নীলার শাশুড়ী পর্ব ৪
নাইম তিন মাসের জন্য দেশে এসেছিল । দেশে আসবার আগে চাকরি ছেড়ে এসেছিল যেন ফিরবার তাড়া না থাকে। গিয়ে আবার নতুন কোন চাকরিতে যোগ দিবে এমনি পরিকল্পনা ।এবার একটু বেশী সময়ই থাকতে এসেছিল । দেশে এসে আত্মীয় বন্ধু পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে মনে হচ্ছে একে বারে থেকে গেলে কেমন হয়! প্রতিবারই ছুটিতে যখন ও দেশে আসে তখন এমনটি মনে হয় ! এই মায়া জিনিসটা বড্ড খারাপ । যেখানেই যায় জালের মত আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে ধরে!
আর এবার আরও একটি নতুন চোরা টান অনুভব করছে তার সাথে ।
নাইমের জীবনটা এখন নীলিমায় নীল হয়ে গেছে , নীলা নামক মহামূল্যবান হীরের ছোঁয়ায়!
নাইমের কেবলি মনে হচ্ছে নীলাকে ছেড়ে কিভাবে যাবে ও অস্ট্রেলিয়ায়!
কাগজ পত্র তৈরী করে নিতে তো একটু সময় লাগবেই । ততদিন কেমন করে ও একা একা থাকবে !
কৈ এতো বছর তো একাই ছিল , এমন তো মনে হয় নি আগে!!
ও দিকে নীলা ভাবছে আদনানের মৃত্যুর পর তার জীবনে যে অন্ধকার নেমে এসেছিল তা যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল নাইমের সংস্পর্শে এসে, দেখতে দেখতে নাইমের চলে যাবার সময় ঘটিয়ে আসছে । ওর কাগজ পত্র তৈরী করা হচ্ছে।হয়ত কয়েকমাসের ব্যবধানে চলে যাবে নীলাও । এখন নীলার আরও একটি পিছুটান আর তা হল ওর শাশুড়ী হাফসা বেগম । ওর কেবলি মনে হয় হাফসা বেগম কে ছাড়া কিভাবে সে একা একা সংসার করবে? এই ক’মাসে ওর কেবলি মনে হয়েছে হাফসা বেগম পাশে না থাকলে ওর জীবনটা এতো মায়াময় থাকবে না।
কথা প্রসংগে একদিন নীলা বলেও ফেলেছিল এ কথাটা , তখন হাফসা বেগম খুব সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন ,
বলেছিলেন…
“বিয়ের পরে সদ্য তোমরা যখন একা একা সংসার সাজাবে, দেখবে একটি হাড়ি , বাটি , একটি সামান্য কৌটাও কতো আনন্দ নিয়ে কিনবে , তারপর আস্তে আস্তে সংসারের মায়া জড়িয়ে নিজের একটা ভুবন তৈরী করে ফেলবে । আমরা তো আছিই সবসময় ছায়া হয়ে । এরও দরকার আছে জীবনে !”
নীলা এতো অবাক হয় হাফসাবেগমের এমনতর ভাবনাগুলো শুনে।
ও ভাবে কৈ আমিও তো এমন করে জীবনকে দেখতে পাই না কখনো!
ওর এখন মনে হয় নাইম তো আছেই তার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া হাফসা বেগমকে শাশুড়ী হিসেবে পাওয়া!
এরই মাঝে নাইমের চলে যাবার সময় হয়ে এলো।নীলার যেতে হয়ত তিন থেকে চারমাস লাগতে পারে ।নীলা নাইম আসন্ন বিচ্ছেদে কাতর। এরই মাঝে দাম্পত্যের অমোঘ নিয়মে নীলা আর নাইমের মৃদু কথা কাটাকাটি হয়েছিল একদিন , দু’তিনদিন ছিল সে অভিমান পর্ব । হাফসা বেগম বা ইসহাক ইসলামের চোখও এড়ায় নি তা। নীলা ভেবেছিল হাফসা বেগম হয়ত জানতে চাইবেন কি হয়েছিল তাদের মধ্যে ।কিন্তু তিনি তা করলেন না ,
নীলাই একদিন ওর শাশুড়ীকে জিগ্গ্যেস করল..
“মা আমাদের মধ্যে মাঝে ক’দিন একটু মান অভিমান সোজা বাংলায় ঝগড়া হয়েছিল , আপনি কি কিছু বুঝতে পেরেছিলেন ?”
হাফসা বেগম হেসে বললেন,
” খুব বুঝেছি , চুল তো আর হাওয়ায় পাকে নি আমার “!
নীলা একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
“কৈ জানতে চাইলেন না তো কি হয়েছিল আমাদের মধ্যে বা ঝগড়াটা কার ভুলের জন্য হয়েছিল বা কে ভুল ছিল ?”
হাফসা বেগম পূর্ণ দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে , ওর চিবুকে হাত দিয়ে হেসে বললেন,
শোন নীলা , দাম্পত্য কলহ প্রতিটা দম্পতিরই হয়।
আর ছোটখাটো এসব মনকষাকষি কিন্তু শরৎ এর মেঘের মতো। এই আছে এই নেই।
তাই এগুলি নিয়ে বেশী মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
মাঝে মাঝে এই মান অভিমানগুলোই জীবনকে আরও মধুর করে তোলে ।
কিন্তু সমস্যাটা হয় তখনি , যখন এখানে তৃতীয়পক্ষ ঢুকে পরে।এই যে তোমরা তোমাদের মান অভিমান পর্ব নিজেরাই শুধরে নিয়েছ ।
এখানে তৃতীয়পক্ষ এলে তা আর তোমাদের দুজনের মধ্যে থাকত না , অনেক সময় খুব ছোট একটি ঘটনাও তৃতীয়পক্ষের হস্তক্ষেপে বিরাট ঘটনায় রূপ নেয়।
যা ভালো কিছু বয়ে আনে না।
তোমায় একটি অনুরোধ করব নীলা , নিজেদের সমস্য নিজেরাই সমাধান করতে চেষ্টা করো সবসময় ,কখনো যদি তৃতীয় পক্ষের সাহায্যোর দরকার হয়েই যায়,খুব ভেবেচিন্তে সত্যিকারের কোন পরীক্ষিত শুভাকাঙ্খী কে ডেকো, যে সমাধান করতেই আসবে ব্যবধান বাড়াতে নয়!”
নীলা অবাক হয়ে ভাবছিল , এই তথাকথিত সেকেলে মানুষ এতো গভীর জীবনবোধ কোথা থেকে পেলো! নীলা একযুগের মেয়ে হয়েও এমন ভাবনা ভাবতে পারছে কৈ!
দেখতে দেখতে কুরবানীর ঈদ এসে গেল । ঈদের পরেই নাইমের ফ্লাইট ।
এরই মাঝে নীলার মা একদিন নীলাকে জানালেন , বিয়ের পরে প্রথম কুরবানী ঈদে ওনারা নীলার শশুড়বাড়ীতে একটা গরু উপহার হিসেবে দিতে চান , এটাই নিয়ম । নীলার বাবা টাকা পাঠিয়ে দেবেন ,একই শহরে তো নয় তাদের বাড়ী, না হলে কিনেই পাঠাতেন। নাইম যেন ওর বাবা ভাইকে নিয়ে পছন্দ করে কিনে নেয় ।
সন্ধ্যে বেলা হাফসা বেগম নীলার ঘরে গিয়ে জানতে চাইলেন , নীলার বাবামা’র গরু উপহার এর ব্যাপারে । নীলা জানালো বিয়ের পর প্রথম কুরবানীর পশুটা তো ছেলের শশুড়বাড়ী থেকেই দেয়া হয় এটাই নিয়ম , তাই ওর বাবামাও সেটাই করছেন ।
হাফসা বেগম একগাল হেসে জানালেন , কুরবানী ফরজ হয় যার আর্থিক সঙ্গতি আছে তার উপর । এটি কেউ কাউকে উপহার দিতে পারে না। আর বিয়ের পর মেয়ের বাবামাকে ছেলের বাড়ীতে কুরবানীর পশু উপহার হিসেবে পাঠাতে হবে এমন কোন ধর্মীয় বিধান তো তিনি কখনোই শোনেন নি ,না কোরআন হাদিসের কোথাও আছে ! এটা তো যৌতুকেরই নামান্তর । আর যৌতুক নেয়া তো হারাম ! আর এই পশু দিয়ে কুরবানী করলে তো কুরবানী ই হবে না । লোক দেখানো বা উপহারের কুরবানীর এই রীতিও সামাজিক কু প্রথা । যা বিষফোঁড়ার মত হয়ে আছে আমাদের সমাজে ।
তিনি আরও বললেন , নীলার বাবামা’র না হয় আর্থিক সঙ্গতি আছে কিন্তু আজও এই আধুনিক যুগে বহু মেয়ের বাবামা সর্বশান্ত হয়ে যায় উপহার নামক এক ছদ্মবেশী যৌতুকের ফাঁদে পরে। এগুলো এখনি বন্ধ করতে হবে না হলে এগুলোকেই মানুষ ধর্মীয় রীতিনীতির মতো অবশ্য পালনীয় বলে ধরে নিবে।
হাফসা বেগমের এ কথার পর নীলা ওর বাবামা’কে জানিয়ে দিলো। এও জানালো হাফসা বেগম তাদেরকে ঢাকায় এসে ওদের সাথে একসাথে ঈদ করবার আমন্ত্রন জানিয়েছেন।
নীলার আত্মীয় মহলে এ ঘটনাও বেশ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল ।
হাফসা বেগম একাই যেন সমাজের এই অচলায়তন ভাঙ্গার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামনে এগিয়ে চলছেন, বলতে গেলে একাই!!
চলবে…..