#WriterঃMousumi_Akter
রাত দুইটা বাজে।প্রিয়তা অন্তর বিছানায় বসে আছে।চোখ দিয়ে অবিরত পানি ঝরছে। এক ধ্যানে বসে আছে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।চোখের কোনো পলক পড়ছেনা।এত ভয়ানক যন্ত্রণা হচ্ছে হৃদয়ের মাঝে কাউকে বুঝাতে পারছেনা।এই যন্ত্রণা যার হয় একমাত্র সেই জানে বেঁচে থাকা কত বেশী যন্ত্রণার।ঠিক ই বধু সেজে বসে আছে অথচ সেই লাল শাড়ি,গা ভর্তি গহনা, দুইহাত ভর্তি মেহেন্দি অথচ যার জন্য এই সাজ সেই মানুষটাই পাল্টে গিয়েছে।যার জন্য এত খুশি,এত আয়োজন সেই মানুষটাই প্রিয়তার জীবন থেকে ছিটকে গিয়েছে।প্রিয়তা আজ অন্তর খাটে বসে আছে।অথচ আজ এই রাতেই শ্রাবণের সাথে বাসর শয্যা হওয়ার কথা ছিল। আজ প্রিয়তার জীবনের সেই খুশির দিনটা হতে পারত যে দিনের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছিল।ভাগ্যোর নির্মম পরিহাসে জীবন টা তছনছ হয়ে গিয়েছে।
অন্ত নিজের রুমে প্রবেশ করল।দরজায় দাঁড়িয়েই চোখ গেল প্রিয়তার দিকে।সাথে সাথেই বুকটা কেঁপে উঠল তার।এতদিন এই রুমটা তার নিজের ছিল আজ থেকে এই রুমটা তার একার নয়, তার জীবন জীবনের সব কিছুর সাথে জুড়ে গিয়েছে প্রিয়তা।শ্যামবর্ণের লম্বা, স্লিম দেহের অধিকারী, শান্ত চেহারার ছেলেটা দেখতে বেশ সুদর্শন।বিয়ের প্রথম রাতটা প্রতিটা ছেলে-মেয়ের জীবনের ই অনেক কাঙ্ক্ষিত একটি রাত।কিন্তু অন্ত আর প্রিয়তা দুজ’নেই দুর্ভাগা। এই রাতটা দু’জনের জন্যই বিষাদের।অন্ত নিজের অজান্তেই প্রিয়তাকে মনে মনে ভীষণ ভালবেসেছিল।সেই ভালবাসা অনেক গভীর ছিল।কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে পারেনি।মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষ কে পাওয়া টা না পাওয়ার চেয়েও বেশী কষ্ট দেয়।কেননা, নিজের ভালবাসার মানুষ অন্য কারো জন্য কাদছে এ ও কি সহ্য করার মত।অন্ত বিষন্ন মনে পা বাড়াল।সে যেন স্বপ্ন দেখছে।কয়েক ঘন্টা আগেও সে ভাবেনি প্রিয়তা তার বউ হবে।আসলে ভাগ্যটাই সব।ভাগ্য অনেক কিছু ম্যাটার করে।
অন্ত নিঃশব্দে প্রিয়তার কাছে এগিয়ে গেল।খাটের কোনায় বসে প্রিয়তার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
“আই আম সরি প্রিয়তা।আমি তোমাকে এইভাবে বিয়ে করতে চাইনি কখনো।আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। তোমাকে কিছু বলার ভাষা আমার জানা নেই।প্লিজ আর কেদোনা।এভাবে কাদলে আমার কষ্ট হচ্ছে।দুঃখ চিরকাল স্থায়ী নয় প্রিয়তা। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
অন্তর কথায় প্রিয়তা অন্তর দিকে রাগি চোখে তাকালো।অন্তর কোনো কথা সে সহ্য করতে পারছেনা।রাগে সমস্ত শরীর টগবগ করছে।দাঁতে দাঁত চেপে অন্তর গালে জোরে থাপ্পড় মারল।অন্তর শার্টের কলার দুই হাতে টেনে ধরে উত্তেজিত হয়ে বলল, ” কি ঠিক হবে হ্যাঁ! কি ঠিক হবে। কে বলেছিল আমাকে বিয়ে করতে। ক্যানো বিয়ে করলেন আমাকে। শ্রাবণ যদি ফিরে আসে আমি কি উত্তর দিবো। কি বলব আমি শ্রাবণ কে? ক্যানো বিয়ে করলেন আমাকে? আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা শ্রাবন এসব করেছে।আমার ভালবাসা মিথ্যা হতে পারেনা।আপনি কোনো চক্রান্ত করেননি তো।আমার শ্রাবণের কোনো ক্ষতি করে আমাকে বিয়ে করেন নি তো।”
অন্ত দুই ঠোঁট চেপে ধরে নিজেকে সামলিয়ে বলল, ” শ্রাবণ ফিরে এলে আমি নিজে তোমাকে শ্রাবণের হাতে তুলে দিবো।বিলিভ মি!”
“আমাকে শ্রাবণের হাতে তুলে দিয়ে নিজে হিরো সাজতে চান।আমার মানসিক এই বাজে পরিস্থিতি তে অমানুষের মত আমাকে বিয়ে করলেন ক্যানো?”
“আমি প্রান্তিক ভাই- এর কথা ফেলতে পারিনি প্রিয়তা।”
“কোনদিন আপনাকে আমি ক্ষমা করব না। কোনদিন ও না।ভুলেও আমাকে আপনার বউ ভাববেন না।”
“আমি কি করেছি প্রিয়তা? তুমি কেনো আমাকে ভুল বুঝছো।”
“তাহলে কাকে ভুল বুঝব।কাকে বিশ্বাস করব।কে ভাল আর কে খারাপ কীভাবে বুঝব।”
“সময় তোমাকে আপনজন চেনাবে প্রিয়তা।”বলেই অন্ত প্রিয়তার দুই হাত থেকে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিল।মুখ ভারী করে উঠে গেল।সারাদিন ভীষণ ক্লান্ত সে।আলমারি খুলে ট্রাউজার আর গেঞ্জি বের করে সাওয়ারে গেল।প্রিয়তা বিছানায় বসে কাদছে।শ্রাবণের হাসি,কথা বলা,কেয়ার করা সব দু’চোখে ভেষে উঠছে।মস্তিষ্ক স্থির থাকছে না প্রিয়তার।দুই কানে হাতে দিয়ে চেপে ধরে কাদছে।মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটে যায় যা মানুষের কল্পনার ও বাইরে থাকে।মানুষ যা ভাবেনা তাই ঘটে যায়।অন্ত ওয়ালে হাত বাঁধিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়তার থাপ্পড়ের শব্দ মিনিটে মিনিটে প্রতিধ্বনি হয়ে তার কানে বেজে উঠছে।এমন সময় কিছু একটার শব্দ হল।শব্দটা কর্ণকুহরে যেতেই অন্ত ওয়াশ রুমের দরজা খুলল তড়িৎ গতিতে।দরজা খুলেই দেখল প্রিয়তা খাটের উপর চেয়ার নিয়ে ফ্যানের সাথে শাড়ির আঁচল পেচিয়ে গলায় দঁড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে।অন্ত রুমে আসতেই প্রিয়তা চেয়ার ফেলে দিল পায়ের নিচ থেকে।দৃশ্যটা অন্তর চোখে যেতেই এক ছুটে গিয়ে প্রিয়তার দুই পা জড়িয়ে ধরে প্রিয়তাকে উঁচু করে ধরল।প্রিয়তাকে ধরে গলা থেকে শাড়ি খুলে কোলে করে নিচে নামিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,
” পা- গ – ল হয়ে গিয়েছো তুমি? এটা কি করছিলে? আমাকে সারাজীবন অপরাধী বানাতে চাও?এখনি তো খারাপ কিছু হতে পারত।যদি কিছু হয়ে যেত তোমার?”
অন্তর চোখে মুখে প্রিয়তার কিছু হয়ে যাওয়ার ভয়ের অতঙ্ক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।এতটা উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে যেন অন্তর নিজের ই প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়তা কেদে কেদে বলল, “ক্যানো বাঁচালেন আমাকে? কতবার বাঁচাবেন।”
“যতক্ষণ আমি জীবীত আছি ততক্ষণ তোমার কিছু হতে দিচ্ছিনা আমি।আমি প্রান্তিক ভাইকে কথা দিয়েছি তোমাকে অক্ষত রাখব,ভাল রাখব।”
“একটা জীবীত মানুষ কে না হয় বাঁচিয়ে রাখা যায় কিন্তু একটা মৃত মানুষ কে কীভাবে বাঁচাবেন আপনি?আপনার কি মনে হয়না আমি ম’রে গেছি অন্ত ভাইয়া।এত কিছুর পরেও আমার মন আমার আত্মা কীভাবে জীবীত থাকবে।”
“এই মুহূর্তে তোমাকে বোঝানোর মত ক্ষমতা আমার নেই। প্লিজ এক শাড়ি চেঞ্জ করো প্রিয়তা।এই কলঙ্কিত শাড়ি তোমাকে আর পরতে হবেনা।যে শাড়ি তোমার গলার ফাঁসি হতে পারে সেই শাড়ি তোমাকে পরতে হবেনা।চলো শাওয়ার নিবে।মাথা ঠান্ডা হবে।”
প্রিয়তা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।অন্ত প্রিয়তার হাত ধরে টেনে ওয়াশ রুমে নিয়ে গেল।শাওয়ারের নিচে প্রিয়তাকে দাঁড় করিয়ে দিল।শাওয়ারের পানি আর প্রিয়তার চোখের পানি মিলে -মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।অন্ত নিজের পোশাক নিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে চেঞ্জ করে নিল।প্রিয়তাকে একটা থ্রি পিছ দিয়ে বলল, ” এটা পরে নাও।”
প্রিয়তা থ্রী পিছ টা পরে বাইরে বেরিয়ে এল। অন্ত একটা মেডিসিন প্রিয়তার হাতে দিয়ে বলল, ” অনেক চোখের পানি ফেলেছো। এটা মাথায় পেইনের ওষুধ খেয়ে নাও।শ্রাবণ যদি ফিরেও আসে তুমি বেঁচে না থাকলে ওর কাছে যাবে কীভাবে?”
প্রিয়তা অন্তর হাত থেকে ওষুধ টা খেয়ে নিল।ওষুধ টা খাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ল।অন্ত সারারাত প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে চেয়ে রইলো।এক মিনিট ঘুমোলোনা।যদি সে ঘুমোলে প্রিয়তা উঠে একটা এক্সিডেন্ট ঘটায়।তাহলে কি হবে? এসব ভেবে ভেবে রাত কাটিয়ে দিল।
পরের দিন সকাল সাত টায় প্রিয়তার ঘুম ভাঙল।ঘুম ভাঙতেই বুকের মাঝে বাড়ি মেরে উঠল।অসহনীয় ব্যাথায় চিন চিন করে উঠল বুক।রাতের সেই তীব্র ব্যাথা আবার শুরু হল। হঠাত খেয়াল করল বারান্দায় আগুনের লালচে আলো দেখা যাচ্ছে।প্রিয়তা বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দায় গিয়ে দেখল তার বেনারসি আগুনে পুড়ছে।কাল রাতে এই বেনারসি সে বারান্দায় শুকাতে রেখেছিলো।এই বেনারসি টা শ্রাবণ তাকে কিনে দিয়ে বলেছিল, “এই লাল টুকটুকে বেনারসি তে আমি আমার বধুরুপে তোমায় দেখব প্রিয়তা।সেই শুভক্ষণ আর বেশী দূরে নয়।”
চলবে?…
(আজ থেকে রেগুলার পাবেন।যদি সুস্থ থাকি।)