নবনী পর্ব ২
নবনী কে নিয়ে ওদের বাড়িতে গেলাম। শশুর বাড়িতে আসলে প্রথমদিন বাজার করতে হয় এমন একটা নিয়ম আমাদের এলাকায় প্রচলিত আছে। আসার সময় মামা বলে দিয়েছেন বড়ো দেখে একটা মাছ কিনতে।
আমিও চিন্তা করেছি বাজারের সবচেয়ে বড়ো মাছটাই কিনে আনব। গতকাল রাতে নবীনদের বাড়িতে এসেছি। ওর বাবা মা খুবই আন্তরিক! আমার ছোটো বোন আর এক ভাগ্নীকে নিয়ে এসেছি সাথে।
রাতে নবনীর সাথে এক ঘরে ঘুমালাম। ও অনেক রাত।অবধি গল্প করে এসে শুয়ে পড়ল! আমার সাথে কোনো কথাই বলল না।
সকালে উঠে বাজার করার জন্য বের হলাম। নবনীদের এলাকার বাজারটা আমি ঠিক মতো চিনি না। একজন কে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাই বাজারটা কোথায়? “
“আপনি কি নবনীর জামাই?”
সরাসরি এমন প্রশ্ন শুনে একটু কেমন লাগল! হালকা হাসলাম কোনো কথা বললাম না। ছেলেটা বুদ্ধিমান।
“আসসালামু আলাইকুম দুলা ভাই।”
“ওয়ালাইকুম সালাম।”
ছেলেটার দিকে খেয়াল করলাম। বয়স কত হবে বাইশ-তেইশ বছরের ছোকরা। পরোনে জিন্স প্যান্ট, কালো রংয়া টি-শার্ট। দেখে বুঝা যায় পড়াশোনা জানা ছেলে। ” কী নাম তোমার?”
“রবিন।”
“কী করো রবিন?”
“আমি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি দুলা ভাই।”
“খুব ভালো। নবনী তোমার কেমন বোন হয়?”
“দূর সম্পর্কের চাচা তো বোন।”
“রবিন এখান ভালো চা বানায় কোথায় জানো? “
“বাজারে একটা ভালো চায়ের দোকান আছে। গরুর দুধের চা পাওয়া যায়। একবার খাইলে বুঝবেন!”
“চলো আগে চা খাই।”
বাজারের এক পাশে টিনের একটা ঘরের দুই পাশে কাঠের বড়ো বড়ো দুইটা টুল। টুলে বসে দুইকাপ চা দিতে বললাম। একজন মধ্যবয়স্ক লোক একটা মাটির চুলায় কেটলিতে চা বসিয়েছে। রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী খবর রবিন?”
“ভালো চাচা।”
“সাথে মেহমান কেডা?”
“নবনী আপার জামাই। “
“ওই নবনী? ” কেমন একটা ইঙ্গিত করল! আমার কাছে একটু কেমন লাগল বিষয়টা। কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম।
“ভালা আছেন জামাই?” কী বাজার করতে এসেছেন বুঝি?”
“জি।”
দুইকাপ চা দিলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। না, চাটা সত্যি সুস্বাদু! খাঁটি দুধের চা খেতে খুব ভালো লাগছে! মনের মধ্যে কেমন একটা খচখচানি চলছে! নবনীর সম্পর্কে এরা এমন কিছু জানে যা আমি জানি না! এমন কিছু কী আছে? বিয়েটা অবশ্য মায়ের পছন্দে হয়েছে। আমি বিয়ের আগে নবনীকে একবার দেখেছিলাম।
চায়ের দাম দিতে গেলাম উনি নিলেন না। আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রবিনও আমার পাশে পাশে হাঁটছে। একবার ভাবছি ওকে জিজ্ঞেস করি নবনীর সম্পর্কে। কেমন কেমন লাগছে! নিজের বউ সম্পর্কে অন্যের কাছে জানতে চাইব! মনের মাঝে সন্দেহের একটা দানা বাঁধছে! নবনী এই জন্যই আমার সাথে মিশতে চায় না? আমাকে ঠিক মানতে পারছে না!
রবিন কে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বাজারে গেলাম। বাজারটা বেশ বড়ো। মাছ বাজারে গিয়ে বিশাল সাইজের একটা কাতল কিনলাম। দুই হালি দেশি মুরগী আর কাঁচা বাজার নিয়ে ভ্যান গাড়িতে চড়ে রওয়ানা দিলাম। মনে মনে ভাবছি আজ রাতে নবনীর সাথে একটা বোঝাপড়া করব। প্রয়োজনে আজ একটু না জোর করলাম। নিজের বউয়ের ওপর একটু জোর তো খাটান যায় নাকি?
মনের মধ্যে কেমন একটা সন্দেহ কাজ করছে! নবনী কি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িত? বাজার নিয়ে ফিরে এলাম শশুর বাড়িতে। বাড়ির সবাই খুব আন্তরিক।
দুপুরে কত সব খাবারের আয়োজন করেছে! আমরা খেতে বসলাম। আধা পাঁকা একটা টিনের ঘর। মাদুর পেতে খাবার ব্যবস্থা। আমার শশুর আনোয়ার মাতবর বসেছেন আমাদের সাথে। চুল সাদা রং ধরলেও মানুষটা এখনো বেশ শক্তপোক্ত।
নবনী সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে। মাছের বড়ো মাথাটা আমার পাতে তুলে দিতে চাইলেন আমার শাশুড়ি রায়মা বেগম। আমি বললাম, ” আমি মাছের মাথা খাই না।”
উনি আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকলেন। মনে হয় এমন কথা জীবনে শুনেনি! ভাবলেন আমি বোধহয় ভদ্রতা করে বলেছি। “খাও বাবা মাথাটা ভারি স্বাদের! “
আমার একটু বিরক্তি লাগল। ওনার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম, “সত্যি আমি মাছের মাথা খাই না।”
আমার ছোটোবোনটা পাশ থেকে বলল,” ভাইয়া কোনো মাছের মাথাই খায় না।”
“আম্মা মাথাটা আব্বা কে দেন।”
মাছের মাথাটা শশুরের পাতে তুলে দিলেন।
নবনীর ভাবি এসে হেসে বললেন, “জামাই তাহলে মাথা খায় না! ভালোই হলো নবনীর মাথাটা বেঁচে গেল।”
“আপনারটা বুঝি খেয়ে ফেলেছে? “
“জামাই দেখি কথা জানে! নবনীর তো মেলা সুখ হবে!”
“তাই বুঝি?”
ভাবি হাসতে হাসতে হাসতে চলে গেল।
নবনীর ভাইয়ের সাথে দেখা হলো রাতে। উনি বাজারে একটা রড সিমেন্টের দোকান চালান। দেখতে উঁচা -লম্বা। সবার খবর নিলেন।
রাতে একটা আলাদা ঘরে আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ভাবি আমাকে ঘরে নিয়ে এলেন। নবনী এখনো আসেনি। আমি ঘরে বসে বসে নবনীর জন্য অপেক্ষা করছি। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আজ ওর সাথে কথা বলতে হবে।
অনেক রাত অবধি নবনী আসছে না! এক সময় শুয়ে পড়লাম কিন্তু আজ চোখে ঘুম নেই!
নবনী ঘরে আসল অবশেষে। ওকে দেখে আমি উঠে বসলাম। আমাকে সজাগ দেখে খুব অবাক হলো ও!
“কি ঘুমাননি এখনো!”
“না, ঘুম আসছে না।”
“কেন আমাদের বাড়ি ভালো লাগছে না বুঝি?”
“ঠিক তা না। এমনই ঘুম আসছে না। তোমার এত দেরি হলো?”
“ভাবির সাথে গল্প করছিলাম। “
“ও আচ্ছা। “
আমার দিকে না তাকিয়ে নবনী কথা বলছে! আমাকে কি ওর পছন্দ না? এমনটা হলে বিয়ের আগে আমাকে বলতে পারত। আমি তো ওর সাথে বিয়ের আগে একবার দেখা করেছিলাম। ফোনেও কথা হয়েছে কয়েকবার তখন তো কিছু বলেনি? এখন কেমন দূরে দূরে থাকছে!
আমি নবনীর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরলাম। ও আমার হাত সরিয়ে দিলো! আমার ভিতরে কেমন একটা জিদ কাজ করল। আমি ওকে শক্ত করে ধরলাম।
“ছারেন আমাকে বলে চিৎকার করে উঠল! জানোয়ার কোথাকার!”
গ্রামের বাড়ি এত চারিদিকে সুনসান নীরবতা! নিশ্চয় বাড়ির সবাই ওর চিৎকার শুনেছে! কী ভাববে সবাই?আমার কী যে লজ্জা লাগছে! মনে হচ্ছে মাটির নিচে ঢুকে যেতে পারতাম। এ কি করল নবনী!
চলবে —
® নাবিল মাহমুদ