নবনী পর্ব ৫
রাতে নবনী আমার ঘরে শোয়ার জন্য আসল। ওকে দেখে আমি খুব অবাক হলাম। রাগ লাগছিল প্রচন্ড!
আমি বললাম,” আপনি কী এ রুমে ঘুমাবেন? “
“হ্যাঁ, আপনার কোনো সমস্যা আছে? “
“একটু আছে। “
“তাহলে আমি কোথায় ঘুমাব?”
আঃ! কী সুন্দর কথা! আমি ঘুমাব কোথায়? খুব রাগ লাগছিল এ মেয়ের কথায়। যেন কিছুই বুঝে না!
“আপনি রুনুর সাথে ঘুমান।”
“আচ্ছা।” বলে হনহন করে চলে গেল। কী মেয়েরে বাবা!
ওদের বাড়ির ঘটনটা মা জানে না। মা কে বলতেও পারছি না। আজকের ঘটনা নিয়ে নিশ্চয়ই মা কথা শুনাবে। তখন কিছু একটা বলা যাবে।
অনেক রাত অবধি সজাগ ছিলাম। চোখে ঘুম আসছিল না। আগেই ভালো ছিলাম। কেন যে বিয়েটা করতে গেলাম! মা ই তো পাগল করে ফেলেছিল বিয়ে করার জন্য। কত মেয়ে দেখেশুনে নবনী কে পছন্দ করল মা। আমার খারাপ লেগেছিল তা না। ভালোই মনে হয়েছিল তখন। একবার ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেছিলাম।
সব জানলে মায়ের খুব খারাপ লাগবে! কত মেয়ে দেখে এমন একটা বউ এনেছে। আমি কী করব? ঠিক বুঝতে পারছি না।
সকালে ঘুম ভাঙলো মায়ের হাতের ছুঁয়ায়। মা মাথায় কেমন আলত করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমার খুব ভালো লাগছে মায়ের আদর খেতে। আদুরে কন্ঠে মা বলল, “খোকন তোর কী হয়েছে বলতো?” মা আদর করে আমাকে খোকন বলে ডাকে। এ ডাকটা শুনলে ভিতরটা কেমন শীতল হয়ে যায়!
“কিছু হয়নি তো মা।”
“নবনী কে তোর পছন্দ হয়নি বাবা?”
আমি কিছু বললাম না।
“বাবা শোন, মেয়েটা অন্য একটা পরিবারে বড়ো হয়েছে। অনেক কিছুই হয়ত আমাদের সাথে মিলবে না। একটু মানিয়ে নিতে হবে। সবাইকে ছেড়ে আমাদের কাছে এসেছে। একটু সময় দে মানিয়ে নিতে।”
মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ” মা ওই মেয়েই তো আমাকে পছন্দ করে না।”
আমার কথা মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। “কিছু বলছে নাকি তোকে?”
“তুমি ওদের বাড়িতে কথা বলো সব বুঝতে পারবে। এ মেয়ের অন্য কারে সাথে সম্পর্কে আছে।”
“কী বলিস! ওরা তো আমাকে কিছু বলেনি। এ মেয়েও তো বিয়ের আগে কিছু বলল না!”
“ওর পরিবার মনে হয় জোর করে বিয়ে দিয়েছে মা।”
মায়ের মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল! “তুই চিন্তা করিস না বাবা। আমি ওদের সাথে কথা বলব।”
উকিল বন্ধুর কাছে এসেছি একটা পরামর্শ করার জন্য। নবনী মেয়েটাকে ঘাড় থেকে নামাতে কোনো সহজ পথ আছে কিনা জানতে। মেয়েটা কে যেমন ভালো লেগেছিল এখন দেখলে খুব রাগ লাগে! এত সুন্দর একটা মেয়ে এমন হয়! মানুষ বলে সুন্দরের আশেপাশে সবসময় বিপদ থাকে। এখন মনে হচ্ছে কথাটা সত্যি।
উকিল বেশ নাম করে ফেলেছে মনে হয়। কী বিশাল অফিস। দামি সব ফার্নিচার দিয়ে সাজান আফিস ঘর।আ্যসিসট্যান্ট আছে দুইজন। আমাকে দেখে হাসি দিয়ে বলল, “আরে তুমি এখানে!”
“আসলাম তোমার অফিসটা দেখতে।”
“স্যরি তোমার বিয়েতে যেতে পারিনি! খুব ইচ্ছে ছিল যাওয়ার। আমি তো ভাবছিলাম একদিন তোমার বাসায় গিয়ে ভাবি কে দেখে আসব।”
মনে মনে বললাম ভালোই হয়েছ যাওনি! “তা তুমি তো বেশ জমিয়ে ফেলেছ দেখি!”
হালকা একটা হাসি দিয়ে বলল, “কী খাবা বলো?”
“না, কিছু খাব না।”
তাকি হয় নাকি! তুমি আমার অফিসে প্রথম আসলা। বাসার মতো অনেক কিছু হয়ত খাওয়াতে পারব না। টেবিলে রাখা বেলটা চাপ দিলো। একজন আ্যসিসট্যান্ট এসে হাজির হলো। “দুই কাপ চা আর কমল দার দোকান থেকে পুরি নিয়ে এস।”
“তারপর নতুন জীবন কেমন লাগছে বলো?”
“বাজে লাগছে!”
“সে কি! বিয়ের এখনো একমাস হয়নি? এর মধ্যেই বুঝে গেলে! মধুর হাঁড়ি খুজে পেতেও তো কয়েকমাস কেটে যায়।” কেমন একটা হাসি দিলো।
আমার মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। হুট করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লাম। এ সময় ওর আ্যসওসট্যান্ট পুরি আর চা নিয়ে আসল। ছোটো ছোটো পুরি। দেখতে ভালোই লাগছে!
“পুরিটা খেয়ে দ্যাখ ভালো লাগবে।”
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না তবুও বন্ধুর কথা ভেবে একটা পুরি নিলাম। খেতে খারাপ লাগছে না। কিন্তু মন ভালো না থাকলে ভালো জিনিস তখন কেমন জানি ভালো লাগে না!
“তুৃমি বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চাও?”
“কেন এমন মনে হলো তোমার?”
“অভিজ্ঞতা বলতে পার। মানুষ নিয়েই তো আমার কাজ বন্ধু৷ তুমি নিশ্চিন্তে বলো ফেল।”
“আমি নবনী কে ডিভোর্স দিতে চাই।”
“কী বলছ এ সব! এ মাত্র বিয়ে করলে, এখনই কী এমন হলো যে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছ? আমাকে সব খুলে বলো তো শুনি।”
আমি এতদিন ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ওকে বললাম। ও কেমন গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনল।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে কিছু একটা আছে। কিন্তু বন্ধু এ সব তোমার অনুমান তাই না? মানে আমি বলতে চাচ্ছি তোমার হাতে কোনো প্রমান নেই। কোর্ট তো প্রমান চাইবে।
“প্রমান! কীসের প্রমান আমার এ মেয়ের সাথে বনছে না আমি ওকে ডিভোর্স দিব ব্যস।”
“আইন কি এত সোজা বন্ধু? তুমি চাইবা আর একটা মেয়েকে তালাক দিয়ে দিবা! কেন দিবা, কী এমন হয়েছে বিয়ের একমাস না যেতেই তালাক দিতে চাও?” সব কোর্ট জানতে চাইবে। তাছাড়া সমাজে তোমার একটা সম্মান আছে। ব্যাপারটা জানাজানি হলেও তো সমস্যা তাই না?”
“আমি কী করব এখন।”
“চিন্তা করো না তো। আমি বিষয়টা নিয়ে একটু ভেবে তোমাকে জানাব। আপাতত এইভাবে থাক। ওদের কিছু বুঝতে দিয়ো না।”
সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ করে দিয়েছে মা। মা কেমন মনমরা হয়ে গেছে! দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না! আমাদের পরিবারটা কত সুন্দর ছিল। শুধু একটাই দুঃখ ছিলো বাবা নাই!
নবনীর বড়ো ভাই রাজিব এসেছেন আমাদের বাড়িতে সাথে একগাদা জিনিসপত্র। মা খুব রাগ করলেন এ সব দেখে। আমারও ভালো লাগেনি!
রাজিব ভাই মায়ের রাগ দেখে হেসে বললেন, “মায়োই মা আমার বোন কে কী আমি কিছু দিতে পারি না।
“হ্যাঁ, পারবা না কেন অবশ্যই পারবা। তোমাদের বাড়িতে গেলে যা খুশি দিবা আমার বাড়িতে দেয়ার দরকার নাই।”
আমি আমার রুমে এসে বসে আছি। নবনী ওর ভাইকে দেখে খুব খুশি হয়েছে। রাজিব ভাই আমার ঘরে এলো সাথে নবনী। আমি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছেন?”
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছ বলো তো?” উনাকে কেমন একটু লজ্জিত মনে হলো। আমার চোখে চোখ রাখছে না!
“আছি ভালোই। ” নবনী ভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না।
উনি আমার কাছে এসে হাত ধরলেন। আমার কেমন অস্বস্তি লাগছে! গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, “রুয়েল কিছু মনে করো না ভাই। আমার বোনটা এখনো বড়ো হয়ে উঠতে পারেনি। একটু মানিয়ে নিও কেমন।”
আমি কিছু বললাম না। ওনার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। কী বলব ঠিক বুঝতেও পারছি না! একটু লজ্জা লাগছে আমার!
রাজিব ভাই বললেন, “আমি এসেছি তোমাদের নিতে।”
“সে আপনি ওকে নিয়ে যান। আমার এখন যাওয়া সম্ভব না।”
“সে কি! তুমি না গেলে নবনীকে নিই কী করে?”
“আমার তো এখন কোথাও যাওয়া সম্ভব না ভাই। পরে সময় করে যাব। “
ওনার মুখটা কেমন কালো হয়ে গেল। দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে! এরা কত ভালো মানুষ। এ মেয়েটা এমন কেন?
খেয়েদেয়ে রাজিব ভাই চলে গেলেন। নবনীকে নিয়ে যাননি। মা কে ওনার সাথে আমাদের নিয়ে কোনো আলাপ করতে মানা করেছিলাম। দেখা যাক বন্ধু কী বলে।
নবনীর সাথে খুব একটা কথা বলি না। ও আছে ওর মতো করে। মেয়েটাকে দেখলে কেমন মায়া লাগে! কেন জানি আমার সাথে মিলছে না! কোন ছেলেটাকে ভালোবাসে জানতে খুব ইচ্ছে করছে। নিশ্চয়ই কোনো লাফাঙ্গা ছেলে হবে। ভালো ছেলে হলে ওর বাবা-মা ওখানেই বিয়ে দিতো। একসাথে পড়েছে এমন কোনো ছেলে কী?
উকিল বন্ধুর চেম্বারে এসে বসে আছি। বন্ধু বাহিরে আছে। ওর সুন্দরী আ্যসিসট্যান্ট চা দিয়ে গেছে। মেয়েটা দেখতে ভালোই! পাঁচ দুই ইঞ্চি লম্বা , একটু হালকা গড়নের। দেখতে দারুণ লাগে!
“কী নাম আপনার? “
একটু হাসি দিয়ে বলল,” রোমানা। “
এ নামে একটা নায়িকা আছে। “আপনার স্যারের আসতে কী দেরি হবে?”
“বেশি দেরি হওয়ার কথা না। এসে পড়বে আপনি অপেক্ষা করুন।”
শুধু বসে থাকা যায় না। রোমানার সাথে গল্প করা যায়। মেয়েটা মনে হয় মিশুক ধরনের। কী সুন্দর করে হাসি দিয়ে কথা বলে।
“আপনার বাড়ি কোথায়? “
মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “বরিশাল। “
নামটা শুনে একটু কেমন লাগল।
“বরিশালের মানুষ বুঝি খুব খারাপ হয়?”
“না, খারাপ কেন হবে?”
“নামটা শুনে আপনার ভালো লাগেনি বুঝাই যায়।”
“আরে না কী যে বলেন। ভালো-খারাপ সব জায়গায় আছে। আসলে এত দূর ভাবিনি তাই।”
“তবে বরিশালের মেয়েরা খুব সুন্দর হয়।”
“আপনি বরিশাল গিয়েছিলেন বুঝি?”
“তা যাইনি।”
একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, “বুঝলেন কী করে?”
“আপনাকে দেখেই বুঝলাম।”
একটু লজ্জা পেলে রোমানা। লজ্জা পেলে মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে! এটা কী সব মেয়েদের লাগে নাকি রোমান কে লাগছে?
এ সময় বন্ধু হাজির হলো।” কী খবর রুয়েল কখন
এসেছ? “
“এই তো মাত্রই আসলাম। তা তোমার কী খবর? “
“আছি ভালোই। রোমানা ওকে চা দিয়েছ?”
“সে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। চা খাওয়া হয়ে গেছে। “
“গুড।” রোমানা ভিতরের রুমে চলে গেল। কায়েস মোবাইলটা বের করে কাকে যেন কল দিলো। ওই লোকটাকে সম্ভবত আসতে বলল।
“তারপর কী খবর বলো তো?”
“সব আগের মতোই।”
“তুমি একটু বসো একজন কে আসতে বলেছি, ও আসলে আলোচনা করব। আমি একটু কাজ সেরে আসি।”
মিনিট দশেক পরে একজন লোক কায়েসের চেম্বারে প্রবেশ করল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। গুটিকয়েক চুকে পাঁক ধরেছে। উচ্চতা খুব একটা বেশি না। পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মতো হবে। গায়ের রং কয়লার মতন। লোকটার দাতগুলি চকচকে সাদা। আমাকে দেখে একখান খানদানি হাসি দিলো।
ভিতর থেকে কায়েস বলল, “কে জয়নাল এসেছ? “
“জি, স্যার।”
কায়েস এসে আমার পাশের চেয়ারে বসল। আমাদের সামনে বসল লোকটা। কায়েস লোকটা কে দেখিয়ে বলল, ” এ হলো জয়নাল। খুব কাজের ছেলে।”
“জয়নাল আমার বন্ধু রুয়েল। ওর কথাই তোমাকে বলেছিলাম। কাজটা খুব ভালো করে করতে হবে বুঝলা।”
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কায়েস কী কাজের কথা বলছে। নির্বাক হয়ে বোকার মতো চেয়ে আছি।
“আচ্ছা শোন রুয়েল। জয়নাল মেয়েটির সম্পর্কে সব ধরনের ইনফরমেশন সংগ্রহ করবে। এখন তুই বল কী করবি?”
আমি কায়েস দিকে তাকিয়ে বললাম। “মানে কী তুই গোয়েন্দা লাগাতে বলছিস?”
“এ ছাড়া উপায় নেই বন্ধু। তুই কী করে প্রমান বের করবি? এমন তো হতে পারে তোর সন্দেহ ঠিক না।”
“তুই বলছিস এ সব করতে?”
“আরে ভাই। এ সব করতে মানে কী! তোর সন্দেহটা সঠিক কি-না সেটা যাচাই করব ব্যস।”
“আচ্ছা তুই যা ভালো করোছ।”
“ঠিক আছে জয়নাল তুমি তাহলে কাজে লেগে পড়ো কেমন। আমি সব ধরনের ইনফরমেশন চাই।”
“কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। সব পেয়ে যাবেন।”
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ