নবনী পর্ব ৬
সাতদিন ছুটি থাকলেও অফিসে আসলাম দশদিন পরে। অফিসে ঢুকার সাথে সাথে কাজল আমাকে দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। মেয়েটা এমনিতে খুব ভালো। সবার সাথে মিশে। কারো বিপদ হলে ঝাপিয়ে পড়ে। ওর হাসি দেখে আমার খারাপ লাগছে! ও কেন হাসছে আমি জানি। নতুন বিয়ে করে হানিমুনে গিয়ে ছুটি বেশি কাটিয়ে এসেছি!
আমি কাজল কে একটু ধমকের স্বরে বললাম, “হাসছেন কেন!”
এতে মনে হয় মেয়েটা আর মজা পেয়েছে। তার হাসির মাত্রা আরেকটু বেড়েছে! আমি কিছু না বলে নিজের রুমে ঢুকে পড়লাম।
হাসতে হাসতে কাজল আমার রুমে আসল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিটা চাপা দেয়ার চেষ্টা করে বলল,” কী খবর রুয়েল ভাই মেজাজ খারাপ কেন? এখন ফুরফুরে মেজাজে থাকার কথা।” বলেই আবার হাসতে শুরু করল।
আমি কঠিন দৃষ্টিতে তাকালাম। তাতে মনে হয় কাজ হলে উল্টো! তার হাসি আর বাড়ল। ঠোঁট টিপে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “কাজল কিছু বলবেন?”
ঠোঁট চেপে হাসি কোনোরকমে থামিয়ে বলল, “বড়ো স্যার আপনাকে দেখা করতে বলেছেন। “
“ঠিক আছে আপনি এখন যান।”
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খিলখিল হাসির শব্দ শুনা যাচ্ছে এখন। এ মেয়ে আজ সারাদিন বোধহয় হাসতেই থাকবে!
আমি পায়ে পায়ে আমাদের অফিসের হেড আমজাদ সাহেবের রুমের দিকে গেলাম। আমজাদ সাহেবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। এখনো টাইট শরীর। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা মানুষটা ধবধবে সাদা গায়ের রং। কেন জানি বড়ো স্যার আমাকে প্রচন্ড রকমের পছন্দ করে। অফিসে কেউ এক মিনিট দেরি করে আসলে তার পানিশমেন্ট হয়। আমি এসেছি তিন দিন পরে।
দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম, “আসতে পারি স্যার?”
উনি একটা ফাইল দেখছিলেন। ফাইল থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, ” রুয়েল ভিতরে এসো।”
ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছেন। আমি বুঝতে চেষ্টা করছি উনি কতটা রেগে আছেন। আমি উনি আমার ওপর রাগতে পারেন না। ভালোবাসা বড়ো অদ্ভুত জিনিস! কঠিন মানুষ কে কেমন দূর্বল করে দেয়। উনি আমার রাগ করতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না। তাই আমার দিকে তাকাচ্ছেন না৷ দাঁড়িয়ে রেখে রাগটা বুঝানোর চেষ্টা করছেন। মিনিট পাঁচেক কেটে গেছে দাঁড়িয়ে আছি।
স্যার ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাঁড়িয়ে আছ কেন বসো।”
আমি চেয়ারটা আলত করে টানলাম যাতে শব্দ না হয়। এ সব শব্দ স্যারের ভালো লাগে না। মুখে কিছু বলেন না ভুরু কুঁচকান।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,” কেমন লাগছে নতুন জীবন?”
আবহাওয়া মনে হয় গরম না। কেমন কাটছে জানতে চাচ্ছেন। স্যারের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিলাম।
“প্রথম দুই বছর কাটবে কী আনন্দে! তারপর রং কমতে থাকবে।”
আমার জীবনের রং প্রথমদিন নষ্ট হয়ে গেছে স্যার। মুখে কিছু বললাম না। নিজের কষ্টের কথা মানুষকে বলা যায় না! আনন্দের কথা বলা যায়।
“ঠিক আছে রুয়েল তুমি এখন যাও। “
আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। এ সময় স্যার বললেন, “আর শোন নতুন প্রোজেক্ট ভালো করে করো। আর একদিন তোমার স্ত্রী কে নিয়ে বাসায় এসো, তোমার ভাবী তোমাদেরকে যেতে বলেছেন। “
আমি খুব অবাক হলাম স্যার একবারও ছুটি প্রসঙ্গে কথা বললেন না!
নিজের রুমে এসে বসে বসে ফাইলগুলো দেখছি। দশদিনে অনেক কাজ জমে গেছে। কাজগুলো দ্রুত শেষ করে ফেলতে হবে। মাথাটা ঠিক মতো কাজ করছে না!
রিসিপশনের মেয়েটা কল দিয়ে বলল, রুয়েল ভাই আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন। এ মেয়েটা অফিসের সবাইকে স্যার বলে আমাকে ডাকে ভাই। দেখে হলেই মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলে, “কেমন আছেন ভাইয়া?”
একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি, “কে এসেছে?” থাক নিচে গেলেই তো দেখা হবে। ওয়েটিং রুমে আসলাম আমাকে দেখে রিসিপশনের সুইটি কেমন একটা হাসি দিলো। অন্য সময় যেমন হাসি ঠিক সেরকম না। ভিতরে ঢুকে হতবাক হয়ে গেলাম! ওয়েটিং রুমে বসে আছে আপন। আজ ও আকাশী রংয়া একটা শাড়ি পরেছে। কী যে সুন্দর লাগছে! এ মেয়েটাকে শাড়ি পরলে এত সুন্দর লাগে কেউ কি ওকে বলেছে?
আমাকে দেখে কেমন রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, “কেমন আছেন? “
“আপনি এখানে!”
“হ্যাঁ, আসলাম আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে।”
“সত্যি বিশ্বাস করতে পারছি না আপনি আমার অফিসে চলে এসেছেন।”
“এখানে বসে গল্প করবেন নাকি?
“ও স্যরি চলুন্। আমাদের ক্যান্টিনে যাই।”
“না ক্যান্টিনে যাব না। আপনার সাথে বাহিরে লাঞ্চ করব।”
একটু অপেক্ষা করুন আমি হাতের কাজটা শেষ করে আসছি। বুঝতেই পারছেন লম্বা ছুটি কাটিয়ে অফিসে এসেছি।
আপনকে নিয়ে বের হয়েছি। কোথায় যাব জানি না। আমার খুব ভালো লাগছে ওকে দেখে। মনের মধ্যে কেমন একটা মেঘ জমেছিল তা কেটে গেছে।
“কোথায় যাবেন বলেন তো?”
“সারাদিন রিকশায় করে ঘুরব। কোনো রাস্তার ধারের হোটেলে দুপুরে লাঞ্চ করব।”
আপন কে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। মনে হয় কোনো আনন্দের খবর আছে। আপনের কী বিয়ে ঠিক হয়েছে? বিয়ে ঠিক হলে মেয়েরা প্রথমে খুব আনন্দে থাকে। বিয়ের দিন যত কাছে আসতে থাকে আনন্দ ততই দূরে যেতে থাকে। কোনো কোনো মেয়ের বিয়ের পর আনন্দ আবার ফিরে আসে। কারো কারো এ জীবনে আনন্দ আর ফিরে না!
“আজ আপনাকে খুব খুশিখুশি লাগছে?”
“তা-ই নাকি?”
“হ্যাঁ, কোনো ভালো খবর আছে বুঝি?”
“আপনি এতটা খেয়াল করতে জানেন জানতাম না তো!” কেমন একটু উদাস হয়ে গেল।
মেয়ে মানুষের মন বুঝা বড্ড কঠিন! এই ঝলমলে পরিস্কার আকাশ মুহূর্তে ঘন মেঘে ছেয়ে যায়।
আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি রিকশার অপেক্ষা বলা যাবে কি-না বুঝতে পারছি না। বেশ কয়েকটা রিকশা এসেছে কোনটায় আপন উঠেনি! মনে হয় রিকশাওয়ালা ওর পছন্দ হয়নি! মেয়েদের মাঝে এ জিনিসটা আছে। সামান্য রিকশাওয়ালাকে পছন্দ করে নেওয়া। আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে সবসময় এমন পছন্দ করে রিকশায় চড়ে কিনা?
শেষমেশ মনে হয় একজন রিকশাওয়ালাকে পছন্দ হয়েছে আপনের। তার সাথে কথা বলে রিকশায় চড়ে বসে আমায় ডাকল। রিকশাওয়ালা মধ্যে বয়স্ক পেটানো শরীর। আপন জিজ্ঞেস করল, “আপনার নাম কী?”
“মজিদ।” নাম জিজ্ঞেস করায় রিকশাওয়ালা খুশি হয়েছে। তার চেহারায় কেমন খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা শহরে রিকশায় চড়ার আলাদা একটা মজা আছে। যাওয়ার কোন তাড়া নেই। গন্তব্যহীন ঘুরে বেড়ান। আপন বলল, “কেমন লাগছে? “
“ভালো। আচ্ছা আপনি আমার অফিস চিনলেন কী করে?”
“ইচ্ছে থাকলে সব খুঁজে বের করা যায়।” কেমন করে একটা হাসি দিলো। মেয়েটা আজ অকারণে হাসছে। নিশ্চয় ভালো কোন খবর পেয়েছে। তার রেশটা রয়ে গেছে। কোন কারণে মন ভালো থাকলে সামান্য জিনিস দেখেও খুব ভালো লাগে!
রিকশাওয়ালা তার ইচ্ছে মতো চলছে। আজ সারাদিনের জন্য তাকে ভাড়া করা হয়েছে। একটা চায়ের দোকানের সামনে আমাদের রিকশা থামল।
ছোর একটা দোকান। একজন বৃদ্ধ বসে আছে দোকানে। এ সময় মনে হয় খুব একটা কাস্টমার হয় না। এলাকাটা শহর থেকে একটু ভিতরে। স্টাফ কোয়ার্টার থেকে অনেকটা ভিতরে। দুই পাশে খোলা জায়গা।অনেকটা গ্রামের মতো লাগছে! দোকানের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” চাচা চা হবে? “
“হবে বাবা। কী চা খাবেন? “
একটা পাত্রে গরুর দুধ জ্বাল দিচ্ছে। দুধের উপরে স্বর পড়েছে। বললাম, ” দুধ চা দেন।”
চায়ের কাপ নিয়ে আমরা রাস্তার পাশে চলে আসলাম। রাস্তার পাশে দুর্বা ঘাসে বসে পড়লাম দুইজন। সামনে বহুদূর পর্যন্ত খোলা মাঠ। গায়ে কেমন শীতল বাতাস এসে লাগছে! বাতাসে আপনের চুল উড়ছে! কী যে সুন্দর লাগছে ওকে! আপন কে বললাম, “আপনি কী কিছু বলতে চান?”
আমার দিকে তাকিয়ে হালকা একটু হাসি দিলো।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ