#মেহরুমা নূর
★”বিনা অনুমতিতে আর বিনা প্রয়োজনে এই রুমে প্রবেশ নিষেধ।”
নূরানের দরজায় টানানো বোর্ডের লেখাটুকু পড়ে নিজের মনে হাসলো আদ্রিতা। যতবারই নূরানের রুমের সামনে আসে এই বোর্ডটা সে পড়ে৷ বড় বড় অক্ষরে তার ভাই এটা লিখে রেখেছে। এই রুমে জনসাধারণের আসা নিষেধ। শুধু পরিবারের লোক আসতে পারে তাও অনুমতি নিয়ে আর প্রয়োজন সাপেক্ষে। প্রয়োজন ছাড়া এ রুমে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা। শুধু নূর আর আদ্রিতা বাদে। এই দুটো ব্যক্তিই কেবল এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। আদ্রিতার নিজেকে অনেক স্পেশাল মনে হয় তখন। কুইন অফ ভিক্টোরিয়া টাইপ ফিলিং আসে। কারণ এই রুমে কেবল সেই যখন তখন প্রবেশ করতে পারে, বিনা কেনো অনুমতিতে। আদ্রিতা হাতের কফির ছোট্ট ট্র-টা নিয়ে আস্তে করে নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। আবছা আলো অন্ধকারে ঘেরা রুম। নূরান পারতো পক্ষে রুমের বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালায় না। তার কাছে নাকি কৃত্রিম আলো ভালো লাগে না। শুধু রাতের বেলায় জ্বালায়। তাও একেবারে জিরো পাওয়ারের। আসলে তার ভাইটা দুনিয়ার থেকে একটু অন্যরকম। কোনোরকম কৃত্রিমতাই তার পছন্দ না। চুপচাপ সারাদিন এই রুমের মাঝে আবদ্ধ থাকাই তার কাজ। পড়ালেখার প্রয়োজন আর অতিরিক্ত দরকার ছাড়া সে কখনো রুম থেকে বের হয়না। এই রুমই যেন তার পৃথিবী। তাকে দেখে কে বলবে নূরান আর আদ্রিতা জমজ ভাই-বোন। দুইজনের স্বভাবের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। যেখানে সারাদিন কৈ মাছের মতো লাফিয়ে বেড়ানো, ননস্টপ বকবক করা আর সবাইকে জ্বালিয়ে বেড়ানোয় আদ্রিতার জীবনের উদ্দেশ্য। সেখানে নূরান একেবারেই তার ভিন্ন রুপ।দুজনের একই বয়স হলেও নূরান এই বয়সেই অনেক ম্যাচিউরড। ওর বয়সের ছেলেদের তুলনায় অনেক বেশি সুশৃঙ্খল, বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ।ছোটবেলা থেকেই অনেক চুপচাপ স্বভাবের। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলে না। নিকট আত্মীয় ছাড়া অনেকে জানেই না যে এই পরিবারে আরেকটা সদস্যও আছে।
আদ্রিতা খুব সাবধানে পা টিপে টিপে ভেতরে প্রবেশ করলো। দেখতে পেল তার ভাই সামনেই বড়ো একটা আর্টবোর্ডে কিছু একটা পেইন্টিং করছে। রঙের কৌটায় ব্রাশ চুবিয়ে আর্টবোর্ডে তার মনের মাধুর্য মিশিয়ে কিছু আঁকছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ তার সেখানেই। মাথায় মেয়েদের মতো কাঁধের নিচ সমান লম্বা চুলগুলো হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে এলোমেলো ভাবে বেঁধে রেখেছে। এ্যাশ কালারের ঢোলা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়নে। আদ্রিতার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। সে ভাবলো নূরানের রঙের সেটগুলো আজ সে চুরি করেই নিবে। নিজের রুমের বারান্দার টব গুলোকে ইচ্ছে মতো রং করবে এগুলো দিয়ে। সেই ভাবনা অনুযায়ী আদ্রিতা কফির ট্রে-টা নিঃশব্দে বিছানার উপর রেখে পা টিপে টিপে নূরানের পেছনে রাখা রঙের সেটটাকে তুলতে গেল। ঠিক তখনই নূরান পিছে না তাকিয়েই বলে উঠলো,
“অরি,একদম দুষ্টুমি না। রুমে তোর যখন তখন আসার অনুমতি আছে বলেই তার ভুল প্রয়োগ করিস না।নাহলে তোকেও বাকিদের কাতারে ফেলে দিবো কিন্তু। “
জিহ্বায় কামড় দিলো আদ্রিতা। সোজা হয়ে নূরানের সামনে এসে বলল,
“তুমি সবসময় আমার উপস্থিতি কীভাবে বুঝে যাও ভাইয়া? আমিতো কোনো শব্দও করিনা। “
জমজ হলেও অরি নূরানকে ভাইয়া বলেই ডাকে। কারণ নূরান আদ্রিতার থেকে ত্রিশ সেকেন্ডের বড়ো। তাই আদ্রিতা নূরানকে বড়ো ভাই হিসেবেই মানে। নূরান পেইন্টিং ব্রাশ রেখে রুমাল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলল,
“তুই বারবার ভুলে যাস অরি, আমি তোকে বাকিদের থেকে নয়মাস বেশি চিনি। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব একসাথে শুরু হয়েছে। তাই তোর উপস্থিতি টের পেতে আমার শব্দের প্রয়োজন হয়না।”
অরি খুশিমনে হেঁসে নূরানের দুই গাল টেনে দিয়ে বলল,
“অঁওওও…. ইউ আর সো কিউট ভাইয়া।”
নূরান মিছে বিরক্তির সুরে বলল,
“অরি! কি করিস এসব! কতবার তোকে মানে করেছি।”
আদ্রিতা হেঁসে দিয়ে বলল,
“বললেই শুনতে হবে এমন কোনো আইন আছে নাকি? আমিতো করবোই। “
বলেই আবারও গাল টেনে দিলো। নূরান মাথা নেড়ে কিঞ্চিৎ হাসলো। তার বোনটা বাচ্চার, বাচ্চাই থেকে গেল। আদ্রিতা নূরানের রুমের পর্দা গুলো ভালো করে খুলে দিলো যাতে ঘরে পূর্ণ আলোর প্রবাহ ঘটে। হাজার বার দেখা ঘরটা আবারও ঘুরে দেখতে লাগলো। নূরানের রুমটা ছোট খাটো একটা আর্ট গ্যালারি বলা চলে। ঘরের চার দেয়ালে নানান রকমের এক একটা অপূর্ব সব পেইন্টিং এঁকে রেখেছে। কোথাও কোনো জায়গা ফাঁকা নেই। আদ্রিতার খুব গর্ববোধ হয় তার ভাইয়ের ওপর। কতো প্রতিভা তার ভাইয়ের। কতো সুন্দর সুন্দর পেইন্টিং করে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, নূরান একদিন অনেক বড়ো শিল্পী হবে। আদ্রিতা পেইন্টিং দেখতে দেখতে বলে উঠলো,
“আচ্ছা ভাইয়া তুমি তোমার পেইন্টিং-এর কোনো এক্সিবিশন করোনা কেন? আমি নিশ্চিত এক্সিবিশন হলে তোমার আর্টের অনেক প্রশংসা হবে। সবাই কিনতে চাইবে তোমার ছবি। তুমিতো বড়লোক হয়ে যাবে ভাইয়া।”
নূরান কফি খেতে খেতে বলল,
“আর কতো বড়লোক হবো? প্রায় ছয় ফিট লম্বা আমি। এরথেকে বড়ো হলে ছাদে মাথা ঠেকে যাবে। পেইন্টিং আমি আমার নিজের মনের আত্মতুষ্টির জন্য করি। কাউকে দেখানোর জন্য না। তবে হ্যাঁ যদি কখনো প্রয়োজন হয় তবে অবশ্যই করবো এক্সিবিশন।”
আদ্রিতা মুচকি হাঁসলো মনে মনে বলল,
“আমি দোয়া করি ভাইয়া সেই প্রয়োজন যেন তোমার জীবনে খুব জলদিই আসে।”
___
একসাথে দুই সিড়ি লাফ দিয়ে টপকাতে টপকাতে নিচে এসে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল আদ্রিতা। তানি আর সানা মিলে দুপুরের খাবারের আয়োজন করছে। মহারাজ নিবিড়ের আগমন উপলক্ষে নিশ্চয় এরা রাজভোজের তৈয়ারি করছে। আদ্রিতা এগিয়ে গিয়ে সানাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“কি করছ ফুপি? “
সানা চুলোয় তরকারি নাড়তে নাড়তে বলল,
“রান্না করছি, আম্মাজান। “
“বাইদাওয়ে তোমাকে কিন্তু আজ এই শাড়ীতে চরম হট লাগছে। তাসির ফুপাকে এই আদা দেখিয়েই বস করেছ তাইনা?”
পাশ থেকে তানি হেঁসে দিলো আদ্রিতার কথায়। সানা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,
“হেই পাজি, কি বলিস এসব! ফুপির সাথে এসব কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? দিবো একটা।
আদ্রিতা হেঁসে দিয়ে সানার গলা পেঁচিয়ে ধরে বলল,
” আমাকে মারতে পারবেনা। আমি তোমার আম্মাজান না!”
“হুম, একারণেই তো তোকে কিছু বলতেও পারিনা। তুই যে আমার মায়ের চেহারা পেয়েছিস।মনে হয় আমার মায়ের আবার পুনর্জন্ম হয়েছে। এইজন্যই তো বাবা তোকে গিন্নি বলে ডাকে।”
“আমি তোমাদের মা-ই তো।”
তানি একটা সুপের বোল ট্রে-তে রেখে আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বলল,
“হয়েছে চাচি আম্মা,এখন যা একটু কাজ কর। এই সুপটা তোর দাদুনকে খাইয়ে দিয়ে আইতো। তারপর ঔষধও খাইয়ে দিস। আমি এখানে ব্যাস্ত নাহলে আমিই দিতাম। আদ্রিতা ট্রে-টা হাতে নিয়ে বলল,
” আচ্ছা দাও,আমি খাইয়ে দিবো চিন্তা করোনা।”
আদ্রিতা ট্রে-টা নিয়ে এগিয়ে গেল তুলি বেগমের রুমের দিকে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই হালকা থমকালো সে। নিবিড় এই রুমে আছে জানলে সে আসতোই না এখানে। কিন্তু এখনতো এসে পড়েছে। ফিরে যাওয়াটা কেমন দেখাবে। তুলি বেগম আদ্রিতাকে মুচকি হেঁসে বলল,
“এসেছিস বোনু, আয় সিট কর এখানে। দেখ নিবিড় আমার জন্য হোয়াট এনেছে।”
আদ্রিতা খেয়াল করলো নিবিড় ভাইয়া দাদুনের পায়ে কি যেন মেশিন লাগিয়ে রেখেছে। সেটা কেমন ভাইব্রেট করছে। আদ্রিতার খুব কৌতূহল জাগলো জিনিসটা কি তা জানার।আদ্রিতা ট্রে-টা বেডের পাশের ক্যাবিনেটের ওপর রেখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তুলি বেগম নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“দাদুভাই আমার জন্য তোকে এভাবে সিডনি(সাডেনলি) আসতে হলো। তোর ড্যাডির(স্টাডির) কোনো ক্ষতি হবে নাতো?
নিবিড় মনে মনে হাসলো। তার দাদীর সেই ভুলভাল ইংরেজি বলার স্বভাব এখনো রয়েই গেছে। কিছু স্বভাব হয়তো কখনোই বদলায় না।বদলালে সেটা ভালোও লাগে না। কারণ সেটাই তার বৈশিষ্ট্য। নিবিড় স্মিথ হেঁসে বলল,
” চিন্তা করোনা দাদুন,আমার কোনো সমস্যা হয়নি। এমনিতেও আমার স্টাডিতো শেষই হয়ে গেছে। আমিতো বর্তমানে শুধু স্পেশাল একটা বিজনেসের কোর্স করছিলাম আর ইটালিতে বড়ো আব্বুর বিজনেসে একটু আধটু হেল্প করছিলাম।”
“হ্যাঁ, আদি আর নূর বৌমাতো তোর অনেক প্রশংসা করে। বলে তোর মতো সান হয়না। ফোন করলেই তোর কথা বলে।ওখানে নাকি তুই আদিকে কতো হেল্প করিস তাও বলে। “
নিবিড় মুচকি হেঁসে বলল,
“আরে, বড় মা আর বাবা তো আমাকে আগে থেকেই একটু বেশিই ভালোবাসে।তাই একটু বেশিই বলে।”
আদ্রিতা বিরক্ত হয়ে অগোচরে মুখ ভেঙালো। এই নিবিড় পুরান শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ সে। তবে আপাতত সে নিজের কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কি দাদুন?”
“আরে এটা নিবিড় এনেছে আমার জন্য। এই মেশিনে নাকি লেগের প্যান(পেইন) কমে যায়।”
আদ্রিতা মজা করে বলল,
“প্যান কমে গেলেতো ভালোই হবে। তুমি শর্ট প্যান্ট পড়ে ঘুড়ে বেড়িও। ছোট দাদু দেখে হাঁটু ফেল করবে।”
বলেই হিহি করে হাসতে লাগলো আদ্রিতা। হঠাৎ নিবিড়ের বিকট ধমক শুনে ফট করে চুপ হয়ে গেল আদ্রিতা। নিবিড় ধমক দিয়ে বলল,
“এমনি এমনিতো তোকে বলদি বলিনা। তুই নিজেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে তোর অপদার্থ কর্ম দ্বারা এই উপাধিটা নিজের জন্য অর্জন করে নিয়েছিস। আসলে তোকে বলদি বলাও বলদির জন্য বিশাল অপমানের বিষয়। সবার অতিরিক্ত আদরে আদরে একেবারে লেজকাটা বাঁদর হয়ে গেছিস তুই।তোরতো মগজে গবরও নেই। গোবরও অন্তত জৈব সারের কাজে লাগে। আর তোর মগজ তো শুধু অকাজে লাগে।”
ব্যাস,আর নিতে পারলোনা আদ্রিতা। রাগে কটমট করতে লাগলো সে। এতক্ষণ অভিমান করে কথা না বললেও এবার জবাব না দিয়ে থাকতে পারলোনা। এবার আদ্রিতার ইগো হার্ট হয়ে গেছে। শুধু হার্ট না, একেবারে কিডনি, লিভারও হয়ে গেছে। এর উত্তম জবাব তো দিতেই হবে। আদ্রিতা কটমটে চোখে তাকিয়ে নিবিড়ের দিকে আঙুল তুলে বিদ্রোহী আওয়াজে বলল,
“দেখুন, একদম বাজে কথা বলবেন না। কি বারবার বলদি বলদি লাগিয়ে রেখেছেন! আমাকে দেখে কোনদিক দিয়ে বলদি মনে হয় আপনার?”
একদমে কথাগুলো বলে একটু দম নিয়ে নিবিড়ের দিকে তাকালো আদ্রিতা। নিবিড় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে। বিছানার উপর বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রেখে প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে আদ্রিতার দিকে এক কদম এগিয়ে গেল। আদ্রিতা এবার একটু থতমত খেয়ে গেল। মনে মনে একটু ভয় পেলেও চেহারায় সেটা না দেখানোর প্রচেষ্টায় রইলো। আমি ভয় পাচ্ছি সেটা আমি জানি, আমার মন জানে। অন্যকে জানানোর কি দরকার। নিবিড় আদ্রিতার দিকে চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“তুই বলদি কি, না এটা জানার জন্য বুঝি তোকে দেখতে হবে? বাহ! নিজেকে দেখানোর জন্য কি ফন্দি এঁটেছিস! তোর ধুরন্ধর গিরির প্রশংসা না করে পারছিনা। তা কতজনকে তোর ধুরন্ধর গিরির জালে ফাঁসিয়ে নিজেকে দেখিয়ে বেড়িয়েছিস?”
আদ্রিতার ঠোঁট দুটো আপনাআপনি আলাদা হয়ে গেল। গোল আলুর মতো হা হয়ে গেল তার মুখখানা। সামান্য বিষয়টাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল এই লোকটা! এমন অবান্তর মানুষ আর দুটো দেখেনি আদ্রিতা। রাগে, দুঃখে মন চাচ্ছে, নিবিড়ের মাথার এই নায়কের মতো সিল্কি চুলগুলো টেনে তুলে ফেরিওয়ালার কাছে চুল দিয়ে বিনিময়ে পাপর কিনে খেতে। আহ! ভাবতেই কতো শান্তি লাগলো আদ্রিতার। মনে মনে চুল বিহীন নিবিড়কে কল্পনা করলো। তাতেই ভীষণ হাসি পেল তার।হাসির কিছু অংশ ঠোঁটেও ফুটে উঠলো। নিবিড় তা খেয়াল ভ্রু কুঁচকে বলল,
“দেখলি, আমার দেওয়া উপাধি আবারও সঠিক প্রমাণ করলি তুই। নাহলে নরমাল ব্যাক্তি কখনো কেউ এই পরিস্থিতিতে একা একা হাসে? সত্যি করে বলতো কি ভেবে হাসছিস তুই?
” বলবো কেন? আমার মুখ, আমার হাসি। আমিতো বলদি, কিন্তু আপনি নাকি বুদ্ধির ঠাকুর। তাহলে নিজেই উদঘাটন করুন আমার হাসির কারণ।”
নিবিড়কে নিয়ে এমন হাস্যকর ইম্যাজিনেশন দেখে আদ্রিতার রাগ কমে এলো। তাই সে আর তর্কে জড়ালো না। এমনিতেও এই লোকের সাথে তর্কে জড়ানো মানে নিজের ইজ্জতের ডাল ঘাটা করা।তাছাড়া দাদুন আছে এখানে, তাই কথা বাড়ালো না সে। আদ্রিতা নিবিড়ের সামনে থেকে সরে এসে সুপের বোল হাতে নিয়ে তুলিকে খাইয়ে দিলো। তারপর ঔষধও খাইয়ে দিলো। তুলি আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তুই খেয়েছিস বোনু?”
“না। তুমিতো জানোই সকাল সকাল খেতে আমার ভালো লাগে না। বমি আসে।”
“এমন করতে নেই বোনু। এভাবে দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বি। তোর মা বাবাকে তখন কি জবাব দিবো আমরা? তাদের অনুপস্থিতিতে আমরা তোর ঠিকমতো খেয়ালও রাখতে পারিনি!”
“আরে ধুর, হুদাই সেন্টি খাইও নাতো। আমার ক্ষুধা লাগলে আমি খেয়ে নিবো। এতো চিন্তা করতে হবে না। তুমি এখন আরাম করোতো। “
আদ্রিতা তুলির গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। করিডরে আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাকলো
“পুতুল।”
এতদিন পর সুপরিচিত সেই ডাক শুনে স্থির হয়ে গেল আদ্রিতা। থমকিত হলো পদযুগল। পেছনে ঘুরে তাকালোনা সে। কেন যেন মনে হচ্ছে পেছনে ঘুরে তাকালে সে কেঁদে ফেলবে। আদ্রিতা ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছোট্ট করে বলল,
“হুম! “
পেছন থেকে নিবিড় বলল,
“আমার ক্ষুধা লেগেছে। খাওয়ার কিছু নিয়ে আয় আমার রুমে।ফাস্ট। “
আদ্রিতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দ্রুত পায়ে সরে এলো ওখান থেকে।ভাবলো অন্য কাউকে দিয়ে সে খাবার পাঠিয়ে দিবে। ওই লোকের রুমে যাবে না। অভিমানের পাহাড় এখনো যে জমে আছে আদ্রিতার। কিন্তু বিধিবাম, কাউকেই পেলনা । সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত। নিচে এসে তানিকে বলল নিবিড়ের জন্য খাবার দিতে। তানি একটা চিকেন স্যান্ডউইচ আর অরেঞ্জ জুস একটা ট্রে-তে করে আদ্রিতার হাতে দিয়ে নিবিড়কে দিয়ে আসতে বলল। তার নাকি অনেক কাজ। তাই অগত্যা মুখ ভোঁতা করে আদ্রিতা খাবারের ট্রে ধরে নিবিড়ের রুমে এগুলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে নিবিড়কে রুমে দেখতে পেলনা। ব্যালকনি থেকে নিবিড়ের কন্ঠ শোনা গেল। হয়তো ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে। যাক ভালোই হলো, খাবার টা রেখেই চলে যাবো। বেডের পাশে ক্যাবিনেটের উপর ট্রে-টা রাখলো আদ্রিতা। একবার চোখ বোলালো রুমটাতে। কতদিন পর এই রুমে আসলো সে। আগেতো দিন-রাত এখানেই পড়ে থাকতো। কিন্তু নিবিড় ভাইয়া চলে যাওয়ার পর, অভিমান করে এই রুমে আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল আদ্রিতা। রুমটা একেবারে নিট এন্ড ক্লিন মনে হচ্ছে। ছেলে মানুষের রুম এতো পরিষ্কার হয় তা নিবিড় ভাইয়ার রুম না দেখলে জানাতো না। উনি আবার খুব শুচিবাই প্রাণী। সবকিছু একদম পরিষ্কার চাই তার। এতো পরিষ্কার দেখে নাক শিটকে আসলো আদ্রিতার। রুমও আবার পরিষ্কার রাখার জিনিস হলো নাকি! রুম থাকবে ওই রাস্তার পাশে ভ্যানে করে বিক্রি করা, যেটা নিবেন একশো টাকার টিশার্টের দোকানের মতো। রুম কেন এমন প্যাথলজি ল্যাবের মতো থাকবে! ছ্যা ছ্যা।
চোখ মুখ শিটকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যোত হলো আদ্রিতা৷ তখনই পেছন থেকে নিবিড়ের ভারী গলায় শোনা গেল,
“দাঁড়া। কোথায় যাচ্ছিস?”
“আপনার খাবার রেখে দিয়েছি। এখন যাই আমি। “
নিবিড় আদ্রিতার সম্মুখে এসে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“খাবার রেখেই এভাবে চোরের পালাচ্ছিস কেন? সত্যি করে বলতো ঘটনা কী? খাবারে বিষ টিষ মিশিয়ে আমাকে মারার প্ল্যান করিস নি তো?”
আদ্রিতা হতবাক হয়ে বলল,
“কি আবোলতাবোল বলছেন? আমাকে কি আপনার টিভি সিরিয়ালের ভ্যাম্প মনে হয়? আমি কেন বিষ মেশাতে যাবো?”
“তোর মতো ধুরন্ধরের উপর কোনো বিশ্বাস নেই। হতে পারে আমাকে মেরে আমার সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিলি।”
আদ্রিতা আবারও হতবিহ্বল হয়ে গেল। ভাষা হারিয়ে ফেলল সে। একটা মানুষ ঠিক কতটা অবান্তর কথার আবিষ্কার করতে পারে তা এই লোকটাকে না দেখলে জানা যেতোনা। নিবিড় বলে উঠলো,
“তোর উপর আমার ভরসা নেই। তাই আগে তুই খেয়ে দেখা। তারপর আমি খাবো।”
আদ্রিতা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“পারবোনা।আপনার খাওয়ার হলে খান, না খেলে জাহান্নামে যান।”
বলেই বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কদম এগুতেই নিবিড় হুমকিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি তোকে যেতে বলিনি, পুতুল। আমার কথা অমান্য করার ফল নতুন মনে করিয়ে দিতে বাধ্য করিস না। একদম তুলে একটা আছাড় মারবো শুধু, ব্যাস।”
দমে গেল আদ্রিতা। আর এগুনোর সাহস পেলনা। এই লোকের কোনো ভরসা নেই। সত্যি সত্যিই আছাড় মেরে নারী ভুঁড়ি বের করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা আছে তার। তার যে শরীর! বিষয় টা শুধু ম,রে যাওয়া বলে না। মরার পর যখন আমার ছবি মিডিয়ায় আসবে তখন,নাড়ি ভুঁড়ি বের হওয়া ছবি কেমন বিচ্ছিরি দেখাবে, ছি ছি। সবাই হা হা রিয়্যাক্ট দিবে। আমার ছবি নিয়ে কতো ট্রোল করবে। এমন ভয়ংকর পরিণতি ভেবে ভয়ে সুড়সুড় করে কদম পিছিয়ে নিলো আদ্রিতা। খাবারের ট্রে-টা হাতে হাতে ডিভানে বসে স্যান্ডউইচ-এ এক কামড় বসালো আর এক ঢোক জুস খেয়ে বলল,
“হয়ে গেছে নিবিড় ভাইয়া। এইযে দেখুন আমি খেলাম৷ এখন নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। এই নেন।”
নিবিড় বিছানায় আরাম করে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বলল,
“এখন কি আমি তোর এঁটো খাবার খাবো? তুই যে পিচাশ, নাজানি কতোদিন ব্রাশ করিসনি তার ঠিক নেই।”
আদ্রিতা হতভম্ব হয়ে বলল,
“তাহলে খেতে বললেন কেন আমাকে?এখন এগুলো কি করবো?”
“কেন, তুই খাবি। খাবার অপচয় করা আমার একদম পছন্দ না। তাই পুরোটা না খেয়ে এখান থেকে উঠবি না।”
“কিহ! দেখুন আমি খেতে পারবোনা। দুপুর বারোটার আগে আমি খেতে পারিনা। বমি আসে আমার।”
নিবিড় ফোন টিপতে টিপতে আয়েসি সুরে বলল,
“ঠিক আছে। না খেলি। আমিও তোর জন্য বড়ো আব্বুর দেওয়া গিফট গুলো দিবোনা। নূরানের জন্য পাঠানো গিফট তো ওকে দিয়ে দিয়েছি। এখন তুই দেখ কি করবি। খাবার খেয়ে নিজের গিফট নিবি,নাকি খাবার না খেয়ে নিজের গিফট হারাবি?”
অসহায় চোখে তাকালো আদ্রিতা।লোকটা কত্তো খারাপ! মা-বাবার দেওয়া গিফট দেওয়ার জন্য কেমন ফ্যাসাদে ফেলে দিলো ওকে। কিন্তু গিফট তো আমার চাই। আদ্রিতা নিবিড়ের করুণ চোখে তাকিয়ে অভিমানী সুরে বলল,
“এভাবে ব্ল্যাকমেইল না করলেও পারতেন। আপনি জানেন, আব্বু-আম্মুর গিফট নেওয়ার জন্য আমি কতো ডেস্পারেট। সেটার এভাবে সুযোগ নিবেন! কি এমন অপরাধ করেছি আমি?”
মুখ গোমড়া করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্যান্ডউইচ মুখে নিয়ে অরুচি ভাবে চিবোতে লাগলো আদ্রিতা। আর মনে মনে নিবিড়কে যতো আজগুবি অভিশাপ দিতে লাগলো। এই যেমন,নিবিড় তার বাসর ঘরে বউয়ের ঘোমটা উঠাতেই যেন দেখতে পায় তার বউয়ের ফকির বাবার মতো লম্বা জট লাগানো দাড়ি। বাথরুম করার পর যেন টিস্যু, পানি কিছু না থাকে। এমন সব উদ্ভট অভিশাপ দিতে দিতে খেতে লাগলো সে।
নিবিড়ের ফোন ধরে রাখাটাতো শুধু উছিলা। নজরতো আবদ্ধ ওই অভিমানীর পানে। আদ্রিতার প্রতিত্তোরে সে নিজের মনে আওড়ালো,
“অপরাধ! অপরাধ তো তুই করেছিস পুতুল। অসামান্য অপরাধ। সাত খুনের মাফ আছে। তোর অপরাধের মাফ নেই। তুই রবি আমার আজন্ম অপরাধী। আমার প্রিয় অপরাধী। “
চলবে…..