®মেহরুম নূর
★আদ্রিতার মন মস্তিষ্কের মাঝে রেসলিং-এর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। যে লড়াইয়ে আদ্রিতার বেহাল দশা। সারারাত চেয়েও ঘুম নামক বস্তুটাকে কাছে আনতে পারেনি।ওর পাশেই সানভি তানহা ঘোড়া, গাধা সব বেঁচে নাক ডেকে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে ঘুমাচ্ছে।আর আদ্রিতা সেখানে দুজনের মাঝখানে জেগে থেকে অস্থির মনে হাতের নখ কামড়াতে কামড়াতে আঙুলের অর্ধেক খেয়ে ফেলার যো।দুই দিকে দুজন আদ্রিতার উপর হাত পা উঠিয়ে দিয়েছে। আদ্রিতার এই অস্বস্তি আর অস্থিরতার সূচনা নিবিড়ের বলা ওই একটা শব্দ ‘বউ’ থেকে। নিবিড়ের মুখে বউয়ের কথা শোনার পর থেকেই আদ্রিতার পেটের ভিতর কেমন গুরুমগুরুম করছে। ছোট ছোট বোম ফাটছে যেন। নিবিড়ের কথায় যেন আদ্রিতার পেটে গ্যাস্টিক জমে বদহজম হয়ে গেছে। তাইতো এমন হচ্ছে । কিন্তু তার কথায় এতো বদহজম হওয়ার কারণ বুঝলোনা আদ্রিতা। যদিও এই কথার কোনো সঠিক সত্যতা আদৌও আছে কিনা সন্দেহ। হয়তো মজা করেও বলতে পারে। সানভি আর তানহাও বলল, নিবিড় নিশ্চয় এটা মজার ছলে বলেছে। সত্যি করে কি ভাইয়া এমন করবে নাকি! কিন্তু তবুও কেন যেন আদ্রিতার মনের অস্থিরতা কমছে না। বুকের মাঝে কেমন অজানা ব্যাথা হচ্ছে। সত্য উদঘাটন না করা পর্যন্ত শান্তি হবে না তার।
পরদিন ছিলো ছুটির দিন। আদ্রিতার কলেজ নেই। সে সকাল থেকেই নিবিড়ের ‘বউ’ রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দার রোল ধারণ করলো। খুব ভোরেই সে বিছানা ছাড়ল। ধীরে ধীরে পা টিপে নিবিড়ের রুমের দিকে এগুলো সে। ভাবটা এমন যেন কোনো মা,র্ডা,র মিস্ট্রি সলভ করতে কোনো ভয়ংকর আস্তানায় যাচ্ছে। এই মুহূর্তে কেউ আদ্রিতাকে দেখলে নির্ঘাত হার্টের সাথে কিডনিও অ্যাটাক করবে। এতো সকাল আদ্রিতাকে দেখা আর গাধার মাথায় শিং দেখা একই কথা। যে মেয়েকে ঘুমের ভেতর কেউ কিডনি খুলে ফেললেও টের পায়না। কানের কাছে অর্কেস্ট্রা বাজালেও ঘুম থেকে সকালে জাগানো যায়না। সেই মেয়েকে এই কাক ডাকা ভোরে জাগনা অবস্থায় কেউ স্বচক্ষে দেখলে নিতে পারবেনা। তাই সবাইকে এই শক থেকে বাঁচাতে আদ্রিতা চুপিসারে নিবিড়ের রুমের সামনে এলো। দরজা খুব আস্তে করে ঠেলা দিতেই বুঝলো লক খোলা আছে৷ এতে যেন মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেল আদ্রিতা। সে খুব ধীরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। রুমের অন্ধকার চোখে সয়ে উঠলে পা টিপে টিপে ভেতরে এগুলো। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিবিড়। আদ্রিতা তার ইন্সপেকশন কোথাথেকে শুরু করবে সেটাই ভাবছে। উনার বউ যদি থেকে থাকে তাহলে নিশ্চয় উনার ঘরে কোনো প্রমাণ থাকবে। আদ্রিতা টেবিল থেকে শুরু করলো। নিজের ফোনের লাইট অন করে টেবিলের কাগজপত্র ঘেটে দেখতে শুরু করলো। ক্যাবিনেট আর কাবার্ডও ঘাটাঘাটি করলো। কিন্তু না কোনো প্রমাণাদি হাতে পেলনা সে। হতাশ আদ্রিতা এবার ঠোঁট উল্টিয়ে কাবার্ডের সাথেই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নজর গেল বিছানায় ঘুমন্ত নিবিড়ের চেহারায়। বালিশ পেঁচিয়ে ধরে তাতে মাথা কাত করে রেখে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। বাতাসে জানালার পর্দা উড়ে ভোরের আলো এসে পড়ছে তার উপর। মৃদু বাতাসে তার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো স্বচ্ছন্দে দোল খাচ্ছে। কি অমায়িক তার মুখখানা এখন। কে বলবে এই লোকই দৈত্যদের মহারাজ! আদ্রিতার সকল অশান্তির একমাত্র কারণ। এইযে এখন তাকে কতো শতো অশান্তি দিয়ে কি সুন্দর আরামে ঘুমোচ্ছে। একদম নিষ্পাপ ছোট্ট কোনো শিশুর মতো।
আদ্রিতা আনমনেই ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে নিবিড়ের পাশে বিছানায় বসলো। এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো নিবিড়ের ঘুমন্ত মায়াবী মুখখানার দিকে। খুব ইচ্ছে হলো নিবিড়ের চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে। জেগে থাকলেতো আদ্রিতা জীবনেও সাহস পাবে না। আদ্রিতা নিজের ইচ্ছে পূরণে হাত বাড়াল। আলতো করে ছুঁয়ে দিলো নিবিড়ের ওই নরম মসৃণ রেশমের মতো চুলগুলো। চুলের গভীরে আঙুল দিতেই মনে হলো যেন নরম তুলোয় হাত ডুবিয়ে দিয়েছে। আদ্রিতার হাত চুল থেকে সরাতেই ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু নিবিড় জেগে যাওয়ার ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত সরিয়ে নিলো। হঠাৎ আদ্রিতার মনে হলো, নিবিড় ভাইয়ার যদি সত্যিই বউ থাকে তাহলেতো সে নিবিড় ভাইয়াকে সবসময়ই এভাবেই কাছ থেকে দেখতে পায়।মন চাইলেই ছুঁয়ে দিতে পারে। বিষয় টা মস্তিষ্কে হানা দিতেই বুকের মাঝে ঝিনঝিন করে ব্যাথার উৎপত্তি হলো বুঝি। তা থেকে কান্নারা হানা দিলো চোখের দরজায়৷ হঠাৎ করে খুব কান্না পেল আদ্রিতার। আর বসে না থেকে উঠে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেল আদ্রিতা।
খাবার টেবিলেও কেমন চুপচাপ মলিন মুখে বসে আছে আদ্রিতা। এমনিতেই সে খাবার মুখে দিতে চায়না। আজ যেন আরও খেতে ইচ্ছে করছেনা তার। সবাই নাস্তা শেষ করে উঠে গেছে। অথচ আদ্রিতা কখন থেকে গালে হাত দিয়ে বসে চামচ দিয়ে শুধু খাবার নেড়ে যাচ্ছে। নিবিড় যে তার পাশে এসে বসেছে সেটাও তার খেয়াল নেই। সে চামচ দিয়ে প্লেটে নকশা আকতে ব্যস্ত। হঠাৎ পাশ থেকে নিবিড়ের গম্ভীর কণ্ঠে আসলো,
“নীড়ের মতো তোরও কি পেইন্টিং-এর শখ জাগলো নাকি! তা প্লেটকে কবে থেকে আর্টবোর্ড বানানো শুরু করলি তুই? তোর যতো ট্যালেন্ট শুধু খাবার আর পড়ার টেবিলেই প্রকাশ পায় তাইনা!”
আদ্রিতা ধ্যান ভেঙে হকচকিয়ে তাকালো পাশে।নিবিড়ের সরু চোখের চাহুনি দেখে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলো সে। হঠাৎ কেন যেন রাগ হচ্ছে ভীষণ। রাগ না অভিমান ঠিক হিসেব করতে পারছেনা। তবে তার ক্ষোভ লাগছে কেমন। ভেতর থেকে থেকে কোনো প্রতিবাদী সত্তা বেরিয়ে এসে বলে উঠল,
“আমার প্লেট, আমার হাত। আমি পেইন্টিং করি,না রেসলিং করি তাতে আপনার কি!”
ফট করে কথাটা বলে আদ্রিতা পাশে তাকাতেই বুঝতে পারলো কতবড় ভুল করে ফেলেছে সে। নিবিড়ের শক্ত মুখমণ্ডল দেখে ভেতরের প্রতিবাদী সত্তা মা-বাপ করতে করতে এক দৌড়ে পাগার পার।মাঝখান থেকে ফেঁসে গেল বেচারি আদ্রিতা। আজতো মনে হচ্ছে এই দৈত্য দানব, ব্রেকফাস্টের বদলে আদ্রিতাতেই ফ্রাই করে খেয়ে ফেলবে। ভয়ে পরপর কয়েকটা ঢোক গিলল সে। নিবিড় গরম চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“মনে হচ্ছে মগজের সাথে সাথে নিজের জিহ্বাও অকেজো হয়ে গেছে তোর। ব্যাপার না। এরও সলিউশন আছে আমার কাছে। বেশি না, জাস্ট একটা আছাড় মারবো। এক আছাড়েই সব ঠিক জায়গায় চলে আসবে,আই প্রমিজ।”
আদ্রিতা মেকি হেঁসে বলল,
“না না, কি যে বলেন না নিবিড় ভাইয়া। এতো মেহনত করার শুধু শুধু কি দরকার আপনার! আমার সবকিছু একদম ঠিক জায়গায় চলে এসেছে। আমার অনেক ক্ষিদে লেগেছে। আমি বরং খাই।”
বলেই আদ্রিতা ফটাফট খাওয়া শুরু করলো। অভিমানের জোরে যেন একটু বেশিই জলদি জলদি খাচ্ছে আদ্রিতা। আজ ওর কেমন লাগছে ও নিজেও জানে না। অশান্ত মনে কি করছে নিজেও বুঝতে পারছেনা। বেশি দ্রুত খেতে গিয়ে গলায় খাবার আঁটকে গেল আদ্রিতার। বিষম উঠে গেল তার। কাশতে শুরু করলো।কাশতে কাশতে চোখ মুখ লাল হয়ে গেল তার। নিবিড় পাশ থেকে দ্রুত পানির গ্লাস নিয়ে আদ্রিতার মুখে ধরলো। পানি খাইয়ে দিতে দিতে রাগী সুরে বলল,
“কেয়ারফুল ড্যাম ইট। এভাবে খেতে কে বলেছে তোকে! তুই কি সারাজীবন বলদির বলদিই থেকে যাবি!”
নিবিড়ের কথায় যেন আদ্রিতার ভেতরের অভিমান গুলো আরও এক ধাপ বেড়ে গেল। অভিমানের জোরে সে আর থাকতে পারলোনা। পানির গ্লাস মুখ থেকে সরিয়ে ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে একপ্রকার দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উঠে গল সে। আজ শুধু বারবার কান্না পাচ্ছে ওর। এই বেহায়া কান্নার উপরও সে বিরক্ত। কেন আজ তাকে বারবার এতো দেখা দিচ্ছে।
__
ক্লিনিকে রুগী দেখছে অপরাহ্ন। সকাল থেকে রুগী দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেছে। তাও রুগীর সিরিয়াল শেষ হয়নি এখনো। অপরাহ্নের বাবারও আজ শরীর বেশি ভালোনা। অপরাহ্ন তাকে বাসায় রেস্ট করতে বলেছে। তাই একাই সব রুগী দেখতে হচ্ছে তাকে। একনাগাড়ে রুগী দেখে মাথাটা কেমন ব্যাথা করছে। বর্তমানের রুগীটা চেকআপ করে ভাবলো একটু ব্রেক নিবে। নাহলে আর চলছেনা। রুগীটা যেতেই অপরাহ্ন কম্পাউন্ডারকে ডাকলো।উদ্দেশ্য এক কাপ চা আনতে বলবে তাকে । কম্পাউন্ডার ভেতরে এসে বলল,”জি স্যার?”
অপরাহ্ন গদি চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষত বলল,
“এক কাপ কড়া করে চা আনো। আর হ্যাঁ, আপাতত আর কোনো রুগী পাঠিও না। কিছুসময় পর পাঠাও।”
“আচ্ছা স্যার। কিন্তু আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে অপে…..
” পরে আসতে বলো। এখন ভালো লাগছেনা।”
“কিন্তু স্যার….
তখনই মেয়েলী কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,
” ইটস ওকে আমি নাহয় পরে আসছি।”
নারী কন্ঠটা যেন পরিচিত লাগলো অপরাহ্নের কাছে। সে ফট করে চোখ খুলে তাকালো। তানহাকে সামনে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে টেবিলের সরঞ্জামাদি কিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে গেল। সেগুলো কোনরকমে ঠিক করে দ্রুত তানহার সামনে এসে ফিচেল গলায় বলল,
“তু….তুমি এখানে? কখন এসেছ?”
তানহা চশমার কোন ঠেলে নিচু স্বরে বলল,
“এইতো বিশ মিনিট হবে।”
“হোয়াট! তুমি এতক্ষণ ধরে বাইরে কেন বসেছিলে?”
অপরাহ্ন তার কম্পাউন্ডারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বশির, তুমি আমাকে আগে কেন বলোনি তনহা এসেছে ? ওকে এতক্ষণ বসিয়ে কেন রেখেছিলে?”
তানহা বলল,
“উনার দোষ নেই। আমিই মানা করেছিলাম। আপনি রুগী দেখছিলেন তাই ডিস্টার্ব করতে চাচ্ছিলাম না। “
“তাতে কি হয়েছে? তাই বলে তুমি বাইরে বসে থাকবে! আচ্ছা যাইহোক, তুমি ভেতরে এসে বসো এখন। বশির দুটো চা নিয়ে এসো।”
বশির মাথা নেড়ে বেড়িয়ে গেল। অপরাহ্ন তানহাকে চেয়ার টেনে বসতে বলে নিজেও ওর চেয়ারে গিয়ে বসলো। তানহাকে হঠাৎ দেখে যেন অপরাহ্নের মাথা ব্যাথা টাথা ব্যাথা সব গায়েব হয়ে গেছে। মনের মাঝে কেমন শীতল অনুভব হচ্ছে। অপরাহ্ন মুচকি হেঁসে বলল,
“কেমন আছ তানহা? হঠাৎ এখানে? শরীর খারাপ করেছে তোমার?”
তানহা আস্তে করে বলল,
“না না, আমি ঠিক আছি। আসলে আমাদের কলেজ থেকে এসাইনমেন্ট দিয়েছে। যেকোনো এক প্রফেশনের উপর একটা ডকুমেন্টস প্রজেক্ট করতে হবে। সবাই বিভিন্ন প্রফেশন চুজ করে নিয়েছে। আমি চিকিৎসা প্রফেশন বেছে নিয়েছি। কারণ প্রজেক্ট ফাইলে উক্ত প্রফেশনের লোকের সাক্ষর লাগবে। সেটার জন্যই ডাক্তার আঙ্কেলের কাছে এসেছিলাম। এই কাজে আঙ্কেল আমাকে সাহায্য করতে পারবে ভেবে। কিন্তু এখানে এসে জানলাম আঙ্কেল নেই।”
“হ্যাঁ বাবার শরীর টা একটু খারাপ করেছে। তাই আমি বাসায় রেস্ট করতে বলেছি। তবে তুমি চাইলে আমি তোমাকে সহযোগিতা করতে পারি। বাবার মতো হয়তো এতো অভিজ্ঞতা নেই আমার। তবুও চেষ্টা করবো তোমার এসাইনমেন্ট পূর্ণ করার।”
“হ্যাঁ সেজন্যইতো অপেক্ষা করছিলাম। আপনার কোনো অসুবিধা নাতো?”
অপরাহ্নের বলতে ইচ্ছে হলো, “হোক অসুবিধা, খুব বেশি করে হোক এমন অসুবিধা। আমি প্রতিনিয়ত এমন অসুবিধায় ভুগতে চাই।তুমি নামক অসুবিধা আমার যে খুব করে কাম্য।” কিন্তু এসব মুখে আর বলা হলোনা। শুধু মুচকি হেঁসে বলল,
“কোনো অসুবিধা নেই। তুমি একটু কষ্ট করে আরেকটু সময় অপেক্ষা করো। চা,কফি কিছু খাও। আমি বাকি পেশেন্ট গুলো দেখা শেষ করে তোমার এসাইনমেন্টের কাজ শুরু করবো।”
“ঠিক আছে। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
” বাহিরে কেন বসবে। পাশে রেস্ট রুম আছে। তুমি ওখানেই বসো। আমি দ্রুত শেষ করে আসছি।”
বশির তানহাকে রেস্ট রুমে বসিয়ে চা দিয়ে চলে গেল। তানহা বসে চা খেতে খেতে অপেক্ষা করতে লাগলো। হঠাৎ পাশ থেকে দুজন নার্সের কথা কানে এলো। একজন বলছে, “আমাদের অপরাহ্ন স্যারটা কতো হ্যান্ডসাম তাইনারে। কিন্তু একটু বেশিই ভদ্র। কতভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি কিন্তু কখনো তাকায়ই না।”
এবার অন্যজন বলল,”হ্যাঁ স্যার অনেক ভদ্র আর ভালো মানুষ। যেখানে সামান্য একটু ডক্টরি ডিগ্রি পেলেই লোক ছুটে টাকা ইনকাম করতে। সেখানে অপরাহ্ন স্যার এতবড় স্পেশালিষ্ট ডক্টর হয়েও তার বাবার এই ছোট্ট ক্লিনিকে পড়ে আছে। গরীব দুঃখীদেরতো উনি বেশিরভাগ ফ্রী চিকিৎসা করেন। কখনো টাকার পিছনে ছুটেন না।এখনকার জামানায় উনার মতো লোক পাওয়া কঠিন।”
ওদের কথা শুনে তানহাও যেন মুগ্ধ হলো। লোকটা সত্যিই খুব বড় মনের। কিছুক্ষণ পরেই এলো অপরাহ্ন। তানহার সাথে ওর প্রজেক্ট নিয়ে ডিসকাস করছে দুজন৷ কাজের মাঝে তানহা মাঝে মধ্যে আরচোখে চেয়ে দেখছে অপরাহ্নকে। মনে তার কেমন সুপ্ত অনুভূতির সূত্রপাত ঘটছে। অপরাহ্ন তানহাকে নিয়ে তার পেশেন্টদের কাছে গেল। সবার সাথে কতো অমায়িক ভাবে কথা বলছেন হাসিমুখে। তানহার তখন ওই নার্সের বলা কথাটা যেন মনে পড়ে গেল। লোকটা সত্যিই বোধহয় সুদর্শন। উনার হাসিটাও সুন্দর। নরম আর চাপা স্বভাবের তানহার মনও যেন হঠাৎ অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করছে।
__
মুখ কালো অন্ধকার করে বই খুলে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে আদ্রিতা। মুখে তার রাজ্যের আঁধার। যেন মাত্রই খবর পেল তার জামাই ম,রে গেছে। এমনিতেই সকাল থেকে মুডের আলু ভর্তা হয়ে আছে। তারওপর এই দৈত্য দানব তাকে একগাদা পড়া ধরিয়ে দিয়ে সামনে আজরাইলের মতো বসে আছে। আদ্রিতার কি এখন পড়া মাথায় ঢুকবে! তার মনতো গিয়ে আঁটকে আছে ওই একটা জিনিসে।সেটা না জানা পর্যন্ত কোনকিছুতেই মন বসবেনা তার। আদ্রিতার নজর গেল টেবিলে রাখা নিবিড়ের ফোনের দিকে। হয়তো এই ফোনে কিছু না কিছু পেয়ে যাবে সে। কোনভাবে ফোনটাকে নিতে হবে। ভাবনা অনুযায়ী আদ্রিতা অবস্থা পর্যালোচনা করলো। নিবিড় ল্যাপটপে কাজ করছে। এই সুযোগে সে ফোনটা নিতে চাইলো। চোরের মতো নিবিড়ের অগোচরে হাতটা ধীরে ধীরে এগুতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ নিবিড় আদ্রিতার দিকে তাকালো। আদ্রিতা ফট করে হাত সরিয়ে নিলো। নিবিড় কেমন সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। তা দেখে আদ্রিতা জোরপূর্বক হেঁসে বইয়ের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিলো। যেন তার মতো মনোযোগী পড়ুয়া মেয়ে ইহকালে জন্মায়নি।
কিছুক্ষণ পর নিবিড় একটু ওয়াশরুমে ঢুকলো। তা দেখে আদ্রিতা খুশি হয়ে ফট করে ফোনটা হাতে নিলো। কিন্তু আদ্রিতার মাথায় ঠুস করে বারি পড়লো যখন দেখলো ফোনে পাসওয়ার্ড লক দেওয়া। আদ্রিতা আন্দাজে কয়েকটা পাসওয়ার্ড টাইপ করে দেখলো কিন্তু কাজ হয়না। তাও এলোপাতাড়ি টাইপ করেই যাচ্ছে। হঠাৎ ছোঁ মেরে কেউ ফোনটা কেঁড়ে নিলো। আৎকে উঠে সামনে তাকিয়ে নিবিড়কে দেখে আদ্রিতার আত্মা বটগাছের ডালে উঠে গেল ভয়ে। ভয়ে হৃদপিণ্ড পেটের ভিতর দৌড়াতে শুরু করলো। নিবিড় এক ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমার ফোনে কি করেছিস তুই হ্যাঁ?”
আদ্রিতা আমতাআমতা করে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না তার। নিবিড় আদ্রিতার কাছে এসে দুই পাশ দিয়ে হাত রাখলো টেবিলের উপর। আদ্রিতা ভয়ে টেবিলের উপর দুই হাত রেখে পেছন দিকে আরও সেটে গেল। নিবিড় আদ্রিতার দিকে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কাহিনি কি? সকাল থেকে তোর ননসেন্স দেখছি আমি। হয়েছেটা কি তোর? সত্যি করে বল?”
আদ্রিতা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
“কি….কিছু না।”
নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ডোন্ট ট্রাই মাই পেশেন্স অরি।সে ইট ফাস্ট! “
আদ্রিতা আর নিতে পারলোনা। সে ফট করে বলে উঠল,
“আপনি কি বিয়ে করেছেন? আপনার কি বউ আছে?”
কপাল কুঁচকে এলো নিবিড়ের।
“হোয়াট! বিয়ে বউ! এসব কোথাথেকে আসলো?”
“কেন, আপনিই তো কাল ছাঁদে বললেন আপনি শুধু আপনার বউয়ের।”
“এক মিনিট! তুই ছাঁদের কথা কীভাবে জানলি? তারমানে তুই চুরি করে মানুষের কথা শোনাও শুরু করেছিস! বাহ! আম ইমপ্রেসড! বলতে হবে, দিনদিন নিজের ট্যালেন্টের লিস্ট বাড়িয়েই চলেছিস তুই। এরপর নিশ্চয় চুরি করার ট্যালেন্টও লিস্টে এড করে নিবি তাইনা!
অন্য সময় হলেতো আদ্রিতা ভীষণ ক্ষেপে যেত নিবিড়ের কথায়।কিন্তু এমুহূর্তে তার প্রশ্নের উত্তর চাই। তাই সে আবারও বেলে উঠল,
“আপনি আগে বলুন বউ আছে কি না?”
নিবিড়ের ঠোঁটে বাঁকা হাসি দেখা গেল। সে আদ্রিতার মুখের উপর আরেকটু ঝুঁকে বলল,
“কেন? তা জেনে তুই কি করবি ? আমার বউ থাকলেই তোর কি,আর না থাকলেই তোর কি? তোর সমস্যা কোথায়?”
আদ্রিতার চোখে হঠাৎ অশ্রুমালা ভীড় করলো আবার। তার কেন যেন চিল্লিয়ে বলতে মন চাইছে,”সমস্যা আছে, অনেক অনেক অনেক সমস্যা আছে। সেই সমস্যার নাম জানিনা আমি। সেই সমস্যা আমাকে অনেক যন্ত্রণা দেয়। বুকে ব্যাথা দেয়। অকারণে কাঁদায়। আপনার বউ কেন থাকবে? থাকা যাবে না। একদমই না। দরকার হলে সারাজীবন ব্রহ্মচারী থাকবেন। তাও বউ থাকা নিষেধ আপনার জন্য। পুরো পৃথিবীর বাপদের জারি করে দেওয়া হোক কেউ যেন আপনার সাথে তাদের মেয়ে বিয়ে না দেয়। আপনার বউ নামক শব্দটা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়।বুকে গ্যাস্টিক গ্যাস্টিক ফিলিং হয়।”
কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা আদ্রিতা। চোখের টইটম্বুর পানি গাল বেয়ে পড়লো। আদ্রিতা আর থাকতে না পেরে নিবিড়ের হাত সরিয়ে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু পেছন থেকে হাত ধরে ফেলল নিবিড়। হাত ধরে টান দিয়ে নিজের বুকে ঠেকালো। আদ্রিতার পিঠ এসে ঠেকলো নিবিড়ের বুকে। নিবিড় একহাতে আদ্রিতার হাতের উপর দিয়ে পেট পেঁচিয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। থমকিত হলো আদ্রিতা। কেঁপে উঠল সে। নিবিড় আদ্রিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসানির সুরে বলল,
“বউতো আমার আছে। আমার লক্ষীসোনা, মিষ্টি বউ। তবে সে এখন কেবলই আমার অন্তর্দেশে বাস করে। বাস্তবে তার আসার সময় হয়নি এখনো। যখন সময় হবে তখন আমাকে বলার দরকার হবে না। তোর এমনিই সব বুঝে এসে যাবে।”
আদ্রিতার অশান্ত মনটা যেন মুহুর্তেই শান্ত শীতল হয়ে গেল। অভিমানের মেঘমালা সরে গিয়ে উঁকি দিলো ঝলমলে ভালো লাগার রোদ্দুর। রঙিন প্রজাতিরা ডানা মেলে আবারও উড়লো আদ্রিতার কোমল মন জুড়ে। মুখের কালো আধার কেটে গিয়ে এক চিলতে হাসি ফুটলো ঠোঁটের কোনে। নিবিড় আদ্রিতার কানে নাক ঠেকিয়ে বলল,
“আচ্ছা একটা কথা বললিনাতো, পুতুল! আমার বউয়ের কথা শুনে তুই কেন এতো উতলা হলি? কেঁদে কেটে গঙ্গা যমুনা বানিয়ে দিচ্ছিস কেন বল?”
আদ্রিতা কি বলবে! নিবিড়ের এভাবে কাছে আসায় আদ্রিতার সব এমনিতেই স্থির হয়ে গেছে। সেই অসভ্য লজ্জাগুলো আবারও আদ্রিতার সর্বত্র বশ করে নিলো। এবার আর থাকা সম্ভব না। আদ্রিতা লাজুক হেঁসে নিবিড়ের হাত ছাড়িয়ে বলল,
“জানি না।”
বলেই ছুটে চলে গেল নিবিড়ের কাছ থেকে। রুমে এসে দরজা আঁটকে দিয়ে দরজার সাথে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগলো আদ্রিতা। সত্যিই তো! নিবিড় ভাইয়ার বউয়ের কথা শুনে আমার এমন কেন লাগছিল! যেন নিঃশ্বাস টাও বুঝি বন্ধ হয়ে যাবে আমার! তবে কি আমি আমার অনুভূতি গুলোকে চিনতে পেরেছি। যে অনুভূতি সৃষ্টি তখন হয়েছে যখন আদ্রিতা জানেও না অনুভূতি কি জিনিস। শুধু জানে ছোট্ট আদ্রিতা যবে থেকে নিজের বোধ সামলেছে তার মনে শুধু একজন পুরুষেরই অবয়ব গেঁথে গিয়েছে। সে পুরুষটি শুধুই ওর নিবিড় ভাইয়া। ছোট্ট আদ্রিতা তখন বুঝতে না পারলেও আজ সে বুঝে গেছে। সে বুঝে গেছে তার অনুভূতির মালিক একমাত্র নিবিড় ভাইয়া। তার মন, মস্তিষ্ক, ভেতর, বাহির সবটাতেই বসবাস ওই পুরুষের। তাকে ছাড়া আদ্রিতার কোন অস্তিত্ব নেই।
চলবে…..