নীলার শাশুড়ী পর্ব ৩
দীর্ঘ ২ মাস হাসপাতালে থেকে নীলা বাসায় ফিরে আসে । শরীরের ক্ষত শুকিয়ে গেলেও মনের ক্ষত এখনো বডড দগদগে। এই দুইমাসে যখন ওর শশুড়বাড়ীর কেউ ওকে হাসপাতালে দেখতেও আসে নি , তখনি ওর মনে হয়েছে কিছু একটা হয়েছে । প্রথমে ওকে আদনানের মৃত্যুর কথা বলা হয় নি। ডাক্তারের পরামর্শেই গোপন রাখা হয়েছিল । বলা হয়েছিল আদনানও ওর মতই অন্য বেডে চিকিৎসাধীন । তাই দেখা করা যাচ্ছে না । কিন্তু ওর শশুড়বাড়ীর কেউ ওকে একবারও হসপিটালে দেখতে এলো না , এতো মানুষ তাকে দেখতে আসে কিন্তু ওর শশুড়বাড়ী থেকে কেউ আসে না,এটা ভেবে নীলা কূল পেত না নীলা, কি হয়েছে!
নীলার পরিবারের সবাই নিজেদের মত করে নীলাকে এটা ওটা বলে বুঝিয়েছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে কখনো কখনো বেশী চিন্তা করতেও তেমন পারত না নীলা। কিন্তু বাসায় ফিরবার কয়েকদিন আগে যখন জানতে পারে আদনান আর বেঁচে নেই তখন ও ওর মাকে জিগ্গ্যেস করেই বসে ঐ পরিবারের সাথে কি কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। নীলার মা আসল ঘটনা চেপে বলেন , তারা তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় ।
বাসায় ফিরবার পর নীলা ধীরে ধীরে সব জানতে পারে , আর সেই থেকে সদ্য স্বামী হারানোর কষ্টের সাথে ও নিজেকেও দোষী ভাবতে শুরু করে। ওর শশুড়বাড়ীর লোকজন এমনও বলে দিয়েছে নীলা যেন কোনদিন ঐবাড়ীর চৌকাঠ না মাড়ায়। তাহলে ও যে অমঙ্গল ওর স্বামীর জন্য বয়ে এনেছিল তার প্রভাব তার পরিবারের উপরও পরবে। নীলার সাথে আদনানের স্মৃতি একেবারেই হাতে গোনা। বিয়ের পরে নীলার আদনানের সাথে যখনি সম্পর্কটা একটু একটু করে গভীর হতে শুরু করছিল ঠিক তখনি এমন ঘটনা ঘটে গেল । একে তো সদ্য বিধবা একটি তরুনী নীলা, তারপর অপয়া অলক্ষ্মীর এই অপবাদে নীলা মানসিকভাবে ভীষন পর্যুদস্ত হয়ে পরল। নীলা এখন পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হয় না , কারও সামনে তো যাই না, কোন সামাজিক অনুষ্টান যেমন বিয়েতে একেবারেই যায় না। ওর নিজেরও মনে হয় ইদানিং ও গেলে হয়ত কোন অমঙ্গল হবে। নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নীলা এক দুর্বিসহ জীবনই কাটাতে লাগল , আর তার সাথে নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না নীলার বাবামা। নীলার বিসিএস পরীক্ষা দেবার কথা ছিল , বাবা ভেবেছিল পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকলে হয়ত সব ভুলে যাবে । কিন্তু নীলার সেদিকে বিন্দু মাত্র কোন ইচ্ছে বা আগ্রহও দেখা গেল না। সারাদিন মনমরা হয়ে নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখাই যেন তার ব্রত ।
দেখতে দেখতে প্রায় বছর হয়ে এলো ,নীলার মাঝে মাঝে মনে হয় তার বিয়ের ঐ সময়টা হয়ত স্বপ্ন ছিল হয়তো বা দু:স্বপ্ন । মাত্র কয়েকটা দিনের স্মৃতি তার জীবনের সব হিসেব নিকেশ এলোমেলো করে দিলো!
হাফসা বেগম নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন কিন্তু নীলা তেমন কারও সাথে কথাই বলতে চায় না আজকাল । হঠাৎ একদিন হাফসা বেগম তার স্বামী ইসহাক ইসলাম ও বড় ছেলে নাইম কে নিয়ে বরিশালে তার বোনের বাসায় এলেন । কিছুদিন আগেই তার বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে এসেছে। তারপর নীলার মা’কে ফোন করে জানালেন সন্ধ্যে বেলা তারা একটু তার বাসায় আসবেন ।নীলার মা অনেকদিন পর মেহমানদারী করবার জন্য কিছু নাস্তা বানালেন , ঠিক করলেন রাতে তাদেরকে খেয়ে যেতে বলবেন , শত হলেও হাফসাবেগমের বড় ছেলেকে নিয়ে হাফসা বেগম প্রথম আসছেন তার বাসায়। তায় ছেলেটা বিদেশে থাকে একা একা । সন্ধ্যে নাগাদ হাফসা বেগমের বোনের পরিবারের সবাই আর হাফসাবেগম নীলাদের বাড়ীতে এসে পৌঁছলে অনেকদিনপর বাড়ীটি যেন একটি গুমোট আবহ থেকে বেরিয়ে এলো। চা নাস্তা খাবার পর হাফসা বেগম বললেন তিনি কিছু কথা বলতে চান।
তিনি আর তার স্বামী জানালেন তারা আজ একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে নীলাদের বাসায় এসেছে।
আর তা হল ,নীলাকে তারা তাদের বড় ছেলের বৌ করে ঘরে নিতে চান।
নীলার বাবামা এমনকি হাফসা বেগমের বোনও এই অভাবনীয় প্রস্তাবে একেবারে বিস্মিত হতবাক হয়ে গেলেন।
নীলার মা বলেই ফেললেন,
“কিন্তু”।
হাফসা বেগম তাকে থামিয়ে বললেন ,
“কিন্তু কি আপা ?”
এবার নীলার বাবাই বলে ফেললেন ,
“নীলা তো আপনার ছেলের চেয়ে বয়সে তিনবারের বড়, আর তাছাড়া…”!
এবার ইসহাক সাহেব হাফসাবেগমের স্বামী বললেন ,
“মেয়ে বয়সে বড় হলে তো ধর্মীয় দৃষ্টিতে কোন সমস্যা নেই , আর যদি সামাজিক রীতির কথা বলেন তাহলে বলব , কুপ্রথা আমাদেরকেই দূর করতে হবে। “
নীলার মা হাফসাবেগম কে বললেন ,
” নীলা যে শুধু বয়সে বড় তাতো নয় ও তো বিধবাও , আপনার ছেলে কি সব জানে আপা”?
হাফসা বেগম বললেন ,
“আমার ছেলেকে আমি সব বলেছি ।সে যেমন মেয়ে পছন্দ করে নীলার মাঝে তার সব গুনাবলি আছে ।আর আমরা তো সব জেনেশুনেই এগিয়েছি ,এমনতো নয় কিছু গোপন আছে এখানে। এখন নীলার মত আর আপনাদের মত থাকলেই আমরা আর শুভ কাজে দেরী করতে চাইনা। “
নীলার মত নিতে নীলার ঘরে হাফসাবেগম আর নীলার মা দুজনেই গেলেন । নীলা বসে কাঁদছিল অঝোরে ।
হাফসা বেগম এসে নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ,
“আল্লাহ যা করেন তা তার বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন ।তোমার কি মত আছে মা এ বিয়েতে । আমার ছেলে নাইম তোমার অযোগ্য হবে না এটুকু বলতে পারি ।”
নীলা এবার প্রথম মুখ তুলে কথা বলল ,
” কিন্তু আমি তো অপয়া, অলক্ষ্মী , আমার জন্য যদি আপনাদের পরিবারের কোন অমঙ্গল হয় ? তাহলে ?”
হাফসা বেগম হেসে বললেন ,
“তুমি কি জান ইসলাম ধর্মে অপয়া, অলক্ষ্মী , কুলক্ষন বলে কিছু নেই ! এটা আমার কথা নয় সহি বুখারী শরীফের হাদিসে আছে । একজন মানুষ অন্য মানুষের একজন মানুষের মৃত্যুর বা দূর্ভাগ্যের কারন হতে পারে না। তার আয়ু আল্লাহ দ্বারা নির্ধারিত । লোকে বলে কালো বেড়াল , কালো কুকুর , কাক ডাকা কুলক্ষন , এগুলো কুসংসকার । ধর্মীয় ভাবে এর কোন ভিত্তি নেই । তাই এগুলো বিশ্বাস করা অযৌক্তিক শুধু নয় ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক ও বটে । “
তিনি আরও বললেন ,
“আমরা যদি এই সুন্দর বিধানগুলে আমাদের বাস্তব জীবনে চর্চা না করে অন্যকিছুর চর্চা করি তাহলে তো দু নৌকায় পা দিয়ে চলার মতো হবে। কুপ্রথার চর্চাই হবে।”
হাফসা বেগমের কথায় নীলার আজ মানে ঐ দূর্ঘটনার পর প্রথম মনে হল সে অপরাধী নয় । এতদিন বিনাবিচারে সে কেবল সাজা ভোগ করছিল ।
নীলা তার সম্মতি জানিয়ে দিল ।
হাফসা বেগমের বোন একটু ইনিয়ে বিনিময়ে বলার চেষ্টা করেছিল যে নাইম অর্থাৎ তার বোনপো তো অবিবাহিত তাই তার জন্য একে তো বড় তায় বিধবা মেয়েকে বিয়ে করা কতটা যুক্তিযুক্ত হচছে।
জবাবে হাফসা বেগম বলেছিলেন রাসুল ( স:) এর সাথে তাঁর প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা:)র বিয়ের আগে তার আরও দু দু বার বিয়ে হয়েছিল আর সেই দু স্বামীর ছেলে মেয়েও ছিল আর তিনি দু দুবার বিধবা হন আরও বয়সে তিনি রাসুল (স:) এর প্রায় ১৫ বছরের বড় ছিলেন । শুধু তাই নয় রাসুল (স:) তালাকপ্রাপ্তা নারীকেও বিয়ে করেছিলেন । হাফসা বেগমের এই জবাবে তার বোনের আর কিছু বলার ছিল না ।
বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করে হাফসা বেগম আবার ঢাকায় ফিরে গেলেন । কিন্তু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে তিনি কিছু শর্ত দিয়ে দিলেন , যা সকলকে বিস্মিত ও অবাক করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
নীলার বিয়েতে বরপক্ষ ঢাকা থেকে খুব অল্প সংখ্যক এসেছিল ।তারা নিজেরাই থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল হোটেলে । নীলার বাবার অনেক অনুরোধেও কাজ হয় নি। নীলার বাবা চেয়েছিলেন বর পক্ষের থাকার ব্যয়ভার তিনিই বহন করবেন ।এটাতে সামাজিক রীতি !মেয়ে পক্ষের পক্ষ থেকে কোন অনুষ্টান করতে দেয়া হয় নি । বিয়ের সকল খরচ ( কাজীর ফি এবং রেজিস্ট্রেশন বাবদ যে টাকা দিতে হয় ) বরপক্ষ বহন করেছে , বিয়েতে কনের বাড়ী থেকে কোন যৌতুক যা উপহার নামে ডাকা হয় তা দেয়া যাবে না। কেবল নীলার মায়ের বহু অনুরোধের পর এক সেট গহনা নীলাকে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন । বিয়ের সাথে সাথে দেনমোহরের টাকা দিয়ে দেয়া হয়েছিল । আর ওয়ালিমার অনুষ্টান এ মেয়ে পক্ষের সবাইকে আর ছেলে পক্ষের আত্মীয়দের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল ।
তাই নীলার বিয়ে ও বিয়ে পরবর্তি ঘটনা প্রবাহ সবাইকে চমকে দিয়েছিল । অনেকেই হাফসা বেগমের কাছে জানতে চেয়েছিলেন , কেন তিনি এতোটাই স্রোতের বিপরীতে হাঁটলেন তার ছেলের বিয়ে নিয়ে । জবাবে তিনি বলেছিলেন তিনি যে মত বা ধর্ম চর্চা করেন,সেই নিয়মেই তিনি সব করেছেন । অন্যরা যে ভুল পথে চলছে তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন সঠিকটা করে। আর পরবর্তীতে তার ছেলের এই বিয়ের ঘটনা প্রবাহ মানুষ কে যাতে উদ্বুদ্ধ করে সঠিক নিয়ম মেনে চলতে তারই একটি দৃষ্টান্ত কেবল তিনি তৈরী করতে চেয়েছেন ।
নীলা হাফসা বেগমের বাসায় এর আগেও বহুবার এসেছে কিন্তু এবারের আসাটা ভিন্ন। এবার এবাড়ীর একজন সদস্য হিসেবে আসা ।
বিয়ের পর হাফসা রান্না ঘরের কাজে সাহায়্য করতে চাইলে হাফসা বেগম বলেছিলেন ,
সংসারের জোয়াল কাঁধে পরলে সব শিখে যাবে আগে ওরা দুজনে দুজনকে জানুক , চিনুক , বুঝুক। এই সময়টা পরস্পরকে বুঝবার জন্য খুব ভাল একটা সময় ।
তাই পরস্পরকে সময় দিয়ে নিজের মধ্যে বোঝাপরাটা করে নেবার এটাই সুবর্ন সুযোগ । আর বিয়ের পর এ সময়টা বড্ড মধুর । আর ফিরে আসে না এ সময়টা । তাই তিনি চান এসময়টা তারা পরিপূর্ন ভাবে উপভোগ করুক।
নীলা অবাক হয়ে ভাবে তার শাশুড়ী তো খুব বেশী পড়ালেখা করে নি তবে কোথা থেকে তিনি এতো স্বচ্ছ আর সংবেদনশীল মানসিকতা পেলেন !
আসলে পুঁথিগত বিদ্যা একটি মানুষের মনুষত্ব্য কে জাগিয়ে তুলতে পারে না এটি মানুষের ভেতর থেকে আসে!!
চলবে…..