®মেহরুমা নূর
★কলেজে আসতেই আদ্রিতার বান্ধবী ইভা,এক গ্রে,নে,ট বো,ম ফাটালো। যা শুনে পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল আদ্রিতা। তখন ওভাবে নিবিড়কে এভয়েড করে চলে আসলেও মন খারাপ টা আদ্রিতার পিছু ছাড়ছিল না৷ ক্লাসে উদাস মনে বসেছিল। তখনই ছুটে এসে ধপ করে আদ্রিতার গা ঘেঁষে বসলো ইভা৷একটুর জন্য আদ্রিতার উপর পড়েনি যেন। বসেই হাঁপাতে হাঁপাতে আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলল,
“জানিস অরি কি হয়েছে! “
আদ্রিতা বিরক্তি ভরা কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে! এমন ভাবে বলছিস যেন আজই তোর বয়ফ্রেন্ডের সুন্নাতে খাতনা হলো।”
“আরে তার চেয়েও ভয়াবহ কান্ড হয়েছে।”
“দেখ, মেজাজের মা বোইন না করে কি বলবি তা জলদি করে বমি কর।”
“আরে তুইতো জানিস আমার বাবা পুলিশ। তো বাবার কাছ থেকে কাল একটা দুর্ধর্ষ কথা শুনলাম। আসলে বাবা কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিল তখনই আমি শুনে ফেলি। তারপর বিস্তারিত বাবার কাছে জানতে চাই। তখন বাবা বলল সব। সেদিন তোকে নিয়ে আমরা যে মেলায় গিয়েছিলাম না! জানিস ওখানে কি হয়েছিল!”
“কি হয়েছিল! “
“ওখানে একদল গুন্ডা মাস্তান টাইপ ছেলে খারাপ মনস্তাপ নিয়ে ঢুকেছিল। আর তাদের টার্গেট কে ছিল জানিস! তাদের টার্গেট ছিলি তুই।”
আদ্রিতা বিস্মিত হয়ে গেল। স্তম্ভিত কন্ঠে বলল,
“হোয়াট! কি বলছিস এসব!”
“আরে সত্যি বলছি৷ ওদের মাঝে লিডার বদমাশটার নাম পিয়াস। সে নাকি তোর ক্ষতি করার উদ্দেশ্যেই ওখানে এসেছিল। কলেজ থেকে আমাদের পিছু নিয়েছিল। মেলা থেকে তোকে তুলে নিয়ে গিয়ে তোর ক্ষতি করার প্ল্যান ছিলো ওদের। প্ল্যান সফলও হয়ে যেত, যদি না…”
আদ্রিতা কৌতুহলী কন্ঠে বলল,
“যদি না!”
“যদি না সময়মতো তোর নিবিড় ভাইয়া চলে না আসতো।”
আদ্রিতা আরও একবার স্তম্ভিত হয়ে গেল। ইভা জানাল,
“হ্যাঁ, নিবিড় ভাইয়া। লোকটা প্রায় তোকে ধরেই ফেলেছিল। ঠিক তখনই নিবিড় ভাইয়া ওখানে পৌঁছে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। আমাদের অগোচরেই তাদের সরিয়ে নিয়ে যায়। অনেক মারধর করার পর পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। শুধু তাই না। ছেলেটাকে পুলিশ রিমান্ডে দিলে তার কাছ থেকে বাবা বিস্তারিত আরও জানতে পারে। আসলে ওই বদমাশ নাকি অনেক আগে থেকেই তোর ক্ষতি করার ধান্দায় ঘুরছে। তোর উপর নাকি প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তার”
“প্রতিশোধ! কীসের প্রতিশোধ?”
“বাবা জানাল,ওই বদমাশটার বাপ নাকি তোর কারণে জেল খাটছে। ওটার বাপ আরেক বিশ্রী খারাপ লোক। সে নাকি তোর ছোটবেলায় তোকে কোন মেলায় তোর ক্ষতি করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিনও নিবিড় তাকে ধরে অনেক মারে। তারপর তোর বাপ চাচারা মিলে তাকে পুলিশে দিয়ে দিলে অনেক বছরের জেল হয়ে যায় তার৷ বাপের বেটা ওই পিয়াস বদমাশটা সেটারই বদলা নিতে চাচ্ছিল। আগেও নাকি অনেকবার চেষ্টা করেছে তের ক্ষতি করার। কিন্তু পেরে ওঠেনি। বাবা জানাল, তোর ফুপির বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও নাকি ছেলেটা এসেছিল। সেদিনও তোর ক্ষতি করায় প্রায় সফল হয়ে যেত। তবে আবারও নিবিড় ভাইয়া তাকে রুখে দিয়ে হাত ভেঙে দেয়। তবুও লজ্জা হয়নি। হাত সেরে উঠতেই আবারও এসেছে।তবে এবার সারাজীবনের জন্য জেলের ভাত পাক্কা হয়ে গেছে। “
সব শুনে আদ্রিতা যেন স্তব্ধ পাথরের মতো হয়ে গেল।ইভার ঠোঁট দুটো অনবরত নড়ে যাচ্ছে। তবে আদ্রিতার কানে আপাতত আর কোনো কিছুই পৌঁছাচ্ছে না। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যাচ্ছে কেমন। চিনচিন ব্যাথায় বুকের মাঝে অসম্ভব যন্ত্রণা দিচ্ছে। চোখ জ্বলছে। চোখের বাঁধে এসে কান্নারা হামলে পড়ছে। আদ্রিতা আটকাতে পারছেনা।হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে ক্লাসরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। দৌড়ে একটা ফাঁকা রুমে এসে মেঝেতে বসে পড়লো। একসময় বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে এলো কান্নার দল। মুখে হাত চেপে কান্নায় ভেঙে পড়লো আদ্রিতা। আজ বুঝতে পারছে নিবিড় ভাইয়া কেন তাকে সেদিন ওভাবে থাপ্পড় মেরেছিল। নিবিড় ভাইয়া, সেই ছোট্ট বেলা থেকেই আদ্রিতাকে প্রটেক্ট করে আসছে৷ আদ্রিতার অগোচরে তার রক্ষাকবচ হয়ে সর্বক্ষণ যে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে আদ্রিতা কিনা তাকেই ভুল বুঝে আছে৷ নিবিড় ভাইয়া ঠিকই বলে,আমি আসলেই একটা বলদি। তাইতো নিবিড় ভাইয়াকে সে বুঝতেই পারলোনা। আসলেই একটা গাধী আমি। ছোটবেলাও আমার জন্যই নিবিড় ভাইয়াকে বিদেশ যেতে হয়েছিল। আর আমি কিনা উল্টো তার উপরেই রাগ করে বসে আছি। কত্তবড় টিউবলাইট আমি।
একটু পরে ইভা দৌড়ে এলো আদ্রিতার কাছে। আদ্রিতার কাছে বসে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো সে। তবে তার ভেতর অনেক কিছুই ততক্ষণে বোধগম্য হতে লাগলো।
__
নিজেকে স্বাভাবিক করতে অনেক সময়ই লেগে গেল আদ্রিতার। কলেজ শেষ হয়ে গেছে অনেক সময় আগেই। আদ্রিতা আর ইভা এতক্ষণে বের হলো। আদ্রিতা ওর ব্যাগ ক্লাস থেকে নিয়ে বাইরে এলো। তখন ব্যাগ ক্লাসেই ভুলে গিয়েছিল সে। ব্যাগ নিয়ে ইভার সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলো আদ্রিতা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে সেই পূরানো দৃশ্য দেখলো। তবে আজ আর মনে কোনো প্রশ্ন জাগলোনা তার। প্রশ্নের উত্তর সে আজ পেয়ে গেছে। ছোট থেকেই ছেলেদের আদ্রিতার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টাতেও যে কোথাও না কোথাও নিবিড়েরই হাত আছে তা আর আদ্রিতার বোধগম্য হতে বাকি নেই। মনের মাঝে এক অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে আদ্রিতার। হাজার রঙের প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়ছে যেন। গত তিনদিনের মন খারাপের মেঘগুলোকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে একরাশ প্রশান্তির ঝলমলে আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। চারিদিক থেকে ভালো লাগারা কোথাথেকে দৌড়ে এসে সব আদ্রিতার মনের জানালায় সজোরে হানা দিচ্ছে। হঠাৎ যেন নিজেকে একেবারে হালকা মনে হচ্ছে। হাওয়ায় ভাসতে থাকা মেঘের ন্যায় অনুভব হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নেচে নেচে গাইতে,♬ আজ মে উপর, আসমা নিচে…..
নিজের মনেই এই গান গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল আদ্রিতা। পাশ থেকে ইভা হঠাৎ বলে উঠলো,
“এই অরি,ওটা তোর নিবিড় ভাইয়া না!”
ইভার কথায় ঝট করে চমকিত চোখে সামনে তাকালো আদ্রিতা। হ্যাঁ, ওইতো নিবিড় ভাইয়া তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অস্থির ভঙ্গিতে কাকে যেন ফোন দিচ্ছে আর এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে কাউকে খুঁজে চলছে। অফিস থেকে সোজা এসেছে বোধহয়। ঘর্মান্ত মুখমন্ডলে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তবু্ও একইভাবেও এই যুকবটিকে কত মনকাড়া লাগছে। সাদা শার্ট আর বাদামী রঙের প্যান্টে সে মোহ ছড়াচ্ছে বায়ুমন্ডলে।তাকে দেখেই যেন মুগ্ধতার বর্ষণে ময়ূরের মতো পেখম মেলে নেচে উঠলো আদ্রিতার তনু মন। বেখেয়ালি হয়ে একমনে তাকিয়ে রইলো সে নিবিড়ের পানে। পাশ থেকে ইভা হা-হুতাশ সুরে বলল,
“হায় ইয়ার! কি চিজ মাইরি! এমন একটা মিসাইল-এর মতো পোলা পাইলে জীবন ধন্য হয়ে যাইতো। অরি বোইন, একটা ইন্ট্রো করিয়ে দেনা। “
ইভার কথায় হঠাৎ করে রাগ হলো যেন আদ্রিতার। ভ্রু কুঁচকে কটমটে চোখে তাকালো সে ইভার পানে৷ ইভা ফিচেল হেঁসে বলল,
“আরে এমনে রাক্ষুসির মতন লুক দিতাছস ক্যান! আমি একাই না। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখ পুরো কলেজের মেয়েদের জিহ্বা ঝুলে মাটিতে পড়ে আছে।”
আদ্রিতা চারিদিকে চোখ বোলালো। সত্যিই সবগুলো মেয়ের চোখ নিবিড়েই আবদ্ধ। যেন শত জনমের ক্ষুদার্থ রাক্ষসের সামনে তরতাজা খাবার পেশ করা হয়েছে। কি অসভ্য সব! নাহ,নিবিড় ভাইরার এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। দেখা গেল রাক্ষুসি মেয়েগুলো নিবিড় ভাইয়াকে ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ঢেকুর তুলাও ভুলে গেল। তখন সোনা মাকে কি জবাব দিবো আমি! সোনা মা যখন আহাজারি করতে করতে বলবে”অরিরে, আমার পোলাডারে এমনে কইরা মাইয়াগুলা খাইয়া ফালাইলো আর তুই কিছুই করতে পারলিনা! কোন মুখ নিয়ে এসেছিস আমার সামনে!”
না,না এটা হতে দেওয়া যাবে না৷ এই রাক্ষুসিদের ডেরা থেকে আমাকেই নিবিড় ভাইয়াকে বাঁচাতে হবে। এই মনস্তাপ করে সামনে এগুতে নিলেই দেখলো নিবিড় হন্তদন্ত হয়ে তার দিকেই আসছে। এক প্রকার তেড়ে এসে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলো,
“কোথায় ছিলি তুই? ফোন কোথায় তোর?ফোন ধরছিলি না কেন? তোকে আমি…..
নিবিড়ের কথার মাঝেই হঠাৎ পাশ থেকে ইভা হাত নাড়িয়ে একগাল হাসি টেনে বলল,
” আসলে আমরা ক্লাসে ব্যাগ রেখে একটু বাইরে গিয়েছিলাম তাই হয়তো ও ফোন ধরতে পারেনি। বাইদাওয়ে, হায় আমি ইভা,অরির বান্ধবী।”
ইভার কথায় নিবিড়ের বোধহয় একটু হুঁশ হলো।পাশে কেউ ছিলো তা খেয়ালই করেনি সে। মুখয়ব পরিবর্তন করে ইতস্তত ভঙ্গিতে ছোট্ট করে শুধু বলল,
“হেলো।”
পরপরই আদ্রিতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“গাড়িতে। ফাস্ট।”
বলেই সানগ্লাস চোখে লাগাতে লাগাতে গাড়ির দিকে চলে গেল নিবিড়। আদ্রিতাও এক মুহূর্তও কালবিলম্ব না করে নিবিড়ের পেছন পেছন ছুটলো। নিবিড় সোজা গিয়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো। আদ্রিতা গিয়ে নিবিড়ের পাশের সিটে বসতেই নিবিড় চোখ মুখ শক্ত রেখে সোজা সামনের দিকে চোখ রেখেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি চালানোয় নজর রেখেই চোয়াল শক্ত করে নিবিড় ধমকের সুরে বলতে লাগল,
“ফোন রেখে কোন মজলিসে গেছিলি শুনি! তুই কি কসম খেয়ে নিয়েছিস, যেভাবেই হোক আমাকে জ্বালাবি! জানিস কখন থেকে ফোন করছিলাম আমি! মানে এতোটা কেয়ারলেস কেউ কীভাবে হতে পারে! আজকাল অনেক বেশি বার বেড়ে গেছে তোর।আমাকে এটিটিউড দেখাস! বাসায় নিয়ে গিয়ে তোর হাত পা গুলো মটমট করে ভেঙে বস্তায় ভরে রাখবো আমি। তারপর দেখি কীভাবে এতো জ্বালাস আমাকে।”
অন্যসময় হলে তো নিবিড়ের এসব কথায় আদ্রিতার প্রচুর রাগ আর অভিমান হতো। কিন্তু আজ তার কিছুই হচ্ছে না। আজ নিবিড়ের বকাঝকাও যেন আরিজিৎ সিং এর গান মনে হচ্ছে। যা শুনে তার ঠোঁটে আনমনেই হাসি ফুটে উঠছে। মুগ্ধ মনে বারবার দেখছে শুধু পাশের সুদর্শন পুরুষটাকে। এইযে রাগী রাগী মুখটা বানিয়ে রেখেছে। তাতেও কত সুন্দর লাগছে তাকে। কেউ এতো সুন্দর করে কীভাবে রাগতে পারে! তাকে দেখে মনে হচ্ছে রাগ করাটাও একটা আর্ট। কত্তো কিউট লাগছে তার রাগী রাগী গাল দুটো। হঠাৎ করে এক ভয়ংকর ইচ্ছে জাগছে আদ্রিতার। নিবিড় ভাইয়ার ওই রাগে শক্ত করে রাখা গাল দুটো টেনে দেওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে জাগছে। হাত দুটো রীতিমতো নিসপিস করছে ওই গাল দুটোতে যেতে। আদ্রিতা তার হাত দুটো মুষ্টি করে মনে মনে ধমক দিয়ে বলছে,”এই এই খবরদার! একদমই না, ভুলেও এই কাজ করবিনা কিন্তু! নাহলে তোদের আর বাঁচিয়ে রাখবেনা কিন্তু সে! ভালো চাস তো ফিরে আয় ও পথ থেকে।”
তবে আদ্রিতার হাত দুটো যেন দেড় আনার মূল্যও দিলোনা আদ্রিতাকে। তার হুমকিকে চালের ভেতর থাকা পাথরের মতো উঠিয়ে ছুঁড়ে মারলো। আদ্রিতা বেচারি চেয়েও পারছেনা তার অবাধ্য হাত দুটোর সাথে। ওদিকে নিবিড় তার মতো সামনের দিকে তাকিয়ে বকাঝকা করেই যাচ্ছে আদ্রিতাকে। আর আদ্রিতা তার হাত দুটোকে আটকাতে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলোনা সে। অতঃপর অঘটন ঘটেই গেল। নিবিড়ের বকাঝকার মাঝেই হঠাৎ আদ্রিতা নিবিড়ের রাগে শক্ত করে রাখা গাল দুটো ধরে ডানে-বামে টেনে দিলো।
আচমকা এহেন কাজে নিবিড় সাথে সাথে গাড়ির ব্রেক কষলো।চমকিত চোখে তাকালো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা গাল টেনে দিয়েই সোজা শক্ত হয়ে বরফের মতো জমে বসে রইলো। যেন এইমাত্র আবিষ্কার হওয়া রোবট সে। দুনিয়াদারীর মোহ-মায়ার সাথে তার কোন প্রকার সম্পর্কই নেই। সদ্য জন্মানো শিশুর মতোই অবুঝ সে। এইমাত্র করা কাজটি তার মতো অবুঝ প্রাণীর হাতে মোটেও ঘটেনি। নিবিড় গলা খাঁকারি দিয়ে ইতস্তত সুরে বলল,
“এটা কি ছিল!”
আদ্রিতা নিরুত্তর। যেন নিবিড় নামক ব্যাক্তির কোনো অস্তিত্বই নেই আপাতত। গাড়িতে সে একাই বসে আছে। নিবিড় আবার বলল,
“কিরে চুপ মেরে গেলি কেন? আমার গাল দুটোকে কি সরকারী মাল পেয়েছিস! রাবারের মতো টানছিলি কেন? মতলব কি তোর!”
আদ্রিতা ফট করে বলে উঠলো,
“তো কি করবো! কে বলেছে গাল দুটোকে এতো কিউট বানাতে!”
আনমনে কথাটা বলে ফেলে হুঁশ আসতেই সাথে সাথে চোখ খিঁচে বন্ধ করে, নিজের মুখ দু হাতে চেপে ধরলো আদ্রিতা।এইরে, শেষ। আজতো তুই শেষ অরি। মনে মনে শেষবার সব প্রিয়জনকে মনে করে নে। আজ তোর টিকিট কাটা কনফার্ম৷ এখন নিশ্চয় নিবিড় ভাইয়া তোকে এই জানালা ছুঁড়ে কোনো ট্রাকের নিচে ফেলে দিবে। তবে আদ্রিতার ভাবনা মোতাবেক কিছু হতে দেখা গেলনা। বরং হঠাৎ করেই নিবিড়ের চেহারার হাবভাবই পাল্টে গেল।মুখয়বে রাগের আধার সরে গিয়ে সেখানে হঠাৎই খুশিময় এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। স্টেরিং-এ দুহাত রেখে মাথা অন্য পাশে ঘুরিয়ে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে হাসলো নিবিড়। একটু পর গাড়ি স্টার্ট দিলো নিবিড়। গাড়ি চলতেই আদ্রিতা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক এযাত্রাই প্রাণে বেঁচে গেছে সে। তবে নিবিড়ের দিকে আর তাকানোর সাহস পেল না। জানালার দিকে মাথা ঘুরিয়েই বসে রইল। গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ আবার থেমে গেল। গাড়ি থামতে দেখে আদ্রিতা নিবিড়ের তাকালো। কিছু বলবে তার আগেই নিবিড় বলে উঠলো,
“আইসক্রিম খাবি!”
আদ্রিতার মনে হলো সে বোধহয় দিবাস্বপ্ন দেখছে। নিবিড় ভাইয়া তাকে আইসক্রিম খেতে বলছে! অবাক বিস্ময়ে চোখ দুটো ক্রমশ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো সে। নিবিড় বলে উঠলো,
“বোস, আমি নিয়ে আসছি।”
বলেই গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে সামনের আইসক্রিম পার্লারে গেল নিবিড়। আদ্রিতা হা করে অবাক নজরে শুধু তাকিয়েই রইলো। খানিক পরেই একটা কর্নেটো চকলেট ফ্লেবারের কোন আইসক্রিম নিয়ে ফিরলো নিবিড়। গাড়িতে বসে আদ্রিতার দিকে আইসক্রিমটা এগিয়ে দিলো। আদ্রিতা এতক্ষণে বিস্ময় কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে। সামনে আইসক্রিম দেখে আপাতত বাকিসব সাইডে রেখে খুশিতে আপ্লুত হওয়া মুখ করে খপ করে হাতে নিলো আইসক্রিম টা। দুনিয়াদারী ভুলে আইসক্রিমে ডুব দিলো। মনের আনন্দে আইসক্রিম খেতে লাগলো। আইসক্রিম খেতে খেতে মুখ দিয়ে স্বাদে মাতোয়ারা হওয়ার মতো তৃপ্তিকর একটা আওয়াজ বের করলো। আইসক্রিমে মনোনিবেশ করা আদ্রিতা জানলোও না তার পাশে বসা যুবকটির মনোভাব।আদ্রিতার এই নিষ্পাপ, খুশিময়, তৃপ্ত মুখখানা দেখে তার পাশের যুবকটির মুখেও এই মুহুর্তে প্রশান্তির শীতলতা ছড়িয়ে আছে। যেন কতশত নির্ঘুম রাতজাগা ফেরারি মন তার নীড়ের দিশা খুঁজে পেয়েছে। শুকনো মরুভূমির বুকে নেমেছে শ্রাবণের বাড়িধারা।
আইসক্রিম খেতে নিয়ে মুখের চারিপাশে অনেক জায়গায় লাগিয়ে নিয়েছে আদ্রিতা। সেসবে তার খেয়াল না হলেও পাশের লোকটার ঠিকই হয়েছে। আদ্রিতার খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ নিবিড় টিস্যু হাতে নিয়ে আদ্রিতার থুতনি আর ঠোঁটের আশেপাশে লেগে থাকা আইসক্রিম মুছে দিতে শুরু করলো। আচমকা নিবিড়ের এই কাজে আরও একবার শক পেল আদ্রিতা। আইসক্রিমের বদলে সে নিজেই জমে বরফ হয়ে গেল। হৃদপিণ্ড থমকে গেল মুহুর্তেই।মাত্র আইসক্রিম খাওয়া গলাটা হঠাৎ শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠলো কেমন। এই লোকটার কাজে আজকের দিন আদ্রিতার জন্য অবাক দিবস মনে হচ্ছে। নিবিড় মুছে দিতে দিতে বলে উঠলো,
“এরচেয়ে ভালো হতো আইসক্রিমের ভেতরেই ঢুকে যেতি! এভাবে কেউ আইসক্রিম খায়। বড় আর হবিনা কোনোদিন।”
আদ্রিতা কি বলবে! সেতো নিজের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। লোকটা কাছে আসলেই কেন সবকিছু পাবনার পাগলদের মতো আউলাঝাউলা হয়ে যায় সব! কি যাদু আছে এই মানবে!
চলবে……