®মেহরুমা নূর
★আদ্রিতার শিয়রের কাছেই বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তানি। ঘুমের মাঝে এখানো থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে মেয়েটা। ঘুমানোর আগ পর্যন্তও সে কেঁদে গেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করাতে পেরেছে সবাই মিলে। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেছে একসময়। আদ্রিতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তানি। কান্নার চোটে মেয়েটার মুখ চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। মেয়েটা হাতে পায়ে বড়ো হলেও এখনো একেবারে ছোট্ট বাচ্চার মতো নিষ্পাপ। সবার চোখের মনি আদ্রিতা। সবার মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসায় সে, দুনিয়ার কঠোর বাস্তবতা থেকে একদমই অজ্ঞাত। তাইতো হঠাৎ নিবিড়ের কঠোর আচরণ কোমল আদ্রিতা সইতে পারেনি। কেঁদে কেটে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। আদ্রিতা ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চিত হয়ে তানি ওর কপালে চুমু খেয়ে গায়ে চাদর টেনে বেড়িয়ে এলো। আদ্রিতার রুমের দরজা চাপিয়ে দিয়ে এগুতে নিলেই নিবিড়ের রুমের দরজায় চোখ পড়লো তার। ছেলেটাকে তখন ওভাবে চড় মেরে এখন নিজেরই মন পুড়ছে। তখন রুমে আসার পর নিবিড়ের রুম থেকে কাচ ভাঙার শব্দ পেয়েছিল তানি। বুঝতে পেরেছিল ছেলে তার রাগ এবার নির্জীব বস্তুর উপর ঝাড়ছে। তানি একবার সেদিকে পা বাড়াতে নিয়েও আবার থেমে গেল। ছেলেকে সে কোনভাবেই প্রশ্রয় দিবেনা। তার রাগ, তাকেই দমন করতে শিখতে হবে।
রাত তখন ১২ টার উপর। দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে নিচ দিকে ঝুঁকে বসে আছে নিবিড়। তার মাঝে কি চলছে তা এমুহূর্তে শুধু সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ ধারণাও করতে পারবেনা। আজ যা হতে চলেছিল তা যদি সত্যি সত্যিই ঘটে যেত তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে যেত। নিবিড়ের শুভ্র পাখিটার উপর এতো অশুভ ছায়া কেন? কোথায় লুকিয়ে রাখবে সে পাখিটাকে! বুকের খাঁচায় কেন বদ্ধ করে রাখা যায় না তাকে! চঞ্চল পাখিটা যে বড়োই অবুঝ।অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো সে। মেঝেতে পড়ে থাকা ফুলদানীর কাচের টুকরো গুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ করে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা এখন সাফও করতে হবে। শার্টের হাতা গুটিয়ে কাঁচের টুকরো গুলো এক এক করে তুলে ডাস্টবিনে ফেললো। কাচের টুকরো তুলতে গিয়ে হাতে অনেক জায়গায় কেটেও যাচ্ছে। তাতে ভ্রুক্ষেপহীন নিবিড়। যেন সে ইচ্ছে করেই এমন করছে। এই হাত আজ খসে পড়লেও তার আপসোস নেই। খাটের নিচের দিকেও চেক করলো আর কোনো কাচের টুকরো আছে নাকি। হঠাৎ ছোট্ট একটা বক্স চোখে পড়লো নিবিড়ের। রিং বক্সের মতো দেখতে বক্সটা। নিবিড় ভ্রু কুঁচকে বক্সটা বের করলো। খাটের উপর বসে বক্সটা খুলতেই দেখতে পেল চকচক করে শাইন করতে থাকা একটা ব্রুস। নিবিড় বুঝতে পারছেনা এটা কোথাথেকে এলো। তখনই মনে পড়লো কালকের কথা। কাল আদ্রিতা ওর রুমে এসেছিল। এটা কি তাহলে ওর হাত থেকেই পড়ে গেছে তখন! কিন্তু এটা কার! নিবিড়ের মনে পড়লো আদ্রিতা ওকে তখন কি যেন বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু রাগে পাগল হয়ে থাকা নিবিড় সেসব শুনলে তো। তবে কি পুতুল এটা আমার জন্য এনেছিল! ব্রুসটা হাতে নিয়ে একনজরে তাকিয়ে রইলো নিবিড়। তারপর ফট করে উঠে দাঁড়াল সে।
বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আদ্রিতা। রাতের দ্বিপ্রহরে মৃদু পায়ে তার রুমে প্রবেশ করলো কেউ। নিরবে আদ্রিতার মুখের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো সে। চোখের শুভ্রতায় সীমাহীন মায়ার উপচে পড়া সাগর। শত জনমের তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় করুন সেই চাহুনি। আদ্রিতার ফর্সা কোমল তুলতুলে গালে পাঁচ আঙুলের কঠোর ছাপ এখনো জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটের কোণে হালকা একটুখানি কেটেও গেছে। নিষ্পাপ মুখটাতে এতো কঠোরতা সে চোখের অপরাধবোধ তীব্র থেকে তীব্রতর করছে। ব্যাথা দিচ্ছে অসীম। এক হাত উঠিয়ে আলতো স্পর্শে আদ্রিতার গালে রাখলো। সাথে সাথেই যেন আগুনের ছ্যাঁক লাগার মতো পুরে উঠলো হাতটা। কপালে হাত ঠেকাতেই আতঙ্কের ছাপ চোখে ভেসে উঠলো। আদ্রিতার জ্বর উঠেছে। ভয়াবহ জ্বর। শরীর থেকে যেন আগুনের শিখা বের হচ্ছে। কপালে ঠেকানো হাতটা মৃদু কাঁপছে। হঠাৎই দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়লো সে।
ঠিক তখনই ফট করে চোখ খুলে তাকালো আদ্রিতা। চোখের সামনে নিবিড়ের চিন্তাগ্রস্ত মুখখানা দেখতে পেল সে। জ্বরের তোড়ে চোখ দুটোও লাল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ আদ্রিতাকে তাকাতে দেখে নিবিড় কিছুটা হকচকিয়ে গেল। অপ্রস্তুত চোখে তাকালো সে। আদ্রিতা হঠাৎ মুচকি হেঁসে বলল,
“আপনি আবার এসেছেন আমার স্বপ্নে! কেন আসেন বারবার! আমিতো আজ স্বপ্নের দরজায় ইয়া… বড় একটা তালা লাগিয়ে দিয়েছিলাম। বাজার থেকে ব্রান্ড নিউ তালা কিনে এনেছিলাম আজকে। আপনি তাও কীভাবে এলেন! “
নিবিড় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। বুঝতে পারলো আদ্রিতা জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে। নিবিড় দ্রুত উঠে গিয়ে কাবার্ড থেকে ফাস্ট এইড বক্স আর একটা বোলে ঠান্ডা পানি আর রুমাল নিয়ে এলো। বক্স থেকে থার্মোমিটার বের করে আদ্রিতার মুখে পুরে দিলো। আদ্রিতা চোখ মুখ কুঁচকে তা সাথে সাথে বের করে দিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলল,
“এটা কি দিলেন! একটুও টেস্ট না। একদম পঁচা। আমি খাবোনা।”
নিবিড় শাসনের সুরে বলল,
“পুতুল, এটা তোর খাওয়ার জন্য দেইনি। জ্বর চেক করার জন্য দিয়েছি। তুই শুধু মুখে ধরে রাখ। একদম বের করবিনা। বের করবিতো একটা আছাড়। “
আদ্রিতা মুখ গোমড়া করে থার্মোমিটার মুখে ধরে রাখলো। সময় দেখে কিছুক্ষণ পর থার্মোমিটার বের করলো নিবিড়। ১০১ ডিগ্রি জ্বর উঠেছে। নিবিড় ঝটপট করে রুমাল ভিজিয়ে আদ্রিতার কপালে জলপট্টি করতে লাগলো যাতে তাপমাত্রা কমে যায়। তবে শুধু এতে কাজ হবেনা।জ্বর কমাতে আদ্রিতাকে ঔষধ খাওয়ানো প্রয়োজন। আর তারজন্য মেয়েটাকে কিছু খাওয়ানো প্রয়োজন আগে। আদ্রিতা যে না খেয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তা তার অজানা না। নিবিড় দ্রুত পায়ে নিচে গিয়ে একটা কলা আর একটা আপেল কেটে আনলো।আদ্রিতাকে তুলে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসালো।তারপর আপেলের টুকরো আদ্রিতার মুখের সামনে ধরলে আদ্রিতা অভিমানে মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“আমি খাবোনা।”
“খেয়ে নে পুতুল। রাগ বাড়াস না আমার। জলদি খেয়ে ঔষধ খেয়ে নে। নাহলে জ্বর কমবে না।”
“না কমলে না কমুক,তাতে আপনার কি! আমি মরে গেলেই বা আপনার কি!”
“অরি!!!…..
নিবিড়ের ধমকে কেঁপে উঠল আদ্রিতা। নিবিড় এক হাতে আদ্রিতার চোয়াল চেপে ধরে আরেক হাতে আপেলের টুকরো তার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁত চিবিয়ে বলল,
“আমাকে না রাগালে তোর হয়ইনা আসলে।এতো সহজেই মরবি! তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করলাম কি আমাকে অকালে ভার্জিন রেখে মরার জন্য! এখন আর একটা কথা না বলে চুপচাপ এগুলো খেয়ে শেষ করবি। না করেছিস তো এখুনি তোর মরার ইচ্ছে পূরণ করে দিবো আমি।”
ছটাক খানেক বুদ্ধির মালিক আদ্রিতার সাধারণ সময়েই নিবিড়ের কথা তার মাথার তিন ফুট উপর দিয়ে যায়। আর এখনতো জ্বরের ঘোরে মাতাল আদ্রিতার কিছু বোধগম্য হবার চাঞ্চই নেই। অগত্যা মুখ ফুলিয়ে অরুচি নিয়ে আপেল চিবোতে লাগলো। যতোই হোক, সত্যি সত্যি তো আর এই দৈত্য দানবের হাতে তার মরার কোন প্ল্যান নেই। না, সে নিজের জন্য মোটেও ভাবে না। সেতো মহৎপ্রাণ আদ্রিতা। সবসময় বাকিদের কথা ভাবাই তার কাজ। এই যেমন এখন আদ্রিতা মরে গেলে নূরান ভাইয়া আর তাসির ভাইয়ার বিয়েতে উড়াধুড়া নাচবে কে! আদ্রিতা ছাড়া এই মহৎ কাজ করার মতো কেউ আছে নাকি! সে না নাচলে বিয়ে কীভাবে হবে! আর এই কারণে তার সব ভাই ব্রাদার সারাজীবন অবিবাহিতই থেকে যাবে। তাদের বংশের এখানেই সমাপ্তি হয়ে যাবে। তাইতো আদ্রিতা তাদের জন্যই কষ্ট করে বেঁচে থাকবে। নিজের জন্য কখনোই ভাবে না সে।
খাওয়ার পর আদ্রিতাকে জ্বরের ট্যাবলেট খাইয়ে দিলো নিবিড়। তারপর আবার বালিশে শুইয়ে দিলো।আদ্রিতার শিয়রে বসে জলপট্টি করা অব্যাহত রাখলো। আদ্রিতা অপলক, নিগুঢ় দৃষ্টিতে চুপচাপ তাকিয়ে আছে নিবিড়ের পানে। দেখতে দেখতেই তার চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল আপনি গতিতে গড়ে পড়লো। জলপট্টি পরিবর্তন করে আদ্রিতার কপালে লাগাতে নিলে তা চোখে পড়লো নিবিড়ের। দৃষ্টি স্থির হলো সহসাই। জলপট্টি কপালে রেখে মাথাটা আদ্রিতার মুখের উপর হালকা ঝুকালো নিবিড়। বৃদ্ধা আঙুলের আলতো মোলায়েম স্পর্শে নোনাজল মুছে দিয়ে বলল,
“কাঁদছিস কেন, পুতুল? বেশি খারাপ লাগছে?”
আদ্রিতা কাঁদো কাঁদো মুখে ঠোঁট উল্টে উপর নিচে সম্মতি স্বরুপ মাথা দোলালো। নিবিড় উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“কোথায়?”
আদ্রিতা বুকের বামপাশে হার্ট বরাবর তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
“এইযে এখানে। এখানে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাকে মারলেন কেন? আমার অনেক কষ্ট লেগেছে। “
নিবিড় আরেকটু ঝুকলো আদ্রিতার নিকট।চোখের উপরের শক্ত পর্দা সরে গিয়ে মায়ার পারদ স্ফুটিত হলো। জ্বলজ্বল চোখ দুটিতে আদ্রিতা কেবলই অপরিসীম মায়া দেখতে পাচ্ছে। আদ্রিতার চঞ্চল নজর স্থির সেই চক্ষুদ্বয়ে। নিবিড় আদুরে কন্ঠে শুধালো,
“খুব লেগেছে বুঝি!”
নিবিড়ের আদুরে সুরে আদ্রিতার কান্না যেন বাচ্চাদের মতো আরও বেগ পেল। কাঁদো কাঁদো জড়ানো গলায় বলল,
“হুম, অনেক। আপনি খুব পঁচা। অরিকে শুধু কষ্ট দেন। এতো কষ্ট দেন কেন!”
নিবিড় আদ্রিতার গালে বৃদ্ধাঙুল বুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা! শুধু আমিই কষ্ট দেই! আর তুই যে আমাকে বছরের পর বছর অগ্নিকুন্ডে ফেলে রেখেছিস তার বেলায় কি! পোড়াতে পোড়াতে আমাকে ছাই করিস, আবার সেই ছাই থেকে নতুন আগুন জ্বালিয়ে নির্দয়ের মতো আবারও পোড়াস। আমি কি কখনো অভিযোগ করেছি! অন্যকে পোড়ালে একটু আধটু ছ্যাঁকা তো নিজেরও লাগবেই।”
আদ্রিতার এবার হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইছে। তবে অভিমানে না। নিবিড়ের এই মুজা জুতা ছাড়া কথা বুঝতে না পেরে কান্না পাচ্ছে। লোকটা ইচ্ছে করে আদ্রিতাকে হয়রানি করার জন্য তার সাথে এমন করে। অসহ্য লোক! আদ্রিতা অভিমান করে অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে নাক টানতে লাগলো। হঠাৎই গালে নিবিড়ের অধর যুগলের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে শিউরে উঠলো আদ্রিতা। গালে চড় দেওয়া স্থানে ভালোবাসার গভীর পরশ বুলিয়ে দিলো নিবিড়। ওষ্ঠের উষ্ণতা ছড়ালো গাল জুড়ে। নব তরুণীর অঙ্গে প্রথম পুরুষের ছোঁয়ায় সর্বাঙ্গ শিনশিনিয়ে আদ্রিতার। চাদর খামচে ধরে চোখ বুজে ফেললো। নিঃশ্বাস কোথায় যেন আটকে গেল। নিবিড় আদ্রিতার গালে অধর ছোঁয়ানোর পর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসানির সুরে বলল,
“তোকে আমি আঘাত করবো, আমিই আবার প্রতিষেধক দিবো।আমি কাঁদাবো, আমিই হাসাবো। আমিই ভাঙবো, আমিই গড়বো।কোনো অভিযোগ করতে পারবিনা তুই। অন্য কারো তোকে নিয়ে সামান্য ভাবনারও অধিকার নেই। তুই অন্য কারোর ভাবনাতেও থাকলে সেটা নিবিড়ের বরদাস্ত হবে না। কিছুতেই না।”
আদ্রিতার দম বন্ধ লাগছে কেমন। এই নব যাতনা সইতে না পেরে ঝট করে উঠে বসে খাট থেকে নেমে দাঁড়াল সে। নিবিড় উত্তেজিত হয়ে বলল,
“এই, তুই উঠলি কেন? শুয়ে পড় এক্ষুনি।”
আদ্রিতা বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল,
“না, শুবোনা। আমি বাতাস খাবো। আমার অক্সিজেন আসছে না।”
বলেই বারান্দার দিকে ছুটলো আদ্রিতা। নিবিড়ও তার পেছনে ছুটতে ছুটতে বলল,
“উফফ,এমন করছিস কেন পুতুল! মাথা ঘুরে পড়ে যাবিতো রে বাবা।”
কে শোনে কার কথা। আদ্রিতা ছুটে এসে বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়াল। হা করে বাইরের বাতাস খেতে লাগলো। অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করছে সে। নিবিড় সেখানে এসে মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
“কথা শুনছিস না কেন পুতুল! আরে রাতের বেলা এখন ঠান্ডা পড়ে। এমনিতেই জ্বর। এই ঠান্ডায় থাকলে আরও শরীর খারাপ করবে। চল, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।”
“না যাবো না। আমার এখানেই ভালো লাগছে। ঘরে যাবোনা।”
“পুতুল, আমার কিন্তু সত্যি সত্যিই রাগ উঠে যাচ্ছে এখন৷ ঘরে চল বলছি।”
নিবিড় আদ্রিতার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু জিদ্দি আদ্রিতা যাবেনা কিছুতেই। সে বাচ্চাদের মতো কাঁদার সুর তুলে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
“যাবোনা আমি, ছাড়ুন না। আমি এখানেই থাকবো।”
বলতে বলতে হঠাৎ আদ্রিতার মাথা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। নিবিড় দুই হাতে আদ্রিতাকে সামলে নিয়ে বলল,
“দেখেছিস, আমি বলেছিলাম না মাথা ঘুরে উঠবে। তুই আমার কথা শুনিস না কেন! আজ অসুস্থ নাহলে একেবারে বাইরেই ছুঁড়ে ফেলতাম তোকে।”
আদ্রিতা নিবিড়ের দিকে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে করুন সুরে বলল,
“আমি এখানেই থাকতে চাই। প্লিজ থাকতে দিন না!”
নিবিড় তাকালো আদ্রিতার মুখপানে। ফোঁৎ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ওকে ফাইন। এখানেই থাকবিতো! ঠিক আছে।”
বলেই নিবিড় আদ্রিতাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে বারান্দার ডিভানে এসে বসলো। আদ্রিতাকে কোলের মাঝে বসিয়ে দুই হাতের মাঝে বুকের মাঝে মিলিয়ে নিয়ে বলল,
“বারান্দায় থাকবিতো। এখন এভাবেই কতো থাকবি থাক।”
নিবিড়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে আদ্রিতা যেন ছোট্ট বিড়াল ছানার মতো মিইয়ে গেল নিবিড় বুকের সাথে। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল কি কি একাই বকতে লাগলো। আর নিবিড় বেচারা আজকের নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করলো। হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই নিবিড় জিজ্ঞেস করলো,
“আচ্ছা তুই আমার জন্য কিছু এনেছিলি কাল?”
আদ্রিতা অভিমানী সুরে বলল,
“হ্যাঁ এনেছিলাম তো। সেটাইতো দিতে গিয়েছিলাম কাল। কিন্তু আপনিতো আমাকে পাশের বাড়ির জরিনা আন্টির বিড়াল তাড়ানোর মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন।”
হালকা করে হাসলো নিবিড়। হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে পুতুলটাকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো। আদ্রিতাও আরও মিশে গেল। মনমাতানো সেই ঘ্রাণে মাতোয়ারা হলো আবারও। এভাবেই একসময় ঘুমিয়ে গেল সে। আদ্রিতার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে নিবিড় তাকিয়ে দেখলো তার পুতুল টা ঘুমিয়ে গেছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখলো জ্বর নেমে গেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। আদ্রিতাকে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিলো। চাদর টেনে দিয়ে আদ্রিতার কপালে শেষবার অধর ছুঁইয়ে বেড়িয়ে গেল নিবিড়। দরজা পর্যন্ত এসে আরও একবার তাকালো আদ্রিতার ঘুমন্ত মুখপানে। সে জানে জ্বরের ঘোরে কাটানো এই সময়টুকু সকালে কিছুই মনে থাকবেনা আদ্রিতার। অবশ্য নিবিড়ও এটাই চায়। এখনো যে তার সময় আসেনি। এখনো অনেক পুড়তে বাকি।
চলবে…..