®মেহরুমা নূর
★প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে পুড়ে কালা ভুনা হয়ে যাচ্ছে আদ্রিতা। রুমের দরজা আটকে আছে গত কয় ঘন্টা যাবৎ। বিছানায় বসে তার ফোনের মৃতদেহের দিকে শোকাহত নজরে তাকিয়ে আছে৷ তার এমন বেজান মৃ,ত,দেহ দেখা যায়না। এইতো কিছু ঘন্টা পূর্বেও কি সুন্দর হাস্যজ্বল, প্রাণবন্ত ছিলো সে। আর এখন মৃ,ত।কেমন নির্মম ভাবে মারা হলো তাকে। অন্য সময় হলে আদ্রিতা গলা ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সারাবাড়ি মাথায় তুলে নিতো। সবকিছু ভাংচুর করে ফেলতো। তবে আজ সে কাঁদবে না। কাঁদলে নাকি মন হালকা হয়ে যায়। কিন্তু আদ্রিতা হালকা হতে চায়না। হালকা হলে রাগ কমে যাবে। আর রাগ কমে গেলে প্রতিশোধ কীভাবে নিবে। আর প্রতিশোধ তো সে নিয়েই ছাড়বে। আদ্রিতা চোখের পানি মুছে ফোনের মৃতদেহের উপর শূন্যে হাত রেখে বলল,
“আমি কসম খাচ্ছি। কসম তোর মেগা পিক্সেল ক্যামেরার, তোর ৩২ জিবি র্র্যামের,তোর অ্যাপস গুলোর, তোর হাজার হাজার ছবি আর ভিডিওর কসম। যে তোকে এইভাবে নির্মম মৃত্যু দিয়েছে ওই মিশা সওদাগরকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো। তোর খুনের প্রতিশোধ নিয়ে তবেই দম নিবো। তোর মৃত্যুর দিন পার হওয়ার আগেই আমি বদলা নিবো। তবেই তোর আত্মা শান্তি পাবে। তার আগে তোর দাফন কাফনের কাজ করতে হবে। “
আদ্রিতা ফোনের মৃতদেহ নিয়ে এসে মাটি খুড়ে কবর দিলো। তার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়াও করলো। তারপর তার প্রতিশোধের পরিকল্পনা আরম্ভ করলো।
সন্ধ্যা তখন সাতটা পার হয়েছে। দুর্ধর্ষ একটা প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে আদ্রিতা। আজতো ওই দৈত্য দানবকে চরম শায়েস্তা করেই ছাড়বে। খেলা হবে, খেলা। ঠান্ডা পানি নেওয়ার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রীজ খুলতেই কিছু কথা কানে এলো আদ্রিতার। তানি কাজের বুয়াকে বলছে নিবিড়ের জন্য পায়েস আলাদা করে রাখতে। তার পায়েসে যেন বাদাম না পড়ে। নিবিড়ের নাকি বাদামে এলার্জি আছে। ব্যাস,এমন একটা সুযোগই তো খুঁজছিলো আদ্রিতা। বাদামে এলার্জি হাঁ? এবারতো এলার্জির বর্ষন হবে ওই দৈত্যের উপর। আদ্রিতা এক কোনে দাঁড়িয়ে রান্নাঘর খালি হওয়ার অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষণ পর খালি হলে আদ্রিতা সুযোগ বুঝে নিবিড়ের পায়েসের বোলে একগাদা বাদাম এনে সেগুলো পিষে গুড়ো করে পায়েসের সাথে মিশিয়ে দিলো যাতে দেখা না যায়। তারপর আবার সেটা আগের মতো রেখে দিলো। মনে মনে পৈশাচিক হাসলো। এটা খেয়ে যখন সারা শরীর চুলকাতে চুলকাতে বেহাল দশা হবে তখন হবে মজা।তখনই আমার ফোনের আত্মা শান্তি পাবে।
আজ খাবার টেবিলে সবার আগে এসে বসলো আদ্রিতা। সে যে ফিল্ম ডাইরেক্ট করেছে তার রিলিজ হতে আর কিছু সময় বাকি মাত্র। একে একে সবাই এসে বসলো টেবিলে। নিবিড়ও এসে যথারীতি আদ্রিতার পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো। আদ্রিতার ভেতরের প্রতিশোধক স্বত্বা এক্সাইটেড হয়ে উঠলো। মেইন কোর্স শেষে পায়েস পরিবেশন করলো তানি। নিবিড়ের সামনে সেই আদ্রিতার বাদাম মেশানো বোল রাখা হলো। আদ্রিতা নিজের পায়েস এক চামচ মুখে নিয়ে আরচোখে নিবিড়ের খাওয়ার অপেক্ষায় রইলো। অতঃপর নিবিড় পায়েস এক চামচ মুখে দিলো। এক চামচ খেয়ে কেমন যেন স্থির হয়ে গেল।হালকা ঘাবড়ে গেল আদ্রিতা। টের পেয়ে গেল নাতো আবার! সেকেন্ড দুই স্থির থেকে আবার খাওয়া শুরু করলো নিবিড়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আদ্রিতা। মনে মনে পৈশাচিক হাসি দিলো। একটু পরেই আসল এন্টারটেইনমেন্ট শুরু হবে। কিন্তু আদ্রিতার আশানুরূপ রেসপন্স এলো না। নিবিড় অনায়াসে পায়েসের বোল চেটেপুটে খেয়ে ঢেকুর তুলে উঠে চলে গেল। হতাশ হলো আদ্রিতা। তবে আশা ছাড়লো না৷ ভাবলো হয়তো কিছুক্ষণ সময় লাগবে বাদাম কার্যকর হতে।
রুমের মাঝে পায়চারী করছে আদ্রিতা। রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চললো কিন্তু আদ্রিতার পরিকল্পনার মুরগী এখনো ডিম পারলোনা কেন!এখনো নিবিড় ভাইয়ার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? গন্ডারের চামড়া নাকি! কোনো প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে না। বাদামের পরিমাণ বোধহয় কম ছিলো। আরও বেশি করে দেওয়া লাগতো। আদ্রিতা নিজের রুমের দরজা হালকা খুলে মাথাটা চোরের মতো বের করে দিয়ে এদিক ওদিক উঁকি দিয়ে সিচুয়েশন পর্যবেক্ষণ করলো। রাস্তা ক্লিয়ার দেখে আস্তে করে বের হয়ে ধীরে ধীরে নিবিড়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজায় কান ঠেকিয়ে ভেতরের অবস্থা পর্যালোচনা করার চেষ্টা করলো। নাহ, রেজাল্ট ওর ব্রেইনের মতোই জিরো। নিজের পরিকল্পনা অসফল হওয়ায় বিরক্ত আর হতাশ মুখে সরে এলো নিবিড়ের দরজার সামনে থেকে। রাস্তায় তানহা সামনে পড়লো। আদ্রিতার লটকানো চেহারা দেখে তানহা চশমার কোনা ঠেলে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে অরি? মুখ এমন পেঁচার মতো বানিয়ে রেখেছিস কেন?”
আদ্রিতা বিরক্ত মুখে বলল,
“ছাগলের ডিম হয়েছে। অমলেট বানিয়েছি, খাবি?”
“নাহ,তুইতো জানিস আমি অমলেট খাইনা। তুইই খা বেশি করে।”
বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল তানহা। অসহ্য বিরক্তি আর রাগ নিয়ে রুমে ফিরে গিয়ে বিকট শব্দে দরজা আটকে দিলো।
ঘুমের মাঝে কেমন শোরগোলের আওয়াজ শুনে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই কপাল কুঁচকে এলো আদ্রিতার। ঘুম কাতরে আদ্রিতা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। হঠাৎ কেউ তাকে ঠেলতে শুরু করলো।
“এই অরি ওঠ,দেখ কি হয়েছে! “
তানহার ডাকাডাকির অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে চোখ কুঁচকে তাকালো আদ্রিতা। তানহার ক্রন্দনরত আর আতঙ্কিত মুখটা দেখে ফট করে চোখ বড় বড় করে মেলে তাকালো। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বলল,
“কিরে তানু, কাদছিস কেন এতো রাতে? কি হয়েছে?”
তানহা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“অরি, ভাইয়া……
আদ্রিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
” ভাইয়া! উনার আবার কি হয়েছে? “
“ভাইয়ার অবস্থা খুব খারাপরে, অরি। হঠাৎ করে কি যেন হয়েছে। খুব অসুস্থ হয়ে গেছে ভাইয়া। ডক্টর আঙ্কেল এসেছে ভাইয়াকে দেখতে।আমার ভয় করছে ভাইয়ার ওই অবস্থা দেখে।”
চমকে উঠলো আদ্রিতা। এসব আবার ওই বাদামের জন্য হয়নিতো! ঘাবড়ে গিয়ে আদ্রিতা বিছানা ছেড়ে দৌড় দিলো নিবিড়ের দিকে। নিবিড়ের রুমের দরজায় এসে দাঁড়াতেই আৎকে উঠলো সে। পরিবারের সবার ভীড় জমেছে এখানে। সবার মুখেই চিন্তার ছাপ৷ ভীড়ের ফাঁক দিয়ে কম্পিত কদমে সামনে অগ্রসর হলো আদ্রিতা। বিছানায় নজর যেতেই পদযুগল সেখানেই থমকে গেল। কেঁপে উঠল অন্তর। বিছানায় শুয়ে থাকা ব্যাক্তিটা য নিবিড় ভাইয়া,তা বুঝতে পারলেও তাকে চেনা দায়। শ্বেত মানবের ফর্সা মুখটায় রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। সারা শরীরে লাল লাল ছোপে ঢেকে গেছে। কি ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে। আর একনাগারে কেশে যাচ্ছে। কাশতে কাশতে দম আঁটকে যাচ্ছে যেন তার। সোনা মা,ছেলের শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।মুখে আঁচল চেপে কান্না দমন করার চেষ্টা করছে। তবে নিরব আঁখি যুগল সে বাঁধা মানছে কই। ডক্টর চেকাপ করছে। এসব দেখে আদ্রিতার হাত পা কাঁপতে লাগলো। বুকে ঘটলো চিনচিন ব্যাথার উৎপত্তি ।সেতো এই মানবকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেতে চেয়েছিল। কিন্তু এখন তাকে দেখে আমার আনন্দ কেন হচ্ছে না? এসব কি আমারর ওই বাদাম মেশানোর কারনে হয়েছে? না না, তা কি করে হয়! এলার্জিতে তো শুধু গা চুলকায়। এ এসব কেন হবে? আমিতো শুধু তাকে চুলকানি দিতে চেয়েছিলাম। নিশ্চয় অন্য কিছু হয়েছে।
কিন্তু ডক্টর যখন জানাল নিবিড়ের এই অবস্থা এলার্জির কারণেই হয়েছে তখন আদ্রিতার বুক কেঁপে উঠল। থরথর করে কাঁপতে লাগলো সারা শরীর। নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলল। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে খড়খড়। এটা কি করে ফেললাম? নিবিড় ভাইয়ার এই অবস্থা আমার জন্য হয়েছে? সবাই জানলে কি করবে আমার সাথে? উনার এই করুণ অবস্থা তো আমি চাইনি। কান্না আসছে আদ্রিতার। ভীষণ কান্না। হঠাৎ মাথা কেমন ঘুরতে লাগলো। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না সে। শক্তিহীন হয়ে পেছাতে নিয়ে পড়ে যেতে নিলেই জুহি আদ্রিতাকে ধরে ফেলে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“অরি, কি হয়েছে? ভয় পাস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। নিবিড় ঠিক হয়ে যাবে। তুই শান্ত হ। লম্বা নিঃশ্বাস নে।”
জুহি আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে রুম থেকে সরিয়ে আনলো। আদ্রিতার নার্ভাস ব্রেকডাউন-এর সমস্যা আছে। তাই ওকে শান্ত করা দরকার। জুহি আদ্রিতাকে ওর রুমে এনে বসিয়ে এক গ্লাস পানি খাইয়ে দিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু আদ্রিতার মন এখন কিছুতেই শান্ত হবার নয়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তার। চোখের সামনে বারবার নিবিড়ের ওই করুন অবস্থা ভেসে উঠছে। অপরাধবোধে বুকের মাঝে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। নিজের উপর প্রচুর রাগ হচ্ছে। নিজের বোকামির কারণে আজ নিবিড় ভাইয়ার কি অবস্থা হয়েছে! এতো ডাফার কেন আমি? নিবিড় ভাইয়া ঠিকই বলে, আমি আসলেই একটা বলদি। নাহলে কীভাবে না বুঝে উনাকে এতো অসুস্থ অবস্থায় পৌঁছে দিলাম। জুহি চলে যেতেই বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো আদ্রিতা। মনে মনে দোয়া চাইলো নিবিড় ভাইয়া যেন ঠিক হয়ে যায়।
__
ঘুমের মাঝে ফ্যাসফ্যাসে কান্নার সুর শুনে ঘুম ভেঙে গেল নিবিড়ের। ডক্টর এন্টিডোটের ইনজেকশন দিয়ে গিয়েছিল। তাই ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে। শরীরের ব্যাথা আর র্র্যাশ অনেকটা কমেছে। হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জালালো নিবিড়। বিছানার পাশে বসে নাক টেনে কাঁদছে আদ্রিতা। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠায় খানিক হকচকিয়ে মাথা তুলে নিবিড়ের পানে তাকালো সে। পরক্ষণেই অপরাধবোধে ফোপাঁতে ফোঁপাতে কান্নার জোর বাড়লো। কাঁদতে কাঁদতে নাক চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। নিবিড়ের দৃষ্টি নির্নিমেষ। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিতার কান্নাভেজা মুখ। যেন অনেক ইন্টারেস্টিং কিছু দেখছে সে। নিবিড়ের এভাবে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিতার কান্নার বেগ বাড়লো বৈ কমলো না। কাঁদছে কম ফোঁপাচ্ছে বেশি। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাক মুছছে বারবার। এই পর্যায়ে নিবিড় দুই হাতে ভর দিয়ে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসলো। হালকা বিরক্তির সুরে বলল,
“এই মাঝরাতে কি আমাকে তোর কান্নার ভ্যারিয়েশন দেখাতে এসেছিস? আমার জিরো পার্সেন্টও ইন্টারেস্ট নেই। যা এখান থেকে।ফুট।”
আদ্রিতা সরলো না। বরং ফোঁপানোর সুর বাড়লো। নিবিড় বলে উঠলো,
“বাইদাওয়ে, মাঝরাতে এমন মরা কান্নার কোনো বিশেষ কারণ? জামায় মরে গেছে তোর?”
এবার কিছু বলতে চেষ্টা করলো আদ্রিতা। ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,
“স স সরি….
” কেন? পায়েসে বাদাম মিশিয়েছিস বলে?”
চমকে তাকালো আদ্রিতা। তারমানে উনি জানতো সব? তাও খেয়েছে? কেন খেল? আদ্রিতার প্রশ্নসূচক চাহুনি দেখে নিবিড় ঠোঁটের কোণ কিঞ্চিৎ বাঁকিয়ে বলল,
“ও আচ্ছা। এখন বুঝতে পারলাম আসল কাহিনি। তুই আসলে নিজের পরিকল্পনা বিফলে যাওয়ার জন্য কাঁদছিস। এইযে আমি এখনো বেঁচে আছি, এইজন্যই তো কাঁদছিস। দেখ এতে আমার কোনো দোষ নেই। আমি কিন্তু ডাক্তার ডাকিনি। আচ্ছা ঠিক আছে যা, আবার বাদাম পায়েস বানিয়ে আন। এবার আর তোর মনকামনা বিফলে ফেলবোনা। কাল সকালেই আমার ডে,ড,ব,ডি দেখতে পাবি। এবার খুশিতো?”
আহত চোখে পানির ফোয়ারা নামলো আদ্রিতার। হঠাৎ কেমন অস্বাভাবিক হলো হৃৎস্পন্দনের গতিবেগ। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। হাত পা কাঁপতে লাগলো অস্বাভাবিক হারে। শরীর হঠাৎ ঘামতে লাগলো। চোখের নজর এলোমেলো। আদ্রিতার এই পরিবর্তন নিবিড়ের নজরে এলো। তার শান্ত চোখে ধীরে ধীরে উদ্বীগ্নর কালো ছায়া জমতে লাগলো।বুকে ভাজ করে রাখা হাত দুটো খুলে, নিবিড় আদ্রিতার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সন্দিহান সুরে ডাকলো,
“অরি…..??”
আদ্রিতার অস্বাভাবিক ভাব আরও বাড়লো। চোখের নজর অন্যরকম হচ্ছে।তিরতির করে কাঁপছে চোখের পাতা। আদ্রিতা নিবিড়ের পানে তাকিয়ে কিছু কম্পিত স্বরে বলার চেষ্টা করলো,
“স স সসরি……আ আ আআমি…….
গলার অস্পষ্ট। কথা বলতে পারছেনা সে। চোখের সামনে ঝাপসা দেখছে কেমন। নিবিড় আদ্রিতার কাছে এসে দুই হাতে আদ্রিতার মুখটা ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“পুতুল? কি হয়েছে?”
“আ আমি বু বুঝতে পারিনি….স স….
” ওকে ওকে রিল্যাক্স। শান্ত হ।টেক এ ডিপ ব্রেথ।”
আদ্রিতা বারবার একই কথাই বলার চেষ্টা করতে লাগলো,
“স স সরি….নি নিবিড় ভাই…..
” পুতুল, শান্ত হ। আমি মজা করছিলাম। শান্ত হ। টেক এ ব্রিথ। শ্বাস নে।”
আদ্রিতার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে কেমন। কন্ঠস্বরও জড়িয়ে এলো। ঠোঁট হালকা নড়ছে কিছু বলার চেষ্টায় তবে আওয়াজ বের হচ্ছে না। নিবিড়ের চোখে ভিতী। নিবিড় হঠাৎ আদ্রিতার মাথা বুকের মাঝে চেপে ধরে বলল,
“শান্ত হ, পুতুল। শ্বাস নে। তুই আমার লক্ষ্মী পুতু…..
বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারলোনা নিবিড়। ততক্ষণে আদ্রিতার নিস্তেজ শরীর ঢলে পড়েছে। স্থির হয়ে গেল নিবিড়। হাত জোরায় মৃদু কম্পন হলো। আস্তে করে আদ্রিতার মাথাটা ধরে সামনে এনে ধরতেই জ্ঞানশূন্য আদ্রিতার মুখখানা নিবিড়ের হাতের মাঝে পেছন দিকে হেলে পড়লো।স্তম্ভিত নিবিড় মূর্তির মতো ক্ষণিক সময় তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার মুখপানে। হাতের কম্পন ক্রমশ বাড়লো। ঢোক গিলে ভীতিগ্রস্থ কন্ঠে ডাকলো,
” পু পুতুল, এই পুতুল চোখ খোল।অনেক হয়েছে তোর নাটক। রাগ হচ্ছে কিন্তু আমার। উঠিয়ে আছাড় মারবো একটা। চোখ খোল বলছি।পুতুল….”
বলতে বলতে নিবিড়ের উত্তেজিত কন্ঠস্বর উচ্চতর হলো। যে কন্ঠস্বরের আওয়াজ পেয়ে ঘুম ভেঙে ছুটে এলো সবাই নিবিড়ের রুমে। এতরাতে আদ্রিতাকে নিবিড়ের রুমে দেখে সবাই একটু অবাক হলো। তবে আপাতত সবাই আদ্রিতার জন্য চিন্তিত। তানির বুঝতে বাকি নেই আদ্রিতার কি হয়েছে। আবির দ্রুত ফোন করলো ডক্টরকে।আদ্রিতাকে আপাতত নিবিড়ের বেডেই শুইয়ে দেওয়া হলো। কিছু সময় পর ডক্টর এসে চেকআপ করে জানাল অতিরিক্ত নার্ভাস আর হাইপার হয়ে যাওয়ায় নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। যা আদ্রিতার প্রায়ই হয়ে থাকে। ডক্টরের কথা শুনে স্তব্ধ নিবিড়। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“এক মিনিট আঙ্কেল! প্রায়ই হয়ে থাকে মানে?”
ডক্টর বলল,
“হ্যাঁ, কেন তুমি জানোনা? অরি মামুনির তো এই সমস্যা অনেক বছর হলো। বেশি হাইপার বা নার্ভাস হয়ে গেলে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।”
নিবিড় একবার তার মায়ের দিকে তাকালো।পরপর বেরিয়ে এলো রুম থেকে। তানি গেল ছেলের পেছনে।
তানি লিভিং রুমে এসে দেখলো নিবিড় মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে আছে। ছেলের মনোভাব এখন কি পরিমাণ বিধ্বস্ত তা অনুমান করতেও ব্যার্থ হচ্ছে তানি। আগের নিবিড় হলেতো এতক্ষণে সারাবাড়ির সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলতো। কিন্তু এই গম্ভীর নিবিড়কে যেন তানি মা হয়েও বুঝতে অক্ষম হয়ে যাচ্ছে। তানি এগিয়ে এসে ছেলের পাশে এসে দাঁড়াল। তবে কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারছেনা। হঠাৎ নিবিড় নিজেই মায়ের পানে না তাকিয়েই থমথমে কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমিতো বলেছিলে আমি না থাকলে নাকি ও ভালো থাকবে। এটাই বুঝি তার নমুনা? এই বুঝি তোমাদের ভালো রাখা? কই আগেতো ওর এমন কোনো সমস্যা ছিলোনা?”
তানি জবাব দিতে পারলোনা ছেলের কথার। কি জবাব দিবে! তার কাছে যে কোনো মোক্ষম জবাব নেই। ছেলের কথা মিথ্যে নয়।আদ্রিতার এই সমস্যা আগে ছিলোনা। যেদিন নিবিড় বিদেশ চলে যায় তারপর আদ্রিতা অনেক কান্নাকাটি হাইপার হয়ে যায়। অতিরিক্ত কান্নাকাটি করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপর থেকেই অরির এই সমস্যা শুরু হয়েছে। আজ যেন তানির নিজের সিদ্ধান্তের ওপর প্রশ্ন উঠছে। আসলেই কি সে ঠিক করছে? নিবিড় থাকলে কি আদ্রিতার এই রোগ হতো কখনো?
চলবে……..