#বিয়ের_আগেই_বাচ্চা!
“আসসালামুয়ালাইকুম প্রিয়,
তোমার লেখা একটা পোস্ট খুঁজে পাচ্ছি না। ঐ যে, কনসিভ করার পর বাচ্চা কয়েক সপ্তাহের বড় দেখায়, ঐটা। আমার পাশের বাসার একটা মেয়ের বিয়ে হলো রোজার ঈদের পরদিন।এরপরপরই কনসিভ করে, রিপোর্ট এসেছে বিয়ের দুই সপ্তাহ আগে কনসিভ করেছে। এখন মেয়েটার হাসব্যান্ড প্রথমে দুইবার এবরশন করাতে নিয়ে গিয়েছিল, কোনো ডাক্তার রাজী হননি, কড়া ধমক দিয়েছেন। এখন ঐ বদমাশ টা বলছে, এই বাচ্চাটা ওর না, অন্যকারো। গত সপ্তাহে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে। ইসলামী শরিয়াহ মতে গর্ভাবস্হায় তো ডিভোর্স হয়না, এজন্য পেন্ডিং আছে। আরও অনেক কথা আছে, বিস্তারিত লিখে তোমার সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। তুমি একটু কষ্ট করে লিংক টা দিতে পারবে বন্ধু?”
উপরোক্ত বার্তাটি আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছেন এক বন্ধু সুহৃদ। তিনি ইতিপূর্বে এ সংক্রান্ত আমার একটি লেখা পড়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। লিংকটা খুঁজে পাচ্ছিনা। ব্যপারটা জনগুরুত্বপূর্ণ বিধায় আবার লিখতে বসলাম। একটা মেয়ে কোনো রকম অন্যায় না করেও মিথ্যা অপবাদের শিকার হবে, তাও আবার লাইফের শুরুতে! যে সময়টায় তার প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে রঙ ছড়ানোর কথা ছিলো সেই সময়টাতে এমন অপবাদ! বাচ্চা জন্মদানের মতো স্বর্গীয় ব্যপারে এমন কালিমা লেপন, এই অবিচার মানা যায় না। তাই চব্বিশ ঘন্টার হেকটিক ডিউটির পর রেস্ট না নিয়েই লিখতে বসলাম। দেখা যাক কতোটা ক্লিয়ার হয়।
মূল কথায় যাওয়ার আগে গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ডেট গননা এবং নারীদের মাসিকচক্র সম্বন্ধে একটু জেনে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আমরা জানি একজন সুস্থ স্বাভাবিক নারীর প্রতিমাসে রজঃশ্রাব হয়। সাধারণত ২৮ দিন অন্তর অম্তর হয়। তবে সাতদিন আগে পরেও হতে পারে। রজঃশ্রাব শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকে পরবর্তী রজঃশ্রাব শুরুর দিন হলো এক সাইকেল। প্রতিটা সাইকেলে তিনটা ফেইজ থাকে।
১. মেন্সট্রুয়াল ফেইজ – চার থেকে সাত দিন। এই সময় রক্তক্ষরণ হয়। মাসিক শুরু হওয়ার দিনটিকে আমরা বলি ডে ওয়ান (D1) বা LMP
গাইনি ডাক্তারের কাছে গেলে দেখবেন একটি কমন প্রশ্ন সবসময় করে, LMP কবে? অর্থাৎ লাস্ট কবে আপনার পিরিয়ড শুরু হয়েছিলো? অনেক কিছু হিসাব করা হয় এটা দিয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রেগন্যান্সির মেয়াদ গননা করা হয় LMP থেকে। নোট করেন। পরে লাগবে।
২. ফলিকুলার ফেইজ – সাত থেকে চৌদ্দ দিন।
এই সময় ক্ষয়ে যাওয়া জরায়ুর ভেতরের লেয়ার পুনর্গঠিত হয়। এখানে উল্লেখ যে, মাসিকের সময় জরায়ুর সবচেয়ে ভেতরের লেয়ারের দুই তৃতীয়াংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এ সময় সেটা রিপেয়ার হয় ।
সাইকেলের চৌদ্দতম দিনে অভুলেশনের মাধ্যমে ওভাম বা ডিম নির্গত হয়। অভাম বা ডিম্বাণু তিন দিন বেঁচে থাকে। এই সময় ইন্টারকোর্স করলে সিঙেল কোর্সেই বাচ্চা আসতে পারে শতকরা বিশ ভাগ ক্ষেত্রে। বাচ্চা এদিন আসলেও হিসাব কিন্তু হবে প্রথম দিন( D1) থেকে। অর্থাৎ দুই সপ্তাহ আগে থেকে। ব্যপারটা নোট করুন। এটা নিয়েই মূলত আজকের লেখা।
৩. লুটিয়াল ফেইজ – ষোলতম দিন থেকে আটাইশ তম দিন পর্যন্ত। জরায়ুর ভেতরের লেয়ার আরো সুগঠিত হয়। এন্ডোমেট্টিয়াল বেড বা বিছানা তৈরি হয় বাচ্চাকে রিসিভ করার জন্য। যদি বাচ্চা না আসে তাহলে এই বিছানা ভেঙেচুরে বের হয়ে আসে যাকে আমরা মাসিকের রক্ত বলি।
আজকের আলোচনায় আমরা দেখতে পাই, অভুলেশন বা ডিম ফোটে মাসিকের চৌদ্দতম দিনে। তখন থেকে ৭২ ঘন্টা বা তিনদিনের মধ্যে ইন্টিমেট হলে বাচ্চা আসবে। অর্থাৎ পুরো মাসের সব দিন না থেকে একদিন থাকলেও বাচ্চা আসতে পারে। সেদিনটা যদি অভ্যুলেশনের দিন হয়। যেটা উক্ত নারীর হয়েছে। লেখার শুরুতে যার কথা বলেছি।
সব প্রেগন্যান্সিতে এমনটাই হয়। ক্যাচাল লাগে শুধু নতুন বিয়ের সাথে সাথেই কনসিভ করলে অথবা স্বামী মরে গেলে বা বিদেশ চলে গেলে কিংবা রেইপের ক্ষেত্রে। অন্যান্য সময় তো স্বামী স্ত্রী একসাথেই থাকে। ফলে কবে কনসিভ করলো না করলো সে হিসাব করতে যায় না।
আগেই বলেছিলাম, প্রেগন্যান্সির হিসাব শুরু হয় LMP মানে ডে ওয়ান ( D1) থেকে। অর্থাৎ অভ্যুলেশনের সময় ইন্টিমেসির ফলে প্রেগন্যান্ট হলেও প্রগন্যান্সির হিসাব শুরু হবে মাসিকের প্রথম দিন থেকে। অর্থাৎ দুই সপ্তাহ আগে থেকে। এটাই স্বাভাবিক।
আলোচিত নারীর LMP ছিলো এপ্রিলের দশ তারিখে। বিয়ে হয় এপ্রিলের ছাব্বিশ তারিখে। ঠিক অভ্যুলেশনের সময়। বিয়ের পর আর মাসিক হয় নাই। তাহলে আমরা ধরেই নিতে পারি, প্রথম ইন্টারকোর্সেই তাদের বাচ্চা এসেছে। এবং এই বাচ্চা তাদের নিজেদেরই। অথচ মেয়েটিকে অপবাদ দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দিলো!
এখন বলেন কেমন বোধ করছেন? একটা ইনোসেন্ট মেয়ে। যার বিয়ে হলো। বিয়ের সময় অভ্যুলেশনের ডেট ছিলো। ফলাফল প্রেগন্যান্ট হলো। বর বলল, এই বাচ্চা তার না। অবিশ্বাস, ডিভোর্স! অথচ পুরো ব্যপারটায় একজন গাইনি বিশেষজ্ঞের মতামত নিলে বিষয়টা পানির মতো স্বচ্ছ ক্লিয়ার হয়ে যেতো। মেয়েটা অপবাদ থেকে মুক্তি পেতো। অনাগত সন্তানের আগমন প্রতিক্ষায় তাদের জীবন হতো আনন্দ ঝলমলে। অথচ কী হলো? এর দায় কার? অজ্ঞতার, অসচেতনতার, নাকি কূপমণ্ডূক সমাজের? যে সমাজ জানে না, জানতে চায় ও না। তার আগেই ফাঁসির রায় দিয়ে দেয়।
কে দেবে উত্তর?
মেয়েটার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করলে সমাজ সংসার সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। কিছুটা হলেও অন্ধকার মোচনের চেষ্টা করলাম। আলো আসুক।
©
ডা. ছাবিকুন নাহার
এমবিবিএস (ঢাকা), বিসিএস(স্বাস্থ্য)
এফসিপিএস (অবস.& গাইনী)
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ইনফার্টিলিটি এন্ড আলট্রাসনোগ্রাফি
গর্ভবতী, প্রসূতি, স্ত্রী ও গাইনীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ(Ex), ঢাকা।
#Lady_in_Red