®মেহরুমা নূর
★নিবিড়ের নির্দয় কঠোরতার তীব্র অনলে দগ্ধ হয়ে আদ্রিতার দেহমন ভস্ম হয়ে যাচ্ছে প্রায়। আজ এক সপ্তাহ হতে চলল সেই রুক্ষ পুরুষের অদৃশ্য নির্মমতার। সাত দিন পার হয়ে গেছে তবুও ফিরেনি সে। আর না তার ফোন খোলা পাওয়া গেছে। নিজেকে একপ্রকার গুম করে ফেলেছে সে। যেন আদ্রিতার সামনে আসলে তার হাইট কমে যাবে। নাহলে চুল পড়ে যাবে। মানুষ এতটা কঠোর কীভাবে হতে পারে ভেবে পায়না আদ্রিতা। আয়রন ম্যানও তার সামনে তুলো ম্যান হয়ে যাবে।সে গর্ভে থাকতে সোণা মা,বোধহয় লোহা চাবিয়ে খেতো। নাহলে রক্ত মাংসের মানুষ এমন হতেই পারেনা। এখানে একজন তার দহনে পুড়ে কয়লা হচ্ছে অথচ সেই নিষ্ঠুরের কোনো ভাবাবেগ নেই। আদ্রিতার সবকিছু অসহ্য লাগছে। নাওয়া, খাওয়া সব অগোছালো হয়ে গেছে তার৷ একাই সারাবাড়ি মাতিয়ে রাখা মেয়েটা চুপসে গেছে যেন। কোনকিছু ভালো লাগে না তার৷ এরচেয়েতো ওই লোকের বকাঝকা, ধমকানোও ভালো ছিলো। অন্তত এমন গুমোট কষ্টতো হতোনা আদ্রিতার। আদ্রিতা আর নিতে পারছেনা এসব। এখনতো তারও খুব অভিমান হচ্ছে। সাথে রাগও হচ্ছে প্রচুর। সামনে পেলে নিবিড়ের সবগুলো চুল ছিঁড়ে টাক্কুবেল করে দেওয়ার মতো রাগ হচ্ছে। এই রাগের বহিঃপ্রকাশ না করতে পারলে শান্তি পাচ্ছে না আদ্রিতা। তাই নিবিড়ের উপরে জমা রাগের শিকার হিসেবে নিবিড়ের রুমই বেছে নিলো আদ্রিতা।চুপিসারে তার রুমে চারিদিকে নজর বোলালো। নিবিড়ের স্যানিটাইস করা ফকফকা,ঝকঝকা, নিট এন্ড ক্লিন রুম কম প্যাথলজি ল্যাব দেখে ভিলেনি হাসি দিলো আদ্রিতা। আমার সাথে ভাব দেখানো না! ভাবে কি সাহেবজাদা নিজেকে! রাগ কি শুধু উনার পার্সোনাল প্রোপার্টি নাকি! আজ দেখাবো আদ্রিতাকে রাগানোর ফল। মনে মনে এসব বলে আদ্রিতা নিবিড়ের রুমের পোস্ট ম,র্টা,ম করতে লেগে পড়লো। পুরো রুম এলোমেলো করে তছনছ করে ফেললো মুহূর্তেই। মনে মনে নিবিড়ের রুমটাকেই নিবিড় ভেবে ধোলায় করছে আদ্রিতা। বিছানা, টেবিল এলোমেলো করা শেষে নিবিড়ের কাবার্ড খুললো সে। কাবার্ডের খুলে কাবার্ডের কাপড়চোপড়ও এলোমেলো করা শুরু করলো সে। তখনই হাতে এলো নিবিড়ের শার্ট। মুহুর্তেই নাকে পেল সেই সুপরিচিত বিমোহিত করা সুবাস। হাত থেমে গেল আদ্রিতার। হাতে ধরে রাখা শার্টটা নাকের কাছে নিয়ে সুবাসটা আরও সুগভীর ভাবে গ্রহণ করলো নিজের শ্বাস প্রশ্বাসে। আদ্রিতার বিদ্রোহী সত্তাটা আবারও প্রতিহত হয়ে গেল তার আবেগী সত্তার সামনে। স্পর্শনেন্দ্রিয় হয়ে উঠলো আবারও হৃদয়-মন। ওই নির্দয় পুরুষটিকে খুব করে সামনে চাইছে মন। তার বুকে মাথা রেখে তার উষ্ণতা অনুভব করতে মন চাইছে।
আদ্রিতা নিবিড়ের শার্টটা কামিজের উপর দিয়ে নিজের গায়ে জড়ালো। শার্টটা শরীরের সাথে টেনে মিশিয়ে নিলো। এভাবে নিবিড়কে নিজের কাছে অনুভব করার ছোট্ট প্রয়াস তার। আরও কিছু কাপড়চোপড় ঘাটাঘাটি করতেই হঠাৎ একটা ডায়েরি গড়িয়ে পড়লো নিচ। আদ্রিতা নিচে ঝুঁকে সেটা তুলে নিলো। এটা দেখে বুঝতে পারলো নিবিড়ের পার্সোনাল ডায়েরি হবে হয়তো। কৌতুহল বশত আদ্রিতা নিবিড়ের বিছানায় বসে ডায়েরিটা মেলে ধরলো। ডায়েরির মলাট উল্টাতেই একটা ছবি বেড়িয়ে এলো। ছবিটি পুরনো। ছোট্ট একটি মেয়ের ছবি। এটা যে আদ্রিতার ছোট বেলার ছবি তা কতক্ষণ দেখার পর বুঝতে পারলো সে। ডায়েরিটা হয়তো নিবিড় ভাইয়া বিদেশ যাওয়ার পর থেকে লিখেছে। প্রথম পেইজ উল্টাতেই দেখলো তাতে লেখা আছে,
“আমার নিঃশ্বাসটাও কেন এতো অবাধ্য বলতে পারিস, পুতুল! আজ এক সপ্তাহ হলো সে আমার প্রতি বিরাগী হয়েছে। অচিন শহরের অপরিচিত বায়ুতে কেন সে তুই নামক অক্সিজেন চায়! যে বায়ুতে তোর সুবাস নেই সেখানে কেন সে বিস্তার করতে চায়না! কেন আমার সর্বস্ব তোর বাধ্যের দাস করে রেখেছিস! গুণে গুণে সব অত্যাচার কেন আমাকেই করিস তুই!”
আরেক পেইজ উল্টালো আদ্রিতা।সেখানে আছে,
“তোর উপর আমার অনেক রাগ, পুতুল। তুই কেন এতো নির্দয়!কেন আমার অনুপস্থিতি তোকে বিচলিত করেনা! কেন আমার নিঃসঙ্গতা তোকে ব্যাথিত করেনা! এমনিতেতো নিজের একটা খেলনা ভেঙে গেলেও কেঁদে কে,টে সারাবাড়ির ঘুম হারাম করে দিস।অথচ আমার বিয়োগ তোকে কাঁদায় না কেন! কেন আমাকে ছাড়া হাসিছ তুই! তোর হাসি সহ্য হয়না আমার। নিজের সাথে লড়তে লড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে একটু শান্তির আশায় বাড়িতে ফোন করি তখন কেন তুই আমার সামনে এসে কথার ঝুলি ছড়িয়ে একটু শান্তি দিসনা! একবার কেন জোর দেখিয়ে বলিসনা, ‘আমি আপনার সাথে কথা বলবো।’ আমাকে ছাড়া তোর ভালো থাকাটা আমার সহ্য হয়না।ইচ্ছে করে তোকে আঘাত করে খুব করে কাঁদাতে। কিন্তু দেখ সেটাতেও আমি অপারগ। আমাকে ছাড়া তোর ভালো থাকাটা আমার সহ্য হয়না অথচ আমার সব দোয়াতেই শুধু তোর ভালো থাকা কাম্য। কারণ তোর ভালো থাকাটা না যত পোড়ায়, তোর খারাপ থাকাটা আরও অসম্ভব হারে পোড়ায়।আমাকে ছাড়া তোর হাসাটা খারাপ লাগে অথচ তোরা কান্নাটা আরও বেশি খারাপ লাগে। যে খারাপ লাগার অনুভূতি বয়ান করার ভাষা কোন ব্যাকরণেও নেই।”
আরেক পেইজ,
“তুই কতটা ভয়ংকর তা তুই নিজেও জানিসনা,পুতুল। আমার জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর বস্তু তুই। জানিস আমার বন্ধুর দেওয়া চ্যালেঞ্জ জিততে অন্ধকার রাতে শ্মশান থেকে একা একা অনায়াসে ঘুরে এসেছি। অথচ আমার সেই বন্ধুরা যদি জানে আমার মতো এমন দুঃসাহসিক মানবের ভয় বাস করে সূদুর বাংলাদেশে থাকা এক পিচ্চি বালিকার মাঝে। তাহলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করে সাথে সাথে ম,রে যাবে। তাদের বিশ্বাসই হবে না, এই লৌহমানবও ভয় পায়। তোকে হারানোর ভয় তার রাতের ঘুম উড়িয়ে দেয়। কত কত রাত জেগে কাটাতে হয় তাকে।”
এতটুকু পড়ে আর পড়তে পারলোনা আদ্রিতা। ডাইরির সবটা জুড়েই শুধু ওই মানবের অব্যক্ত অনুভূতির বসবাস। আদ্রিতা ঠাস করে বন্ধ করে ফেললো। দুচোখে নামলো আবারও অঝোর ধারা। নিজেকে ভীষণ রকম অপরাধী মনে হচ্ছে তার।ডাইরিটা বুকে চেপে ধরে কাঁদতে কাদতে বিড়বিড় করে বলল,”আমিতো আপনারই ছিলাম আর আপনারই আছি। সেই অনুভূতির সূচনাকাল থেকেই এই মনে শুধু আপনারই বাস। প্লিজ ফিরে আসুন একবার। আপনার পুতুল আপনার অপেক্ষা করছে।”
__
অপরাহ্নের ক্লিনিকে এসেছে তানহা। কাল থেকে ঠান্ডা সর্দির ভাব হয়েছে তার। সেটাই দেখাতে এসেছে। যদিও এটা তার নিজস্ব বিশ্লেষণ। কিন্তু তার ভেতরের অন্য সত্তা মুখ ভেঙিয়ে যেন বলছে,”ঢং করছিস কেন! তুই যে এখানে ওই ডাক্তারকে দেখতে এসেছিস তা মানছিস না কেন! এসব সর্দিকাশিতো জাস্ট অযুহাত।” তানহা তার সত্তার কথায় ধরা খাওয়া চোরের মতো নাকোচ করে দিয়ে বলছে,”কি যা তা বলছিস! এমন কিছুই না। আমি শুধু অসুস্থতার জন্যই এসেছি।” ভেতরের সত্তাটা যেন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “আচ্ছা! তা শেষ কবে তুই এই সামান্য সর্দির জন্য ডাক্তার দেখিয়েছিস বলতো! আমার যতদূর মনে আছে তুই তো মায়ের কাছ থেকেও ঔষধ খেতে চাইতিনা। মা জোর করে তোকে খাইয়ে দিতো।” তানহা এবার রাগ দেখিয়ে বলল, “এই তুই যাতো। নিজের কাজ কর গিয়ে। শুধু শুধু আমার মাথা খাস না।” তানহার সত্তাটা যেন খুব মজা পেয়ে তানহাকে দেখিয়ে দেখিয়ে হাসলো।
তানহা রিসিপশনিস্টের কাছ থেকে জানতে পারলো অপরাহ্ন কেবিনেই আছে। তানহা কেবিনের সামনে আসলে দরজার বাইরের পিয়ন তাকে বলল,ভেতরে লোক আছে আপনি বসে অপেক্ষা করুন। তানহা মাথা নেড়ে কেবিনের বাইরে রুগির বসার জন্য সারি করে রাখা চেয়ারে বসলো। যেখানে বসলো সেখানে কেবিনের জানালা। তানহা বসতেই হঠাৎ তার কানে উচ্চস্বরে মেয়েলি হাসির আওয়াজ এলো। হাসির উৎস খুঁজতে এদিক ওদিক তাকাতেই জানালার ওপাশে অপরাহ্নের কেবিনে নজর পড়লো তার। যেখানে অপরাহ্নের সামনের চেয়ারে একটা অতি সুন্দরী মেয়ে বসে আছে।মেয়েটা অনেকটা স্টাইলিশ আর ফ্যাশনেবল, তা তার পোশাক পরিধানে প্রতীয়মান হচ্ছে। হাসির শব্দও এখান থেকেই আসছে। তানহার কেমন উসখুস ফিলিংস হলো। মেয়েটা কে তা জানার কৌতুহল জাগলো। কোন রুগী তো আর এভাবে হাসবেনা। নিশ্চয় পরিচিত কেউ হবে। জানালার পাশ থেকেই তাদের কথপোকথন শোনা যাচ্ছে। মেয়েটি বলছে,
“তুমি কিন্তু ডাক্তার হওয়ার সাথে আরও বেশি হ্যান্ডসামও হয়ে গেছ। আমি কিন্তু এখনো সিঙ্গেল আছি। সো চাঞ্চ নিতে পারো। রাজি হতেও পারি। আফটার অল আমিও ডাক্তার। একই প্রফেশনে হলে আন্ডারস্ট্যান্ডিও ভালো থাকবে। কি বলো!”
মেয়েটির কথায় উচ্চস্বরে হাসলো অপরাহ্ন। তারপর বলল,
“প্রস্তাবের জন্য শুকরিয়া। তবে আমিতো এখনো বাচ্চা মানুষ। এসব বিয়ে শাদির করার বয়স হয়েছে নাকি আমার!”
“এখনো বদলালেনা তুমি। রমনীর মন নিয়ে খেলাতো কেউ তোমার কাছ থেকে শিখুক। ভার্সিটিতে আমার মতো আরও কত নারীর মন নিয়ে খেললে। সেই প্লে বয় অভ্যস তোমার এখনো গেলোনা।”
অপরাহ্ন আবারও খানিক হাসলো।মেয়েটা আবার বলল,
“তা বিয়ে শাদি কি করবে, নাকি সারাজীবন খেলেই যাবে।”
“সময় আসুক দেখা যাবে।”
“জানো আমারনা জানতে ইচ্ছে করে কে তোমার বউ হবে। সে নিশ্চয় কোন সেরা কেউ হবে। কারণ তোমার সাথে যাকে তাকে মানবেও না। সবচেয়ে বেস্ট আর বেটারই হবে সে।”
“হুম, তাতো অবশ্যই। অপরাহ্নের জীবনসঙ্গী নিসন্দেহে সেরাই হবে। সবচেয়ে স্পেশাল সবচেয়ে বেস্ট।সে হবে শ…….”
বাকি কথা শোনার জন্য আর বসে থাকার ধৈর্য হারিয়ে ফেললো তানহা। হঠাৎ যেন কেমন বুকের মাঝে চিনচিন ব্যাথার যাতনা শুরু হলো। আর এক মুহুর্তও আর বিলম্ব না করে দ্রুত উঠে চলে গেল সে। দরজার পাশে কর্মরত পিয়ন পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলো তবুও ফিরে তাকালোনা তানহা। এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে গেল সে।
আরও কিছুসময় পর মেয়েটা অপরাহ্নের কেবিন ত্যাগ করলো। মেয়েটা যেতেই অপরাহ্ন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। মেয়েটা ভার্সিটি থেকেই অপরাহ্নকে অনেক ইশারা ইঙ্গিতে তার প্রতি আকর্ষিত করতে চেয়েছে। কিন্তু অপরাহ্ন পাত্তা দেইনি। আজ ডক্টরদের একটা কনফারেন্সে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। সেখান থেকেই ওর সাথে একপ্রকার জোর করেই এখানে এসেছে। তার মনকামনা ভালো ভাবেই জানে অপরাহ্ন। মেয়েটা খুবই ধূর্ত। তাইতো তাকে তাড়ানোর জন্য হাবিজাবি বলেছে তখন। নাহলে কিছুতেই পিছু ছাড়তোনা। মেয়েটা যেতেই পিয়ন এসে বলল,
“স্যার আপনার সাথে এক ম্যাডাম দেখা করতে এসেছিল।”
“কে?”
“ওইযে, যে ম্যাডাম আগেও কয়েকবার এসেছে।শ্যামলা করে চশমা পড়া মেয়েটা।”
পিয়নের বলা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ব্যক্তিটি কে তা বুঝতে পেরেই অপরাহ্ন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
“তানহা এসেছে! কোথায়! ভেতরে পাঠাও।”
“এসেছিল মিনিট দশেক আগে। ভেতরে লোক ছিল দেখে আমি তাকে বসতে বলেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কেন যেন চলে গেলেন উনি। কিছু বললও না।”
অপরাহ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“চলে গেছে মানে! এখানে এসেছিল তাহলে হঠাৎ চলে গেল কেন! আর তুমি আমাকে আগে কেন বললে না!”
“সরি স্যার। আসলে কেবিনে লোক ছিলো তাই..”
“তো কি হয়েছে! ভালো করে শুনে রাখো। এরপর তানহা যখনই আসুক সোজা আমার রুমে পাঠাবে। অন্য কোথাও বসাবে না।বুঝতে পেরেছ!”
“জি স্যার।”
“ঠিক আছে যাও এখন।”
অপরাহ্ন একটু চিন্তায় পড়ে গেল। মেয়েটা এসেছিল তাহলে হঠাৎ চলে গেল কেন! কিছু হয়নিতো ওর! অপরাহ্ন ফোন করলো তানহার নাম্বারে। গ্রাম থেকে আসার পর থেকে তানহার সাথে তার যোগাযোগ, ভাবক্রিয়া অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। মাঝে মধ্যেই তাদের হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। তানহার কলেজেও মাঝে মধ্যে নানান অজুহাতে যায় সে। তানহার কলেজ ছুটি হলে তানহাকে বাইকে উঠিয়ে তার বাইকটাকে ধন্যও করা হয় মাঝে মধ্যে। যদিও সেটা করতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। মেয়েটা একটু বেশিই লাজুক আর অন্তর্মুখী স্বভাবের। তাইতো অপরাহ্নকে প্রচুর খাটতে হয় শ্যামকন্যার সান্নিধ্য পেতে। তাতেও খুশি সে। তার শ্যমককে নিজের শ্যামকন্যা করে পেতে সারজীবনও খাটতে রাজি সে। তার শ্যামকন্যা যে ব্যাক্তিটাই এমন। অমূল্য রতন। তাকে পেতে এটুকু খাটনিতো হাসিমুখে করতেই হবে। কিন্তু আজ হঠাৎ এখানে এসে আবার চলে গেল কেন! ফোন দিলে ফোনটাও রিসিভ হলোনা৷ কয়েকবার দেওয়ার পর হঠাৎ ফোন বন্ধ শোনা গেল। অপরাহ্নের চিন্তা আরও বাড়লো। মেয়েটা ঠিক আছে তো!
____
রাত তখন ১১ টা পেরিয়ে গেছে প্রায়। সবাই যার যার রুমে ঘুমুতে চলে গেছে। ঘুম নেই শুধু আদ্রিতার চোখে। তখন অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে নিবিড়ের এলোমেলো করা রুম আবারও গুছিয়ে দিয়ে এসেছে। তখন থেকেই বিষন্ন মনে ঘরে বসে আছে। কতক্ষণ বই খুলে বসলেও পড়ায় মন বসাতে অক্ষম হয়েছে। রাতের খাবারও ঠিকমতো খায়নি। বিষন্ন চোখে ঘুমও আসছেনা কিছুতেই। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ সাই করে একটা গাড়ি তাদের বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকতে দেখলো সে। গাড়িটা দেখেই আদ্রিতার চোখ মুখ চকচকে হয়ে উঠলো। ওটা যে নিবিড়ের গাড়ি। তারমানে নিবিড় ভাইয়া এসেছে।তা দেখে আদ্রিতার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটলো। স্ফূর্তি মনে সে উঠে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। লিভিং রুমে বর্তমানে কেউ নেই। আদ্রিতা বেল বাজানোরও অপেক্ষা করলোনা৷ বেশি উদ্দীপনায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। খুলে দিতেই সম্মুখে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখের দর্শন পেল আদ্রিতা। খুশি ছড়িয়ে পড়লো সবখানে যেন। নিবিড় ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ দরজা খুলে যাওয়ায় মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে কিছু মুহুর্তের জন্য থমকিত ভাব দেখা যায় তার মাঝে। তবে পর মুহূর্তেই চোখ সরিয়ে নিয়ে আদ্রিতাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল নিবিড়। আদ্রিতার মন খারাপ হলো। তবে আশা ছাড়লো না। এই ক্ষ্যাপা ষাঁড়কে আজ মানিয়েই ছাড়বে৷
আদ্রিতা রান্নাঘর থেকে কিছু খাবার ট্রেতে রেখে, ট্রে-টা নিয়ে নিবিড়ের রুমের দিকে এগুলো সে। নিবিড়ের রুমের দরজায় নক করে কয়েকবার ডাকলো তাকে। কিন্তু কোনো প্রতিত্তোর এলোনা। অগত্যা আদ্রিতা দরজা ঠেলে নিজেই ভেতরে ঢুকে গেল। নিবিড় ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজের ঘড়ি খুলছিল। আদ্রিতা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“নিবিড় ভাইয়া,আপনার জন্য আপনার জন্য খাবার এনেছি। খেয়ে নিন।”
নিবিড় আদ্রিতার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর, ভারী গমগমে গলায় বলল,
“খাবোনা আমি। তুই যা এখান থেকে।”
আদ্রিতা খাবারের ট্রে টেবিলের উপর রেখে অনঢ় কন্ঠে বলল ,
“তা বললে হয়! খেতেতো হবেই। সোনা মা,বলে রাতে না খেয়ে ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো না।”
নিবিড়ের মুখয়ব যেন ধীরে ধীরে কঠিন শক্ত হয়ে আসছে। সে চোয়াল চিবিয়ে বলল,
“তোকে যেতে বলেছি আমি অরি।”
আদ্রিতা এবার নিবিড়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে নমনীয় সুরে বলল,
“আমি জানি আমার উপর রেগে আছেন আপনি। তবে সত্যি বলছি আপনি ভুল বুঝছেন। একবার আমার কথাটা শুনুন৷”
নিবিড় চোখ বুজে মুঠো শক্ত করে রাগী সুরে আবারও বলল,
“অরি,জাস্ট গো।”
আদ্রিতা ভয় পেলেও দমে না গিয়ে বলতে থাকলো,
“দেখুন আমি ইচ্ছে করে জোভান ভাইয়ার সাৎে কথা বলিনি। উনি হঠাৎ ছাঁদে চলে এলো আর বলতে লাগ…..
এতটুকু বলতেই নিবিড়ের সব নিয়ন্ত্রণ যেন ছুটে গেল। সে তীব্র ক্রোধে ড্রেসিং টেবিলের উপরের সব এক হাত ঠেলে মাটিতে সজোরে ছুঁড়ে মেরে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,
” আই সেড গোওওওওও……”
নিবিড়ের হুংকারে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল আদ্রিতার। তবে সেটার অনুভব হওয়ার আগেই সে পায়ে তীব্র ব্যাথার অনুভব পেল। নিবিড়ের ছুঁড়ে মারা জিনিসপত্রের মধ্যে একটা কাচের পারফিউমের বোতলও ছিলো। সেটাই পড়ে ভেঙে গিয়ে কাচের টুকরো ছুটে গিয়ে আদ্রিতার পায়ে গেঁথে পড়েছে। যার দরুন আদ্রিতা ব্যাথা পেয়ে হালকা আর্তনাদ করে উঠলো। তা শুনে নিবিড় চমকে তাকালো আদ্রিতার পানে। রাগী চোখে হঠাৎই আতঙ্ক ছেয়ে গেল। আদ্রিতা ততক্ষণে পায়ের অসহনীয় ব্যাথায় নিচে বসে পড়েছে। নিবিড় ঝট করে তার সামনে বসে দুই হাতে আদ্রিতার মুখ ধরে বিচলিত হয়ে বলল,
“পুতুল, এই পুতুল কি হয়েছে!
নিবিড়ের চোখ গেল আদ্রিতার পায়ের দিকে। কাচ বিঁধে গেছে। র,ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। স্তব্ধ হয়ে গেল সে। তার শরীরের মৃদু কম্পন অনুভব করতে পারছে আদ্রিতা। চোখে মুখে তীব্র ভাই ভীতিও স্পষ্ট।
ঠিক তখনই তানি আর আবিরও দৌড়ে এলো। তানি জেগেই ছিলো। নিবিড়ের রুম থেকে ভাঙচুরের শব্দ শুনেই দৌড়ে এসেছে সে। আর তার পিছে আবিরও। তানি এসেই আদ্রিতাকে ওভাবে দেখে দ্রুত তার কাছে গিয়ে বসলো। আদ্রিাতার পায়ের অবস্থা দেখে তার বুঝতে বাকি রইলোনা কি ঘটেছে এখানে। সাথে সাথেই নিবিড়ের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তানি। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
” আবির দেখছ তো,এই নাকি তোমার ছেলে বদলে গেছে! এটাই তার নমুনা! আজ আমি শিওর হয়ে গেলাম। আমার ডিসিশন ভুল ছিলোনা। এই ছেলে অরির আশেপাশে থাকা মানেই ওরজন্য ক্ষতিকর। কোনদিন নিজের ক্রোধে তুই মেয়েটাকে মে,রেই ফেলবি।”
নিবিড় করুন সুরে বলল,
“মা…! পরে আমাকে যতখুশি মেরো। এখন প্লিজ পুতুলকে দেখতে দাও আমাকে৷ ওর পায়ে র,ক্ত ঝরছেতো..”
বলেই নিবিড় আদ্রিতাকে ধরতে নিলেই তানি তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“খবরদার! তুই ওর ধারে কাছেও আসবিনা একদম। আজকের পর তুই অরির আশেপাশেও আসবিনা। দরকার হলে আবার বিদেশ চলে যা। তবুও ওর থেকে দূরে থাক। অরির জন্য আমরা আছি। আমরা দেখে নিবো।”
এদের মা,ছেলের বিরোধের মাঝে আদ্রিতা আর আবির যেন নিরব দর্শক ছাড়া কোন ভুমিকাই খুঁজে পাচ্ছে না। তবে নিবিড়ের জন্য খারাপ লাগছে আদ্রিতার। যাই হয়ে যাক সেতো আর ইচ্ছে করে আঘাত করেনি তাকে। অন্তত এটুকুতো আদ্রিতা খুব করে বুঝে গেছে যে, নিবিড় ভাইয়া আর যত রাগই করুক তার সাথে। কিন্তু স্বজ্ঞানে বা অজ্ঞানে কখনোই আদ্রিতাকে ইচ্ছে করে আঘাত সে করবেনা। এটা তার পক্ষে সম্ভবইনা।
তানি আবিরের উদ্দেশ্যে বলল,
“আবির অরিকে জলদি রুমে নিয়ে চলো। আমি ডক্টর আঙ্কেল কে ফোন করছি।”
আবির মাথা ঝাকিয়ে আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিয়ে আদ্রিতার রুমে নিয়ে এলো। নিবিড়ও পিছে পিছে আসতে নিলে। তানি তাকে বাঁধা দিলো। রুমে ঢুকতে দিলোনা তাকে।
চলবে……..