ওহে প্রিয় পর্ব ২৫
জান্নাতুল_নাঈমা
পর্ব_২৫
__________
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতার্ত ভোরে হুমায়ুন তালুকদার তাঁর অর্ধেক পরিবার নিয়ে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রুবিনার একমাএ ভাইয়ের ছোট মেয়েটাকে আজ ছেলেপক্ষরা দেখতে আসবে। মেয়ে পছন্দ হলেই মেয়েপক্ষরা একদিন পরই যাবে ছেলের বাড়িঘর দেখতে। সব ঠিকঠাক থাকলেই বিয়ে ফাইনাল। বাড়ির বড় মেয়ে এবং মেয়ের জামাই হিসেবে হুমায়ুন তালুকদারের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেখানে। তাই ছেলে, ছেলের বউ আর ছোট ছেলেকে রেখে বাকি সবাই তিনদিনের জন্য রওনা হয়েছে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে।
সকালের নাস্তা শেষে সব কিছু গুছিয়ে উপরে গেলো আহি৷ হ্যাভেন ব্ল্যাক শার্ট, হোয়াইট স্যুট, ব্ল্যাক,হোয়াইট কম্বিনেশন টাই পড়ে রেডি হচ্ছে। আহি মাথার ঘোমটা টা ফেলে গুটিগুটি পায়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। হ্যাভেন আড় চোখে একবার তাঁকে দেখে নিয়ে ত্বরিতগতিতে চুল ঠিক করে নিয়ে ফোন ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে ঘড়ি পড়তে লাগলো। তাঁর বউ দিন দিন যা বেহায়া হচ্ছে কখন আবার গলায় ঝুলে পড়ে উল্টাপাল্টা কান্ড করে ফেলবে তাঁর কোন ঠিকঠিকানা নেই। এই মূহুর্তে সে অত্যন্ত জরুরি একটি কাজে বের হচ্ছে তাই বের হওয়ার সময় অত্যন্ত বিপদজনক এই রমণীর মাতলামোর শিকার হতে সে ইচ্ছুক নয়৷
আহি ড্যাবড্যাব করে চেয়ে তাঁর অতি হ্যান্ডসাম বরের সাজসজ্জা দেখতে থাকলো। যতো যাই হোক না কেনো বিনা পারমিশনে তাঁর জীবনে প্রবেশ করা এই কৃষ্ণমানবটিও যে কম সুদর্শন নয়। তাঁর এই হ্যান্ডসাম লুক, স্মার্টনেস যে কোন রমনীকেই ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট। গায়ের রঙ চাপা হলেও এমন সুঠাম, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী পলিটিকাল কিংকে দেখে আকৃষ্ট হওয়ার মেয়েলোকের অভাব আছে নাকি এই ঢাকা শহরে? কিন্তু আকৃষ্ট হয়ে লাভ কি শহরের এই পলিটিকাল কিং যে শুধুই আমার। আনমনা হয়েই মুচকি হাসলো আহি। হ্যাভেন সেই হাসিটুকু সরু চোখে দেখে নিয়ে টোপ করে তাঁর কপালে নিজের ওষ্ঠজোরা ছুঁইয়িয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো।
হুঁশ ফিরতেই আহির মনে পড়ে গেলো গতকাল রাতে তাঁর এক বান্ধবী মেসেঞ্জারে নক করে বলেছিলো তাঁরা বেশ কয়েকজন আজ তাঁদের ভার্সিটিতে ঘুরতে আসবে৷ সাথে আরো বান্ধবীরা থাকবে। শুক্রবার তাই আহির আজকে ভার্সিটিতে যাওয়া দিবাস্বপ্নের মতোই। তবুও তাঁর এই সাইকো বরটাকে একবার বলে দেখতে চাইলো তাই ত্বরিতগতি তে বিছানা ছেড়ে নেমেই বললো,
-‘ শুনুন আমার খুব জরুরি কথা আছে আগেই যাবেন না ‘।
দরজার বাইরে পা বাড়াতে গিয়েও পা টা পিছিয়ে নিলো হ্যাভেন। ভ্রুযুগল কুঁচকে পিছন ঘুরে চোখের ইশারায় প্রশ্ন করলো,
-‘ কি ‘?
আহি তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বারকয়েক শ্বাস নিলো আর ছাড়লো। তারপর আকুতিভরা গলায় বললো,
-‘ আমার বান্ধবী রা আজ আমাদের ভার্সিটিতে বেড়াতে আসবে। কাল রাতেই মেসেঞ্জারে কথা হয়েছে ওদের সাথে বিশ্বাস না হলে দেখে নিবেন। ওরা বলেছিলো আমিও যেনো ওদের সাথে কিছু সময় থাকি। আপনি কি যেতে পারমিশন দেবেন ‘?
-‘ আজকে ফ্রাইডে তারওপর ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভাবলে কি করে আজ বাসার বাইরে তবুও বান্ধবীদের সাথে যাওয়ার পারমিশন পাবে ‘?
প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেলো আহির তাই তিরিক্ষি মেজাজে বললো,
-‘ কেনো সমস্যা কি আমি তো বিবাহিত তাহলে বাইরে গেলে সমস্যা টা কি? তাছাড়া আপনার সিসি ক্যামেরা গুলোতো সর্বক্ষণ আছেই তবুও প্রবলেম টা কোথায়? বাপের বাড়ি যেতে দেন না এখানে একটা বান্ধবী পর্যন্ত নেই আজ ওরা আসছে তাছাড়া আজকে আমার বিশতম জন্মদিন। আপনার এসব বিষয়ে কোন খেয়াল নেই। না একটা জন্মদিন আর না বিবাহবার্ষিকী কোন কিছুতেই আপনার গুরুত্ব নেই। আজ আবার দেশ জুরে ভালোবাসা দিবসও উদযাপিত হচ্ছে একটা গোলাপ তো দূরের কথা ছাঁইও পাবো না আপনার থেকে গতবছরও এদিনটা একা একা বিষন্নতায় কাটিয়েছি। আজকে আমি যাবোই কোন কথা শুনবো না ‘।
চিন্তান্বিত চোখেমুখে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে আহির মুখপানে তাকিয়ে আছে হ্যাভেন। বিশতম জন্মদিন? এবছর ১৪ই এপ্রিল তাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী সে হিসেবে আহির সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছে আঠারো বছর বয়সে এতো পিচ্চি একটা মেয়ে তাঁর ঘরের বউ? তাঁর সাথে তাঁর বউয়ের এইজ ডিফারেন্ট আটবছর বর্তমান সময় এটা একটু বেশীই মনে হলো হ্যাভেনের কাছে। রূপসার সাথে তাঁর এইজ ডিফারেন্ট মাএ তিনবছর ছিলো সে হিসেবে আহি সত্যিই অনেক ছোট নিচের ওষ্ঠে দাঁত কেটে নিচু গলায় জিগ্যেস করলো,
-‘ বিশতম জন্মদিন ‘?
প্রশ্নটায় চিন্তার সাথে বিস্ময় স্পষ্ট দেখতে পেলো আহি। খানিকটা নয় অনেকটা বেশীই তাই প্রচন্ড রাগান্বিত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠলো,
-‘ নিশ্চয়ই বউয়ের এইজ সম্পর্কেও অবগত নন আপনি। কি জানেন আমার ব্যাপারে আমার নামটা ঠিকঠাক মনে আছে আপনার? আমার জন্মপরিচয় মনে আছে? আমার বাবা,মা কে রাস্তাঘাটে দেখলে চিনবেন তো? কোন বাড়ি থেকে তুলে এনেছেন সেটা খেয়াল আছে তো? নাহ সেসব না হয় বাদই দিলাম বউয়ের শরীরে কোথায় কয়টা তিল আছে সেটা জানেনতো? একটা মেয়েকে দিয়ে শুধু শরীরের খোরাক মেটালেই স্বামী হওয়া যায় না মি.হ্যাভেন তালুকদার ‘।
প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে আহি বুঝতে পেরে ঠোঁটের কোনায় কুটিল হাসি ফুটিয়ে তুলে আহির দিকে ঝুঁকে চোখ ইশারা করে বক্ষঃস্থলের মাঝ বরাবর ইশারা করে মৃদুস্বরে বললো,
-‘ লাল টকটকে তিলটায় বহুবার ডুব দিয়েছি সুন্দরী ‘।
দারুণ লজ্জা পেয়ে গেলো আহি। কয়েক সেকেন্ডেই সেই লজ্জা নিবারণ করে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে কড়া কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
-‘ আমি যেতে চাই ওদের সাথে মিট করতে যেতে পারি ‘?
-‘ একেবারেই নয় সুন্দরী ‘। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো হ্যাভেন।
-‘ আমি যাবোই ব্যাস ‘।
-‘ আই ডোন্ট লাইক ইট সুন্দরী এমন অবাধ্য হয়ে আমাকে বিগরে দিও না ফল খুব খারাপ হবে ‘। বলেই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো হ্যাভেন। আহিও প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে দরজাটা ঠাশ করে বন্ধ করে দিলো।
একটা সম্পর্কে যদি বিশ্বাসই না থাকে সে সম্পর্ক টা সত্যি মূল্যহীন৷ যে সম্পর্কে সন্দেহ, অবিশ্বাসে ভরপুর সে সম্পর্কের ভিত কখনোই মজবুত হয় না৷ এতো অবিশ্বাস, সন্দেহের মাঝে কি করে সুখ,শান্তি বয়ে আনবে আহি? কি করে তাঁদের মধ্যে ভালোবাসার ভিত তৈরি করবে? সম্পর্কে অবিশ্বাস যে মানুষকে অন্ধ করে দেয়? ভালোবাসা ঢেকে যায় সেই আঁধারে! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোধহয় এমন অবস্থার বর্ণনা করতেই লিখেছিলেন, ‘কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?’ কথাটার সঙ্গে মিল রেখে প্রশ্ন তোলা যায়, কেন মনের আকাশে অবিশ্বাসের আনাগোনা?
.
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই আহি গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ কে ‘?
-‘ ভাবি আমি রমা দরজা খুলেন ‘।
কাজের মেয়ে রমা এসেছে। বাড়িতে হিরা ছাড়া কেউ নেই এ কয়েকজনের রান্না সে একাই করতে পারতো শুধু শুধু আজ রমা না এলেও পারতো। শুক্রবার টা রমার ছুটির দিন থাকে আজ বাড়িতে শ্বাশুড়ি নেই বলেই হয়তো ওর ছুটি ক্যানসেল করা হয়েছে। একরাশ বিরক্তি এসে ভর করলো আহির চোখে মুখে। দরজা খোলার পূর্বে মুখটা স্বাভাবিক করে নিয়ে দরজা খুলে মিষ্টি করে হেসে প্রশ্ন করলো,
-‘ আজ না এলেও সমস্যা হতো না ‘।
-‘ কি কন ভাবি হিরা ভাইজান যে কইলো তাঁর বন্ধু-বান্ধব আইবো ভালো মন্দ রান্না করে রাখতে কইলো যে ‘?
-‘ সে কি আমিতো কিছুই জানিনা তোমার ভাইজান কি বাড়িতে আছে এখনো ‘?
-‘ হ নিজের ঘরেই তো যাইতে দেখলাম ‘।
-‘ আচ্ছা তুমি নিচে যাও আমি আসছি ‘।
হিরার রুমের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলো আহি। হিরা ‘কে’ বলতেই আহি বললো ‘ভাবি’ সঙ্গে সঙ্গে গানের টোন অফ হয়ে গেলো। সাউন্ড বক্সে গান জুরে দিয়ে পুরো রুমজুরে ডান্স করছিলো সে। আজ বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তাঁর নিউ জিএফও আসবে সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশই ঘটাচ্ছিলো বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালে। দ্রুত গায়ে টিশার্ট পড়ে নিয়ে দরজা খুলে মিষ্টি করে হেসে বললো,
-‘ ভিতরে আসুন ভাবি মা ‘।
আহি জোর পূর্বক হেসে ভিতরে প্রবেশ করলো। বাচ্চার খবর নাই অথচ সে মা হয়ে গেছে। বড় বড় দামড়া ছেলেগুলো মা মা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে একদম। ভাবিই ঠিক আছে সাথে মা যোগ করতে হবে কেনো? মনে মনে ভয়ংকর গালাগাল করলো হ্যাভেনকে। হ্যারি, হিরা আহির বেশ সিনিয়র বলেই হ্যাভেনের এই আদেশজারি ভাবিকে অত্যাধিক সম্মান দেওয়ার খাতিরেই ‘ভাবি মা’ বলে ডাকতে হবে। তাই গালাগাল হ্যাভেনকেই করলো আহি। আর মুখে বললো,
-‘ ভিতরে যাবোনা ভাই। শুনলাম তোমার বন্ধু-বান্ধব আসবে কজন আসবে আর কি রান্না হবে বললে ভালো হয় ‘?
হিরা বাধ্য ছেলের মতো মাথা নিচু করে বললো,
-‘ জ্বি সাত জন আসবে। আপনি যা ভালো বুঝেন করবেন ‘।
আহি দুষ্টুমির সুরে বললো,
-‘ স্পেশাল কেউ আসবে নাকি ‘?
হিরা লজ্জায় লাল হতে শুরু করলো। মাথা চুলকে জ্বিহ্বা দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আহিও মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে চলে গেলো।
রান্না করার পূর্বে আহি হ্যাভেনকে ম্যাসেজ করে বললো তাঁর জন্য অন্তত একটি লাল গোলাপ নিয়ে বাসায় ফিরতে নয়তো ভয়ংকর রেগে যাবে সে। প্রতুত্তরে কোন ম্যাসেজই পেলো না আহি তাই খানিকটা রেগে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে নিচে চলে গেলো।
.
বন্ধুদের সাথে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে সকলকে নিয়ে উপরে ওঠে গেলো হিরা। আহি দুপুরের খাবার খেয়ে শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এর মধ্যে হ্যাভেন বেশ কয়েকবার ফোন করেছে তাঁকে। ফোন সাইলেন্ট রয়েছে সে খেয়ালই নেই আহির। এদিকে রাগে বোম হয়ে আছে হ্যাভেন।
প্রায় বিকেলের দিকে বন্ধুদের বিদায় দিলো হিরা। রাতে আবার ক্লাবে সকলে একসাথে হবে শুধু মেয়েগুলো বাদে। রাত করে বাসা থেকে ওদের ছাড়বেনা বলেই দিনের বেলায় এই আয়োজন করেছিলো হিরা। বন্ধু রা বেরিয়ে যেতেই আহি হাই তুলতে তুলতে আবার উপরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরলো হ্যাভেন দরজাটা খুলে দিলো রমা। যা দেখে মেজাজ অত্যাধিক বিগরে গেলো তাঁর। উপরে যেতে যেতেই টাই স্যুট খুলে ফেললো রুমে গিয়ে সেগুলো ফ্লোরে ছুঁড়েও ফেললো৷ বিছানার একপাশে ফোন পড়ে থাকতে দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লো সে। ফোনটা খুব হিংস্র ভাবে ওঠিয়ে আছাড় দিলো। প্রথম আছাড়ে চূর্ণবিচূর্ণ না হলেও পরপর কয়েকবার আছাড় দিতেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। শব্দ পেয়ে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো আহি। হ্যাভেনের অমন ক্ষিপ্ত রূপ দেখে ভয়ে শিউরে ওঠলো। মুখটা কাচুমাচু করে ঘুমকাতুরে গলায় প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হয়েছে এমন করছেন কেনো ‘?
ট্রি টেবিলে সাজোরে এক লাথি মেরে রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো হ্যাভেন। আহি না রাগের কারণ জানতে পারলো আর না ফোন ভাঙার কারণ জানলো। ঠোঁট ফুলিয়ে চিন্তান্বিত মুখশ্রী তে বিছানা ছেড়ে ওঠে বাথরুম গিয়ে চোখে, মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে রুমে এসে ভাঙা ফোনের দিকে চেয়ে আফসোসের সুরে বললো,
-‘ আহারে মোবাইলরে তোর কপালটাই খারাপ ঐ ক্ষ্যাপা ষাড়ের হাতে কেনো পড়তে গেলি ‘?
দরজায় বেশ শব্দ করেই রুমে প্রবেশ করলো হ্যাভেন। ভয়ে আহির হেচকি ওঠে গেলো দ্রুত সেন্টার টেবিলের সামনে গিয়ে গ্লাসে পানি ভরে খেলো। হ্যাভেন গায়ে থেকে শার্ট খুলতে খুলতে তয়ালে নিয়ে বাথরুম ঢুকে গেলো। আহি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচল বিরবির করে বললো ‘ ভাগ্যিস শুনেনি নয়তো এই ফোনের পরিণতি টাই পুনরাবৃত্তি ঘটতো শুধু ফোনের জায়গায় থাকতাম আমি ‘। বলেই বড়সড় এক ঢোক গিললো।
____________
রাত দশটা। হিরা এইমাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। হ্যাভেনের যাওয়ার কথা থাকলেও বাড়িতে আহি একা বলে সে যেতে পারলো না। ফার্স্ট সেও খেয়েদেয়ে রেডি হতে যাচ্ছিলো আহি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেছিলো,
-‘ আপনার কি বিবেক লোপ পেয়েছে পুরো বাড়িতে আমাকে একা রেখে আপনি নাইট ক্লাবে যাবেন আড্ডা দিতে মস্তি করতে ‘?
চিন্তান্বিত হয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ চেয়ে থেকে উপরে ওঠে যায় হ্যাভেন আহি ভেবেছিলো হয়তো তাঁর কথার তোয়াক্কা না করেই বেরিয়ে যাবে। কিন্তু রুমে এসে যখন দেখলো সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে টিভি দেখছে হ্যাভেন তখন ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে তাঁর। হ্যাভেন বেরসিক হলেও সে আর বেরসিক হয়ে জীবন কাটাতে চায় না। জীবন একটাই তাঁকে হেসে, খেলে আনন্দ, উল্লাস করে কাটানোই ব্যাটার। এক জীবন বিষন্নতায় ডুবিয়ে রেখে লোকসান বই লাভ হবে না। কাবার্ড থেকে কালো রঙের একটি নাইটি বের করে বাথরুম ঢুকে পড়লো আহি। নাইটি পড়ে খোলা চুলে বাথরুম থেকে বের হতেই হ্যাভেনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। হ্যাভেন চকিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বিয়ের পরপরই এই নাইটিটা কিনে এনেছিলো হ্যাভেন। আহিকে পড়তে বলার পর আহি তিরিক্ষি মেজাজে না করে দেয়। হ্যাভেন জোর করে একদিন পড়ালেও নেক্সট আর কোনদিন জোর করেনি আহিও পড়েনি। আজ হঠাৎ এভাবে দেখে সত্যি হকচকিয়ে গেছে হ্যাভেন। আহি ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজেকে বেশ কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে চুলগুলো খোঁপা করে ফেললো। তারপর হ্যাভেনের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। হ্যাভেন আড়চোখে একপলক দেখে নিয়ে আবার টিভিতে মনোযোগ দিলো। আহি মুখ ভেঙচি কেটে হ্যাভেনের মুখোমুখি হয়ে ট্রি টেবিলের ওপর বসলো। একটু ঝুঁকে হ্যাভেনের গলা জরিয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ কেমন লাগছে আমায় ‘?
হ্যাভেন কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আহি যে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী তা কারো বলার অপেক্ষা রাখেনা। ধবধবে ফর্সা গায়ে কুচকুচে কালো অতি ক্ষুদ্র নাইটিটা মুক্তোর মতো ঝকঝক করছে যেনো। আগের তুলনায় আহির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে স্বাস্থ্যেরও বেশ উন্নতি ঘটেছে। নাইটির গলা টা বেশ বড় হওয়া তে বক্ষবন্ধনীর বিভাজন স্পষ্টতর হয়ে ওঠছে দৃষ্টিতে। এমন রূপে রমণীরা যে কোন পুরুষের মাথাই নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেখানে আহিতো তাঁর নিজের বিয়ে করা বউ। নিঃশ্বাস আঁটকে গেলো হ্যাভেনের। শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে তাঁর। এক ঢোক গিলে জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠজোরা ভিজিয়ে নিয়ে একটানে আহিকে নিজের বুকের ওপর ফেলে কোমড় জরিয়ে কানের কাছে মুখ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে টানা সুরে বললো,
-‘ সো হট ‘।
আহি হ্যাভেনের দুকাধ আঁকড়ে ধরে বললো,
-‘ একটা গোলাপ আনতে বলেছিলাম আজকের দিনটার জন্য অথচ আপনি বাসায় এসে ভাঙচুর উপহার দিলেন ‘?
নিভে যাওয়া আগুন যেনো হঠাৎই ফুঁসে ওঠলো। এক ঝটকায় আহিকে সড়িয়ে দিয়ে গর্জন তুলে বললো,
-‘ কয়টা ফোন দিয়েছি? প্রয়োজনে ফোন করে যদি নাই পাই তাহলে সে ফোন থাকা থেকে না থাকাই ব্যাটার ‘।
আহি আবারো এগিয়ে গিয়ে জরিয়ে ধরলো হ্যাভেনকে বললো,
-‘ ইশ আমি শুনতেই পাইনি। সাইলেন্ট ছিলো তো।সারাদিন অনেক ব্যাস্ত ছিলাম তাই বলে এতো রেগে যেতে হয় ‘?
হ্যাভেন কিছু বললো না শুধু টিভিটা বা হাতে অফ করে দিয়ে অস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতেই আহিকে পাঁজা কোল করে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। আহিও ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলা জরিয়ে ধরলো তাঁর।
.
শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর হ্যারি ফিরেছে হিয়া রয়েই গেছে মামা বাড়িতে। দুমাস পরে বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে তাই হিয়া বাড়ি আসেনি একদম বিয়ে কমপ্লিট হলেই ফিরবে সে। তালুকদার বাড়ির সকলে বিয়ের এক সপ্তাহ আগে আবার যাবে টাংগাইলে।
সকাল থেকেই গুমোট আবহাওয়া। দুপুরের দিকে চারদিক অন্ধকার হয়ে এলোমেলো বাতাস বইতে লাগলো চারদিকে। ছাদে কিছু কাপড় শুখাতে দিয়েছিলো আহি। উল্টাপাল্টা বাতাসের বেগ দেখে কাপড় গুলো ওঠিয়ে চিলেকোঠার ঘরের রশিতে টাঙিয়ে দিতে দিতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। ইচ্ছে করলো না আর নিচে ফিরে যেতে ভিজতে ইচ্ছে করলো খুব। কিন্তু একা একা বৃষ্টিবিলাস জমে নাকি? ভাবলো হ্যাভেনকে ডাকতে যাবে একসঙ্গে ভিজবে কিন্তু আবার ভাবলো ‘ নাহ মানুষ টা বড্ড আনরোমান্টিক বেরসিক পার্সন একাই ভিজি ডাকতে গেলে আমার ইচ্ছেটাই আবার মাটি চাপা পড়ে যাবে ‘।
বেশ অনেকটা সময় নিয়ে বৃষ্টি তে ভিজছে আহি। প্রকৃতির মারাত্মক এই স্নিগ্ধতা গায়ে মেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে দুহাত দুদিকে মেলে বারকয়েক ঘুরপাক খেতে লাগলো। হঠাৎই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিতেই কারো বাহুডোরে আঁটকে গেলো সে। ভয়ে চোখ, মুখ খিঁচে আঁকড়ে ধরলো তাঁর শার্ট। হ্যাভেন ধমকে ওঠে বললো,
-‘ এসব কি হচ্ছে এখানে ‘?
চোখ মেলে মাথা ঘুরানিকে তোয়াক্কা না করে চোখ পিটপিট করতে করতে মিষ্টি করে হেসে বললো,
-‘ বৃষ্টিবিলাস ‘।
হ্যাভেনও অনেকটাই ভিজে গেছে আহিকে ছেড়ে এক হাতে কপাল থেকে থুতনি অবদি পানিগুলো মুছে নিয়ে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘ নিচে চলো বৃষ্টিবিলাস করতে হবে না ‘।
আকাশে বিকট আওয়াজ হতেই আহি শক্ত করে জরিয়ে ধরলো হ্যাভেনকে। হ্যাভেন জোর করে ছাড়িয়ে আহির হাত চেপে ধরে বললো,
-‘ নিচে চলো ‘।
আহি রেগে গিয়ে হাত ছাড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
-‘ ধ্যাত আপনি বড্ড আনরোমান্টিক এমন রোমাঞ্চকর পরিবেশে আপনার রুমে যেতে ইচ্ছে করছে আসুন না দুজন বৃষ্টিবিলাস করি ‘।
-‘ আনরোমান্টিক না রোমান্টিক রুমে চলো বুঝাচ্ছি ‘।বলেই হিরহির করে টানতে টানতে নিচে নামতে থাকলো। আহি কপট রেগে তাঁর সাথে পা মিলিয়ে নামতে নামতে বললো,
-‘ রোমান্স মানেই কি শুধু শরীলবিলাস নাকি? রোমান্স মানে একে অপরের মনে বিচরণ করা। রোমান্স মানে প্রাকৃতিক পরিবেশে দুজন যুবক, যুবতী, বা বুড়ো,বুড়ি যাই হোক না কেনো একে অপরের মাঝে ডুবে যাওয়া। একে অপরের মনের অনুভূতি মনে মনেই বুঝে নেওয়া। বৃষ্টিবিলাস,সমুদ্রবিলাস,রাতের আঁধারে এক সঙ্গে চন্দ্রবিলাস এগুলোকে রোমান্স বলে এগুলো বুঝেন? আপনি শুধু বুঝেন শরীর ‘।
একটানে রুমে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ধমকে ওঠলো হ্যাভেন,
-‘ বকবকানি থামিয়ে ভেজা কাপড় পাল্টে আসো শরীর খারাপ করলে রোমান্টিকতা খুব ভালো ভাবেই টের পাবে ‘।
-‘ অসহ্য একটা লোকের সাথে বসবাস করছি আমি বলেই গটগট করে বাথরুমে ঢুকে পড়লো আহি ‘ হ্যাভেন রুমেই ভেজা কাপড় পাল্টে নিলো।
.
মাঝরাতে আহির শরীরে অত্যাধিক তাপমাত্রা বেড়ে গেলো। গরম লাগছে বলে হ্যাভেন শুধু একটা শর্ট প্যান্ট পড়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে খালি গায়ে ঘুমাচ্ছে আর এদিকে আহির শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বেশ কাঁপুনি দিয়ে ওঠছে। গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসে গেলো আহির। ঘুমের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে হ্যাভেনের একদম কাছে গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলো৷ একে তো গরম তারওপর আহির শরীরের অত্যাধিক উষ্ণতা মেজাজ খারাপ হয়ে কপাল কুঁচকে চোখ দুটো খুললো হ্যাভেন। যখন বুঝলো মেয়েটার ধুম জ্বর এসেছে তখন ইচ্ছে করলো এক লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিতে। “রোমান্স করতে গিয়েছিলো বৃষ্টিবিলাস করতে গিয়েছিলো ” বির বির করতে করতে এসির পাওয়ার কমিয়ে থার্মোমিটার নিয়ে এসে জ্বর মাপলো। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর দেখতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো হ্যাভেনের। দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স থেকে জ্বরের ট্যাবলেট নিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে আহিকে ধমকে ধমকে ওঠিয়ে ওষুধ খাওয়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর আবার এসে শুয়ে পড়লো আহির পাশে। যদিও বুকে নিতে ইচ্ছে করছিলো তবুও বৃষ্টি তে ভিজে ইচ্ছে কৃত জ্বর আনাতে ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রাখলো।
পরেরদিনও তেমন জ্বর কমলো না আহির। ঠান্ডায় গলা বসে গেছে, টনসিল বেড়ে গেছে। রুবিনা তালুকদার আহিকে নিয়ে ডক্টর দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধপএ নিয়ে এসেছেন। বিপদ ঘটলো সেদিন মাঝরাতে জ্বর ছেড়ে গেছে বলে আহি নিশ্চিন্ত ছিলো। কিন্তু মাঝরাতে অসহনীয় পেট ব্যাথায় আচমকাই ঘুম ভেঙে গেলো।বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় খেয়াল করলো সে যে জায়গাটাতে শুয়েছিলো সেখানে পুরোটাই ভেজা৷ হাত দিয়ে স্পর্শ করে চোখের সামনে হাত ধরতেই শিউরে ওঠলো। পরোক্ষণেই মনে পড়লো গত দুমাস তাঁর পিরিয়ড মিস গেছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিছানায় এসে বসতেই বমি করে দিলো আহি। মেঝেতে তাকাতেই লাল বর্ণের তরল পদার্থ দেখে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠলো। কিছু সময় বাদে টের পেলো তাঁর দু হাঁটু বেয়ে রক্ত নিঃসৃত হচ্ছে। সেই সাথে পেটে অস্বাভাবিক ভাবে মোচড় দিয়ে ব্যাথা হচ্ছে। হাত,পায়ে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। প্রথমে স্বাভাবিক নিলেও পরোক্ষণেই কিছু একটা ভেবেই তলপেট চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো সে। ক্রন্দনধ্বনিতে হ্যাভেনের গভীর ঘুম আলগা হয়ে গেলো। যখন বুঝলো আহি কাঁদছে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ধমকে বললো,
-‘ কি সমস্যা মাঝরাতে ব্যাকুবের মতো কাঁদছো কেনো সারাদিন জ্বালিয়ে শান্তি হয়নি মাঝরাতে কি নাটক শুরু করলে ‘?
বলতে বলতেই বিছানায় চোখ পড়তে সড়িয়ে নিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে তাকালো। তারপর ত্বরিতগতিতে আহির দিকে পুরো দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তাঁর ফর্সা পা দুটোর রক্তে লাল দৃশ্য দেখে গলা শুকিয়ে গেলো। উত্তেজিত হয়ে বললো,
-‘ কি হয়েছে এসব কি ‘?
আহি পেট চেপে ধরেই ঠোঁট ফুলিয়ে ডুঁকরে কেঁদে দিয়ে বললো,
-‘ মা কে ডাকুন প্লিজ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মরে যাচ্ছি ব্যাথায় ‘। বলেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকলো ভাবটা এমন যেনো তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
চলবে…
ভুলত্রুটি ক্ষমা করে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।