®মেহরুমা নূর
★নিবিড় ডক্টরকে হয়তো চিনতে পারলো। তবে তার মুখমন্ডলে কেমন যেন হঠাৎ কেমন একটা অপ্রস্তুত ভাব দেখা গেল। কিছুটা জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
“আরে জেরিন তুমি! তা কেমন আছ! ডক্টর হয়ে গেছ দেখছি।”
জেরিন ফ্যাকাসে হেঁসে বলল,
“যাক অন্তত চিনতে তো পারলে। আর কেমন আছি সেটা নাই বা বলি। জেনেই বা কি করবে তুমি! যখন তোমার জন্য পাগল ছিলাম,তোমার জন্য মরতে গেছিলাম সেটাই কখনো জানতে চাওনি। তাহলে আর এটা জেনে কি করবে! বেঁচে আছি শুধু এটাই মনে আছে।”
জেরিনের কথাবার্তায় নিবিড়যে প্রচুর অস্বস্তিবোধ করছে তা তার চোখে মুখে স্পষ্ট। তবু্ও সে সৌজন্যতা বজায় রেখে বলল,
“প্লিজ জেরিন, ওসব ছেলেমানুষী ছিল। অল্প বয়সের পাগলামী। তাই সেসব মনে না করলেই বেটার হবে।শুধু শুধু অকওয়ার্ডনেস হবে। এমনিতেও তুমি নিজেকে অনেক ভালো একটা পজিশনে এনেছ। ডক্টর হয়েছ। দ্যাট ইজ রিয়েলি অ্যাপ্রিশিয়েটিং।”
এদের কথাবার্তার মাঝে আদ্রিতা নিজেকে খুবই অস্বস্তিকর অনুভব করছে। হঠাৎ করেই আদ্রিতা খেয়াল করলো ডক্টর জেরিন, মেয়েটা অত্যাধিক সুন্দর। যাকে বলে মারাত্মক রূপবতী। তার রুপের আগুনে যে কেউ ঝলসে যেতে পারে। আর এই অসাধারণ রূপবতী মেয়েটাই নিবিড় ভাইয়াকে চাইতো। শুধু চাইতো না, তার চাহুনি বলে দিচ্ছে সে এখনো চায়। উনি নিবিড় ভাইয়ার জন্য মরতে বসেছিল এটা কেন বলছে! তাদের মাঝে কিছু একটা তো ছিলো। সেটা কি তবে প্রেম ঘটিত কিছু! এসব মনে আসতেই আদ্রিতার মন হঠাৎ বিষন্নতায় ফেঁপে উঠল। অভিমানী মন ভীষণ পরিমাণ গুমরে উঠল। এদের কথাবার্তার মাঝে নিজেকে অযাচিত ব্যক্তি মনে হচ্ছে তার। আর অযাচিত ব্যক্তি হিসেবে আদ্রিতা মোটেও থাকতে চায়না৷
আদ্রিতা চলে যাওয়ার জন্য নিবিড়ের হাতের মাঝ থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু পারলোনা সে। হাত ছাড়াতে নিলে নিবিড় তৎক্ষণাৎ আরও শক্ত করে আদ্রিতার হাত চেপে ধরলো। আদ্রিতা তবুও ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো।অকারণেই হঠাৎ তার মাঝে ভীষণ রাগ আর জেদ কাজ করতে লাগলো। এখানে সে কোনমতেই থাকবেনা। তাই সর্বশক্তি দিয়ে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। আর নিবিড়ও হাত না ছাড়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর যেন। হাত মোচড়াতে মোচড়াতে হাতের কব্জি লাল হয়ে জ্বলন অনুভব হতে লাগলো আদ্রিতার। তবুও প্রয়াস ছাড়ছেনা সে। তখনই জেরিন বলে উঠলো,
“তো মিঃ নিবিড় শাহরিয়ার ফাইনালি বিয়েও করে ফেলেছ! তা বউতো দেখছি পিচ্চি মেয়ে। লাখ লাখ মেয়ের মন ভেঙে শেষমেশ কিনা বাল্যবিবাহ করলে!”
জেরিনের কথাটা যেন আদ্রিতার আত্মসম্মানে আঘাত হানলো। প্রতিবাদী সত্তাটা জাগ্রত হয়ে উঠল। রাগ,জেদ আর আত্মসম্মানবোধের সংমিশ্রণে প্রচন্ড রকম বাজে অনুভূতিতে আদ্রিতার মন মস্তিষ্ক তিক্ত হয়ে উঠলো। যার দরুন আদ্রিতা চোখ মুখ শক্ত করে দৃঢ় প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি উনার বউ না৷ উনি আমার চাচাতো ভাই। এখানে আমাদের দাদুন ভর্তি আছে তাকেই দেখতে এসেছি। ভুলে আপনার কেবিনে ঢুকে পড়েছিলাম।তাই আপনাকে দেখে মিথ্যে বলেছেন। সরি ফর দ্যট।”
একদমে কথাগুলো বলেই আদ্রিতা এবার সর্বশক্তি দিয়ে নিজের হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে ওখান থেকে সরে এলো। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো নিবিড় হয়তো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। থাকুক, আদ্রিতার এখন তা দেখার ইচ্ছেও নেই। মনটা ভীষণ রকম বিষন্ন হয়ে পড়ছে হঠাৎ তার। কান্না পাচ্ছে তার। তবে সে কাঁদবেনা। রাগী সত্তাটা তার কান্না বাইরে আসতে দিলোনা। আদ্রিতা নিজেকে সামলে নিয়ে দাদুনের কেবিনে এলো আবার।মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে আবিরের বাবা আহনাফ সাহেবের কাছে গিয়ে বসলো সে। মিনিট দুই এর ব্যবধানেই আদ্রিতা দেখতে পেল জনাবও এসে হাজির কেবিনে। চেহারায় উদ্বিগ্নের ছাপ। আদ্রিতা তাকে দেখেও দেখলোনা যেন। দাদার বাহু জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে বসে রইল সে। আরচোখে তাকিয়ে দেখলো নিবিড় কেমন রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একবার হাতে পেলেই খেয়ে ফেলবে অবস্থা। দেখুক,তাতে আদ্রিতার কি! আদ্রিতা তার হাতে ধরা দেওয়ার মুডে নেই এখন মোটেও।
রাত আটটার দিকে তুলি বেগমেকে রিলিজ দিয়ে দিলো। তখন বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সবাই। এর মাঝে নিবিড় অনেকবার আদ্রিতার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই আদ্রিতা তাকে এড়িয়ে গিয়ে অন্যদের সাথে মিশে গেছে। চোখের ইশারায় ডাকলেও তার তোয়াক্কা করেনি। এতে যে নিবিড়ের রাগের মাত্রা হাই হচ্ছে তাতেও ভ্রুক্ষেপ করছেনা আদ্রিতা। গাড়ির কাছে এসেও আদ্রিতা নিবিড়ের গাড়িতে না গিয়ে দাদা,দাদুনের সাথে যেতে চাইলো। কিন্তু তুলি বেগম অসুস্থ থাকায় তাকে পেছনের সিটে শুইয়ে নিয়ে যেতে হবে।তাই ওই গাড়িতে বসার জায়গা পেলনা সে। অগত্যা না চাইতেও নিবিড়ের গাড়ির কাছে এলো সে। নিবিড় চোখের ইশারায় আদ্রিতাকে সামনের সিটে বসতে বলল।কিন্তু আপাতত জেদি মুডে চলা আদ্রিতা নিবিড়ের ইশারা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পেছনের সিটেই গিয়ে বসলো। আদ্রিতা, সানভি, তানহা পেছনের সিটে বসলো। আর তাসান নিবিড়ের পাশে সামনের সিটে বসলো। গাড়ি স্টার্ট হতেই তাসান হঠাৎ বলে উঠলো,
“ধুরর,আজকের দিনটা একেবারে নিরামিষ গেল। হসপিটালে একটাও হট ফিমেল ডাক্তারতো দূরের কথা একটা সুন্দরী নার্সও দেখলাম না। সবগুলান জরিনা খালা টাইপ। আমারতো মুডে গ্যাস্টিক জমে গেছে।”
তাসানের কথায় সানভি আর তানহা হাসলো। তবে আদ্রিতা প্রতিত্তোরে বলে উঠলো,
“কি বলো ভাইয়া! হসপিটালে এত সুন্দরী ডক্টরকে তুমি আনদেখা করো দিলে! আমিতো এক মহা সুন্দরী ডক্টরকে দেখলাম। তার মতো সুন্দরী বাংলাদেশে আর আছে কিনা সন্দেহ। “
তাসান আচম্বিত ভঙ্গিতে বলল,
“কস কি বোইনা! আম্রে আগে কবিনা! আর একবার দেখাই দিলেইতো পারতি! এই ভাইডার জন্য এইটুকু করতে পারলিনা!”
“কি করবো ভাইয়া! আমি তোমার ভালো করতে গিয়ে তো আর আরেকজনের ঘর ভাঙতে পারিনা!”
“মানে!”
“আরে মানে হলো, সেই ডক্টর তোমাদের ভাবি হয়, ভাবি।আর ভাবিকে প্রেমিকা বানাতে চাইলে পাপ হবে পাপ। জি হ্যাঁ, ভাই এন্ড বোনেরা আজ আমি হসপিটালে তোমাদের সবার বড় ভাই, নিবিড় ভাইয়ার প্রেমিকাকে দেখেছি। সেকি সুন্দরী কি বলবো!”
তানহা আর সানভি একসাথে বলে উঠলো,
“সত্যিই বলছিস!”
“দুইশ পার্সেন্ট সত্যি। আরে তাদের প্রেমতো সেই কলেজ টাইমের। আজ এতদিন পর বিচ্ছিন্ন হওয়া দুই মনের মিলন হলো হসপিটালে। কি একটা সিন ছিল মাইরি। জাস্ট ফিদা হয়ে গেলাম। আমিতো আজ বাসায় গিয়েই সোজা সোনা মাকে বলব,সোনা মা, তোমার ছেলের বউ পাওয়া গেছে। আজ এক্ষুণি শুভকাজ সেরে ফেলো। আমরা এত সুন্দর ডক্টর ভাবি হাতছাড়া করতে চাইনা তাইনারে!
কথা শেষ করে একবার সামনের আয়নায় তাকাতেই দেখতে পেল নিবিড়ের অগ্নিশর্মা দুটি চোখ। রাগ যেন তার চোখ দিয়ে বেড়িয়ে আসছে। তবুও তাতে ভ্রুক্ষেপ করলোনা আদ্রিতা। চোখ নামিয়ে কিঞ্চিৎ ভেংচি কাটলো সে। তাসান নিবিড়ের উদ্দেশ্যে অতিব হতাশার সুরে বলল,
” এখানেও তুইই বাজি মেরে নিলি ভাই! আর কাউকে তো এই গরীব মিসকিনদের জন্য রাখ!”
নিবিড় এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“জাস্ট শাট আপ ইডিয়টস! অরি এক পাগল আর তার সাথে তোরাও পাগল হয়েছিস। দুনিয়াতে আর কাউকে পেলিনা ওই গাঁধিটার কথা বিশ্বাস করছিস! আরে ও নিজের মাথায় মগজ আছে নাকি কচুভর্তা আছে সেটাই আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলোনা। আর ওর কথা শুনে তোরা নাচছিস। বুঝতে পারছিনা এখানে কে বড় পাগল! আর অরি তুই , আর একটা। শুধু আর একটা ফালতু কথা বলে দেখ। তোকে যদি গাড়ি থেকে ছুঁড়ে না মেরেছি তো আমার নামও নিবিড় না।”
নিবিড়ের রাগ দেখে সবগুলো চুপসে গিয়ে। সাথে আদ্রিতাও। এই পর্যায়ে সত্যিই ভয়ে চুপ হয়ে গেল সে।
___
নূরান অনেকক্ষণ হলো নীলাম্বরীর আইডিতে ম্যাসেজ পাঠিয়ে বসে আছে। কিন্তু রিপ্লাই আসছে না। আইডিতে সবুজ বাতি জ্বলছে তবুও রিপ্লাই দিচ্ছে না দেখে একটু কেমন যেন লাগছে তার। এই কেমন লাগাটা রাগ নাকি অন্য কিছু তা ঠিক ঠাহর করতে পারছেনা। যদিও নূরানের রাগ খুব কমই হয়। বলতে গেলে হয়ইনা। রাগ তার স্বভাবে নেই। তবে নীলাম্বরীর সাথে কথা হওয়ার পর থেকে তার সব নিয়মই যেন অনিয়মে জর্জরিত হচ্ছে। তেমনি হয়তো এই রাগ নামক বস্তুটাও তার মাঝে দেখা দিচ্ছে। অপেক্ষার প্রহর শেষে নীলাম্বরীর রিপ্লাই এলো। সে লিখেছে,
“সরি,সরি.. আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম তো তাই রিপ্লাই দিতে পারিনি।”
নূরানের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটল। সে রিপ্লাই দিলো,
“ইটস ওকে। সরি বলতে হবে না। তা কি কাজে ব্যস্ত ছিলে শুনি!”
নূরানের ম্যাসেজের রিপ্লাইতে নীলাম্বরী যে রিপ্লাই দিলো তার জন্য নূরান মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সে লিখেছে,
“আসলে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছে আমাকে। তাদের সামনে ছিলামতো তাই।”
ম্যাসেজটা পড়ে নূরান কিছুসময়ের জন্য কেমন স্থির হয়ে গেল যেন। হঠাৎ করেই কেমন স্তম্ভিত হয়ে গেল সে। নূরান কখনো নীলাম্বরীকে সরাসরি আই লাভ ইউ বা ভালোবাসার অভিপ্রায় জাতীয় কিছু বলেনি। তবে অনুভূতির কিছু আলাপন করেছে তারা, যেগুলোয় নূরান ধারণা করেছিল নীলাম্বরীও তার মতোই অনুভব পোষণ করছে। কিন্তু আজ হঠাৎ এমন কথায় হতভম্ব হয়ে গেল সে। কিছুসময় থম মেরে বসে রইল সে। অনেকক্ষণ পর নীলাম্বরীর টেক্সট এলো। সে লিখেছে,
“হেই, কোথায় হারিয়ে গেলেন! আর বাইদা ওয়ে আমি কিন্তু মজা করছিলাম।”
সাথে অনেক গুলো হাসির ইমোজি দিলো। তা দেখে নূরানের হঠাৎ করে ভীষণ রকম মেজাজ খারাপ হলো। রাগে সে ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মারলো। দুই হাতে মাথার চুল চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে রইল সে। এই কয়েকটা সেকেন্ডে যে বাজে অনুভূতিটা সে অনুভব করেছে তা নূরান ইহকালেও চায়না। হঠাৎ কিছু একটা মনে আসার মতো ঝট করে মাথা তুলল নূরান। ছুঁড়ে মারা ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত গতিতে টেক্সট লিখল,
“তোমার সাথে দেখা করতে চাই আমি।”
লিখে সাথে সাথে সেন্ডও করে দিলো। সেন্ড করেই হৃদপিণ্ড অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে চলে গেল। অশান্ত ভাবে পা উপর নিচে নাচাতে লাগলো। এর আগে কখনো এমন কিছু বলেনি সে। কখনো নীলাম্বরীর দেখার কথা বলেনি। আসলে কখনো তেমন আকাঙ্খাই জাগেনি। সে এভাবেই খুশি ছিলো। তবে আজ নীলাম্বরীর ওমন কথায় তার মস্তিষ্কে কিছু একটা যেন ঘটে গেছে। যার কারণে এখন সে এমন কথা বলল। হঠাৎ করেই যেন দেখা করাটা তার কাছে জরুরি হয়ে গেছে। অজানা একটা ভয় তাকে এটা করতে বাধ্য করেছে। কিন্তু এখন নীলাম্বরী কি রিয়্যাক্ট করবে এটাই চিন্তা হচ্ছে তার। সেকি রাজি হবে নূরানের প্রস্তাবে!
___
মুখের উপর পানির ছিটা পড়তেই ঘুমের ঘোর থেকে ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠলো আদ্রিতা। চোখ মেলে তাকাতেই নিবিড়ের বাজখাঁই নজরের সম্মুখীন হলো সে। হতবুদ্ধির মতো ডানে বামে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো সে। শেষ যতদূর মনে আছে সে গাড়িতে জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসেছিল। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছে খেয়াল নেই। কিন্তু এখানে কীভাবে এলো! আর বাকিরা কোথায়! তার ভাবনার মাঝেই নিবিড় আদ্রিতার মুখের উপর তুড়ি বাজিয়ে বলল,
“ঘুম ভেঙেছে, নাকি ওই সামনের নদীতে নিয়ে চুবানি দিয়ে আনবো!”
আদ্রিতা এবার পূর্ণ দৃষ্টি স্থির করলো নিবিড়ের উপর। সে যে এখন শুধু এই দৈত্য দানবের সাথে একাই আছে তা বুঝতে পেরেই গলা শুকিয়ে আসছে তার। আদ্রিতা কম্পিত গলায় বলল,
“আ….আমাকে এখানে কেন এনেছেন! আর সবাই কই?”
নিবিড় স,য়,তা,নি হেঁসে বলল,
“সবাইকে দিয়ে কি করবো! খু,ন তো আমি তোর করবো। বাকিদের নাকি! তাইতো শুধু তোকে কৌশলে নিয়ে এসেছি। দাদুনের গাড়িতো আগেই বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল। আর তাসান,সানভিকে ওদের বাসায় ড্রপ করার সময় তানহাকেও ফুপিদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এসেছি। এখন আরামে তোকে খু,ন করতে পারবো। আমাকে ইগনোর করার শাস্তি হিসেবে এটুকুতো তোর পাওনাই। তা বল, কীভাবে উপরে যেতে চাস তুই! পানিতে চুবিয়ে মা,র,বো, নাকি এখানেই গ,লা টি,পে মে,রে নদীতে ভাসিয়ে দিবো তোকে। বলনা কোনটা করবো! চাইলে তুই নিজস্ব চয়েসও বলতে পারিস। আমি আবার খু,ন করার বিষয়ে অনেক জেনারিস বুঝেছিস!”
আদ্রিতার আত্মা অর্ধেক এমনিতেই বেড়িয়ে গেল নিবিড়ের ভয়ংকর কথায়। এই দৈত্য দানব দেখছি সত্যি সত্যিই মানুষ মা,রা শুরু করে দিয়েছে। কি দরকার ছিল তখন ওতো রাগ দেখানোর! এখন কে বাঁচাবে তোকে! এই অল্প বয়সে ম,রার কোন শখ নেই আদ্রিতার। এখনোতো দশ বারোটা বাচ্চা পয়দা করে নিজের ফুটবল টিমই বানালোনা। নিজের ফুটবল টিমের জন্যে হলেও তাকে বাঁচতে হবে।আদ্রিতা সুযোগ বুঝে নিজের জান বাঁচাতে ফট করে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে পালাতে চাইলো। কিন্তু বিধিবাম, তা আর পারলো কই। নিবিড় তার থেকেও দ্রুত ছুটে এসে ছোঁ মেরে আদ্রিতাকে খপ করে ধরে ফেললো।ধরে এনে দুই হাতে আদ্রিতার কোমড় ধরে তাকে উঁচু করে গাড়ির ডিকির উপর বসিয়ে দিলো। তারপর আদ্রিতার দুই দিক দিয়ে ডিকির উপর নিজের দুই হাত রেখে আঁটকে ফেললো তাকে নিবিড়। হালকা ঘাড় বাঁকিয়ে আদ্রিতার মুখের কাছে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“এখন পালাচ্ছিস কেন হ্যাঁ! তখনতো খুব বাহাদুরি দেখাচ্ছিলি! আমাকে এটিটিউড দেখানো! নিবিড়কে ইগনোর করার স্পর্ধাও দেখানো হচ্ছিল! নট ব্যাড! তা এখন কি হলো! এখন এটিটিউড দেখা!”
আদ্রিতা ভয়ে ঢোক গিলে ফিচেল গলায় বলল,
“কিযে বলেন না! এটিটিউড আর আমি! আপনার বোধহয় কোন মিসআন্ডারস্টান্ডিং হয়েছে। এটিটিউড কোন খেতের মূলা তাইতো জানিনা আমি। সেটা কি খায়, না পড়ে! খাওয়ার জিনিস হলেতো আমার এমনিতেও পছন্দ না৷ আপনিতো জানেনই আমি খাবারের ব্যাপারে খুব অনিচ্ছুক। আপনি শুধু শুধু ভুল বুঝছেন। আমি বরং যাই হ্যাঁ! “
নিবিড় ধমকের সুরে বলল,
“চুপপ! মজা হচ্ছে আমার সাথে! খুব বেশি মজা করা শিখে গেছিস মনে হচ্ছে! মজার ছলে যা খুশি তাই বলবি! তখন ওদের কি বলছিলি ওসব হ্যাঁ! আমার নামে বানোয়াট কথা বলার সাহস কি করে হলো তোর!”
তখনকার কথা বলতেই আদ্রিতার এবার সেই সুন্দরী ডক্টরের ব্যাপারটা মনে পড়লো। আর তা মনে আসতেই হঠাৎই ভয়কে সাইডে সরিয়ে দিয়ে সেখানে দখল করলো অভিমানী সত্তা। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যাওয়া অভিমানটা আবার নতুন আমেজে জাগ্রত হয়ে উঠলো। অভিমানে টইটম্বুর আদ্রিতা মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“বানোয়াট কথা কই বললাম! যা সত্যি তাইতো বলেছি।”
নিবিড় এক হাতে আদ্রিতার চোয়াল ধরে সামনে ঘুরিয়ে ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
“সত্যিই বলেছিস তাইনা! মনতো চাচ্ছে এখুনি তুই আর তোর সত্যকে উঠিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেই। আইছে সত্যের দেবী। ইডিয়ট একটা।”
আদ্রিতা এবার অভিমানের সাথে একটু প্রতিবাদীর সুর মিশিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ এখনতো আমাকে ডাস্টবিনেই ফেলবেন! আমার আর দরকারইবা কি আপনার! নিজের পথের কাটা সরাতে এখানে নিয়ে এসেছেন। এত কষ্ট করতে হবে না আপনার। শুধু শুধু আমার মতো তুচ্ছ প্রাণীকে মে,রে হাত ময়লা করার দরকার হবেনা আপনার। কারোর মাঝে অযাচিত ব্যক্তি হওয়ার মতো অন্তত আমার মনমানসিকতা না। তাই আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। এখন সরুন যেতে দিন আমকে।”
নিবিড় ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“পারলে যেয়ে দেখা!
আদ্রিতা নিবিড়কে সরানোর জন্য ঠেলতে লাগলো। কিন্তু বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী নিবিড়কে আদ্রিতার মতো চড়ুই পাখির থাক্কায় একচুলও নড়াতে পারলোনা। তবুও সে ঠেলে সরাতে চাইছে। অভিমানী মন ভীষণ পরিমাণ ফেঁপে উঠছে তার। যার প্রখরতায় দুচোখের নোনাজল বিনা অনুমতিতেই গড়িয়ে পড়া শুরু করে দিলো। নিবিড়ের বুকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নাক টেনে ফোঁপাতে ফোপাঁতে সে বলতে লাগলো,
“সরুন বলছি, থাকবোনা আমি। চলে যাবো আমি। যেতে দিন আ…….
এই পর্যায়ে এসে নিবিড় তার সেই অভিনব কায়দায় আদ্রিতার মুখ বন্ধ করে দিলো। তৎক্ষনাৎই আদ্রিতার প্রহাররত হাত দুটো বন্ধ হয়ে গেল। ধমকিত হলো তার সর্বাঙ্গ। হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। নিবিড়ের প্রয়াস অন্য কিছু থাকলেও আদ্রিতার নেশায় ডুবে তার চাহিদা আরও বাড়লো যেন। সে দুই হাতে আদ্রিতার মুখটা ধরে আরও নিগূঢ় করলো অধরের ক্রিয়া। কম্পনের পীড়া প্রতিহত করতে লাগলো আদ্রিতার সর্বস্ব। নিঃশ্বাস আটকে রইলো শ্বাসতন্ত্রের মাঝে।
এই ক্রিয়া কতক্ষণ স্থায়ী থাকলো তা জানা নেই কারোরই। একসময় ক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটালো নিবিড় নিজেই। আদ্রিতার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো দুজনেই। আদ্রিতা চোখ বুজেই রইলো। এই মুহূর্তে চোখ খুলে তাকানো তার পক্ষে সবচেয়ে অসম্ভব কাজ। সারা শরীর কেমন অবশ হয়ে গেছে যেন। নিবিড় আদ্রিতার কপালে কপাল, নাকে নাক ঠেকিয়ে মায়াবী সুরে বলল,
“মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে গেছে। নাহলে আজ তোর পটল তোলা অপরিহার্য ছিলো। এই পাগলী, না জেনেই কেন অযথা আমাকে পোড়াচ্ছিস! হ্যাঁ কলেজে জেরিন আমাকে পছন্দ করতো। সেটা ও আমাকে বলেছিল অনেক বার। অনেক পাগলামিও করেছিল আমার জন্য। কিন্তু আমি কি করতাম! আমার ঘরেতো পিচ্চি বউ আছে সেটাতো আর ও জানে না৷ বউ রেখে পরকিয়া করার মতো পাপ কি আর করতে পারি আমি! পিচ্চি পুতুলের ইন্দ্রজাল ভেদ করে অন্যথায় নজর দেওয়ার সময় আছে নাকি আমার! কিন্তু ওই মেয়েটা আমার পিছুই ছাড়ছিল না।মানা করার পরও আমাকে পাওয়ার জন্য রোজ পাগলামি করতো। একদিন মাথা গরম হয়ে যায়। চড় মেরে দেই ওকে। তারপর শুনেছিলাম নাকি সু,ই,সা,ই,ড এটেম করেছিল। যদিও তাতে আমার মাঝে কোনো ভাবান্তর হয়নি। আমিতো পারলে ওর ওই কাজের জন্য আরও কয়েকটা দিয়ে নিজেই উপরে পাঠিয়ে দিতাম। এর কিছুদিন পরেইতো আমি বিদেশ চলে যাই। সময়ের সাথে জেরিন নামের কেউ ছিলো সেটাই ভুলে গেছি। তাইতো ওকে দেখেও চিনতে পারিনি।”
এতটুকু বলে খানিক থামলো নিবিড়। আদ্রিতার অভিমানীর চাদর এবার ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগলো। পুরোপুরি সরিয়ে দিতে নিবিড় বলল,
“মেয়ে তুই ভয়ংকর কালোজাদুকারী বিভীষিকা,
তোর সেই জাদুর ঘোরে ডুবে থাকাই এই মানবের জীবন, জীবিকা।”
আদ্রিতা ধ্যানমৌন হয়ে শুনছে শুধু নিবিড়ের হৃদয় শীতল করা আলাপন। মনের সকল জমাট তিক্ততা ধুয়েমুছে যাচ্ছে যেন তার আকৃষ্ট আলাপনে। সুখময় স্নিগ্ধতায় মন জুড়িয়ে যাচ্ছে যেন। এরইমাঝে নিবিড় আবার বলে উঠলো,
“বাইদাওয়ে, তোর এতো রাগের কারণ কিন্তু আমি বুঝলাম না। মনে হচ্ছে জ্বলছে কোথাও। দেখনা কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। তোর কলিজা পোড়ার কি বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে।”
আদ্রিতা তেজী কন্ঠে বলল,
“আমি জেলাস! তাও আবার ওই ডক্টরনীর উপর! ওহ প্লিজ! আমার বয়েই গেছে। আপনি যা খুশি তাই করুন তাতে আমার কি! দরকার হলে ওই ডক্টরের রুগী হয়ে যান৷ নাহলে তার গলার স্টেথোস্কোপ হয়ে যান। তাতে আমার কি!”
নিবিড় বাঁকা হেঁসে আদ্রিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“সত্যিই রুগী হয়ে যাবো বলছিস! ঠিক আছে, তুই যখন বলছিস তাহলে তোর কথা কীভাবে ফেলে দেই তাইনা! কালই জেরিনের হসপিটালে রুগী হয়ে যাই তাহলে।”
আদ্রিতা রাগে কটমটে চোখে তাকিয়ে নিবিড়ের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“যান,কাল কেন, আজই যান। এখুনি যান। কে ধরে রেখেছে আপনাকে! অসহ্য লোক।”
বলেই আদ্রিতা নেমে কপট রাগ দেখিয়ে চলে যেতে নিলেই নিবিড় হেঁসে দিয়ে পেছন থেকে আদ্রিতার কোমড় পেঁচিয়ে তাকে ধরে ফেললো।আদ্রিতা ছাড়া পাওয়ার জন্য মোড়ামুড়ি করতে লাগলো। নিবিড় তাকে পেছন থেকে পেটে পেচিয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আদ্রিতার পিঠ এসে নিবিড়ের বুকে সাথে লেগে গেল। আদ্রিতার রাগ দেখে হাসতে লাগলো নিবিড়। একসময় উচ্চস্বরে প্রাণখোলা হাসি হাসলো নিবিড়। তা দেখে আদ্রিতা ছোটাছুটি বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। ঘাড় বাঁকিয়ে সে নিবিড়ের প্রাণখোলা হাসি দেখতে লাগলো মুগ্ধ নয়নে। আজ প্রথম সে নিবিড়কে এভাবে হাসতে দেখছে। লোকটাকে হাসলে কত অমায়িক সুন্দর লাগে। ভালোই হয়েছে সে সবার সামনে হাসে না। নাহলে হয়তো নজর লেগে যেত সবার। এই হাসি শুধু আদ্রিতার জন্য। যা কেবল সেই দেখবে।
হাসি থামলে নিবিড় আদ্রিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে গাড়ির ডিকির উপর আধো বসা হয়ে দাঁড়াল। আদ্রিতার কাঁধে থুতনি রেখে কানে চুমু খেয়ে বলল,
“এক তুইতেই আমার নির্বাসন।
তোর নামেই শুধু লেখা আমার সব অনুভূতির বর্ষন।
আদ্রিতার হৃদগৃহে এবার ঝলমলে হলো হাজার তারার মেলায়। বসন্তের আগমনের ন্যায় হাজার পুষ্পের সুবাসে মন মোহনীয় হয়ে উঠলো। দূর আকাশের রুপালী চাঁদটাকে চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো, “দেখ চাঁদ, সে শুধুই আমার।”
চলবে……