®মেহরুমা নূর
★ঝলমলে রোদের উঁকিঝুকির মাত্রা বাড়তেই ঘুমের লেশ ধীরে ধীরে কমে এলো আদ্রিতার।ধীরে ধীরে আঁখি পলক মেলে তাকালো সে। মুখে তার মিষ্টি হাসির রেখা বিদ্যমান। মুখমন্ডলে আবেশিত অনুভব। গত রাতের সেই মিষ্টি মুহুর্তের আবেশ যেন এখনো জড়িয়ে রেখেছে তাকে। নিঃশ্বাসে এখনো সেই সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। আদ্রিতার যেন এই সকাল হওয়াতে আপসোস হচ্ছে। সকাল হওয়া কি খুব জরুরি ছিল! আজকের সকাল না এলেইতো পারতো। কি হতো সময়টা ওখানেই থেমে থাকলে। কিছুটা রাগ নিজের উপরও হচ্ছে আদ্রিতার। গত রাতে নিবিড়ের বুকের উষ্ণ আলিঙ্গনে সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। তাইতো কখন আবার রুমে দিয়ে গেছে তাও ভালো করে মনে নেই। সব যেন স্বপ্নের মতো ঘটেছে। নিভৃতে, নির্জনে এসে প্রণয়কাব্য লিখে আবার নিরবে চলে গেছে। আদ্রিতার মনে সুখ পায়রা গুলো ডানা মেলে উড়ছে। মন নেচে উঠছে সুরের ধ্বনিতে। প্রেম প্রেম অনুভূতিতে ভাসছে সে। মনে আবারও সেই গান বাজছে ♬ প্রেমে পড়েছে মন, প্রেমে পড়েছে…..
আদ্রিতার এই প্রেম প্রেম আবেশের উপর নুন মরিচের গুঁড়ো ছিটাতে তার ভাই বোনের অসভ্য জনগোষ্ঠী এসে হামলে পড়লো তার বিছানায়। তার পুরো বিছানা দখল করে নিয়ে আলোচনায় বসে পড়লো তারা। যে আলোচনার না মাথা আছে, না মগজ। আদ্রিতার প্রেম প্রেম ফিলিংসের বোরহানি বানিয়ে দিলো পুরো। আদ্রিতার মাঝে মাঝে মনে হয় তার এই ভাই বোনের জনগোষ্ঠীর মাঝে সভ্যতার বড্ড অভাব। এদের জন্য একটা সভ্যতার টিচার রাখা দরকার। আদ্রিতার ভাবনা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সানভি তাকে ঠেলা দিয়ে বলল,
“এই অরি, কি মরা গরুর মতো শুয়ে আছিস! আজ ফাইজা আপুর শশুর বাড়ি বৌ ভাতে যাবিনা! আমি কোন ড্রেস পড়বো বুঝতেই পারছিনা। একটু হেল্প করনা৷”
আদ্রিতা ব্যাঙ্গাত্মক হেঁসে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ কেন নয়। বৌ ভাতেতো সবাই এটাই জানার জন্য বসে আছে যে জনাবা সানভিজি আজ কি পড়বে। তোর ড্রেসআপ দেখার জন্য ফাইজা আপুর দাদা শশুরের ভুতও আজ কবর থেকে উঠে বেড়িয়ে আসবে। তোর ড্রেসআপ না দেখলে আজ বৌ ভাতই হবেইনা। বৌ রুটি,বৌ নুডলস হবে তবে বৌ ভাত হবে না। বৌ ভাত করতে দুলাভাইকে আরেকটা বিয়ে করতে হবে।”
আদ্রিতা যদিও ব্যাঙ্গ করে বলল তবে সানভি তার বয়ানকে নিজের প্রশংসা হিসেবে নিয়ে গর্বে গদগদ হয়ে বলল,
“হ্যাঁ তা যা বলেছিস। এখন আমি জন্ম থেকেই এত সুন্দর এতে আমার কি দোষ বল”
তাসান মাঝ থেকে বলে উঠলো,
“দিস ইজ নট ফেয়ার অরি। আমার পছন্দের কিছুইতো রাখলিনা। এসব রুটি,নুডলস কোনো খাওয়ার জিনিস হলো! আরে করতে হলে বৌ বিরিয়ানি, বৌ কাচ্চি কর। তাহলে একটা কথা হলো।”
তানহা বলে উঠলো,
“না না এসব বিরিয়ানি, কাচ্চি স্বাস্থ্যের জন্য একদমই ভালো না। উই সুড ইট হেলদি ফুড।”
তাসান তিরস্কারের সুরে বলল,
“আইছে আমার স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তোর জনস্বাস্থ্যের কল্যাণ সংস্থার সদস্য করার জন্য বলির পাঠা হিসেবে কি আমাদেরই পেয়েছিস। যা সর,দূরে গিয়ে মর। এমনিতেই আমার রুচি নাই। কাল বিয়েতে মাত্র পাচ প্লেট বিরিয়ানি, দশ গ্লাস বোরহানি আর দুই প্লেট দই খেয়েছি। এটা কি খাবারের মধ্যে পড়ে বল!এই সামান্য খাবার খেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবো আমি!”
আদ্রিতা সহমর্মিতার ভঙ্গিতে বলল,
“হ্যাঁ তাইতো। আপনার মতো এতো কম খাওয়া লোক কোথায় পাওয়া যায় আজকাল। আজ আপনার মতো মহৎপ্রাণ ব্যক্তি নিজের খাবার কম খাচ্ছেন বলেই অন্য ব্যক্তির পেটে আহার যাচ্ছে। আপনি কম না খেলে দুনিয়া কবেই গায়েব হয়ে যেত।”
তাসান গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
“আরে আরে এত তারিফের কি দরকার। আমি আবার নিজের মহত্ত্বের শো অফ করিনা। এত মহৎ কাজ করেও কখনে অহংকার করিনি।”
“বাহ ভাইয়া! আপনারা দুই ভাই বোনকেই নিজনিজ প্রতিভার জন্য এক ড্রাম ভর্তি অস্কার দেওয়া উচিত।”
তানহা বলে উঠলো,
“আরে এসব ছাড়। জলদি উঠ। মা ডাকছে সবাইকে। সকাল সকাল রেডি হতে বলেছে। আজ আমরা কিসে করে যাবো জানিস!”
“কিসে করে?”
“আজ আমরা স্যালোর নৌকায়(মটরে চালিত নৌকা) যাবো।”
আদ্রিতা উৎসাহে লাফিয়ে উঠে বসে বলল,
“সত্যিই!! ওয়াও!”
“হ্যাঁ সত্যি। প্রথমে অবশ্য গাড়িতেই যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ভাইয়া বলল,আমরা গ্রামীণ লোকদের মতোই স্যালোর নৌকায় যাবো। শহুরে ব্যক্তিদের জন্য নতুন একটা এক্সপেরিয়েন্সও হবে। পরে সেটাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাঁচটা স্যালোর নৌকা ভাড়া করা হয়েছে।”
“ইয়েএএএ কি মজা! কত্তো মজা হবে!”
“হ্যাঁ মজাতো হবেই। এখন তাড়াতাড়ি উঠে খেয়েদেয়ে রেডি হ।দুপুরের ভেতরই সবাইকে রেডি হয়ে নদীর ঘাটে যেতে হবে।”
“আরে আমি তিন সেকেন্ডর মধ্যেই রেডি হয়ে আসছি।”
সানভি অবাক হয়ে বলল,
“তিন সেকেন্ডে রেডি হওয়া যায় বুঝি! আমারতো তিনদিন আগে থেকে শুরু করলেও শুধু চোখটাই সাজানো হয়।”
আদ্রিতা বিড়বিড় করে বলল,
“সবাই তো আর তোর মতো এক্সট্রা অর্ডিনারী এলিয়েন না।”
__
যোহরের পরপরই সবাই রেডি হয়ে নদীর ঘাটে এলো। যেখানে পাঁচটা স্যালোর নৌকা এক লাইন করে ভিড়ানো আছে। নৌকার উপর সামিয়ানা টাঙিয়ে ছাউনির মতো করে দেওয়া হয়েছে। রঙিন কাগজে সজ্জিত সব নৌকা। একটাতে বড় বড় মিউজিক সিস্টেমও রাখা হয়েছে। এসব দেখে খুবই এক্সাইটেড আদ্রিতা। নৌকায় পিকনিক করার মতো ফিল হচ্ছে তার। লঞ্চের চাইতে এমন খোলা নৌকায় জার্নির মজাই আলাদা। আর বিয়ের অনুষ্ঠান হলেতো মজা আরও চারগুণ বেড়ে যায়। আদ্রিতা উত্তেজনায় ফুলে উঠছে। নৌকায় উঠার জন্য আকুপাকু করছে সে। কিন্তু নৌকা অনেকটা উঁচু। তাই একা উঠতে একটু ভয়ও হচ্ছে তার। তাই আগে অন্যদের উঠার অপেক্ষা করছে যাতে কেউ ওর হাত ধরে তুলতে পারে।
নদীর ঘাটে গ্রামের লোকজন গোসল করছে। তারা সবাই ওদের দিকেই উৎসুক নজরে তাকিয়ে আছে। নদীতে কয়েকটা মেয়েও গোসল করছে। তারা সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তা দেখে কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা তাসান বাঁকা হেঁসে বলে উঠলো,
“বুঝলি অপু, বেশি হ্যান্ডসাম হয়েও মুশকিলে পড়ে গেছি। দেখনা মাইয়া গুলা কেমনে তাকাইয়া আছে। মনে হচ্ছে এখুনি আমাকে পানির নিচে টেনে নিয়ে পানি ঘোলা করবে। আমার এত রুপ কোথায় লুকিয়ে রাখি আমি বলতো”
অপরাহ্ন বলে উঠলো,
“ওই ভবের কাঙ্গালি, হুদাই তালগাছে উঠিসনা। নাইম্মা আয় নিচে। একবার পেছনে তাকা। মেয়েগুলোর ব্যাকুলতার কারণ তুই না। অন্য কারোর রুপে ঘায়েল হচ্ছে তারা।”
অপরাহ্নের কথায় তাসান আর বাকিদের মতো আদ্রিতাও পেছনে ফিরে তাকালো। মেয়েগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণকারী আর কেউ নয়, স্বয়ং নিবিড়। যে এমুহুর্তে আকাশী কালারের শার্টের উপর নেভি ব্লু কালারের হাতা কাটা কোট আর নেভি ব্লু প্যান্ট পড়ে এদিকেই আসছে। ফয়সালের সাথে কি যেন কথা বলতে বলতে আসছেন উনি।তাকে দেখে আদ্রিতা নিজেও বুঝি ওই মেয়েগুলোর কাতারেই সামিল হয়ে গেল। গোপন দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। লোকটার উপর মেয়েদের নজর পড়তে পড়তে একদিন গায়েবই হয়ে যাবে নির্ঘাত। তবে নিবিড়ের কোটে আদ্রিতার কেনা ব্রুসটা লাগানো দেখে অনেকটাই অবাক হলো সে।এটা উনার কাছে কখন গেল! তারপর ভাবলো হয়তো সেদিন উনার ঘরেই ফেলে এসেছিলাম। যেভাবেই হোক,এটাযে সে ব্যবহার করেছে তাতেই ভালো লাগছে আদ্রিতার।
সবাই এবার নৌকায় উঠা শুরু করলো। ইয়াংস্টাররা সব মিউজিক সিস্টেম ওয়ালা নৌকায় উঠবে। বাকিরা অন্য নৌকায়। আদ্রিতা উঠার জন্য নৌকার কাছে আসতেই উপর থেকে জোভান হাত বাড়িয়ে দিলো। আদ্রিতা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল যেন। আরচোখে তাকিয়ে দেখলো তার থেকে কিছুটা দূরে নিবিড় ফিরোজের সাথে কথা বলছে। তবে তার একটা সত্তা যে সর্বক্ষণ আদ্রিতার উপরই থাকে তা একটু হলেও বুঝে গেছে আদ্রিতা। সে দ্রুত কদম পিছিয়ে নিয়ে অযুহাত দেখিয়ে বলল,
“আরে আমি এখন উঠবোনা। সোণা মায়ের কাছে একটু কথা আছে তারপর উঠবো। আপনি গিয়ে বসুন না।”
জোভান বলল,
“আচ্ছা কথা বলে আসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার।”
আদ্রিতা বিরক্ত মনে সরে এলো। জোভানের উপর রাগ হচ্ছে তার। কেন অপেক্ষা করতে হবে তার! সে ছাড়া কি কেউ নেই আদ্রিতার! লোকটা না সরা পর্যন্ত আদ্রিতা উঠতেও পারছেনা। অন্য দিকে এসে দাঁড়িয়ে রইলো সে। নিবিড়ের সাথে কথা বলা শেষে ফিরোজ ইয়াংস্টারদের নৌকার সামনে এসে জোভানের উদ্দেশ্যে বলল,
“জোভান,তিন্নি অনেক কান্না করছে। সে তোমার কোলে যাবে বলে জিদ করছে। গিয়ে একটু দেখোনা ভাই। এই নৌকায় লাউড মিউজিক বাজবে। বাচ্চাদের থাকা ঠিক হবে না। তুমি একটু ওই নৌকায় গিয়ে ওর কাছে বসবে প্লিজ।”
জোভান বেচারা যেন আবারও মাইনকার চিপায় পড়ে গেল। দুলাভাইয়ের কথা রাখতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“ঠিক আছে দুলাভাই যাচ্ছি আমি।”
জোভান নেমে গেল নৌকা থেকে। তখনই নিবিড় এগিয়ে এসে আদ্রিতার হাত ধরে বলল,
“চল।”
বলেই নৌকার দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। জোভানের এভাবে হঠাৎ অন্য নৌকায় যাওয়ার পেছনে যে নিবিড়ের কুটিল ষড়যন্ত্রের হাতসহ পুরো বডি আছে তা যেন খুব করেই বুঝতে পারলো আদ্রিতা। নিবিড় হাত ধরে আদ্রিতাকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠলো। নৌকার মাঝে পাটি বিছানো হয়েছে বসার জন্য। নিবিড় পাটির উপর বসে মৃদু করে গলা খাঁকারি দিলো। আদ্রিতা যেন তার ইশারা বুঝতে পারলো। এবং তার ইশারা অনুযায়ী আদ্রিতা নিবিড়ের পাশেই গিয়ে বসলো। বাকিরাও একে একে সবাই যার যার মতো স্থান গ্রহন করে বসে পড়লো। তানহা বসতেই একটু পরেই তার পাশে অপরাহ্নকে বসতে দেখলো সে। তা দেখে তার বুকের দুরুদুরু ভাব আবার শুরু হয়ে গেল। আজকাল এই লোকটা আশপাশ থাকলেই তার এমন হয়। তবে তানহা এটাও অনুভব করেছে যে লোকটার আবহ তাকে এক ধরনের ভালো লাগাও দেয়। যে ভালো লাগার অনুভূতি তানহার জন্য নতুন। যে অনুভূতিতে জড়াতে তানহার অনেক ভয় হয়। অনেক ভয়।
নৌকা স্টার্ট হতেই শো শো করে পানির উপর দিয়ে চলতে শুরু করলো। সেই সাথে শো শো বাতাসও লাগা শুরু হলো।ধীরে ধীরে মাস্তি শুরু হয়ে গেল ফুল দমে। মিউজিক প্লেয়ারে ফুল ভলিউমে গান বাজনা শুরু হয়ে গেল। নৌকার উপরই নাচগান করতে লাগলো সবাই। সবাই মিলে ঠেলে তাসানকে নাচতে পাঠাল। তাসান মাঝখানে এসে,মমতাজের গান ♬ পোলাতো নয় একখান আগুনেরই গোলা রে……গানটাতে উড়াধুড়া এলোপাতাড়ি নেচে, নাচের মা বোইন করতে লাগলো। তার বিশ্ব কুখ্যাত নৃত্য প্রদর্শনী দেখে নৌকার দর্শকমণ্ডলী হাসতে হাসতে লুটোপুটি। নদীর দুই ধারের মানুষও তাদের কান্ড দেখলো। হাসি আনন্দ আর উল্লাসের মধ্যেই ওরা ফাইজার শশুর বাড়ি এসে পৌছাল। তারপর এলো খাবার দাবারের পালা। খেতে বসতে গেলেই তাসান সেই লুট করা গুন্ডি মেয়ে তাসলিমাকে দেখতে পেল। বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে গেল তার কাছে। তার পাশে বসে বলল,
“হাই বেবি,আমাকে নিশ্চয় অনেক মিস করছিলে বুঝি! ওয়েল,আমি ব্যক্তিটাই এমন। কেউ চাইলেও ভুলতে পারেনা। বিশেষ করে মেয়েরা।”
তাসলিমা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“ও প্লিজ! আমার এতো খারাপ দিনও আসেনি যে আপনাকে মিস করবো। দুনিয়াতে আপনি শেষ ছেলে হলেও কখনো আপনাকে মনে করবোনা।”
“আরে এতো ভাও খাচ্ছ কেন! নিজেকে কি বয়লার মুরগী ভাবো নাকি!”
“হোয়াট!”
“আরে হোয়াইট, ব্লাক ছাড়ো। আচ্ছা একটা প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারবে!”
“কি?”
“দুজন লোক রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। একজনের নাম ” আই লাভ ইউ” আরেকজনের নাম “আই লাভ ইউ টু”। হাঁটতে হাঁটতে ” আই লাভ ইউ টু” গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। তাহলে ওখানে থাকলো কে?”
তাসানের ট্রিক বুঝতে না পেরে তাসলিমা ফটাফট জবাব দিয়ে দিলো,
“আই লাভ ইউ।”
তাসান খুশিতে গদগদ সুরে বলল,
“আরে আরে কি করছ! এভাবে সবার সামনে বলতে হয় নাকি। বুঝতে পারছি তুমি আমার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছ। চিন্তা কোরোনা। আমি তোমাকে অবজ্ঞা করবোনা৷ তোমাকে আমি এখন এই মুহূর্তে সজ্ঞানে গ্রহণ করিলাম। আজ থেকে তুমি আমার জান,প্রাণ,কলিজা,ফোপরা সব। চলো এখন বাচ্চার প্ল্যান করি।”
তাসলিমা বিরক্তিতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“ইউ আর এ ম্যাড। টোটালি ম্যাড।”
“শুধু তোমার প্রেমে পাগল, প্রিয়া।”
তাসলিমা আর পেরে না উঠে বিরক্ত হয়ে চলে গেল। আবারও হাসলো আবির।”
তানহার প্রচুর ঝাল ধরেছে। আজকের খাবারে অনেক বেশি ঝাল ছিলো। তানহা বেশি ঝাল সহ্য করতে পারে না। শ্বাস টেনে আসে তার। এখনো তেমনই হচ্ছে। আজ যদিও ইনহেলার সাথে এনেছে। তাতে শ্বাস প্রশ্বাস কিছুটা ঠিক হলেও ঝালে ওর চোখ,নাক, ঠোঁট সব লাল হয়ে গেছে। মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে পারলে হয়তো একটু ভালো লাগতো। কিন্তু এখানে শুধু দই আছে। তানহা আবার দই খেতে পারেনা।দই খেলেই তার বদহজম হয়। তাই ছোট থেকেই সে দই খায়না। বাড়ির ভেতর হয়তো মিষ্টি আছে। কিন্তু সেটা চাইতেও তানহার ভীষণ লজ্জা করছে। আজ ওর মা-ও আসেনি। আর ফাইজা আপুতো বঁধুবেশে বসে আছে। তাকেও বলতে পারছেনা। এদিকে ঝালে করুন অবস্থা তার। চোখে পানি চলে এসেছে।ভীড় থেকে বেড়িয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় এসে হাঁটছে আর বারবার পানি খাচ্ছি তবুও কাজ হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তার সামনে কেউ মিষ্টির প্লেট এগিয়ে দিলো। তানহা একটু চকিত নজরে তাকিয়ে দেখলো অপরাহ্ন প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে। তানহা হালকা বিস্মিত চোখে একবার প্লেট আর একবার অপরাহ্নের দিকে তাকালো। অপরাহ্ন স্মিথ হেঁসে বলল,
“আরে ওই হয়েছে কি।আসলে আমার না অনেক মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছিলো। আমি আবার খুব মিষ্টিখোর। তাই লোভ সামলাতে পারিনি। প্লেট ভর্তি মিষ্টি নিয়ে চলে এসেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি একা একা খেয়ে বোর হয়ে গেছি। কেউ একটু আমার খাওয়ায় কোম্পানি দিলে খুশি হতাম। তুমি একটু কোম্পানি দিবে প্লিজ! “
অপরাহ্নের কথায় তানহার চাহুনি যেন আরও তীক্ষ্ণ হলো। সে মুখমন্ডল দৃঢ় স্থির করে বলল,
“আপনি ডাক্তার অনেক ভালো হলেও মিথ্যে কথা বলায় একেবারেই বাজে। আপনি এসব আমার জন্যই চেয়ে নিয়ে এসেছেন তাইনা! কিন্তু কেন? আর আপনি কীভাবে জানলেন আমার এখন মিষ্টির প্রয়োজন! “
অপরাহ্ন ফিচেল হেঁসে মাথা চুলকে বলল,
“আসলে তখন খাবার সময় খেয়াল করেছিলাম তোমার ঝাল লেগেছে। একারণে তুমি খাবার রেখেই উঠে এসেছিলে। তাই আরকি…. দেখ রাগ কোরোনা প্লিজ। নতুন দুলাভাইকে তার বউয়ের কাছ থেকে টেনে তুলে তাকে বলিয়ে মিষ্টি নিয়ে এসেছি। আমার জন্য না হলেও বেচারা দুলাভাইয়ের সেক্রিফাইজের জন্য হলেও খাও প্লিজ। নতুন বর হয়ে পাঁচ মিনিট বউ থেকে দূরে থেকেছে। তার এতবড় আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া কি ঠিক হবে বলো।!”
তানহার ভীষণ হাসি পেল। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে মুখ টিপে খানিক হাসলও সে।তারপর আবার স্বাভাবিক মুখ করে বলল,
“এসবের কোনো দরকার ছিল না। দুলাভাইয়ের এতবড় আত্মত্যাগের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকবো কীভাবে আমি! যাইহোক, এত কসরত করে এনেছেন যখন না বলি কীভাবে। দিন। “
অপরাহ্ন খুশি হয়ে একটা চেয়ার টেনে তানহাকে বসতে দিলো। আর সামনেরটাতে নিজে বসে মিষ্টির প্লেট এগিয়ে ধরলে তানহা মিষ্টি একটা নিয়ে খেয়ে নিলো। ঝাল কিছুটা কমলো তখন। আরও একটা হাতে নিয়ে বলল,
“আত্মত্যাগের প্রতিদান দেওয়ার ভাগ কিছুটা আপনিও নিন। এতগুলো আমি তিন জনমেও খেয়ে শেষ করতে পারবোনা।”
অপরাহ্ন মুচকি হেঁসে বলল,
“আরে আমিতো তোমার বলার অপেক্ষায়ই ছিলাম। দেখ কীভাবে প্রতিদান দেই।”
বলেই অপরাহ্ন একটা মিষ্টি হাতে নিয়ে তানহার মিষ্টির সাথে টোকা দিয়ে “চিয়ার্স” বলে খাওয়া শুরু করলো। মুচকি হাসলো তানহা৷ তার এই হাসিমাখা মায়াবী মুখটা আবারও প্রতিহত করলো অপরাহ্নের হৃদকুঞ্জকে।
__
আদ্রিতা তিন্নির পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে।জুহি ফাইজার লাগেজ গোছাতে গেছে। ফাইজা আর তার বরকে সাথে নিয়ে যাবে আজ সে কারণে। তাই তিন্নিকে আদ্রিতার কাছে দিয়ে গেছে। দস্যু মেয়েটা তখন থেকে তাকে নিজের পেছনে ছোটাচ্ছে। আদ্রিতা হয়রান হয়ে গেছে প্রায়। ছুটতে ছুটতে প্যান্ডেলের বাইরের দিকে চলে এসেছে ওরা। যেখানে আম,কাঁঠালের গাছের মাঝে মানুষের বসার জন্য বাঁশের মাচা করা আছে। সেখানে দুজন লোক বসা আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে নিবিড় আর অপরাহ্ন বসা। কোল্ড ড্রিংকসের ক্যান হাতে নিয়ে খেতে খেতে দুই বন্ধু কথা বলছে। তিন্নি ততক্ষণে দৌড়ে আবার প্যান্ডেলের ভেতর ঢুকে গেছে। আদ্রিতাও ফিরে আসতে নিলেই হঠাৎ কিছু কথা কানে আসতেই পা থেমে গেল তার। অপরাহ্ন বলছে,
“আন্টি তোকে সেদিন না পাঠালে কি তুই আদৌও যেতিস! তোর কারণে সেদিন আদ্রিতার ভয় পেয়ে জ্বর উঠে গিয়েছিল। একারণেইতো আন্টি তোকে সেদিন তোকে কি মারটাই না দিলো। আবার বিদেশও পাঠিয়ে দিলো। দাদুন অসুস্থ অবস্থায় তোকে দেখতে না চাইলেতো হয়তো এখনো ফিরতি না তুই। আন্টির কথা অনুযায়ী তোকে আরও কয়েক বছর পর ফিরতে হতো। অন্তত অরির গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার আগেতো বোধহয় আসতে বলতোনা। তোর কি আন্টির উপর রাগ হতো এসব নিয়ে!”
নিবিড়ের প্রতিত্তোর এলো,
“আরে না। মায়ের উপর রাগ হয় নাকি। আমি জানি মা যা করেছে তার সন্তাদের ভালোর জান্যেই করেছে। হ্যাঁ প্রথম প্রথম একটু রাগ হয়েছিল। কারণ তখন ছোট ছিলাম। তবে সময়ের সাথে বুঝতে পেরেছি আমি। আর তাছাড়া আমি শুধু মায়ের কথার জন্যও যায়নি। আমি না চাইলে মা কখনও আমাকে পাঠাতে পারতোনা।”
“মানে!”
“মানে আমি নিজের ইচ্ছেতেই গিয়েছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম আমি এখন অরির থেকে দূরে না থাকলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবোনা। অরিতো ছোট, কিন্তু আমিতো নব তরুণ ছিলাম তখন৷ অরির বাড়তি বয়সের সাথে আমার নিজের মাঝেও কিছু পরিবর্তন ঘটছিলো। যা আমাদের জন্য ভয়ংকর কিছু হওয়ার ভয় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। বিশেষ করে অরির জন্য। আর একারণেই আমি তখন মায়ের কথা মেনে চলে গিয়েছিলাম।”
অপরাহ্ন দুষ্টু সুরে বলল,
“তো! এখন বুঝি আর ভয় নেই! নাকি বিদেশ গিয়া জেন্ডার পরিবর্তন করে ফেলেছিস! ওসব দেশেতো আবার এসব পপুলার।”
বলেই হাসলো অপরাহ্ন। নিবিড় কিছু প্রতিত্তোরে কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিতা চলে এলো ওখান থেকে। হঠাৎ তার মন কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। আসলে এটা বিষন্ন নাকি অন্য কিছু তা বুঝতে পারছেনা আদ্রিতা। শুধু বুঝতে পারছে তার হঠাৎ কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না। বুকের কোনে ব্যাথার অনুভব হচ্ছে।
আদ্রিতা দূর থেকে দেখলো তিন্নি তানহার কোলে আছে। সে আর সেদিকে গেল না। তার এখন নির্জনতা প্রয়োজন। আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফাইজার শশুর বাড়ির পুকুর পাড়ের দিকটায় চলে এলো সে। বিয়ে বাড়ি হওয়ায় সব জায়গাতেই লাইটিং এর আলো আছে। আদ্রিতা আস্তে করে গিয়ে ঘাট বাঁধা পুকুর সিমেন্টের বেঞ্চের উপর বসে পড়লো। তার মনের মাঝে নানান অনুভূতির জোড়ালো আওয়াজে ভারী হয়ে উঠছে হৃদয়। যে অভিমান কত বছর ধরে মনের মাঝে পুষে রেখেছিল তার অবস্থান আদৌও সঠিক কিনা তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে তার। নিজেকে অভিমানী করবে নাকি অপরাধী তাও জানা নেই তার। শুধু জানে তার পীড়ন ওই রুক্ষতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা মানবটার সামনে কেবলই হাস্যবস্তু। আদ্রিতা কি কখনও পারবে তার এক বিন্দুও সমতা করতে! এসব ভাবনার মাঝে কখন দুচোখ ভরে এলো তার তা টের পেলনা। একসময় তা গাল বেয়ে গড়িয়েও পড়লো।
এভাবে কতসময় বসে ছিলো আদ্রিতার নিজেরও খেয়াল নেই। খেয়াল এলো পেছন থেকে পরিচিত সেই মানবের ডাকে। যে অস্থির,উদ্বেগী কন্ঠে ডাকলো আদ্রিতাকে,
“পুতুল……!”
তার কন্ঠ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালো আদ্রিতা।ওইতো সেই মানব,যার চোখে মুখে এমুহূর্তে স্পষ্ট চিন্তা আর ভয়ের ছাপ বিদ্যমান। যেন কতশত ঘাবড়ে গেছে সে কোনো কারণে। আদ্রিতা আনমনা চোখে এক নজরে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।নিবিড় দ্রুত বেগে তেড়ে এলো আদ্রিতার কাছে। হাত ধরে টেনে তুললো। অগ্নি চোখের চাহুনি নিক্ষেপ করে তার দিকে চড় উঠাতে নিয়ে আবার হাত মুঠো করে, চোখ বুজে নিজেকে হয়তো সামাল দিলো। আদ্রিতা আগের মতোই শুধু একধ্যানে তাকিয়ে রইলো নিবিড়ের দিকে।যেন নতুন করে দেখছে আজ তাকে।চোখের শিরায় শিরায় সামিল করে নিতে চাচ্ছে তাকে। নিবিড় চোখ খুলে দুই হাতে আদ্রিতার দুই বাহু চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে তার সেই সুপরিচিত রাগী সুরে বলল,
“এই ইডিয়ট, এখানে কি করছিস তুই! জানিস কখন থেকে খুঁজছে সবাই তোকে! সবাই যাওয়ার জন্য বের হয়েছে অথচ ম্যাডামের খবর নেই। এখানে কি তোর পেত্নী জনগোষ্ঠীর সাথে মজলিশে বসেছিলি! মনতো চাচ্ছে এই পুকুরের পানিতে ছুঁড়ে রেখে যাই তোকে। তারপর এই পেত্নী জনগোষ্ঠীর সাথেই থেকে যাস। মানে আমাকে জ্বালানোর জন্য নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করিস তাইনা! আমাকে অশান্তিতে রাখার কসম খেয়েছিস তুই! আর কত জ্বা……”
নিবিড়ের বাকি কথা পূরণ হওয়ার আগেই হঠাৎ আদ্রিতা নিবিড়ের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিবিড়কে। মুহূর্তেই নিবিড়ের কথা বন্ধ হয়ে গেল। আদ্রিতা টের পেল নিবিড়ের শরীরের হঠাৎ ধমকিত ভাব।অনুভব করলো তার হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা। যা এমুহূর্তে খুব বেশিই দ্রুত চলছে যেন৷ আদ্রিতা আরও একটু মিশে গিয়ে হালকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো,
“জ্বালাবো আমি। অনেক জ্বালাবো। তবুও সব সইতে হবে আপনার। আমাকে রেখে যেতে পারবেন না। কখনো না।”
আদ্রিতা অনুভব করলো নিবিড়ের অশান্ত মনোভাব টা আচমকা একেবারে শান্ত নদীর মতো হয়ে গেল যেন। এবারে নিবিড়ও দুই হাতে আদ্রিতাকে নিজের বুকের মাঝে আবদ্ধ করে নিয়ে শান্ত সুরে বলল,
“তুই আসলেই একটা চরম লেভেলের ধান্ধাবাজ। আমার মতো মাছুম ছেলেটাকে কীভাবে নিজের জ্বালানোর খোরাক বানাচ্ছিস!”
আদ্রিতা রাগলোনা। বরং মুচকি হাসলো। সে জানে এই লোকটার সব রুক্ষতার মাঝে কমনীয়তার অধিকারী একমাত্র আদ্রিতা।
চলবে…….
(পর্ববর্তী পর্ব ৩টায়। সবাই একটু বেশি বেশি রেসপন্স করবেন। একদিনের যে রেসপন্স হতো তা দু ঘন্টায় পেলে আরও খুশি হবো।)