®মেহরুমা নূর
★খুশিমনে হেলেদুলে নাচতে নাচতে আদ্রিতা নূরানের রুমে এসে পৌঁছাল। রুমে ঢুকে দেখলো নূরান রুমে নেই । ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ দেখে বুঝলো নূরান ওয়াশরুমে। আদ্রিতা গিয়ে নূরানের বিছানায় বসতেই হঠাৎ নূরানের ফোনে ম্যাসেজ টোন শুনতে পেল। ফোনের দিকে তাকাতেই নীলাম্বরী নামের আইডি উপরে ভেসে উঠতে দেখলো সে। কৌতূহল বশত আদ্রিতা ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করলো। এইমাত্র ম্যাসেজ দেখতে গিয়ে নূরান আর নীলাম্বরী আইডির সকল চ্যাট আদ্রিতার নজরে এলো। তার নীরব চুপচাপ গাই-এর মতো ভাইটা যে তলে তলে টেম্পু চালাচ্ছে তা দেখে আদ্রিতা হতবাক হয়ে গেল। মনে মনে তার দুষ্টু বুদ্ধি এলো। নীলাম্বরীর কারেন্ট ম্যাসেজ ছিলো,
“কি করছ?”
আদ্রিতা দুষ্টুমি করে তার রিপ্লাই দিলো,
“তোমার পিরিতের রঙিন জলে হাবুডুবু খাচ্ছি প্রিয়তমা। তুমি আমার জান,তুমি আমার প্রাণ, তোমারে না দেখলে আমার মন করে আনচান। ওগো প্রাণপ্রিয়া, আমার কাছে এসে আমাকে তোমার পিরিতির কাঁঠালের আঠা দিয়ে দুজনকে একসাথে চিপকিয়ে দাও।”
টেক্সট সেন্ড করে খিলখিল করে হাসতে লাগলো আদ্রিতা। অনেকক্ষণ পর রিপ্লাই এলো,
“নূরান, তোমার শরীর অসুস্থ নাকি! নাকি উল্টো পাল্টা কিছু খেয়েছ! কি বলছ এসব আবোলতাবোল!”
রিপ্লাই দেখে আদ্রিতা আরও অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সে আবারও রিপ্লাই দিলো,
♬ ওরে আয় আয় আয়,
♬ ভীষণ প্রমের ঝড় উইঠাছে আমার অন্তরায়..
নীলাম্বরীর রিপ্লাই এলো,
“তুমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছ। গিয়ে মাথায় পানি ঢালো। আমি বরং তোমার সাথে পরে কথা বলছি।”
আদ্রিতা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। তখনই নূরান ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। আদ্রিতাকে এভাবে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে আসতে আসতে বলল,
“কিরে অরি,পাগলের মতো একা একাই হাসছিস কেন?”
বলতে বলতেই আদ্রিতার হাতে নিজের ফোন দেখতে পেল নূরান। সে দ্রুত আদ্রিতার হাত থেকে ফোনটা ছোঁ মেরে কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“কি করছিস আমার ফোনে তুই! “
নূরান ফোনে আদ্রিতার টেক্সট গুলো দেখে চোখ কপালে উঠে গেল তার। হতবিহ্বল কন্ঠে বলল,
“এই পাগলী কি পাঠিয়েছিস এসব! সকাল সকাল দুষ্টুমি করার জন্য আমার ফোনটাই পেলি! মেয়েটা কি ভাববে বলতো!”
বলতে বলতে নূরান দ্রুত ম্যাসেজগুলো ডিলিট করে দিলো। সাথে লিখে দিলো ওগুলো আমি পাঠায়নি, “আমার বোন দুষ্টুমি করে পাঠিয়েছে। প্লিজ তুমি কিছু মনে করোনা।” আদ্রিতা নূরানের হাত টেনে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“আগে তুমি বলো,কবে থেকে চলছে এসব হ্যাঁ! আর আমাকে জানাওনি কেন! তলে তলে টেম্পু চালাচ্ছ!”
নূরান কিছুটা শাসনের সুরে বলল,
“অরি,অনেক বেশি বাঁদর হয়ে যাচ্ছিস দিনদিন।এসব কি অভদ্র ভাষা ব্যবহার করিস! কোত্থেকে শিখিস এসব!”
“আচ্ছা, আচ্ছা সরি। এখন বলোনা ভাইয়া মেয়েটা কে? কবে থেকে চলছে তোমাদের!”
নূরান আবারও শাসনের নজরে তাকালো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা ফিচেল হেঁসে বলল,
“আই মিন কথা, কবে থেকে কথা চলছে তোমাদের তাই বলতে চাচ্ছিলাম।”
নূরান বলল,
“সেটা এমনিতেও তোকে বলতাম। ওর নাম তনয়া। গত কয়েকমাস হলো পরিচয়। এতদিন শুধু ভার্চুয়ালই চ্যাট হতো। গত তিনদিন পূর্বে দেখা করেছি।”
“ও, তারমানে সেদিন তোমার এক্সিবিশনের প্রয়োজন বুঝি এটাই ছিলো!”
নূরান হ্যাঁ বলল। তারপর তনয়ার বিষয়টাও খুলে বলল ওকে। সব শুনে আদ্রিতা তার ভাইয়ের কাজে আবারও মুগ্ধ হলো। আদ্রিতা উৎসুক কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া আমি তাকে দেখবো একবার। একটু ভিডিও কল করি! “
আদ্রিতা অনুমতি স্বরুপ কথাটা বললেও তা অনুমোদিত হওয়ার অপেক্ষা করলোনা এক মুহুর্তও।নূরানের কিছু বলার আগেই আদ্রিতা ছোঁ মেরে নূরানের ফোনটা নিয়ে তনয়াকে ভিডিও কল করে বসলো। নূরান তাকে বাঁধা দিতে গিয়েও সক্ষম হলোনা। নূরান নিজেই কখনো তনয়াকে ভিডিও কল করেনি। ভাবছে মেয়েটা কি ভাববে কে জানে। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে তনয়াকে দেখা যাচ্ছে। তার লম্বা এলোকেশ ছড়িয়ে আছে তার কাঁধ বেয়ে। নূরানের তনয়ার এই লম্বা চুলগুলো ভীষণ পছন্দ হয়। সেদিন প্রথম এই চুল দেখেই তার মনে দোলা দিয়েছিল।মেয়েটা ক্যামেরার সামনে আদ্রিতাকে হয়তো একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে।নূরান পরিচয় করিয়ে দিলো আদ্রিতার সাথে। আদ্রিতা তনয়ার জড়তা মুহূর্তেই কাটিয়ে দিলো তার বকবকানি কথায় আদ্রিতা তনয়াকে দেখেই বলল,
“অওওওওওওও.. কত্তো কিউট তুমি। মন চাচ্ছে ফোনের মাঝে ঢুকে তোমার গাল টেনে দিই। সত্যি বলছি আমার সামনে এলে তোমার গাল আর বেঁচে থাকবেনা।”
আদ্রিতার কথায় তনয়া লজ্জা পেয়ে হাসলো। তার ওই হাসিতে নূরানের হৃদকুঞ্জ শীতলতায় ভরে গেল। আদ্রিতা তার বকবকানির ঝুলি খুলে বসলো তার সাথে। নূরান শুধু আদ্রিতার পেছন থেকে দেখে গেল তনয়াকে। তনয়াও মাঝে মাঝে আরচোখে তাকালো নূরানের দিকে। চোখের ভাষায় হলো তাদের আলাপন।
___
নিবিড় অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই লিভিং রুমে সবাইকে জড়ো হওয়া দেখতে পেল।সবার মাঝেই কেমন চিন্তা আর উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। নিবিড় এগিয়ে এসে বলল,
“কিছু কি হয়েছে! সবাইকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
নিবিড়ের প্রশ্নে সবাই একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। নিবিড় এবার একটু উচ্চস্বরেই বলল,
“কেউ কিছু বলবে! “
আবির এই পর্যায়ে বলে উঠলো,
“আসলে, অরি মামুনি কলেজ থেকে এখনো বাড়ি ফেরেনি। ড্রাইভারকে ফোন করলাম বলল অরি নাকি গাড়ির কাছে আসেইনি। কিন্তু কলেজতো ছুটি হয়েছে আরও তিনঘণ্টা আগে। মেয়েটার ফোনও বন্ধ আসছে ।নূরান কিছুক্ষণ আগেই গেল কলেজের দিকে। কোথায় গেল মেয়েটা কে জানে! চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। ওর কোনো ক্ষতি হয়ে গেলে ভাইকে কি জবাব দিবো আমি! “
নিবিড় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। কানে শুধু বারবার আদ্রিতাকে পাওয়া যাচ্ছে না, এই বাক্যটাই ঘুরছে। এলোমেলো বিভ্রান্ত নজর ডানে বামে ঘুরতে লাগলো তার। পরপরই হঠাৎ পাগলের মতো দৌড়ে বেড়িয়ে গেল সে। পেছন থেকে সবাই কতবার ডাকলো তাকে, সে ফিরলোনা। তানি ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। সবকিছু কেমন যেন এক অশুভ সংকেত দিচ্ছে তাকে। তার কলিজার টুকরোগুলোর যেন কোনো ক্ষতি না হয়,এটাই তার শুধু প্রার্থনা।
নিবিড় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফুল স্পিডে ছোটাল সে আদ্রিতার কলেজের দিকে। মাথা কপাল ঘামে দরদর করছে তার। গলা শুঁকিয়ে হচ্ছে মরুভূমি যেন। হাত পায়ের মাঝে মৃদু কম্পন ঘটছে। সে কীভাবে আদ্রিতার কলেজে এসে পৌঁছাল তার হুঁশ নেই। কলেজে পৌঁছালে গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়াল কলেজের ভেতর। ভেতরে এসে নূরানকে দেখতে পেল সে। নূরান আতঙ্কিত স্বরে নিবিড়কে বলল,
“ভাইয়া, অরি নেই ভেতরে। আমি খুঁজে দেখলাম।”
নিবিড়ের দ্রুত কদম কিছুসময়ের জন্য স্থির হয়ে গেল। তারপর কেমন অস্বাভাবিক সুরে বলল,
“আরে তুই ভালো করে খুঁজিসনি বোধহয়। দাঁড়া আমি খুঁজে বের করে আনছি বদটাকে।”
বলেই উন্মাদের মতো সারা কলেজ তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো।নূরানও সাথে খুঁজল। কিন্তু পেলনা কোথাও। শেষে নিবিড় কলেজের সিকিউরিটি ডিপার্ট্মেন্টের কাছে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলো। সিসিটিভি ফুটেজে আদ্রিতাকে কলেজ ছুটির পর গেটের বাইরে যেতে দেখা যাচ্ছে। নূরান চিন্তিত গলায় বলল,
“অরি বাইরে গিয়ে তাহলে গাড়ির কাছে না গিয়ে গেল কোথায়! ভাইয়া,কি করবো এখন আমরা!”
নিবিড় মাঝে সব ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। অস্থিরতায় সারা শরীর ঝিনঝিন করছে তার। অশান্ত কন্ঠে বলল,
“কি আর করবো! খুঁজে বের করবো। নিশ্চয় সেদিনের মতো বান্ধবীদের সাথে কোথাও আড্ডা দিতে গেছে গাধীটা। একবার শুধু পাই হাতের কাছে। হাত পা ভেঙে যদি ঘরে বসিয়ে না রেখেছি তো, আমার নামও নিবিড় না। তুই বামের রাস্তায় যা। আমি ডানের দিকে গিয়ে খুঁজছি। আর হ্যাঁ, ওর একটা বান্ধবী আছে না! ইভা নাকি কি যেন নাম! বাড়িতে ফোন করে বল,কারো কাছে যদি ওর নাম্বার থাকে তাহলে যেন ওর কাছে ফোন করে অরির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।”
“ওকে ভাইয়া।”
নূরান আর নিবিড় দুজন দুদিকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো আদ্রিতার খোঁজে। সন্ধ্যা থেকে রাত এগারোটা বেজে গেল তবুও কোনো সন্ধান পেলনা আদ্রিতার। নিবিড়ের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে যেন৷ নূরান জানিয়েছে বাড়ি থেকে ইভার নাম্বারে ফোন দেওয়ায় হয়েছিল। ইভা নাকি বলেছে সে জানে না অরি কোথায় গেছে। নিবিড়ের নিঃশ্বাস আঁটকে যাচ্ছে কেমন। নিবিড় বুকের বাম পাশে হৃদপিন্ডের উপর কয়েকবার নিজ হাতের মুঠো দিয়ে চাপড় মারতে লাগলো। যেন আঁটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করার চেষ্টা করছে সে। ফর্সা মুখটা ঘামে ভিজে লাল বর্ণ ধারণ করে বিধ্বংসী দেখাচ্ছে। নিবিড় অশান্ত এলোমেলো হাতে এসির পাওয়াটা বাড়াতে গিয়ে বোয়ালখালীতে রেডিওর বাটনে চাপ লেগে রেডিও চালু হয়ে যায়। রেডিওতে রাত এগারোটার খবর চলছিল তখন৷যদিও নিবিড়ের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। তবে হঠাৎ একটা খবর কানে এলো তার। মহিলা সাংবাদিক বলছে,”কাল এক কলেজ ছাত্রীকে গ,ন,ধ,র্ষ,ন করে হ,ত্যা করে ফেলে যায় রাস্তার পাশে। জরিপ অনুযায়ী ঢাকা শহরে ধ,র্ষ,নের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। রোজ কোনো নারী ধ,র্ষ,ণের শিকার হচ্ছে।” খবরটা কানে আসতেই সজোরে ব্রেক কষলো নিবিড়। রেডিওটা ঝট করে বন্ধ করে গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো সে। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। বুকটা শুঁকিয়ে খা খা হয়েছে যেন৷হাত পা অসম্ভব কাঁপছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ার চেষ্টা করছে সে। গাড়ির ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেতে গেলে পানিও গলায় আঁটকে গেল। বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো নিবিড়। কাশতে কাশতে নাড়িভুড়ি উল্টে আসতে লাগলো যেন তার।মুখ দিয়ে লালা বের হতে লাগলো। মুখমন্ডলে র,ক্ত জমাট হয়ে গেল কেমন। নিচে বসে হাঁপাতে লাগলো সে। কতক্ষণ পর নিবিড় রাস্তার উপর থেকে একটা পাথর হাতে নিয়ে গাড়ির ভেতর বসে রেডিওর উপর পাথর দিয়ে আঘাত করে রেডিও ভেঙে ফেলল। ভাঙতে ভাঙতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“যতসব অকার্য এই খবরের চ্যানেল গুলো। ফালতু খবর শুনিয়ে বেড়ায়।”
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আবারও গাড়ি স্টার্ট দিলো। পাগলের মতো খুঁজে বেড়ালো সারা শহর তার জান আবদ্ধ থাকা পাখিটাকে। রাত তখন প্রায় বারোটা। গাড়ি-ঘোড়া রাস্তায় অনেকটাই কমে গেছে। নিবিড় চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ির সামনে একটা মেয়েকে দেখতে পেল যে, রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটছে। নিবিড় ভালো করে খেয়াল করতেই চমকে গেল সে। কারণ মেয়েটি আর কেউনা, তারই প্রানভোমরা। নিবিড় দ্রুত গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে গেল আদ্রিতার কাছে। দেখলো আদ্রিতা কেমন বোধশূন্য ভাবে হাঁটছে। প্রচন্ড রাগে ক্ষিপ্ত হলো নিবিড়। সে তেড়ে গিয়ে আগে আদ্রিতার ধরে কোনকিছু না বলে ওকে গাড়ির ভেতর নিয়ে এসে পেছনের সিটে ঠাস করে বসালো।আদ্রিতাকে কেমন প্রতিক্রিয়াহীন দেখা গেল। নিবিড় আদ্রিতার সামনে বসে রাগে চোয়াল শক্ত করে থাপ্পড় দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার দিকে হাত তুলেও আবার থেমে। সেই হাতেই আদ্রিতাকে এক টানে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। দুই হাতে আষ্টেপৃষ্টে মিশিয়ে ফেললো নিজের সাথে। এতো শক্ত করে ধরেছে যেন,ছেড়ে দিলেই সোনার গৌড় এখুনি হারিয়ে যাবে। হৃদপিণ্ডের মাঝে ঢুকিয়ে ফেলার প্রচেষ্টা যেন তার। চোখ বুজে অনুভব করলো তার প্রাণটাকে। এতক্ষণে বুঝি তার মাঝে প্রাণের সঞ্চালন হলো। দুই হাতে আদ্রিতার মুখটা ধরে সারা মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। তারপর আবারও জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলি বেয়াদব! এভাবে ছকিনার মায়ের মতো রাস্তার মাঝে ঘুরছিলি কেন! এটা কি গার্ডেন পেয়েছিস! আমাকে জ্বালাতে না পারলে ভালোই লাগে না তোর তাইনা! রোজ রোজ মারার থেকে একদিনেই মেরে ফেলনা আমাকে।”
আদ্রিতা কিছুই বলছেনা। আবার নিবিড়কে জড়িয়েও ধরছেনা। নিবিড় হালকা ধমকের সুরে বলল,
“এখন কথা বলছিস না কেন ইডিয়ট! বল কোথায় গিয়েছিলি তুই! আর রাস্তার মাঝে ঘুরছিস কেন!”
আদ্রিতার কোনো জবাব এলোনা। হঠাৎ নিবিড় অনুভব করলো আদ্রিতার শরীর কেমন ছেড়ে দিয়েছে। মাথাটা হেলে পড়ছে৷ নিবিড় আদ্রিতার মুখটা সামনে এনে দেখলো আদ্রিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। চোখে মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট হলো নিবিড়ের। সে ভীতিকর চোখে তাকিয়ে আদ্রিতার গাল ঝাকিয়ে বলল,
“পুতুল, এই পুতুল, কথা বল।”
নিবিড়ের মনে পড়লো আদ্রিতার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। হয়তো আজও তাই হয়েছে। নিবিড় আদ্রিতাকে পেছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে। নিজে সামনে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। যেতে যেতে বাড়িতেও ফোন করে জানিয়ে দিলো। আর ডক্টরকেউ আসতে বলার কথা বলে দিলো।
দ্রুত গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে পৌঁছাল নিবিড়। আদ্রিতাকে কোলে বাসার ভেতর ঢুকলো। আদ্রিতার এই অবস্থা দেখে সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেল। তানিতো আগে থেকেই কাঁদতে কাঁদতে পেশার ডাউন করে ফেলেছে। মেয়েটাকে এই অবস্থায় দেখে তার মনে কু ডাক। মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হলো নাকি সেই ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে তার। নিবিড় আদ্রিতাকে এনে ওর রুমের বিছানায় শুইয়ে দিলো। অপরাহ্ন আগে থেকেই এসে ছিল। অপরাহ্নের বাবা অসুস্থ থাকায় সেই এসেছে। এমনিতেও আদ্রিতার কথা শুনে সেও চিন্তিত হয়ে এসেছে। অপরাহ্ন আদ্রিতাকে চেক-আপ করলো। নিবিড় পাশেই অশান্ত, শঙ্কিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। তানি আদ্রিতার মাথার কাছে বসে আছে আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাকিরাও চিন্তিত অবস্থায় রুমের চারিদিকে অবস্থান করছে। সানার পরিবারও চলে এসেছে ভাতিজির চিন্তায়। অপরাহ্ন চেক-আপ শেষে বলল,
“এমনিতেতো সব ঠিকই মনে হচ্ছে। তেমন কোনো সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় নার্ভাস ব্রেকডাউন এর কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান ফিরে আসবে।”
অপরাহ্ন নিবিড়ের দিকে তাকালে নিবিড় চোখের ইশারায় কিছু জানতে চাইলো হয়তো। অপরাহ্ন তা বুঝতে পেরে সেও চোখের ইশারায় আস্বস্ত করলো যে,আদ্রিতা ঠিক আছে। ভয়ের কিছু নেই। নিবিড় এতক্ষণে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
মিনিট ত্রিশেক পর আদ্রিতার জ্ঞান ফিরলো। সবাই রুমেই উপস্থিত ছিলো। আদ্রিতার জ্ঞান ফিরতে দেখে সবার মুখে স্বস্তির হাসি ফুটল। আদ্রিতার পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো।মাথাটা ভীষণ ভারি লাগছে তার। আর অনেক মাথা ব্যাথাও হচ্ছে। আদ্রিতা মাথা চেপে ধরে কপাল কুঁচকে চারপাশে চোখ বোলালো। সামনেই চেয়ারে এলোমেলো, বিধ্বস্ত চেহারায় বসে থাকতে দেখতে পেল নিবিড়কে।যেন এইমাত্রই তার উপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবলীলা বয়ে গেছে। চারপাশে সবার চিন্তিত মুখও দেখতে পেল সে। তানি আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তুই ঠিক আছিস অরি মামুনি! তোর কিছু হয়নিতো!”
অপরাহ্নও জিজ্ঞেস করলো,
“এখন কেমন লাগছে অরি! তুমিতো সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে!”
আদ্রিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মানে! আমার আবার কি হয়েছে! আর আমি বাসায় কখন এলাম! আমিতো কলেজে ছিলাম।”
আদ্রিতার কথায় সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। নিবিড়ের কমে যাওয়া ভীতিটা যেন আবার ছেয়ে গেল তার চোখে মুখে। অপরাহ্নের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো সে।অপরাহ্নও যেন এই মুহূর্তে ঠিক করে কিছু ধরতে পারছেনা। অপরাহ্ন আদ্রিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার শেষ কি মনে আছে?”
আদ্রিতা বলল,
“শেষ মনে আছে আমি ফিজিক্স ক্লাস করছিলাম। তারপর আর মনে নেই। কিন্তু হয়েছে কি আমার!”
তানহা আদ্রিতাকে আসল কথা বলতে যাবে তখনই নিবিড় ধমকে উঠে বলল,
“কি আবার হবে। বলদিদের সাথে যা হয় তাই হয়েছে। খাবার দাবার তো তোর জাতশত্রু। তাইতো তার সাথে সাক্ষাৎ করিসনা। আর আপনার সেই গুনের সুফল হিসেবে। ক্লাসেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। এখন খুশিতো! বসে বসে ডান্স কর এখন সেই খুশিতে।”
বলেই মিছে রাগ দেখিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল নিবিড়। যেতে যেতে অপরাহ্নকে চোখের ইশারায় ওর সাথে যেতে বলল। অপরাহ্নও তার পিছে পিছে বের হলো। তানি বাকিদেরও চোখের ইশারায় আপাতত যেতে বলল।তাসান হতাশ সুরে বলে উঠলো,
“এইডা কোনো কথা! অজ্ঞান খাওয়ার আর টাইম পাইলিনা তুই অরি! আরে আজই অজ্ঞান হতে হলো তোর! তোর অজ্ঞান হওয়ার চক্করে আমার পার্টিতে যাওয়া হলোনা। আরে অজ্ঞান হওয়ারই ছিলো তো শুক্রবার হতি! ছুটির দিন ছিলো। সকালে আরাম করে উঠে চা নাস্তা খেয়ে তারপর ঠাস করে অজ্ঞান হয়ে যেতি! আমরাও নাস্তা খেয়ে দেয়ে গালে দিয়ে চিন্তা করতাম। তুই ভুল সময়ে অজ্ঞান হওয়ার মিটিং রেখেছিস। পুরাই ফ্লপ।”
বলেই তাসান হতাশা দেখিয়ে বেড়িয়ে গেল। সবাই বের হতেই তানি আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে নে। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”
আদ্রিতা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝাল।
নিবিড় রুমে এসেই মাথার চুল টেনে অশান্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করতে লাগলো। অপরাহ্ন আসতেই নিবির তার সামবে এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“অরি এমন বলল কেন অপু? ওর কিছু মনে নেই কেন? কি হচ্ছে ওর সাথে বলনা?’
অপরাহ্ন নিবিড়কে শান্ত করার জন্য বিছানার উপর বসিয়ে বলল,
” আগে রিল্যাক্স কর তুই। এত হাইপার হওয়ার কিছু নেই। দেখ, অনেক সময় এমন৷ মানুষের মস্তিষ্ক অনেক সময় ব্লাঙ্ক হয়ে যায়। কিছু সময় মাথা থেকে চলে যায়। এর অনেক গুলো কারণ থাকতে পারে। টেনশন,ট্রমা, বা কোন নেশাজাতীয় নেওয়ার কারণেও হতে পারে।এছাড়াও আরও অনেক কারণেও হতে পারে। হতে পারে অরি অজান্তেই এমন কিছু খেয়েছিল যাতে অ্যালকোহল থাকতে পারে৷ শুধু মদেই না, অনেক রকম প্যাকেট জাতীয় খাবারের মাঝেও অ্যালকোহল থাকে। এবং তা বেশি মাত্রায় খেলেও অনেক সময় নেশা হয়। হতে পারে অরিও এমন কিছু খেয়েছিল। তাই তুই আগেই বেশি টেনশন নিসনা৷ আগে যাক কয়েকদিন। এরমাঝে অরি ঠিক থাকলেই বোঝা যাবে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি…
নিবিড় অস্থির কন্ঠে বলল,
“আর যদু কি….? কি বলতে চাচ্ছিস তুই?”
“আরে কিছুই না বাপ। শুধু বলছি যদি আবার কোনো সমস্যা হয় তখন নাহয় প্রোপার টেস্ট করিয়ে নিবো অরির। এখন শুধু শুধু চিন্তা করিসনা। আমি আসছি এখন।”
অপরাহ্ন চলে গেল। অপরাহ্ন বুঝিয়ে দিলেও নিবিড়ের মন পুরোপুরি আস্বস্ত হতে পারছেনা৷ মনে অজানা শঙ্কা এসে ঘর করছে যেন৷ নিবিড়ের পুতুল সোনাটার কিছু হলো নাতো!
চলবে…..