#মেহরুমা নূর
★খাবার টেবিলের অবস্থা দেখে চোখ উল্টে পিঠে চলে আসার উপক্রম আদ্রিতার। রকমারি খাবারে ভরা টেবিলে সুই ঢুকানোর কায়দা নেই। মনে হচ্ছে কারোর কাঙ্গালি ভোজের আয়োজন করেছে যেন৷ আদ্রিতা নিজেকে এই নিপিড়ন থেকে বাঁচানোর উপায় খুঁজছে। এমনিতেই ওই দৈত্য দানবের অত্যাচারে তখন পুরো একটা স্যান্ডউইচ আর জুস পেটের ভিতর চালান করতে হয়েছে ওকে। এখন আবার খেতে বসতে হবে ভাবতেই মাথা ঘুরছে। এখন খেতে বসা মানে নির্ঘাত প্রাণদান করা। আদ্রিতা ভেবে পায়না এতো সুন্দর পৃথিবীতে এই খাবার নামক বস্তুকে এনে সবকিছু ঘেটে দেওয়ার কি দরকার ছিল? এখন বসার তার মোটেও ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে জানে আদ্রিতা খেতে না বসলে এবাড়িতে ছোটোখাটো সিডর বয়ে যাবে। আমার কি হয়েছে, খাচ্ছি না কেন এসব বলতে বলতে চিন্তায় সবাই আইসিইউতে পৌঁছে যাবে। সবার কাছে আদ্রিতা কলিজার টুকরা। এটা যেমন আদ্রিতার কাছে সৌভাগ্যের বিষয় তেমন,মাঝে মধ্যে এই আদরই আবার আমার কাল হয়ে দাঁড়ায়। এই যেমন,এখন খেতে বসলেই চাচ্চু,দাদু, ছোট দাদু, সবাই নিজের প্লেট থেকে মাছ, মাংস উঠিয়ে উঠিয়ে আমার প্লেটে পাহাড় তৈরি করবে। যেন আমি হাতির বংশধর। উফফ! কি করি এখন?
জান হাতে নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে বসলো আদ্রিতা। পরিবারের বাকি সদস্যরাও এসে বসলো একে একে। নিবিড় এসে বসলো আদ্রিতার পাশের টেবিলে। আত্মা আরও ধড়ফড় করতে লাগলো আদ্রিতার। তখন একবার স,য়,তা,নি করে খাওয়ালো। এখন আবার নাজানি কী করে। সবাই মজা নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। তাসান ভাইয়াতো এসেই হামলে পড়েছে। যেন এটাই তার জীবনের শেষ খাওয়া। এরপর দুনিয়া থেকে খাবার গায়েব হয়ে যাবে। তাই সাত জনমের খাবার একবারেই ঠুসে নিয়ে পেটের গুদামে মজুত করে রাখছে। সানভির খাওয়া দেখে আদ্রিতা ভাবনায় পড়ে গেল। সে আদৌও খাচ্ছে,নাকি খাবারের সাথে রাষ্ট্রীয় মিটিংয়ে বসেছে সেটাই আবিষ্কার করছে সে। একেবারে নায়িকাদের মতো কাটা চামচ, ছু,রি দিয়ে সুফেস্টিকেটেড ভঙ্গিতে খাচ্ছে। ভাবটা এমন যেন খাবার ব্যাথা পাবে। সানভির এই আল্ট্রা মডার্ন ঢং করা নতুন না। ওর আবার সবকিছুতে ঢং করার পিএইচডি করা আছে। আদ্রিতা একবার আরচোখে পাশে তাকিয়ে দেখলো নিবিড়ের পূর্ণ মনোযোগ খাবারে। আদ্রিতার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে খাবারের প্লেট হাতে তানির উদ্দেশ্যে বলল,
“সোনা মা,আমি রুমে গিয়ে খাই? আমার না খাটে বসে আরাম করে খেতে ইচ্ছে করছে। আমি যা……..ই।”
শেষের কথাটা একটু সুর টেনে বলল আদ্রিতা। তবে তানি আদ্রিতার ফন্দি ধরে ফেলে বলল,
“অরি,আবারও খাবারে ফাঁকি দেওয়ার উপায় খুঁজছিস! রুমে গিয়ে যে খাবার গুলো তোর বদলে, তোর বিড়ালের পেটে যাবে তা আমি ভালো করেই জানি। চুপচাপ এখানে বসে খেয়ে নে।”
নিবিড় পাশ থেকে খেতে বলে উঠলো,
“মা এক কাজ করো। বিড়ালটাকে ধরে নিয়ে এসো। আজই এনিমেল হাউসে দিয়ে আসবো। যে প্রাণী বাসায় থাকায় খাবারের চোরাচালানি হয় সেই প্রাণীর এই বাসায় থাকার কোনো অধিকার নেই।”
হৃদপিন্ড মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম আদ্রিতার। বলে কি! আমার মিমিকে এনিমেল হাউসে দিয়ে আসবে! সত্যিই একটা দৈত্য দানব। অবস্থা বেগতিক দেখে ভয়ে আদ্রিতা গপাগপ মুখের ভেতর খাবার ঠুসতে ঠুসতে বলল,
“এইতো খাচ্ছি আমি। আমি খাবার খাবোনা এমন মিথ্যে অপবাদ কে ছড়ালো! তুমিও না, সোনা মা যারতার কথায় কান দিয়ে বেড়াও।”
খেতে খেতে নিবিড়কে হাজার খানেক গাল দিলো।দাদুন বলেছে কাউকে মনে মনে গাল দিলে সে নাকি বিষম খায়।তাই ইচ্ছে করে বেশি বেশি করে গাল দিলো, যাতে নিবিড় বিষম খায়। খাবার যাতে তার নাক মুখ দিয়ে উঠে বেহাল অবস্থা হয়ে যায়। সেই দশা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পাবে আদ্রিতা! কিন্তু হায় আদ্রিতার ফাটা কপাল! পাশে বসা নিবিড়ের বিষম তো দূর, খাবারের মাঝে এক গ্লাস পানিও খেলোনা। পরম আনন্দে খাবার শেষ করলো। হতাশ হলো আদ্রিত। দাদুনের কথা কি তাহলে ভুল? নাকি আমার গালিতেই কোনো কমতি আছে? মনে হচ্ছে আমার গালিতে ওজন কম। উনি যেমন দৈত্য দানব, উনার জন্য গালিও তেমন ভারী ভারী লাগবে। আজই গুগল থেকে আপডেটেট কিছু গালি শিখতে হবে।
নিবিড় শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠার সময় আদ্রিতার উদ্দেশ্যে ধীর কন্ঠে বলল,
“শকুনের দোয়ায় গরু ম,রে না। বুঝেছিস বলদি।”
গলায় খাবার আঁটকে গেল আদ্রিতার। দুই গাল ভরা খাবার নিয়ে হেঁচকি তুলতে লাগলো। পানির গ্লাস নিবিড়ের হাতেই ছিলো। যেন সে জানতো এমনটাই হবে। গ্লাস টা এগিয়ে দিতেই আদ্রিতা খপ করে হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে দিলো। নিবিড় সরে এলে ওখান থেকে। ঠোঁটের কোণে তার কিঞ্চিৎ হাসির রেখা।নিবিড় যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল আদ্রিতা। এই দৈত্য দানব একদিন তার প্রাণপাখী বের করেই ছাড়বে।
___
তানহা তার চশমা ঠেলে ঠিক করতে করতে চতুর্থ বারের মতো ফ্রীজে রাখা তারা ড্রাগন জেলি জমেছে কিনা চেক করতে আসলো। এই প্রথম এটা ট্রাই করছে সে। অনলাইনে দেখে করেছে। কিন্তু তিন ঘন্টা হয়ে গেল জেলি জমছেই না। রেসিপিতে কি কোনো ভুল হলো? তানি মেয়ের উঁকিঝুঁকি দেখে বলল,
“কি হয়েছে তানু? ফ্রিজে কি দেখছিস বারবার?”
তানহা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আম্মু, আমি জেলি জমতে দিয়েছি সেই তিন ঘন্টা আগে। কিন্তু এখনো জমছে না কেন?”
“আরে জমবে কি করে? ফ্রিজতো নষ্ট হয়ে গেছে কাল। আমি মিস্ত্রীকে ফোন করে আসতে বলেছি। হয়তো চলে আসবে এখুনি। মিস্ত্রি আসলে তুই ফ্রিজটা দেখিয়ে দিস তো। আমি একটু বাজারে যাচ্ছি কিছু জিনিস আনতে। “
“ওকে আম্মু।”
তানহা বারবার দরজায় উঁকি দিয়ে মিস্ত্রির অপেক্ষা করতে লাগলো। তার এতো মেহনতের ড্রাগন জেলি শেষমেষ নষ্ট না হয়ে যায়। মিনিট দশেক পর এক যুবককে আসতে দেখলো সে। হাতে তার একটা সরঞ্জামাদির ব্যাগ দেখে তানহা ভেবে নিলো এটাই মিস্ত্রি। সে দ্রুত যুবকটির সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আরে এতো দেরি করলেন কেন? কখন থেকে আপনার অপেক্ষা করছিলাম জানেন?”
তানহার কথায় যুককটি একটু অবাক হলো বোধহয়। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তানহার পানে। যেন সে তানহার মাঝে কিছু বোঝা বা মেলানোর চেষ্টা করছে।তানহার তাড়া দেওয়ায় সে অপ্রস্তুত ভাবে বলল,
“আমার অপেক্ষা? কেন? না মানে আমিতো…
” আরে মানে মানে ছাড়ুন তো। জলদি আসুন আমার সাথে। ইমার্জেন্সি হয়ে গেছে।”
যুবকটা এবার একটু তটস্থ হয়ে বলল,
“ইমার্জেন্সি! কোথায়? জলদি চলুন।”
তানহা যুবকটিকে এনে ফ্রিজের সামনে নিয়ে এসে থামলো। যুবকটি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“কই? পেশেন্ট কোথায়? কার ইমার্জেন্সি?”
তানহা ফ্রিজ দেখিয়ে বলল,
“এইযে, এটাইতো আপনার পেশেন্ট। ফ্রিজ ঠিক করতেই তো এসেছেন। জলদি করুন। আমার ড্রাগন জেলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
যুবকটি কেশে উঠলো। পূর্ণ দৃষ্টি মেললো সে তানহার পানে। এই চশমার আড়ালে ডাগর আঁখির অধিকারী মেয়েটি যে,তাকে ভুল ব্যাক্তি ভাবছে তা কিছুটা বুঝতে পারলো সে। তবে কেন যেন এই মায়াবী সরল মেয়েটার ভুল ধারণা ভাঙার করতে ইচ্ছে হলোনা।তার ড্রাগন জেলি বাঁচাতে না পারলে তার ডাক্তারি বিদ্যা বৃথা যাবে। কিছু একটা ভেবে যুবক বলে উঠলো,
“আচ্ছা, তো কি সমস্যা হয়েছে? মানে পেশেন্টের রোগ কি? কি কি লক্ষণ দেখা দিয়েছি?”
তানহা চশমা ঠিক করে বলল,
“কি জানি, তাতো জানি না। তবে কেমন যেন গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে।”
“ওহ,তাহলে রোগ ধরে ফেলেছি। ফ্রিজের পেট খারাপ হয়েছে। আচ্ছা বলোতো কাল রাতে কি খেয়েছিল সে?”
তানহা হতবাক চোখ করে বলল,
“কি বলছেন? ফ্রিজেরও পেট খারাপ হয় নাকি? আর ফ্রিজ কি খাবার খায় নাকি?”
“কেন খাবে না? তার ভেতরে আমরা কতশত খাবার রাখি, সেগুলো দেখে কি লোভ হয়না? তারওতো ক্ষুধা লাগে। ফ্রিজ বলে কি তার ক্ষুধা নেই? তোমাদের মতো মানুষের জন্যই আজ মেশিন জাতি অবহেলিত। তাদের ফিলিংস কেউ বোঝেই না।”
তানহার খুব অপরাধবোধ হলো। আসলেই তো,মেশিনেরও তো মন আছে। কিন্তু আমরা কখনো তাদের কথা ভাবিই না৷ কতদিনের বাসি খাবার রাখা থাকে। নিশ্চয় সেসব খেয়ে খেয়েই বেচারা ফ্রিজের পেট খারাপ হয়েছে। মিস্ত্রি তো আর ভুল বলবে না। তানহার অপরাধী চেহারাটা দেখে ভীষণ হাসি পেল যুবকের। কতোটা সরল মনের হলে কেউ এমন কথাও বিশ্বাস করি নেয়। সরল এক পিচ্চি। হঠাৎ দরজায় অন্য একটি লোক এসে দাঁড়িয়ে ভেতরে আসার অনুমতি চেয়ে বলল,
“জি, আমি ফ্রিজের মিস্ত্রি। মিসেস তানি ম্যাডাম ফোন দিয়েছিলেন। “
তানহা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তার সম্মুখের যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনি মিস্ত্রি হলে তাহলে আপনি কে?আর এখানে কি করছেন? “
যুবকটি মুচকি হেঁসে বলল,
” আরে বাহ! এত জলদি ভুলে গেলেন? আপনার ইমার্জেন্সি দেখাতেই তো নিয়ে এলেন।আপনার ড্রাগন জেলিকে বাঁচাতে। ডাক্তার হয়ে কোনো রোগীকে বাঁচাব না তা কি হয়?”
“মানে? কে আপনি?”
“জি অধমকে অপরাহ্ন বলে। নিবিড়ের ফ্রেন্ড।”
তানহা চোখদুটো বড়সড় করে বলল,
“আরে আপনি অপু ভাইয়া!ছোট বেলায় ভাইয়ার সাথে বাড়িতে আসতেন! সো সরি আমি আসলে চিনতে পারিনি।”
অপরাহ্নের চোখে বিস্ময়। সে আগ্রহী কন্ঠে বলল,
“এক মিনিট! তুমি তানু? সেই পিচ্চি তানু? যে তানু আমাকে দেখলে ভীষণ নাক ফুলিয়ে নিতো কারণ আমি তার ভাইকে মারতাম বলে!”
তানহা একটু লজ্জা পেল। ছোটবেলায় অপরাহ্ন ভাইয়ার সাথে দুষ্টুমির ছলে মারতো। আর সেটা দেখেই তানহা কেঁদে কেটে একাকার করে ফেলতো। ভাবতো লোকটা তার ভাইকে মারছে। তানহা চশমার কোনা ঠেলে বলল,
“আপনি নিশ্চয় ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছেন। যান ভাইয়া তার রুমেই আছে।”
অপরাহ্ন উপরে যেতে নিয়ে আবারও তানহার দিকে হালকা কাত হয়ে ঝুঁকে বলল,
“বাইদাওয়ে, তোমার ড্রাগন জেলি বাঁচাতে না পারার আপসোস থেকে গেল। মনে হচ্ছে এবার ফ্রিজ সারার কাজ শিখতে হবে। যাতে পরবর্তীতে তোমার ড্রাগন জেলির উপকারে আসি।”
মুচকি হেসে উপরে উঠে গেল অপরাহ্ন। বোকা তানহা তার কথার ভূমিকা, উপসংহার কিছুই বুঝলো না। সে আসল মিস্ত্রিকে ডেকে ফ্রিজ দেখাতে লাহলো।
নিবিড়ের রুমে এসে অপরাহ্ন হাসিমুখে বলে উঠলো,
“কিরে ব্যাটা ফরেনার,তোর বনবাস শেষ হইলো?”
নিবিড় শুয়ে ছিলো। অপরাহ্নকে দেখে খুশিতে আপ্লূত হয়ে বলল,
“আরে অপু! কেমন আছিস তুই?”
বলতে বলতে এগিয়ে এসে দুই বন্ধু আলিঙ্গন করলো। নিবিড় বলল,
“আই মিস ইউ ইয়ার।”
“হইছে আর ঢপ মারিস না। কতো মিস করছস জানি। ফরেনের মিসদের রেখে এই দেশি বন্ধুদের মিস করার সময় আছে নাকি।আধা ইউরোপ তো নিশ্চয় নিজের নামে করেই নিয়েছিস তোর স্ট্যামিনা দেখিয়ে।”
“এসব বলে মিছেমিছি মজা নিতে পারলে নে। তবে সত্যিটা তুই ভালো করেই জানিস।”
কথা বলতে বলতে দুজন বিছানায় গিয়ে বসলো। অপরাহ্ন বলল,
“হুম জানি,তুইতো আবার এক বিষে বিষাক্ত, এক ভাইরাসে আক্রান্ত।তা বনবাস কি পুরোপুরি শেষ হলো। নাকি আরও ইনিংস আছে?”
হালকা নীরব হাসলো নিবিড়। এই প্রশ্নের উত্তর কি এতোই সহজ?
____
ভাদ্রের আকাশে মেঘ গুরুম গুরুম করছে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি চাইছে ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ ধরণী। তবে বৃষ্টি যেন লুকোচুরি খেলছে। নামতে চেয়েও নামছে না। একটু প্রকৃতির বাতাস পেতে বিকালে ছাঁদে এসেছিল আদ্রিতা। কিন্তু বাতাসতো মনে হচ্ছে নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা মুড়ি দিয়ে আছে। আদ্রিতা ভেংচি কেটে চলে যেতে চাইলো। যেন বাতাস তাকে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ ছাদের পাশে লম্বা আমগাছে একটা পাকা টসটসে আম দেখতে পেল আদ্রিতা। লোভ লাগলো আদ্রিতার। আমটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আদ্রিতা লালসা সামলাতে না পেরে আমটা পারতে উদ্যোত হলো। কিন্তু হাত ডাল পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। আদ্রিতা ছাঁদের রেলিঙ ঘেঁষে পায়ের গোড়ালি উঁচু করে আমটা ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আদ্রিতা ছাঁদের এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা টুল দেখতে পেল। সেটা নিয়ে এসে রেলিঙের কাছে রেখে সেটার উপর উঠে আবারও আমটা পারার চেষ্টা করতে লাগলো। আমটা প্রায় ধরেই ফেলেছিল ঠিক তখনই পেছন থেকে কারোর উচ্চশব্দের চিল্লানোর আওয়াজ শোনা গেল।
“পুতুললললল….”
আচমকা উচ্চস্বরে চমকে গেল আদ্রিতা। পেছনে ফিরতে নিলে টুলের উপর রাখা পায়ের ব্যালেন্স হারিয়ে গেল। টুলটা নড়বড় করতে লাগলো। শেষপর্যন্ত ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়েই যেতে নিলো সে। ভয়ার্ত হালকা চিৎকার করে দুই হাত ঝাপটাতে ঝাপটাতে চোখ খিঁচে বন্ধ করে উপুড় হয়ে পড়ে গেল আদ্রিতা। আদ্রিতা ভাবলো তার আয়ু বুঝি আজই শেষ। এই শক্ত ছাঁদে মুখটা বুঝি থেতলে আলু ভর্তা হয়ে যাবে। কিন্তু পড়ার কিছুক্ষণ পর আদ্রিতার হঠাৎ মনে হলো সে কোনো শক্ত কনক্রিটে পড়েনি। বরং কোনো মাংসল বস্তুর উপর পড়েছে। উষ্ণ কোনোকিছুর উপর। তার নাকে তীব্র এক সুগন্ধ এসে লাগলো। মোহনীয়, মনমাতানো ঘ্রাণ। আদ্রিতা নাক টেনে ঘ্রাণটা আরও বেশি করে নিঃশ্বাসে ভরে নিলো। তার এতো এতো দেশি-বিদেশি ব্রান্ডের পারফিউম আছে। কিন্তু এমন সুগন্ধি সে আজ পর্যন্ত কোনো পারফিউমে পায়নি। এতো সুন্দর সুগন্ধ কীসের?
আবারও বেদম ধমক শুনে হুঁশ ফিরলো আদ্রিতার। ফট করে চোখ খুলে তাকিয়ে মাথা তুলে তাকাতেই বিস্মিত হয়ে গেল সে। নিবিড় ভাইয়া! আমি নিবিড় ভাইয়ার উপর পড়েছি! কিন্তু ছাঁদের ফ্লোরের জায়গায় উনি কখন এলো? আদ্রিতা খেয়াল করলো নিবিড়ের চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত হয়ে চামড়ার উপর দৃশ্যমান হয়ে আছে। ভয়ে শুঁকনো ঢোক গিললো আদ্রিতা। উনার চোখে কি আলতার কৌটা ঢেলে পড়েছে নাকি! এমন ভয়ংকর চেহারা করে আছে কেন? মনে হচ্ছে এখুনি আমাকে পিচ পিচ করে কেটে, গ্রিল করে টমেটো সসে চুবিয়ে চুবিয়ে খাবে। আমি উনার উপর পড়েছি বলে? কিন্তু আমার কি দোষ? আমি কি জানতাম নাকি উনি এখানে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে? এটা কোনো শোবার জায়গা হলো? অদ্ভুত প্রাণী! নিজে ভুল জায়গায় শুয়েছে আবার আমাকে দেখ কেমন ভয়ংকর লুক দিচ্ছে!
আদ্রিতার ভাবনা চিন্তার মাঝেই নিবিড় আরও একবার ধমকে চোয়াল চিবিয়ে বলে উঠলো,
“এখন কি উঠবি! নাকি আমার কলিজা, ফুসফুস সব ঠেসে ফাটিয়ে ফেলবি! ওঠ এক্ষুণি। হাতনির শরীর নিয়ে আমার কলিজা ভর্তা করে ফেললি।”
নিবিড়ের পরপর ধমকে বেচারি আদ্রিতা কেঁদে দিবে প্রায়। আমাকে কোনদিক দিয়ে উনার হাতি মনে হয়? অসভ্য দৈত্য দানব একটা। কাঁদো কাঁদো মুখ করে আদ্রিতা উঠার চেষ্টা করলো। নিবিড়ের দুইপাশে হাতে ভর দিয়ে উঠতে চাইলো সে। কিন্তু উঠতেতো পারলোই না, বরং উল্টো হাত ফসকে আবারও নিবিড়ের বুকের উপর গিয়েই পড়লো। মুখ থুবড়ে পড়ে নাখ আর ঠোঁট দুটোই ঠাস করে লেগে নিবিড়ের শার্টের ফাঁকে বের হয়ে থাকা উষ্ণ বুকে। থমকিত হলো আদ্রিতা। অজানা এক শিহরণ বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। নিবিড়কেও হঠাৎ কেমন স্থির দেখা গেল।নিবিড়ের বুকে মাথা থাকায় আদ্রিতা অনুভব করলো নিবিড়ের হার্টবিট কেমন অস্বাভাবিক ভাবে চলছে। যেন এখনই ব্লাস্ট হয়ে যাবে। এমন হচ্ছে কেন? উনি কারণে অস্থির আছেন? যেন কোনো কারণে খুব ঘাবড়ে গেছেন উনি। আদ্রিতার নাকে আবারও সেই বিমোহিত করা সুগন্ধ লাগলো।সে ওভাবেই নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ নিতে মশগুল রইলো। আদ্রিতার জানতে ইচ্ছে হলো নিবিড় ভাইয়া কোন ব্রান্ডের পারফিউম ইউজ করে। নাম জেনে সেও এটা কিনে আনবে নাহলে অনলাইন অর্ডার করবে। কিন্তু আদ্রিতার সুগন্ধি পর্যালোচনার কাজ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। হঠাৎ নিবিড় আদ্রিতার দুই বাহু ধরে ওকে নিজের বুক থেকে টেনে তুলে সোজা করে বসালো। তারপর নিজেও ঠাস করে উঠে দাঁড়াল। আদ্রিতাও উঠে নিজের কাপড় ঝাড়তে লাগলো। ভয়ে ভয়ে নিবিড়কে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিবিড় চোখ মুখ কঠিন করে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল,
“তোকে বলদি বলি,বলে কি তুই সেই পদবীকে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছিস? কি করছিলি তুই ওখানে? তুই জানিস এখুনি…………।মনতো চাচ্ছে এখুনি তোকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেই। তোকে…”
“আপনার পারফিউমের নাম কি?”
নিবিড়ের ক্রোধ বর্ষণের মাঝে হঠাৎ আদ্রিতার এমন কথা শুনে কথা বন্ধ হয়ে গেল নিবিড়ের। কিছুটা থমকিত হলো সে। আদ্রিতা সরল মনে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার ঘ্রাণ টা অনেক সুন্দর। আমারও মাখতে ইচ্ছে করছে। বলুন না কি পারফিউম ইউজ করেন আপনি?”
নিবিড়ের কি হলো কে জানে,সে কতক্ষণ চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার পানে। তারপর হঠাৎ হনহন করে নেমে গেল ছাঁদ থেকে। আদ্রিতা বোকার মতো তাকিয়ে ভাবলো, এভাবে চলে গেলেন কেন উনি? কি হিংসুটে লোক! পারফিউমের নাম বলবেনা বলে চলে গেল। পারফিউমের নামটাই তো জানতে চেয়েছি, তাও বলবে না হুঁহ্।যেন পারফিউমের নাম না, উনার জান চেয়েছি। নেহাৎ ভালো সুগন্ধ ছিলো।তাছাড়া কে ওই দৈত্য দানবের কোনো জিনিসের ব্যাপারে জানতে আমার বয়েই গেছে। ভেংচি কেটে বেড়িয়ে যেতে নিলে হঠাৎ ছাঁদের দরজার সামনে ফ্লোরে কারোর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকা ফোন দেখতে পেল। ফোন, ব্যাটারি আর কভার তিন খন্ড হয়ে পড়ে আছে ফোনটা। আদ্রিতা ফোনটা উঠিয়ে দেখলো এটা নিবিড়ের। তার হাতে দেখেছে এই ফোন। কিন্তু এই খানে এই ভাবে পড়ে আছে কেন? কি অদ্ভুত লোক! পারফিউম রহস্য গোপন রাখতে সে ফোনটার মায়াও করলোনা। বেচারা ফোন!
বোকা আদ্রিতা জানলোও না ফোনের এই দশা তার কারণেই হয়েছে। আদ্রিতাকে ওই অবস্থায় দেখে, কানে ধরে রাখা ফোনটা সহসাই পড়ে গিয়েছিল নিবিড়ের।
নিচে এসে টেবিলে রাখা পানি ভর্তি জগটা ধরে এক দমে পুরোটা খেয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো নিবিড়। নিজেকে শান্ত করার যথাযথ চেষ্টায় সে। তিন্নির মা জুহি, নিবিড়কে দেখে একটু বিচলিত হয়ে শুধালো,
“নিবিড়! তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে? কেমন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো কারণে ঘাবড়ে গেছ তুমি।”
নিবিড় নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলল,
“তেমন কিছুনা, ভাবি। আমি ঠিক আছি।”
নিবিড় প্রস্থান করতে নিয়ে আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে জুহির উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাবি,আমাকে রড মিস্ত্রি আর কাঠ মিস্ত্রির নাম্বার দেনতো।”
পরদিন সকালে আড়মোড়া ভেঙে হাম ছাড়তে ছাড়তে ছাঁদে আসতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল আদ্রিতা।কাঁধের উপর আড়মোড়া দেওয়া হাত জোড়া হাওয়াতেই থেমে গেল। হাম ছাড়তে হা করা মুখ সেভাবেই হা হয়েই রয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ছাঁদের চারিদিকে লম্বা লম্বা উঁচু গ্রিলের দেওয়াল দেখে। রাতারাতি খোলা ছাঁদে গ্রিল কীভাবে চলে এলো। এটা কি কোনো ভূতের কারাবার? আদ্রিতার বিস্ময়ের ধাপ আরও বাড়লো যখন ছাঁদের পাশের লম্বা আম গাছটাকে দেখতে পেলনা। আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে দেখলো আম গাছটা কেটে ফেলে হয়েছে। চোখ ফেটে কান্না পেল আদ্রিতার। এমন নির্দয় কাজ কে করলো। আহারে, আমার প্রিয় আম গাছটা। গাছটার উপর আমি ছোট্ট ঘর বানাতে চেয়েছিলাম।এখন আমার ঘরের কি হবে? এমন নির্দয় যে করেছে তাকে আমি অভিশাপ দিলাম,সে যেই গাছের নিচেই দাঁড়াবে সেখানেই যেন সব পাখিরা এসে তার উপর মল ত্যাগ করে চলে যায়। শেওড়া গাছের পেত্নীরা যেন তার কম্বলের নিচে গিয়ে শুরশুরি দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। অপরাধীকে অভিশাপ দিতে দিতে ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল আদ্রিতা। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে নিচে নেমে গেল সে।
চলবে…..
(মনে হচ্ছে গল্প আপনাদের অভিভূত করছে না।তাইতো আপনাদের কমেন্টে শব্দ ভান্ডার এতো কম। আপনাদের শব্দ ভান্ডারের এতো কৃপণতা দেখে আমার লেখার প্রতিও কৃপণতা আসছে। একসময় আমার লেখাগুলোও হয়তো একেবারে সংকীর্ণ হয়ে যাবে।)