নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৩২.
#WriterঃMousumi_Akter
চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে প্রিয়তার বর বিয়ে করবে না বলে পালিয়েছে।মানুষ নানা ধরনের গুঞ্জন ছড়াচ্ছে।কিছু মানুষ খুশি ও হয়েছে। এদের খুশির কোনো কারণ নেই তবুও খুশি হয়েছে। কারণ এরা মানুষ ই এমন। অন্যোর ক্ষতি দেখলে, কষ্ট দেখলে এদের পৈচাশিক আনন্দ লাগে। নিজের কোনো ভাল কর্মের মাঝে আনন্দ খুজে পায়নি এরা।এদের আনন্দ অন্যকে পঁচিয়ে, অন্যকে নিয়ে নোংরা সমালোচনা করার মাধ্যমে।শ্রাবণ কে খুজতে লোক পাঠানো হয়েছে, পুলিশ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারেনি।কেউ কেউ তো বলেই ফেলছে এত খোজাখুজি করে পাওয়া যাবেনা। কেউ নিজ ইচ্ছায় হারালে তাকে কখনো খুজে পাওয়া যায়না।মানুষের এসব বাজে কথা প্রিয়তার সহ্য হচ্ছেনা।মানুষ এত খারাপ ক্যানো? এত খারাপ কথা ক্যানো বলছে মানুষ। কি আনন্দ পাচ্ছে সবাই। প্রিয়তা কাদতে কাদতে কোনো কথা বলতে পারছেনা। চোখের কাজল লেপ্টে একদম কালি হয়ে গিয়েছে পুরা মুখ৷ সাজ গোজ বিশ্রী লাগছে দেখতে।প্রিয়তার মন বলছে শ্রাবণ আসবে।শ্রাবন কে আসতেই হবে।ধীরে ধীরে সময় গড়াচ্ছে কিন্তু শ্রাবনের আর খোজ নেই।
এক সময় প্রিয়তা কাদতে কাদতে সেন্সলেস হয়ে যায় রজনীর কাঁধের উপর।রজনী প্রিয়তার মুখ ধরে ডাকাডাকির পরেও কোনো হুঁশ এলোনা।মানুষ আরো ভীড় জমিয়েছে প্রিয়তাকে ঘিরে।অন্ত দূর থেকে ছুটে এল।মানুষ জন ঠেলে অন্ত ধমক দিয়ে বলল,
”আপনারা যান। যার যার বাড়ি যান। আপনাদের ভীড়ে প্রিয়তা মা-রা যাবে।”
রজনি বলল, ” অন্য ভাইয়া প্রিয়তা কে ঘরে নিতে হবে।”
অন্ত প্রিয়তাকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে প্রিয়তার ঘরের দিকে গেল।সাথে রজনি ও আছে।অন্ত প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটার মুখে হাসি ছাড়া কিচ্ছু মানায়না।মায়াবী মুখটা জুড়ে রয়েছে মলিনতা, আর কষ্টের ছাপ। অন্ত মনে মনে বলছে তোমার এই কষ্টের ভাগ আমি নিতে চাই৷ তোমার সব কষ্ট আমাকে দিয়ে দাও।তবুও তুমি কষ্ট পেওণা।তোমার সুখের জন্য তোমার সব কষ্ট আমি মেনে নিতে রাজি আছি।অন্ত প্রিয়তাকে নিয়ে ওর রুমের বিছানায় সুইয়ে দিল।রজনি বালিশ দিল মাথার নিচে।রজনি আর অন্ত দুজনে মিলে প্রিয়তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। চোখে মুখে পানি দিচ্ছে তবুও জ্ঞান ফিরছেনা।অন্ত বলল,
“ভাবি ওর কাছে থাকুন৷ আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।”
অন্ত হাঁটা দিতেই প্রিয়তা অন্তর হাত টেনে ধরে বলল, ” অন্ত ভাইয়া।”
অন্ত তুফানের গতিতে প্রিয়তার দিকে ফিরল। প্রিয়তার তার হাত ধরেছে দেখে অবাক হল।অন্ত যেন বাকরুদ্ধ। ভীষণ অবাক হয়ে বলল,
“ব-বলো।”
“আপনার কাছে কোনদিন কিছু চাইনি। আজ চাইছি-আমার ভালবাসা খুজে এনে দিন। শ্রাবণ আমার ভালবাসা।আমি শ্রাবণ কে ছাড়া বাঁচব না।আমার ভালবাসা আমার কাছে এনে দিন অন্ত ভাইয়া। প্লিজ অন্ত ভাইয়া।আমার শ্রাবণ কে চাই।”
“তুমি আমার কাছে এ কি চাইলে প্রিয়তা? যা অসম্ভব তাই চাইলে।”
“অসম্ভব মানে? ক্যানো অসম্ভব। আমার শ্রাবনের কিছু হয়েছে?”
“তুমি আমার কাছে সুখ চাইলে আমি সুখ এনে দিতে পারতাম। কিন্তু শ্রাবণ কে হয়ত পারব না।”
“আমার সুখ ই শ্রাবণ।”
“মাঝে মাঝে আমরা বি-ষ কে অমৃত ভাবি প্রিয়তা। কিন্তু যখন ভেতর জ্বলে পুড়ে মৃত্যুর দিকে চলে যায়,আমরা শেষ হয়ে যায় তখন বুঝতে পারি অমৃত ভেবে বি-ষ পান করেছিলাম আমরা।”
অন্তর কথায় প্রিয়তার ভেতর কেমন খা খা করে উঠল। খারাপ ইঙ্গিত পেল।সে বুঝতে পারল তার কল্পনার বাহিরে কিছু হতে চলেছে।অজানা এক ভ*য়ে বুক কেঁপে উঠল।এরই মাঝে অঞ্জুমান, মাহবুব আর প্রান্তিক প্রিয়তার রুমে প্রবেশ করল। আঞ্জুমানসহ সবার মুখ থমথমে। প্রিয়তা সবার মুখের এমন ভাব দেখে বলল,
“কি হয়েছে? শ্রাবণ আসেনি।”
আঞ্জুমান কিছু না বলে প্রিয়তার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল।থমথমে মুডে বলল, “এটা পড়ো। যার জন্য কেদে কেদে সাগর বানাচ্ছো তার আসল রুপ দেখো।আমরা তো তোমার পছন্দের মানুষ কে মেনে নিয়েছি কিন্তু তুমি কাকে পছন্দ করলে।আমরা নিষেধ করলে তো মানতে না। এখন দেখো তার আসল রুপ।”
প্রিয়তা আঞ্জুমানের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করল।
“প্রিয়তা,
জানিনা কখন এই চিঠি তুমি পড়বে।আমি তোমার কাছে ক্ষমা ও চাইব না। সারাজীবন অভিশাপ দিও সমস্যা নেই।তুমি আমার আসল চেহারা জানোনা।তোমাকে সরাসরি এসব আমি বলতে পারতাম না তাই চিঠিতে লিখলাম। আমি তোমাকে কখনো ভালবাসিনি। যা করেছি সব অভিনয়। আমার জীবনে ভালবাসা বলে কিছু নেই। আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে আমার বিছানায় আনা।কিন্তু পারিনি। তার একমাত্র কারণ প্রান্তিক চৌধুরী।তোমার ভাই এর জন্য হাজারবার চেষ্টা করেও তোমার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস পাইনি আমি।তুমি ছাড়া অনেক মেয়েই আমার জীবনে এসেছে। কত মেয়ে আমার বিছানায় এসছে আমি গুনে রাখিনি।একটা মেয়ের সাথে এক রাত কাটানোর পর আমার আর সেই মেয়েকে ভাল লাগেনা।অনেক মেয়ের চোখের পানি দেখেছি।আমি এসবে অভ্যস্ত।তোমার পিছে দীর্ঘদিন থেকেছি এর অনেক বড় কারণ ছিল। সেই কারণ আমি বলতে পারব না।আমি আমার উদ্দেশ্য সফল হতে গিয়ে ফেঁসে যাচ্ছিলাম। বিয়ে করার মত ঝামেলায় পড়ব বুঝিনি। বিয়ের কথা আমি ভাবতেও পারিনা।এসব আমার লাইফের রুলস নেই। তবে রজনি মারাত্মক জোস দেখতে। একটাই আফসোস মাফিয়ার বোন আর বউকে নিজের বিছানায় আনতে পারলাম না।তোমাদের লতিফা খালার মেয়ের ধ র্ষ ন আমি করেছিলাম। আমি সব সময় প্রান্তিক চৌধুরীর সর্বনাশ চেয়েছি। ক্যানো চেয়েছি? কি কারনে চেয়েছি কোনদিন বলব না। এই যন্ত্রণা প্রান্তিক চৌধুরীকে পু*ড়ি*য়ে ছাঁই করে দিক।ক্যানো তার বিশ্বস্ত মানুষ তার ক্ষতি চেয়েছে। ইচ্ছা ছিল তোমাকে নিজের বিছানায় নিয়ে চরম ক্ষতি করে সারা দুনিয়ার মানুষ কে জানিয়ে দিতে।তুমি বেঁচে থেকেও মৃ* ত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে আর এটা দেখে প্রান্তিক চৌধুরীর যন্ত্রণা হত।তখন সব প্রতিশোধ পূর্ণ হত আমার।কিছু হলনা। তবে তোমাকে ধোকা দিয়ে যেটুক কষ্ট দিতে পেরেছি এতেই আমার শান্তি।আমাকে খোঁজার চেষ্টা করোনা। খুঁজেও লাভ নেই। আমি বিয়ে করব না তোমাকে।তোমার প্রতি এক বিন্দু ফিলিংস নেই আমার।গুড বাই।”
প্রিয়তা চিঠি পড়া শেষ করে দেখল হাতের লেখাটা শ্রাবনের।কেমন যেন শ্বাষ কষ্ট হচ্ছে প্রিয়তার।নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা।বুকের ভেতর অসহনীয় ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।সেই ব্যাথায় বুক ভেঙে চুরে যাচ্ছে।রক্তক্ষরন হচ্ছে হৃদয়ে।কোনভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা,হাঁপানি শুরু হয়েছে।চোখের সামনে ভেষে উঠছে শ্রাবনের সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্ত গুলো।চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়ছে। বুক চেপে ধরে বসে পড়ল।এখনি তার হার্ট এট্যাক হবে হয়ত।মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা।হৃদয় ভাঙার আওয়াজ কি কেউ শুনতে পায়।হৃদয় ভাঙলে মানুষের সব থেকে বেশী ব্যাথা অনুভব হয়।কিন্তু আওয়াজ টা কেউ শুনতে পায়না।প্রান্তিক একভাবে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে।আদরের বোনের এই হাল সে সহ্য করতে পারছেনা।রজনি প্রিয়তাকে বলল,
“প্লিজ শান্ত হও। পৃথিবীর প্রতিটা ছেলেই বেঈমান,ভন্ড,প্রতারক।” কথাটা প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে বলল।আঞ্জুমান,মাহবুব,একমাত্র মেয়েকে সামলানোর জন্য বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছে।কিন্তু প্রিয়তাকে সামলানো যাচ্ছেনা।প্রিয়তার বিশ্বাস হচ্ছেনা এসব।সে মেনে নিতে পারছেনা এসব।
অন্ত বলল, ” প্লিজ প্রিয়তা তুমি কাদো। জোরে কাদো। না কাদলে মনের কষ্ট কমবেনা।তোমাকে কাদতে হবে।”
মাহবুব প্রিয়তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, ” আমার ভাল মেয়েটার সাথে এমন হল কেনো? ক্যানো হল।”
প্রান্তিক এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোর।আমাকে বল। “
প্রিয়তা এইবার প্রচন্ড জোরে হাউমাউ করে কেদে উঠল।প্রান্তিককে জড়িয়ে ধরে বলল,
” ভাইয়া,আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শ্রাবণ কি সত্যি এমন ভাইয়া।আমি না হয় মানুষ চিনতে ভুল করলাম তুমিও কি মানুষ চিনতে ভুল করলে ভাইয়া।তুমি বলো শ্রাবন কি এত নিকৃষ্ট। আমি এসব বিশ্বাস করিনা ভাইয়া। এই চিঠি ক্যানো পড়ালে আমাকে।আমি এইবার ম রে ই যাবো ভাইয়া।যাকে আমি নিজের থেকে বেশী ভালবাসি, যে আমার শিরা উপশিরায় মিশে আছে সে এত খারাপ হতে পারেনা।আমি এই ভয়ানক কষ্ট সহ্য করতে পারছিনা। দম বন্ধ কষ্ট হচ্ছে আমার।আমি ম-রে যাবো। এই কষ্ট কোনদিন ভুলতে পারব না।শ্রাবনের এই চিঠি আমি বিশ্বাস করিনা ভাইয়া। এসব ষড়যন্ত্র। শ্রাবণ এমন হতে পারেনা।”
প্রান্তিক প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ” এ সব সত্য। কিছুই মিথ্যা নয়।”
প্রিয়তা প্রান্তিক কে ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ল।দুই কানে দুই হাত চেপে ধরে পা-গ-লে-র মত কাদছে।বেসামাল কান্না।পা দাপাদাপি করছে আর কাদছে।দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফ্লোরে আঘাত করতে করতে বলল,
“তুমি আমার সাথে এমন করলে ক্যানো শ্রাবন। আমার সহজ সরল মনটা ভেঙে চুরে চুরমার করে দিয়েছো।তোমার কি বিবেকে একবার বাঁধেনি।একবার ও ভাবলে না আমি কীভাবে বেঁচে থাকব।আমার কি দোষ ছিল শ্রাবন। তুমি প্রমান করে দিলে মানুষ যতটা ভালবাসা দেখায় অতটা ভালবাসেনা।তুমি কি সত্যি আমাকে ভালবাসোনি শ্রাবণ।”
আঞ্জুমান বরাবর ই কঠিন।কঠিন মেজাজে বলল,
“যে আমার ছেলে মেয়ের এত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছে তাকে যেদিন পাবো কু -কু- রে- র মত মারব।ওই কুলাঙ্গার এর জন্য আমার মেয়েকে কষ্ট পেতে দিবনা।এখনি আমার মেয়ের বিয়ে দিব। অনেক ভাল ছেলের সাথে বিয়ে দিবো।”
প্রিয়তা কেদে বলল,
“প্লিজ আম্মু আমাকে আর কোনদিন বিয়ে দিতে চেওনা।আমি কোনদিন বিয়ে করব না।”
“তুমি ওই বেঈমানের শোকে কাতর হয়ে ম-রে যাবে নাকি। আমি তা হতে দিবনা।বিয়ে না হলে কোনদিন এইসব থেকে বের হতে পারবেনা।জীবনে সঠিক মানুষ আসলে ভুল মানুষ কে ভুলতে বেশী সময় লাগেনা।”
চলবে?