মাঝরাতে হঠাৎ প্রচুর ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। সমস্ত আকাশ যেন তার সব কিছু নিয়ে প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল পৃথিবীর উপর। তীব্র আলো আর বিকট নিনাদ নিয়ে বাজ পড়তে লাগল। এতো জোরে হাওয়া বইতে লাগল যে টেবিলের সব কাগজ উড়ে গেল। ঘুম ভেঙেছিল আগেই, উঠে দৌড়ে বারান্দার জানালাটা লাগিয়ে দিলাম। আবার শুয়ে পড়লাম বিছানায়। বারান্দার দরজা আগেই লাগানো ছিলো।
আমার ছোটবোন মিলি আমার সাথেই ঘুমায়। ওরও ঘুম ভেঙে গেছে। হঠাৎ ও আমার হাত চেপে ধরে বললো, ‘আপু, শুনতে পাচ্ছিস?’
‘কি শুনবো? ঝড় বৃষ্টি আর বাজ পড়ার শব্দই তো শুনছি শুধু।’
‘ভালো করে শোন। কে যেন বারান্দার দরজায় বাড়ি দিচ্ছে।’
ভালো করে শুনলাম। হ্যাঁ, কেউ বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের রুমের দরজাতে বাড়ি দিচ্ছে। প্রথমে একে ঝড়ের হাওয়ার ধাক্কা মনে করলেও এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি। এটা কারো হাত দিয়ে বাড়ি দেয়ার আওয়াজ।
ভয়ে আমার হাত পা হিম হয়ে এলো।
আমরা থাকি ছ’তলার ওপর। আমাদের রুমের সাথেই বারান্দা। আমাদের পুরো বারান্দা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে কারো বারান্দায় আসার সুযোগ নেই। আর রাতে ঘুমানোর আগে আমি বারান্দার দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছি। ঘরের কেউ বারান্দায় গেলে তাকে দরজাটা খুলে যেতে হবে। কিন্তু দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ। বাড়িতে মানুষ বলতে শুধু আমরা দু’বোন। আব্বা আম্মা পিরোজপুর গেছেন, আমাদের এক দুসম্পর্কের দাদা অসুস্থ, তাঁকে দেখতে।
তাহলে বারান্দায় যে আছে, সে কে?
দরজায় বাড়ি দেয়ার শব্দ বাড়তে লাগল। চুপ করে আছি, বুঝতে পারছি না কি করব। এমন সময় মিলি চিৎকার করে উঠল। ওর চোখ জানালার দিকে। আমিও সেদিকে তাকালাম।
আমাদের জানালা থাই গ্লাসের। প্রচন্ড বৃষ্টিতে গ্লাস ঝাপসা হয়ে গেছে। সেই ঝাপসা গ্লাসের ওপারে এক মানুষের অবয়ব। সে চোখের কাছে দুহাত জড়ো করে রুমের ভেতর তাকিয়ে আছে।
আমি মিলিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,’চুপ, তাকাবি না ওদিকে।’ মিলি থরথর করে কাঁপতে লাগল।
এসময় কেমন কানে তালা লাগানো শব্দ শুরু হলো। দেখি সে জিনিসটা গ্লাসের ওপর আঁচড় কাটা শুরু করেছে। তীক্ষ্ণ শব্দ আর সহ্য হলো না, দুবোন কানে হাত চেপে চোখ বন্ধ করে রইলাম।
হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। চোখ খুলে দেখলাম বারান্দায় কেউ নেই। ঝড়ও থেমে গেছে। যেমন হঠাৎ করে সব শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেছে সব।
কিছু সময় কাটল। আমাদের ভয়টাও কাটতে লাগলো আস্তে আস্তে। মিলি বলল, ‘আপু, কেমন সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে।’
‘হ্যাঁ।’
‘শোন, বাথরুমে যাবো। অন্ধকার ড্রয়িংরুম দিয়ে যেতে ভয় লাগবে। তুই আসবি একটু আমার সাথে?’
‘চল।’
ড্রয়িংরুমে ঢুকে লাইট জ্বালালাম। রুমের শেষ মাথায় বাথরুম। মিলি বাথরুমে চলে গেল। আমি ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এসময় এই বাড়ি নিয়ে যত ভৌতিক কথা শুনেছি সব মনে পড়তে লাগল একে একে।
আমরা এই ফ্ল্যাটে ভাড়া এসেছি দু’মাস হলো। আসার আগেই কিছু ভয়ংকর কথা শুনেছিলাম এই ফ্ল্যাটটি নিয়ে। প্রথম যারা এখানে ভাড়া এসেছিলেন তারা নাকি খুব অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিলেন। বাইরে বের হতেন না খুব একটা, কারো সাথে মিশতেনও না। হুট করেই তারা একদিন ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যান। বাড়িওয়ালা ফ্ল্যাটের খোঁজখবর করতে এসে দেখেন দেয়ালে দেয়ালে অদ্ভুত সব সাইন আর ছবি আঁকা। মানুষজন বলাবলি শুরু করলো এগুলো ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাইন। বাড়িওয়ালা ফ্ল্যাট চুনকাম করে আবার ভাড়া দেন।
এরপর থেকেই এখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে থাকে। কোনো ভাড়াটিয়াই দু তিনমাসের বেশি টিকতে পারেন না। সবাই ভয়াবহ কোনো ঘটনার শিকার হয়ে চলে যান। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটে এক ছোট ফ্যামিলির সাথে। বাবা মা তাদের দুই মেয়েকে রেখে বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন মেয়েরা দরজা খুলছে না। পুলিশ এসে দরজা ভাঙে। বাড়ির ভেতর দু মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এলাকায় বেশ আলোড়ন ফেলে ঘটনাটি। কিন্তু কেস আনসলভড থেকে যায়, রহস্যের কোনো সমাধান হয় না। সেসময় বেশ কিছুদিন খালি পরে থাকে এই ফ্ল্যাট। তখন নাকি খুব বৃষ্টির রাতে পাশের আর নিচের তলার মানুষেরা এই খালি ফ্ল্যাটে মানুষের হাটা চলার শব্দ পেতেন। কেউ কেউ নাকি চিৎকারও শুনতেন।
ফ্ল্যাটটি বেশিদিন খালি পরে থাকে না। শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত জায়গায় বলে বাড়িটি দ্রুতই আবার ভাড়া হয়ে যায়। কিন্তু একই সমস্যা চলতে থাকে, কেউই টিকতে পারেন না বেশিদিন।
এসব কথা আব্বা শুনেন বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়াদের কাছে, ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে আসার সময়। আমার পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক বাবা এগুলো কিছুই বিশ্বাস করেন না।তিনি বলেন বিজ্ঞান আর যুক্তি দিয়ে সবকিছুর ব্যাখ্যা দেয়া যায়, অলৌকিক বলে কিছু নেই। তার মতো আমরাও অলৌকিকে বিশ্বাস করতাম না কখনো। কিন্তু আজ যা দেখছি আর শুনছি, তা অবিশ্বাস করি কি করে?
হঠাৎ আবার প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। লাইট নিভে গেল। আমাদের বারান্দার দরজাটা খুলে গেল শব্দ করে। দেখলাম সে জিনিসটা দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। সে চারহাত পায়ে ভর দিয়ে বসে গেল। এরপর ছুটে আসতে লাগল আমার দিকে।
আমার আর কিছু মনে নেই।
সকালে সূর্যের আলো চোখে পড়তে ঘুম ভাঙলো। দেখলাম বিছানাতেই শুয়ে আছি, আমার পাশে মিলি হাটু জড়ো করে বসে আছে।
মিলিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে কিভাবে এলাম আমি?’
‘এখানে কিভাবে এলি মানে? তুই তো এ বিছানাতেই ঘুমিয়েছিলি।’
‘তুই না বাথরুমে গিয়েছিলি? ঐ জিনিসটা আমার দিকে আসতে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।’
‘কি বলছিস এগুলা? পাগল হয়ে গেছিস নাকি?’
‘কি বলিস? কালকে রাতে দেখলি না কে যেন বারান্দার বাইরে দাঁড়ায় আছে?’
‘কি উল্টাপাল্টা বলিস? কাল রাতে ঝড় শুরু হলো, তুই লাফ দিয়ে জানলা বন্ধ করে ঘুমায় গেলি।’
‘ওহ, তাহলে মনে হয় স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তোর চোখ এতো লাল কেন?’
‘লাল নাকি? রাতে ঐ ঝড়ের পর ঘুম আসে নাই আমার। তাই মনে হয় এখন লাল হয়ে আছে।’
‘তাই বলে এতো লাল? রক্তের মতো…’
‘আরে ঘুম পাচ্ছে বেশি এজন্য মনে হয় এতো লাল। এখন তুই তাড়াতাড়ি উঠে নাস্তা বানা। ক্ষুধা লেগেছে, খেয়ে লম্বা ঘুম দিবো।’
‘আচ্ছা দাঁড়া ফ্রেশ হয়ে আসি আগে।’
টাওয়েল নিতে বারান্দায় গেলাম। ঝড়ের পরেরদিন সূর্য অনেক উজ্জ্বল, চারদিক ঝলমল করছে।
এসময় জানালার দিকে আমার চোখ পড়ল।
জানালার গ্লাসের উপর নখের আঁচড়ের দাগ, একদম দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
সমাপ্ত ~
অলৌকিক
#লেখনীতে_সোয়েব_বাশার