®মেহরুমা নূর
★নিশির জাল ভেদ করে কুসুম রঙের সূর্যদ্বয় ঘটছে। তার কিরণে ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে ভুবন। দিনের শুরুর ঘটানো সেই প্রথম প্রহরের সাক্ষী হচ্ছে নূরান। ভোর পাঁচটায় উঠে এসে নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রকৃতির এই দারুণ অবিস্মরণীয় মুহুর্ত স্বচক্ষে ধারণ করতেই রাত থাকতেই আসা তার। শ্যামল মায়ায় ঘেরা পরিবেশে ভোরের প্রথম আলোর সৌন্দর্য উপভোগ করাই তার উদ্দেশ্য। যেটা সে খুব করে করছে। প্রাতঃকালের শীতল বাতাস, সেই বাতাসে দোল খাওয়া ধানের খেত, নীড় ছেড়ে উড়ে যাওয়া ব্যস্ত পাখির কিচিরমিচির সবই এক মোহময় প্রশান্তি ছড়াচ্ছে। নূরান দুই হাত ছড়িয়ে চোখ বুঁজে প্রকৃতির এই অপরুপ মায়ায় নিজেকে দ্রবীভূত করলো।এভাবেই কিছুক্ষণ থাকার পর নিজের আর্টবোর্ড স্টানের সাথে সেট করলো নূরান।আজ এই ছোট্ট সবুজ গ্রামটার কিছু অংশ তার আর্টবোর্ডে বহন করবে সে। ধীরে ধীরে গ্রামের লোকজন তাদের নিত্যকাজে বের হচ্ছে। গবাদিপশু-পাখি গুলোও আবাসস্থল ছাড়ছে। চাষী ছুটছে খেতে,জেলে জাল ফেলে মাছ ধরছে, দুধের কলসি নিয়ে কেউ আবার ছুটছে হাটে। শিশুরা ছুটছে তাদের মনমতো। নূরান সবকিছুই সংগ্রহ করে নিচ্ছে তার চিত্রে। আঁকতে নিয়ে তার মনে খেয়াল আসছে কবির বলা সেই লাইন গুলি,
♬একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে
♬ যেথায় কোকিল কুহু কুহু
♬ দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
♬ নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়….
গ্রামের বাড়ি সকলের কোলাহলে সকাল সকালই ঘুম ভেঙে যায় সবার। তারউপর বিয়ে বাড়ির সমাগম তো আছেই। তাই শহরের মতো বেলা করে ঘুমানো অসম্ভব প্রায়। তানহাও সকাল সকালই তাই উঠে পড়েছে। নিজের চশমা পড়তে পড়তে বাড়ির সামনের উঠোনে এসে ফিরোজের দাদীকে মালসা হাতে যেতে দেখলো। তানহা কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“দাদী এতে কী আছে? এটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছো।”
দাদী বলল,
“আরে বু তুই উঠছু! এর মইদ্যে গুড়া গোলাইন্যা আছে। হাঁসের নাইগা।”
“ওয়াও দাদী তোমার হাসও আছে!”
“হ, আছেতো। আয় তোক দেহাই।”
তানহা দাদীর সাথে গেল। দাদী হাঁসের খোপের কাছে এসে দরজা খুলে দিতেই প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজের ঝড় তুলে ঝাঁক ধরে হুড়মুড় করে সব হাঁসগুলো বেড়িয়ে এলো। বেড়িয়ে এসেই গুঁড়া গোলানো মালসার মাঝে হামলে পড়লো। পাড়াপাড়ি করে হাঁসগুলো খেয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে কয়েকটা সাদা রাজহাঁসও আছে। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে তানহার কাছে। তানহা উৎসুক কন্ঠে বলল,
“এগুলো সব তোমার দাদী!”
“হ, ব্যাকটি আমার। হাট থাইহা একটো কিনে আনাইছিল্যাম। হেরই থাইহা এহন এত্তগুলান হইছে।”
ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ সেখানে অপরাহ্ন এসে হাজির হলো। তানহা সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিলো। জগিং করতে গিয়েছিল বোধহয়। মাথা কপাল ঘামে ভেজা। অপরাহ্ন বলে উঠল,
“বাহ দাদী! সৈন্য সেনা ভালোই করেছ। তা দাদী এতগুলোকে পালতেও তো তোমার অনেক কষ্ট হয় তাইনা! তবে চিন্তা করোনা৷ এই অপু থাকতে তোমার কষ্ট থাকতে দিবো না।আজই জবাই করে হাঁসের মাংস ভুনা করে খেয়ে তোমার কষ্ট কমিয়ে দিবো। তোমার জন্য নাহয় এতটুকু সেক্রিফাইস করলাম।”
হাসলো দাদী। কেউ ডাক দেওয়ায় দাদী চলে গেল। তানহা তখন অপরাহ্নকে বলল,
“আপনিতো দেখছি খুব নিষ্ঠুর লোক। এতো সুন্দর হাঁসগুলোকে জবাই করে খেয়ে ফেলতে চান! আপনার মায়া করবেনা একটুও!”
অপরাহ্ন বাঁকা হেঁসে একটা হাসকে কোলে তুলে নিয়ে তানহার মুখের সামনে ঝুঁকে বলল,
“মায়াতো অনেক হয়। কিন্তু মায়ার দাম কি কেউ দেয়! কারোর মায়ায় দিনদিন আধা হয়ে যাচ্ছি অথচ সে দেখেই না।নাওয়া খাওয়া ভুলে যাই। স্বজ্ঞানে তো জ্বালায়ই, আবার ঘুমের দেশেও হানা দেয়। ভেতর বাহির সবটায় রাজত্ব করে বসে আছে। মা বলে আমার নাকি কিছু হয়েছে। আজকাল নাকি কেমন অন্যমনস্ক থাকি। অথচ দেখ, সেই ব্যাক্তি নিজের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে।একবারও এই অধমের শোচনীয় অবস্থা দেখে দয়া করছেনা। ডাক্তারকে রুগী বানিয়ে ফেলেও তার ভাবাবেগ নেই। এখন তুমিই বলো। কে বেশি নিষ্ঠুর? আমি নাকি সে?”
তানহা আবারও নজর লুকিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। এই লোকটা আজকাল সর্বক্ষণ শুধু তানহাকে যেন ইন্দ্রজালে আবদ্ধ করতে ব্যাস্ত থাকে। কেমন অনূভুতির এক অশান্ত সাগরে তাকে ছুড়ে মারে৷ যে সাগরে তানহা, না ডুবতে পারে আর না বাঁচতে পারে। অথই পানিতে ছটফট করতে থাকে তার হৃদয় টা। তানহাকে চুপ দেখে অপরাহ্ন আরেকটু ঝুঁকে বলল,
“কি হলো বললে না!”
তানহা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। কাঁপা কাঁপা স্বরে, “জানিনা” বলেই চলে যেতে নিলেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো অপরাহ্ন। কেঁপে উঠল তানহার ভেতর বাহির। ভয় মিশ্রিত এক অশান্ত অনূভুতির তীব্র জোড়ে সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। অপরাহ্ন তানহার পেছনে এসে কানের কাছে মুখ নিলো। ভীতু তানহা আরও শক্ত হয়ে চোখ বুঁজে জামা খামচে ধরলো। অপরাহ্ন ফিসফিস করে বলল,
“শুনেছি এখানকার লোকেরা বাড়ির জামাইকে খুব আপ্যায়ন করে।জামাই আসলেই দেশি হাঁস,মুরগী জবাই করে ভুনা ভুনা করে খাওয়ায়। আমার আবার দেশি হাঁস,মুরগী খাওয়ার খুব লোভ। ভাবছি এই এলাকার জামাই হয়ে যাই। কি বলো!”
তানহা লাজুক হেঁসে বলল,
“জানি না।”
বলেই হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালালো সে। পেছন থেকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে হাসলো অপরাহ্ন।
___
আজ ফাইজার বিয়ে। বাড়ি জুড়ে আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বসার সময় নেই কারো। উঠোনের মাঝে মাটিতে চুলো বানিয়ে তাতে বিশাল বিশাল ডেক্সিতে রান্না করছে বাবুর্চিরা। বাড়ির ছেলেগুলো সব আয়োজন দেখতে ব্যাস্ত। মহিলারা বাড়ির ভেতরের অন্য সব আয়োজন দেখাশোনা করছে।আর মেয়েগুলো সব সাজা গোঁজের তৈয়ারিতে ব্যাস্ত। সানভি সকাল থেকে মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে, দুই চোখের উপর দুটো শশার স্লাইস লাগিয়ে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। তা দেখে বাড়ির কাজের মহিলা আম্বিয়া ভয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
“ভুউউউত….বাঁচাও… ও আম্মা আপনাগেড়ে বাড়িত পূরাণ বটগাছের ভুত আইছে!”
তানি হেঁসে বলল,
“আরে নারে আম্বিয়া। ও ভুত না। আমাদের সানভি৷ মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়েছে।”
আম্বিয়া কপাল কুঁচকে বলল,
“কি প্যাক নাগাইছে!”
“ফেসপ্যাক।”
“মুহে যে শিয়ালের গুর নেহাল দেহা যাইত্যাছে, এইডো ফুসপ্যাক!”
সানা হেসে উঠে বলল,
“ফুসপ্যাক নারে গাধী,ফেসপ্যাক। আর যাকে তুই শিয়ালের গু বলছিস ওইটা আমার মেয়ে আমেরিকা থেকে লাখ টাকা দিয়ে আনিয়েছে।”
“কন কি খালাম্মা! আরে আমাক একশো ট্যাহা দিলিইতো আমি এবা শিয়ালের গু এক বালতি আইনা দিত্যাম।”
সানা আর তানি হাসলো ওর কথা শুনে।
বাড়ির বাচ্চারা নিজেদের মতো ছোটাছুটি করছে। আর তাদের সাথে যোগ হয়েছে আরেক ধামড়ি বাচ্চা আদ্রিতা৷ গ্রামের বাচ্চা পোলাপানদের সাথে মার্বেল খেলতে বসেছে সে। উঠোনের এক পাশে সে মার্বেল ছুঁড়ে ছুঁড়ে খেলছে। কিন্তু আনাড়ি আদ্রিতা, গ্রামের বাচ্চাগুলোর সামনে একেবারেই অপরিপক্ক খেলোয়াড়। তাদের সাথে পেরে উঠছেনা। তার কেনা মার্বেল গুলোর বেশির ভাগই হেরে বসে আছে। শেষ বার এসেও হেরে গেল সে। কিন্তু মানতে নারাজ। তা নিয়ে বাচ্চাদের ঝগড়া লেগে গেল। বাচ্চাগুলো তাকে চিটিংবাজ বলছে আর আদ্রিতা তার প্রতিবাদ জানিয়ে নিজেকে নির্দোষ সাব্যস্ত করছে। শেষমেশ আর পেরে না উঠে বলল,
“যাও খেলমুই না। তোমরা আমার মতো এক মহান খেলোয়াড়কে আজ অপমান করেছ৷ জাতি সইবেনা৷”
দূর থেকে এসব দেখে অসহায় স্বরুপ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে নিবিড়।যেন তার চোখের সামনে নিজের ভবিষ্যৎ রসাতলে যেতে দেখতে পারছে সে। আবার ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসছেও। বিয়ের নানান কাজের মাঝে থাকলেও তার পরক্ষ নজর ঠিকই থাকছে আদ্রিতার উপর। খেলায় হেরে গিয়ে আদ্রিতা গাল ফুলিয়ে এসে চেয়ারে তানহার পাশে এসে বসলো।তানহা হেঁসে দিয়ে বলল,
“কিরে ছকিনার মা,বাচ্চাদের সাথেও হেরে গেলি। বংশের নাক কাটিয়ে ফেললি। সো স্যাড।”
আদ্রিতা চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,
“ওই চুপ চশমিশ। আমি হেরে যাইনি। ওটাতো ওদের মন রাখতে হেরে গেছি। এটা আমার মহত্ত্ব বুঝেছিস।”
ওদের কথার মাঝেই ওখানে জোভান এসে উপস্থিত হলো। আদ্রিতার পাশের চেয়ারে বসে বলল,
“ওয়াও আদ্রিতা তুমি সত্যিই অনেক সুইট। বাচ্চাদের মন রাখার জন্য নিজে হেরে গেলে। হাউ সুইট।”
আদ্রিতা মেকি হেঁসে বলল,
“থ্যাংক ইউ ভাইয়া।”
জোভান অসহায় সুরে বিড়বিড় করে বলল,
“বাক্যের মাঝে ভাইয়া স্কিপ করেও মাঝে মধ্যে কথা বলতে পারো।”
“কিছু বললেন ভাইয়া!”
“না কিছুনা। আচ্ছা শোনো তোমাকে কিছু দেখাই।”
জোভান ফোনের স্ক্রিনে একটা ছবি বের করে আদ্রিতাকে দেখালো। ছবিটা একটা সুন্দর বিলের। শাপলা ফুলে ভরা বিলটা। এত সুন্দর বিল দেখে যে কারোরই পছন্দ হবে।আদ্রিতারও খুব পছন্দ হলো। আদ্রিতা উৎসুক কন্ঠে বলল,
“বাহ! অনেক সুন্দর তো! কোন জায়গায় এটা?”
“সুন্দর না! এটা পাশের গ্রামের বিল। আমি আগে একবার দেখেছিলাম৷ আজ আবার যাবো। তুমি যাবে দেখতে?”
“আজ! কিন্তু আজতো আপুর বিয়ে।”
“হ্যাঁ তো বিয়ের পর যাবো। এমনিতেও রাতে এর সৌন্দর্য আরও হাজার গুণ বেড়ে যায়। তাই রাতেই যাবো দেখতে।”
আদ্রিতা ইতস্তত সুরে বলল,
“রাতে!”
তখন পাশ থেকে তানহা বলে উঠলো,
“আরে তুই কি একা যাবি নাকি! এই সুন্দর বিলটা দেখতে আমরা সবাই একসাথে যাবো। অনেক মজা হবে।”
জোভানের মুখটা আবারও চিপে রস বের করা আমের মতো হয়ে গেল। কিন্তু আদ্রিতা খুশি হয়ে বলল,
“ওয়াও তাহলেতো মজাই হবে। ঠিক আছে, রাতে আমরা সবাই মিলে যাবো।”
জোভান হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তবে নাই মামার চেয়ে কানা মামাও ভালো। সবার সাথে গেলেও আদ্রিতার সাথে সময় কাটাতে পারবে এটাতেই আপাতত খুশি আবিষ্কার করে নিচ্ছে জোভান।এখন শুধু রাতের অপেক্ষা। আজকের সময়টা সে কাজে লাগিয়েই ছাড়বে। আদ্রিতা নজর ঘুরিয়ে নিবিড়কে খুঁজল। কিন্তু কোথাও পেলনা তাকে। মাত্রই তো এখানে ছিলো। হঠাৎ কোথায় গেল! আদ্রিতার খুব জানতে ইচ্ছে করছে নিবিড় ভাইয়াও কি ওখানে যাবে। তার সঙ্গ পেলে যে সময়টা আরও মোহময় হয়ে উঠবে।
___
বিয়ের জমকালো আয়োজন শুরু হয়ে গেছে সবাই রঙবেরঙের পোশাক আর সাজসজ্জায় নিজেদের সাজিয়ে তুলেছে। সানভি মেকাপের ড্রামে চুবিয়ে তুলেছে নিজেকে যেন। দশ ঘন্টা ধরে মেকাপের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে অবশেষে বের হলো সে। বের হতেই কাজের মহিলা আম্বিয়া আবারও তাকে দেখে বলল,
“ও আফা কেডো আপনে? এহেনে আঙ্গারে বাড়িত ঢুকছেন ক্যা? বিয়া বাড়ি দেইহা মাগনা খাব্যার নাইগা ঢুক্যা পড়ছ্যাও তাইনা! খাঁড়াও দেহাইত্যাছি তোমাক….
আম্বিয়া ঝাড়ু হাতে নিয়ে সানভিকে মারার জন্য উদ্যত হলেই সানভি নিজেকে বাঁচাতে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
” এই এই কি করছ তুমি! পাগল হয়ে গেছ নাকি! আমাকে মারছ কেন! মাম্মি…বাঁচাও.. দেখ এই আম্বিয়া কি করছে..মাম্মি..
সানভি দৌড়াতে দৌড়াতে আবিরকে পেল।ছুটে গিয়ে আবিরের পেছনে লুকিয়ে ভীতু গলায় বলল,
“মামা,প্লিজ বাঁচাও আমাকে। দেখ এই আম্বিয়া পাগল হয়ে গেছে।”
আবিরকে দেখে আম্বিয়া থেমে গেল। আবির বলে উঠলো,
“কিরে আম্বিয়া কি হয়েছে? “
“আরে চাচা এই বেটি মাগনা খাওয়ার জুন্যি আঙ্গারে বাড়িত ঢুইহা পইড়ছে।তাই হ্যাক দাবড়াইয়া বাইড় কইরত্যাছি।”
“তো কি হয়েছে? তাই বলে ঝাড়ু দিয়ে মারবি!নাহয় বেচারি অনাহারী মানুষ একটু খেতে এসেছে তো কি হয়েছে! আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি।”
আবির এবার সানভির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“দেখ ভয় পেওনা। তুমি খাবার খাবে এটা বললেইতো হতো। চুরি করে ভেতরে ঢোকার কি দরকার ছিল! আমরা এমনিতেই সব অনাহারীদের খেতে দেই৷”
সানভি এবারে ক্ষেপে গিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“মামা!..
এরমধ্যে সানা,তাসির আর তানিও এগিয়ে এলো। সবাই জানতে চাইলো কি হয়েছে। সানভি দৌড়ে গিয়ে সানাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” মাম্মি..দেখোনা মামা আমাকে চিনতেই পারছেনা। আমাকে ভিখারি ভাবছে।”
তাসির তখন বলে উঠলো,
“সানা,তুমি এতবড় ধোঁকা দিতে পারলে আমাকে! এখানে তোমার আরেকটা মেয়ে আছে! তা আমি জানিই না! আমার কথা নাহয় বাদই দিলাম। তুমি একবারও তোমার ছেলে মেয়ের কথা ভাবলে না! তাসান,সানা জানলে কি ভাববে!
তানি বলে উঠলো,
” আরে না, আমাদের সানা এমন কিছু করতেই পারে না। এই মেয়েটা মিথ্যে বলছে। এই মেয়ে কে তুমি?”
সানভি এবার করুন সুরে বলল,
“পাপা তুমিও! নিজের মেয়েকেই চিনছ না! আরে আমি সানভি, সানভি৷ যাও কথা নেই তোমাদের সাথে।”
বলেই রাগ দেখিয়ে চলে গেল সানভি। আর বাকিরা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফিক করে হেঁসে দিলো।
আদ্রিতা রেডি হয়ে নিচে আসতেই আবির তাকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বাহ! আমার মামুনিকে একেবারে প্রিন্সেস লাগছে।”
আদ্রিতা আহ্লাদী হেঁসে বলল,
“দেখতে হবে না ভাতিজিটা কার! কিউট চাচ্চুর কিউট ভাতিজী।”
আবির গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
“হ্যাঁ তাতো ঠিকই। কিউটতো আমি অনেক। জন্ম থেকেই কিউটনেস আমার মাঝে ঠুসে ঠুসে ভরা।”
তখনই তানি উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“এইযে মিঃ কিউটের বুইড়া দাদাজী। গিয়ে একটু দেখেন বরযাত্রী এলো নাকি।”
আবির অসহায় মুখ করে বলল,
“খালি তোর সোনা মা বুঝলোনা আমার কিউটনেসের মহত্ত্ব।”
হিহি করে হাসলো আদ্রিতা। হাসির মাঝেই পাশে নজর যেতেই নিবিড়কে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখলো সে। মেরুন রঙের পাঞ্জাবির উপর ব্লাক কালারের শেরওয়ানি পড়েছে।শেরওয়ানির সব বোতাম খুলে রাখায় সামনের দিকটা খোলা । সাথে গিরার উপর পর্যন্ত ঝুলের ব্লাক প্যান্ট। ফোন টিপতে টিপতে নিচে নেমে আসছে সে। তাকে দেখে হালকা মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে রইলো আদ্রিতা। হয়তো ওই পুরুষের একটু মুগ্ধ চাহুনির অপেক্ষায় তার অবচেতন মন। আরচোখে তাকিয়ে দেখলো নিবিড় সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো। তারপর ফোন কানে নিয়ে কথা বলতে বলতে আদ্রিতার সামনে দিয়ে চলে গেল। একবারের জন্য আদ্রিতার দিকে তাকালও না। আদ্রিতার আবেগী মনটা চুপসে গেল। তবে বেশি লাগালো না৷ ভাবলো হয়তো ফোনে কথা বলায় খেয়াল করেনি। এমনিতেও বিয়ের আয়োজনে অনেক ব্যস্ত সে। এমনটাই বুঝ দিয়ে মনকে বোঝাল আদ্রিতা।
বরযাত্রীও এরমধ্যে এসে পড়েছে। সবাই হৈ হুল্লোড় করে এগিয়ে গেল। পোলাপান গেটের সামনে ফিতা বেঁধে রেখেছে। বরকে ভেতরে ঢুকতে মোটা অংকের টাকা খসাতে হলো। এটাতো শুরু ছিলো। পদে পদে তাদের একপ্রকার লুটে নেওয়ার দশা করে ছাড়ছে কনেপক্ষ। আদ্রিতা,তানহা আর সানভিসহ আরও কিছু মেয়েরা মিলে বিশালকার খানচা সাজিয়ে পেশ করেছে বরের স্টেজে বসা বর আর তার সাথের কোলদারা(সিরাগঞ্জে বোন জামাইরা বরের সাথে আসে, তাদের কোলদারা বলে)দের সামনে। সেগুলো খাইয়েও ডাকাতি করে নিলো অনেক টাকা। তারপর আবার জুতা চুরি করেও আবার লুটে নিলো। বরপক্ষের ছেলেগুলো আদ্রিতার সাথে বিয়াইন বিয়াইন বলে অনেক মজা করতে লাগলো। আদ্রিতাও মজার ছলে কিছুক্ষণ তাদের সাথে হাসিঠাট্টা করলো। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে সবকিছুতে অনিহা চলে আসছে কেমন তার৷ কারণ এতটা সময় অতিবাহিত হওয়ার মাঝে একবারও নিবিড় তার দিকে একবারের জন্যও চোখ তুলে তাকায়নি। সামনে দিয়ে চলে যায় তবুও তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। যেন তার জন্য ইনভিসিবল হয়ে গেছে আদ্রিতা। আদ্রিতা কতবার ইচ্ছে করে নিবিড়ের সামনে নানান অজুহাতে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু নিবিড় প্রতিবারই তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে। যেন এই বসুন্ধরায় আদ্রিতা বলতে কোন বস্তুই নেই। তার এই উপেক্ষা আদ্রিতার কোমল মনকে চপেটাঘাত করছে। আদ্রিতা বারবার মনকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে। ভাবছে সে হয়তো বিয়ের ঝামেলা সামলাতে ব্যস্ত আছে। ইচ্ছে করে মোটেও এমন করছেনা। কিন্তু অভিমানী মন আদ্রিতার যুক্তি মানতে নারাজ। সেতো ধীরে ধীরে বিষন্ন হয়ে উঠছে।
তাসান আজও কালকের মেয়েটিকে দেখতে পেল। একপাশে চেয়ারে বসে আছে। তবে আজকে তার পোশাক আশাক আর সাজগোজের ধরন একেবারেই আলাদা। কালকের লাজুক, ভীতু মেয়েটা আর এই মেয়েটির মাঝে আকাশপাতাল পার্থক্য। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হলো মেয়েটাকে আজ এখানে দেখে। কালকে ওভাবে ডাকাতি করে নিয়ে গিয়েও আবার আজ এখানে আসার সাহস হয় কেমন করে। তাসান এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। তার পাশের চেয়ারে বসে বলে উঠলো,
“তুমি! তোমার সাহস তো দেখছি কম না। ডাকাতি করে আবার সেই জায়গাতেই দাওয়াত খেতে এসেছ!”
মেয়েটি তাসানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“সাহস আমার এমনিতেই বেশি।টেল মি সামথিং আই ডোন্ট নো। আর হ্যাঁ, এখানে বলতে কি বোঝাতে চাইছেন! আপনি কি ভেবেছেন আপনার ভয়ে আমি আসবোনা! আপনি আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিবো সেই ভয়ে! ও প্লিজ, গ্রো আপ। আমি যে ডাকাতি করেছি তার কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে। বরং উল্টো প্রমাণ আমার কাছে আছে। “
মেয়েটি তার মোবাইল ফোনে একটা ভিডিও চালু করে দেখালো যেখানে তাসান মেয়েটিকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে কাচারি ঘরে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা দেখিয়ে বলল,
“এটা দেখিয়ে যদি পুলিশকে আপনার নামে রে,প কেস করি তাহলে কে ফাঁসবে সেটা নিশ্চয় ভালোই জানেন। তো বলুন পুলিশে ধরিয়ে দিবেন আমাকে!”
তাসান বাঁকা হেঁসে বলল,
“পুলিশে কে দিতে চায় বেবি। যেখানে আমি নিজেই তোমার কাছে গ্রেফতার হয়ে গেছি।তবে তোমার উপর আমার একটা অভিযোগ আছে বুঝছ। তুমি আমার সব লুটে নিলে অথচ আসল জিনিসটাই রেখে গেলে। “
তাসলিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি?”
“আমার ইজ্জত। তুমি সবই লুটে নিলে অথচ আমার ইজ্জতটাই রেখে গেলে। এটা কেমন অবিচার! তুমি ইজ্জত কেন লুটেপুটে নিলে না! কেন অবজ্ঞা করে ফেলে গেলে। বাট ব্যাপার না। কাল যেটা অসম্পূর্ণ ছিলো। আজ পূরণ করে ফেলো। আজকে ইজ্জত লুটে নেও। ফালা ফালা করে ফেলো আমাকে। আই ওয়ান্ট টু বেইজ্জত।”
“আপনি কি জন্ম থেকেই পাগল, নাকি স্পেশাল কোর্স করেছেন! আর হ্যাঁ, আমি ওইসব সস্তা পঁচা সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস লুটি না।”
“সেকেন্ড হ্যান্ড! আরে কি বলছ! আমার ইজ্জত একেবারে তরতাজা ইনটেক মাল। এখনো প্যাকেটই খোলা হয়নি। তোমার হাতেই উদ্বোধন হবে। তোমাকে দেখে আমি অনেক জোরে প্রেমে পড়ে গেছি বুঝেছ! এত জোরে পড়েছি যে হাড্ডি গুড্ডি সব ভেঙে গেছে। এখন আর উঠার উপায় নেই।”
“আপনার কি লজ্জা শরম বলতে কিছু নাই! নাকি বুড়িগঙ্গায় জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছেন! কালকের ঘটনার পরেও আমাকে প্রেমের কথা বলতে লজ্জা করেনা আপনার! “
“যেমন ওয়াটার প্রুফ ঘড়ি পাওয়া যায়। আমি তেমন লজ্জাপ্রুফ। কোনকিছুতে লজ্জা পাইনা আমি। এইযে যেমন তুমি যদি আমাকে এখন জড়িয়ে ধরে জব্বর একটা কিস্সি দাও, আমার লজ্জা করবেনা। বিশ্বাস নাহলে ট্রাই করে দেখো।”
বলেই তাসান ঠোঁট চোখা করে তাসলিমার দিকে মুখ এগিয়ে নিলো। তাসলিমা চোখ মুখ কুঁচকে দৌড়ে উঠে গেল ওখান থেকে। তাসান চোখ খুলে হো হো করে হেঁসে উঠলো।
খাবার টেবিলে মলিন মুখে বসেছে আদ্রিতা।প্লেটে নামমাত্র কিছু খাবার নিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করছে। তানহা আর সানভিদের সাথে বসেছে সে। তবে খাবারে একটুও মন নেই তার। তার অসভ্য বেয়ারা মনটা ওই নিঠুর পুরুষকে ভাবতে ব্যস্ত। যে আদ্রিতাকে তখন থেকে উপেক্ষার অনলে পুড়িয়ে যাচ্ছে। এখনতো সেই বেয়ারা মনটা আর কোনো অযুহাতও মানছেনা। বিষন্নতার অতলে ডুবছে ক্রমশ। হঠাৎ আদ্রিতা দেখলো নিবিড় মেহমানদের খাবার পরিবেশন পর্যবেক্ষণ করছে। তাকে দেখে ক্ষিণ আশা জাগলো মনে।নিবিড় সামনের টেবিলে আসতেই কিছু একটা ভেবে আদ্রিতা নিবিড়কে শুনিয়ে শুনিয়ে তানহাকে বলল,
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে নারে কিছু।”
তানহা বলল,
“সেকি তুইতো কিছু খেলিই না৷ আর একটুখানি খা।”
“না আমি খাবোনা। খেতে ইচ্ছে করছে না।”
আদ্রিতা আরচোখে দেখছে নিবিড়কে। ভাবলো তার কথা শুনে হয়তো আসবে তার কাছে। ধমক দিয়ে বলবে,”আমার সামনে পুরো খাবার শেষ করে উঠবি। নাহলে বিয়ের সব থালাবাসন তোকে দিয়ে মাজাবো।” কিন্তু না, আদ্রিতা ভাবনা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া এলোনা। নিবিড় ওর দিকে না তাকিয়েই ওদের টেবিলের সামনে দিয়ে চলে গেল। এপর্যায়ে আর আদ্রিতা সইতে পারলোনা।খাবারের প্লেট ছেড়ে ছুটে চলে গেল সে। এক দৌড়ে নিজের রুমে এসে বিছানায় শুয়ে কেঁদে ফেললো সে। নিবিড় ভাইয়ার এই উপেক্ষা ভীষণ রকম কষ্ট দিচ্ছে। এরচেয়ে তো ডজনখানেক ধমক দেয়,উল্টোপাল্টা কথা বলে ওর পিত্তি জ্বলিয়ে দেয় তাও এতো খারাপ লাগে না। কিন্তু আদ্রিতা বুঝতে পারছে না তার অপরাধ টা কি! নিবিড় ভাইয়ার এই রুক্ষতার কারণ কি! এসব ভেবে ভেবে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে গেল সে।
রাত তখন দ্বিপ্রহর। ঘুমের দেশে হারিয়ে আছে আদ্রিতা। তখনই নিস্তব্ধ পায়ে রুমে ঢুকলো কেউ। মৃদু পায়ে আদ্রিতার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি তার। কিছুক্ষণ দেখার পর দুই হাতে আলতো করে কোলে তুলে নিলো ঘুমকুমারিকে। কোলে নিয়ে আবারও বেড়িয়ে গেল সে।
চলবে……