#লেখনীতে #রেহানা_পুতুল
আমি কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে এক নারকীয় ঘটনার সাক্ষী হয়ে পড়ে রইলাম নির্জীবের মতন।
তিনি উদভ্রান্তের ন্যায় কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ফোন দিয়ে বললেন,
তুই নাকি বিয়ে করলি কবিরের বউকে? সেতো আমার প্রিয় বৌমাকে মেরে ফেলল বাবা।
আলতাফ শিকদারের পাকা অভিনয় দেখে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। ঘৃণায় নাড়িভুড়ী ঠেলে ভিতর থেকে বমি আসার উপক্রম। সারা গা গুলাতে লাগল। মনে হলো কেয়ামতের আলামত তখনি আমি চাক্ষুষ দেখতে পেলাম। ফোনের ওপাশে সজীবের বাবা কি বলল তা আমি শুনতে পাইনি। তার কিছুক্ষণ পর আমার স্বামী কবির আমাকে ফোন দিল। বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করল।
ডাইনী, রাক্ষুসী এই ছিল তোর মনে? তোকে তালাক দিচ্ছি। কেন মিথ্যে বলে আমার বন্ধুর বউকে মেরে ফেললি? আমার বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
তার কিছুক্ষণ পর খবর এলো সজীবের বাবা ঢাকায় আকস্মিক স্ত্রী শোক সইতে না পেরে হার্টস্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন।
পরেরদিন সকালে সজীবের বাবা ও মায়ের একসাথে দাফন সম্পন্ন হলো। সজীবের দাদা জানাযার আগে উঠানে দাঁড়িয়ে সবাইকে শুনিয়ে বললেন,
যেহেতু আমার ছেলে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তাহলে আজ থেকে সেই মেয়েলোকটা শিকদার বাড়ির বউ হিসেবেই স্বীকৃতি পাবে। এবং আমার কলিজার টুকরা নাতি সজীবকে লালন পালন করবে। উপস্থিত কেউই কোন উচ্চবাচ্য করলনা। কায়মনোবাক্যে সবাই মেনে নিল উনার কথা।
সুজানা এবার একটু থামল জিরোনোর উদ্দেশ্যে। লতা নির্বিকার কন্ঠে বলল,
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর সেই মানুষ এতটা হিংস্র! এতটা দানবীয় কান্ড ঘটাতে পারে। এ যেন সিনেমা, রূপকথার কাহিনীকেও হার মানাবে। বুড়া শিকদারের মৃত্যু হবে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম ও নিকৃষ্টতম মৃত্যু!
আচ্ছা আপনার নিকটজন কেউ এ নিয়ে প্রতিবাদ করেনি? বা থানা পুলিশ?
মাগো! এই সমাজ চলে সবলের ইশারায়। আর সবল পিষে মারে দূর্বলকে। তারা অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারেনি। শুরু হলো আমার দূর্বিষহ জীবন। সজীবকে কত করে বোঝালাম, বললাম আসল সত্য। কিন্তু মুখোশ পরা দাদার অপার স্নেহ মমতায় অন্ধ সজীব। দাদার কথাকেই সে বেদবাক্য মনে করল। সজীব যখন বড় হতে লাগল আর পৃথিবী সম্পর্কে বুঝতে লাগল,তখন থেকে আমার প্রতি তার ঘৃণা ক্রমশ বাড়তে লাগল। আমাকে কোনভাবে সহ্যই করতে পারতোনা। বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতো। কিন্তু তার দাদা তাকে বলত,
তোর বাবার বিয়ে করা স্ত্রী যাবে কোথায়।
এদিকে আমার আত্মীয় স্বজন ও মিথ্যেকে সত্যি ভাবতে শুরু করল। আমার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। ধীরে ধীরে আমি একা হয়ে যাই। সজীবকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরে তার খালার বাসায়। সজীব ওখানে থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে। পরে ঢাকায় বড় বিজনেস শুরু করে পাটনার নিয়ে।
তো আপনি এখন পড়ে আছেন কেন? চলে যেতেন?
গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুজানা আবার ও বলতে শুরু করল,
উনি নিজ থেকেই আমাকে দশ শতাংশ জায়গা দিয়েছে। এবং হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যেন এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা না করি ও মুখ বন্ধ রাখি। নইলে আমার কাছের সবাইকে মেরে ফেলবে।
উনি কি আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছে?
না এটা কখনোই চায়নি। যেহেতু সমাজে প্রকাশ করেছে আমি তার ছেলের বউ। তাহলে এটাতো পারছেনা। উনার মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় যে তাহলে। কিন্তু উনি সবসময় আমার সাথে শারিরীক সম্পর্ক করতো খুব। এবং উনি শারিরীক শক্তি ও যৌনশক্তি বৃদ্ধি করার জন্য নিয়মিত ঔষধ খায়। বাগানে বহু ঔষধি বুনোলতাপাতা লাগিয়েছে এজন্য। উনার এসব কিন্তু সজীব জানেনা। সে বাড়ির চারপাশের কোন খবরই রাখেনা। বাড়িতেও তেমন আসেনা আমাকে সহ্য করতে পারেনা বলে। আর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এত বিপুল অর্থ সম্পদ সব আলতাফ শিকদারের নামেই। সজীব বাড়ি আসলে উনি মুসল্লী সাজে তার সামনে।
তারমানে এই বিষয়টা এখনো আপনার সাথে চলে?
নাহ। আজ চার বছর ধরে বন্ধ। আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছি। ঘরের কোন কাজ ও করতে পারিনা তেমন। তাই তারপর থেকে বাসায় কাজের মেয়ে রাখা হয়। চরের থেকে নিয়ে আসে মাসান্তে বেশি বেতন দেওয়ার কথা বলে। দরিদ্র পিতামাতা অর্থলোভে বাড়ন্ত বয়সের কিশোরী মেয়েদের তার হাতে তুলে দেয় অগাদ বিস্বাসে। ছয়মাস না যেতেই সেই মেয়েরা চলে যেতে চায় উনার নষ্টামির জন্যই।
তোমাকেও পছন্দ করে এনেছে তিনি ভোগ করার জন্যই। ভেবেছে তোমরা সজীবদের চেয়ে দূর্বল। তোমার নামে জায়গা লিখে দিলে তুমি মুখ বন্ধ রাখবে এবং তার কামনা চরিতার্থ করার সুযোগ করে দিবে। এজন্যই আমি তোমাকে সাবধানে থাকতে বলেছি। সরাসরি বলে কোন বিপদে পড়ে যাই। তাই পরোক্ষভাবে বলেছি তোমাকে। উনি বিয়ে করেনি এজন্যই। করলেতো স্ত্রী তার বাধা হয়ে যাবে। কম বয়েসী মেয়েদের শরীরের উপর উনার মারাত্মক লোভ।
সুজানার গলা ধরে আসে। আর বলতে পারছেনা। অবসাদগ্রস্ত দেহটাকে এলিয়ে দিল বিছানার মাঝে।
লতা উঠে দাঁড়ালো। সুজানার পিঠে সহানুভূতির হাত রাখল। বলল,
আপনি এখন ঘুমিয়ে যান। পরে আরো কিছু জানার প্রয়োজন হলে আমি জিজ্ঞেস করব।
লতার কাছে সবকিছু বলতে পেরে সুজানার বুকটা হালকা হয়ে গেল আজ। যেন বহুদিন পর সে কারাগার থেকে মুক্ত পেল। লতা তার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে গেল। যদিও ঘুম তেমন এলনা। দূর্ভাবনায় নিশি ফুরিয়ে গেল। এক দরিয়া ঘৃণা ও ক্রোধ জমা হলো তার সৎ মা মাসুদার উপরে। সে কি জেনেশুনেই তাকে এখানে বিয়ে দিল। নাকি না জেনেই কেবলমাত্র ধনী ঘর দেখেই।
নিত্যদিনের মতই সবার যাপিত জীবন চলতে লাগল। বেলা হয়ে এলে সবুজ বোন রুমকিকে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে বোনের বাড়িতে এলো। লতার রুমে গিয়ে তালা চাবি বুঝিয়ে দিল চুপিচুপি। লতা সবাইকে বলল রুমকি আসতে চাইল। তাই সবুজ নিয়ে আসল।
লতা ফার্মেসীর কথা বলে সবুজের সাইকেলে চড়ে নিকটবর্তী থানায় গেল। রুমকিকে চুমকি ও সুজানার হেফাজতে রেখে গেল। চটপটে রুমকির অপার কৌতুহলী চোখ সারাবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল বিমোহিত হয়ে। আলতাফ রুমকিকে দেখেই ডাক দিল। রুমকি রঙিন প্রজাপতির মতো তিড়িংবিড়িং করতে করতে তার রুমে গেল।
দাদাজান কেমন আছেন?
এখন বেশী ভালো তোমাকে কাছে পেলাম বলে। তোমাদের বাড়ির সবাই কেমন আছে?
এইতো ভালো দাদাজান।
তুমি কিসে পড় রুমকি?
এবার এসএসসি দিব।
ওহ আচ্ছা। তুমি আমার রুমে আসলা। কি যে খাওয়াই তোমারে। পান খাইবা দাদুভাই।
রুমকি একগাল হেসে বলল,
হ খামু। দাদা কইলে।
তাইলে আমাকেও দাও। তুমিও খাও।
রুমকি খুশী খুশী মনে পান বানিয়ে দিল আলতাফকে। নিজেও বানিয়ে মুখে পুরে দিল। অল্পসময়ের ভিতরে রুমকিকে পানের নেশা ধরে ফেলল।
সে ঝাপসা চোখে আলতাফের দিকে চাইল। জড়ানো কন্ঠে বলল,
ওমা! দাদা কি পান খাওয়াইলেন আমাকে। আমি পড়েই যাচ্ছি।
আরেহ পড়বানা। আমি আছিনা। ঠিকভাবে বিছানায় শুয়ে থাক কিছুক্ষন। আরাম পাইবা একটু পরে।
আলতাফ উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। রুমকি কে বিবস্র করে ফেলল। রুমকি বুঝতে পারল। চিৎকার দেওয়ার আগেই তার মুখ বেঁধে ফেলল। হ্যাংলা পাতলা গড়নের রুমকি পুরুষের শক্তির সাথে পেরে উঠলনা। তার কুমারিত্ব হরণ হয়ে গেল ঘন্টাব্যাপী। একাধিক লাল চিহ্নতে বিছানা ভরে গেল। রুমকি ব্যথায় কোঁকাচ্ছে। উঠতেও পারছেনা। আলতাফ নিজেই রুমকিকে সেলোয়ার কামিজ পরিয়ে দিল। কিন্তু রুমকি উঠে দাঁড়াতেও পারছেনা।
লতা থানা থেকে হতাশ মনে বাড়ি ফিরে এলো। পুলিশ লতাকে বলল,
প্রত্যক্ষ প্রমাণ না মিললে আমরা অপরাধীকে সনাক্ত করতে পারিনা। এরমধ্যে আলতাফ শিকদার প্রভাবশালী লোক। এই পৃথিবী টাকার গোলাম। তাই উনার টাকার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে প্রশাসনের লোকেরাও।
লতা ঘরের দোরগোড়ায় পা রাখতেই, চুমকি ও সুজানা ভয়ার্ত কন্ঠে,
সর্বনাশ হতে গিয়েছে। রুমকিকে হাসপাতালে নিতে হবে। তুমি বের হয়ে যাওয়ার পর রুমকি আমাদের কাছ থেকে উঠে যায়। কিছু সময় বাদে চুমকিকে পাঠাই রুমকিকে খুঁজতে।
লতা বাঘীনি রূপ ধারণ করে। চুমকি ও সুজানাকে সাহস দিয়ে তার সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আলতাফ শিকদার তার রুমেই ছিল দম্ভের সাথে। তার বিশ্বাস ছিল লতা সুজানার মতই নিরব থাকবে।
চুমকি দুটো রিক্সা ডেকে আন দ্রুত।
সুজানা ও লতা রুমকিকে ধরে বিছানা থেকে তুলে দাঁড় করালো। রুমকি ব্যথায় পা ফেলতে পারছেনা। তাকে রুমের বাইরে এনে দাঁড় করালো। আলতাফের হাত থেকে তার মোবাইল ছিনিয়ে নিল লতা। যেন কোথাও কোনভাবে যোগাযোগ না করে কোন নতুন ফন্দী না আঁটতে পারে।
আলতাফ চোখ কড়মড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
এই ফকিরনীর মাইয়া। তোর এত বড় হিম্মত হয় ক্যামনে আমার মোবাইল কেড়ে নেওয়ার?
লতা বলল,
আমি যেই সেই লতা নয়। নীল বুনোলতা। তোর যম। বুঝলি কিছু খাটাইস।
চুমকি রিকসা ডেকে আনলে সবাই মিলে রুমকিকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে গেল। লতা রিকসায় বসেই তার দাদীকে ফোন করে জানায়,
রুমকি তার দাদাশশুর আলতাফ শিকদার দ্বারা বাজেভাবে রেপ হয়েছে। এখন হাসপাতালে আছে৷
বিকেলে রুমকির কাছে সুজানা ও চুমকিকে রেখে বাড়িতে গেল লতা। তাদের গেইটের সামনে যেতেই দেখল শতশত উৎসুক জনতার ভীড় বাড়ির উঠানে।
লতা বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
কি হয়েছে। বাড়িভর্তি জনসমাগম কেন?
অচেনা কজন বলল,
ভয়ংকর আলতাফ শিকদার খুন হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।
খুউন! কে করেছে? ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলো লতা।
জানিনাতো।
লতা ভীড় ঠেলে ঘরের সামনে গেল। দেখল…
চলবে — ৯
জনরা #থ্রিলার