরে ভাই আপনি আমাকে শালা ডাকবেন কেনো? ডাকব তো!”
“তাইলে কি দুলাভাই ডাকব। “
শ্রাবন মুগ্ধ এক হাসি দিল। প্রান্তিক বলল,
“বাবুর অবস্থা এত খারাপ হল কীভাবে? কাল রাতে তো এত খারাপ ছিল না। কেউ চক্রান্ত করে নাই তো।”
“ভাই বাবু সুস্থ হয়ে যাবে। সিকিউরিটি দিয়ে রাখব। রোমিও ম’রে মরুক।”
” রোমিও ম’রে যাক আর আমার ফাঁসি হোক। আমার সদ্য বিবাহিত বউ বিধবা হোক। আগে আমি তিন বাচ্চার বাপ হবো তারপর এসব মরার চিন্তা।”
” ভাই তিন বাচ্চার বাপ হবেন?”
“ইচ্ছা আছে যত গুলা বাচ্চা হয় তত গুলার ই বাপ হওয়া।”
এরই মাঝে রজনি এসে বলল, ” তাই নাকি?”
প্রান্তিক ফোন কেটে দিয়ে বলল, ” একটু মজা করছিলাম সুইটহার্ট। “
কিসব রিপোর্ট দিয়েছে ডাক্তার। একটু দেখুন। বাবা এসব বুঝতে পারছেনা।প্রান্তিক বলল,
” আমি আছিতো ডোন্ট ওরি।’
প্রায় দশ দিন কেটে গিয়েছে। হসপিটালে একভাবে দৌড়াদৌড়ি করছে রজনি। হসপিটালের পাশেই একটা হোটেলে উঠেছে রজনিকে নিয়ে।বিগত দশ দিনে সে বাড়িতে যায়নি। মাহবুব, প্রিয়তা, শ্রাবণ,অন্ত হাজারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বাড়িতে যায়নি। কেটে গিয়েছে আরো পাঁচদিন। ছেলেকে ছাড়া বিগত পনেরো দিন ছটফট করতে করতে অবশেষে আঞ্জুমান নিজেই এল রজনির কাছে।রজনি তখন হসপিটালের জন্য খাবার গোছাচ্ছিল।আঞ্জুমান কে দেখে রজনি ভীষণ খুশি হল। আঞ্জুমানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
” মা আপনার ছেলের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি রাগ করে নেই মা। আমার ভাই এর অবস্থা ভালনা মা।”
আঞ্জুমান রজনিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” কিছু বলতে হবেনা মা।আমি সব জানি। আমি ভুল করেছিল মা। তার শাস্তি পেয়েছি।আমি আমার ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারছিনা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে বাড়ি ফিরে চলো।”
হসপিটালে ভাই ও সুস্থ প্রায় এইদিকে শ্বাশুড়ির ভালবাসা। কেমন যেন একটা বড় পাথর নামল রজনির বুক থেকে।
হসপিটালে বাবুর জ্ঞান ফেরার পর সবার আগে প্রান্তিক কথা বলেছে। সবাই কে বাইরে পাঠিয়ে বাবুর হাত ধরে বলেছে,
” বাবু আমি তোর গায়ে কেনো হাত তুলেছি সেটা জানলে তোর বেঁচে থাকার ইচ্ছা হবেনা। রোমিওর সাথে মিলে মিশে যে মেয়েকে নিয়ে নোংরা কথা বলেছিলি সেই মেয়ে আর কেউ না তোর বোন।আশা করি এই ঘটনার পর আর কোনদিন কোনো মেয়েকে নিয়ে এমন বাজে মন্তব্য করবিনা।প্রতিটা মেয়েই কারো না কারো বোন। আমি তোকে মে’ রে’ছি এটা জানলে তোর বোন আমাকে যেটুক্য ঘৃণা করবে তার চেয়ে হাজার গুন বেশী ঘৃণা করবে যখন জানবে তুই নোংরা কথা বলেছিস।তাই আমি চাইছি অতীত অতীতেই থাকুক। আমরা সব ভুলে এক সাথে পথ চলি। রোমিওর সঙ্গ ছেড়ে দে।”
প্রান্তিকের কথায় বাবু সেদিন থেকে নরম হয়ে গিয়েছে। সেই যে নরম হয়েছে আর কখনো মাথা তুলে কথা বলেনি। অনুতপ্ত সব কিছুতে। সব সময় বাড়িতে থাকে।মা বাবার কথার বিরুদ্ধে যায়না।যেই খারাপ ছেলেটা কেমন চোখের পলকে ভাল হয়ে গেল।
সময় এগিয়ে গেল আরো এক মাস।
বাড়িতে প্রিয়তার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে।শ্রাবণ আর প্রিয়তার ভালবাসার প্রণয়ের মাঝে এল বিরাট এক বাঁধা।
চলবে?…