অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১১
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
রাত সাড়ে আটটা কিংবা ন’টা বাজে হয়তো। টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে আছে দুটো খোলা বই, হিবিজিবি মার্কা লেখাওয়ালা একটা খাতা, দু রঙের ক্যাপ খোলা কলম আর ক্যালকুলেটর। সন্ধ্যা থেকে তীব্রভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম অঙ্কে মনোযোগ দেওয়ার কিন্তু সেটা হয়ে উঠলো না। অংক কিছুতেই মিলল না। তাই গালে হাত দিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে আছি খাতার দিকে। বিকেল থেকেই আম্মুর কাল পাত্রী দেখতে যাওয়ার তোড়জোড় দেখছি। হয়তো এখনো তাই করছে। যেন ওনার ছেলের জন্যেই বউ দেখতে যাচ্ছে। আজব! এরমধ্যেই ভাইব্রেশন মুডে রাখা আমার ফোনটা হঠাৎ ভাইব্রেট করে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম ‘আদ্রিয়ান ভাই’ নামটাই ভেসে উঠেছে স্ক্রিনে। সন্ধ্যা থেকে নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ অংকে দেওয়ার চেষ্টা করে করে নিজের মনটা যেটুকু ভালো করতে পেরেছিলাম। এই নতুন বরের নামটা দেখে মেজাজ এবার আসমান ছুঁই ছুঁই। দাঁতে দাঁত চেপে কল কেটে দিলাম। ফোন রেখে যেই আবার বইয়ে চোখ দিতে যাব অমনি আবার ফোন নামক বস্তুটি বেজে উঠল। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম স্ক্রিনের দিকে। এই লোকটার সমস্যা কী? আমায় কেন কল করছে? কলতো করবে নিজের হবু বউকে। কাল দেখতে যাচ্ছে বলে কথা। বউকে তো ইন্সট্রাকশন দেবে তাইনা? কীভাবে সাজবে? কীভাবে তার ফ্যামলিকে ইম্প্রেস করবে। আমায় কেন কল করছে? যত্তসব। এসব চিন্তার মাঝেই কল কেটে গেল। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কলম হাতে নিতে নিতে আবার ফোন বেজে উঠল। এবার রাগে আমার মাথা একপ্রকার ধরে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উনি বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে উঠল,
‘ ফোন ধরছিলিনা কেন? সমস্যা কী?’
আমিও এবার বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,
‘ আপনার সমস্যা কী সেটা বলুন। আজকে কী আমায় কল করার সময়? আজকেতো নিজের বউকে ফোন করবেন। কীভাবে সেজে গেলে মামণির মনে ধরবে, কীভাবে কী করতে হবে। সেসব না করে আপনি আমায় ফোন করে সময় নষ্ট করছেন কেন? আপনার বউ রাগ করবে না? যদিও বিয়েতো এমনিতেও ফাইনাল। দেখতে যাওয়াটা তো ফর্মালিটি তাইনা?’
ওপাশ থেকে উনি বললেন,
‘ ডান? এবার আমি বলি?’
‘ কী বলবেন? ওও হ্যাঁ বুঝেছি। নিশ্চয়ই শুনেছেন কাল আমিও যাচ্ছি আপনার বউকে দেখতে? কিছু বলতে হবে? ছবি চাই নিশ্চয়ই? আপনি চিন্তা করবেন না আমি খুব সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে নিয়ে আসব। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেব সবগুলো আপনাকে। কোন গিফ্ট দেবেন? সমস্যা নেই জাবিনের কাছে দিয়ে রাখবেন আমি দিয়ে দেব ভাবিকে। আর কিছু করতে হবে? আপনার বউকে__’
উনি ওপাশ থেকে ধমকে বলে উঠলেন,
‘ থাপড়ে গাল লাল করে দেব। বউ বউ যপে যাচ্ছে। কে বউ? না বুঝেই চিল্লাস কেন?’
ওনার ধমক আমার রাগে যেন ঘি ঢেলে দিল। রাগে মাথা ফেটে পড়ার উপক্রম হল আমার। আমি নিজেও এবার কঠিন গলায় বললাম,
‘ আমি তো বলদ-ই। দুনিয়ার সকল বুদ্ধি তো আপনার মাথায় আছে তাইনা? আমার জন্যে আর বাকি ছিলোনা। তো এই বলদ মেয়েটাকে কল দেওয়ার কথা ভুল করেও আর মাথায় আনবেন না আদ্রিয়ান ভাই। প্রয়োজন পড়লেও না। আপনার প্রয়োজন মেটানোর দ্বায় নিয়ে আমি বসে নেই। আরেকবার যদি আপনার কল আমার ফোনে আসে আমি কিন্তু আব্বুকে বলে দেব আপনি আমায় ডিস্টার্ভ করেন। তাদের সবার মহাভদ্র ছেলে আসলে একটা ক্যারেক্টারলেস।’
এটুকু বলে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। কী বলেছি আমিও জানিনা। শুধু জানি এতোদিন ধরে জমিয়ে রাখা কষ্ট, দুঃখ, অভিমান, রাগ মিশে গিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু প্রবল আত্মসম্মানে ভরপুর ঐ মানুষটার কাছে আমার বলা কথাগুলোর ধার ঠিক কতোটা ছিল সেটা ঐ মুহূর্তে বুঝে উঠতে পারিনি। ওপাশ থেকে উনি থমথমে কন্ঠে বলল,
‘ ক্যারেক্টারলেস?’
‘ অবশ্যই, হবু বউ রেখে অন্য মেয়েকে ডিস্টার্ভ করা মানুষকে দেওয়ার জন্যে এরচেয়ে ভালো বিশেষণ আমার জানা নেই।’
আদ্রিয়ান ভাই চুপ করে রইলেন। একটু পরেই একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পেলাম, এরপর ফোন কাটার শব্দ। আমিও কান থেকে ফোন থামিয়ে আবার বইয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। না হলে এখন আবার কান্না পাবে, ভয়ানক কান্না।
রাতে খেতে বসেও নানান চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছি। খেতে ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু আব্বু ডাকায় খেতে বসতে আসতে হল। যথারীতি বাবা-মা কথা বলছে কিন্তু আমার সেদিকে কোন মনোযোগ নেই। আমি অন্য হিসেব মেলাতে ব্যস্ত। কাব্য ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সমস্যা কী? ভাত সামনে রেখে ধ্যান করছিস কেন?’
আমার এখন ওর সাথে ঝগড়া করার কোনরকম ইচ্ছা নেই। তাই ওর দিকে না তাকিয়ে-ই বললাম,
‘ নিজেরটা খেয়ে শেষ কর না? আমার প্লেটে নজর দিস কেন? কাজ নেই? চুপচাপ খা।’
ও কিছু বলতে নিচ্ছিল তার আগেই আম্মু বলল,
‘ অনি কাল রেডি হওয়ার দরকার নেই। আমরা যাচ্ছিনা।’
আমি মুখে ভাত তুলতে গিয়েও থেমে গেলাম। অবাক হয়ে তাকালাম আম্মুর দিকে। এতক্ষণ অন্যমনস্ক থাকলেও এবার ঠিকভাবে বসে কৌতূহলী কন্ঠে বললাম,
‘ কেন?’
‘ মেয়ে দেখতে যাচ্ছেনা ওরা। রিমা ভাবি বলল হয়তো আর যাওয়াও হবেনা।’
আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,
‘ তোমাকে কখন বলল?’
আম্মু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেতে খেতে বলল,
‘ আটটার দিকে কল করেছিল।’
আমি একপ্রকার মূর্তি হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। কোনরকম রিঅ্যাকশন এলোনা ভেতর থেকে। খুশি হয়েছি কি-না সেটাও বুঝতে পারছিনা। কোনরকমে খাওয়া শেষ করে রুমে এসে পড়লাম। সারা রুমে পায়চারী করতে করতে ভাবছি যে কেসটা এক্সাক্টলি কী হল? এন্ড মুমেন্টে টুইস্ট?
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাত হয়তো দশটা বেজে গিয়েছিল। আবার ফোনের আওয়াজেই ঘোর কাটলো। মনে ধাক্কা লাগল। নিশ্চয়ই আদ্রিয়ান ভাইয়ের ফোন? হয়তো খুশি হলাম খানিকটা। দ্রুত গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম কলটা জাবিন করেছে। এ সময়ে ও কেন ফোন করবে? আমি ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে জাবিন বেশ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ অনিপু ভালো আছো?’
আমি হালকা হেসে বললাম,
‘ আমি ভালো আছি পুটি? তুমি কেমন আছো?’
‘ আমিতো ভালোই। শোননা আজ বাড়িতে পুরো মহা তান্ডব হয়ে গেছে।’
আমি জাবিনের কথা বুঝলাম না। তাই কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,
‘ অনিপু, দা’ভাই আজ বাড়িটাই ভেঙ্গে ফেলতো পারলে। কী রেগেছে!’
বুঝলাম এটা সারার কন্ঠ। আমি বললাম,
‘ ছুটকি? কেমন আছো?’
‘ অনিপু দা’ভাই..’
আর কিছু বলার আগেই জাবিন ধমকে বলল,
‘ চুপ করবি তুই? খালি বেশি কথা! আমি বলছিতো আপুকে। চুপচাপ শোননা।’
‘ আমি বললে কী সমস্যা?’
‘ আমি বড় তাই আমি-ই বলব।’
আমি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললাম। জাবিন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার আর সারা ক্লাস নাইনে পড়ে। তবুও কেমন বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছে।আমি বললাম,
‘ জাবিন? কী হয়েছে বলোতো?’
‘ আরে শোন তাহলে! ছুটকি তুই মুখ বন্ধ রাখবি। কোন পয়েন্ট মিস হলে শুধু বলবি। নয়তো চুপ! দে ঠোঁটে আঙুল। হ্যাঁ আপু, কালকে ভাইয়ার জন্যে মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল না? দেখতে যাওয়া কেন বলছি পাত্রি তো অলমোস্ট ঠিক হয়েই গেছিল। কিন্তু আম্মু, আব্বু, দাদু কেউই ভাইয়াকে বলেনি যে ওনার বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখা হচ্ছে। অলমোস্ট ফিক্সড-ই হয়ে গেছে। গত পরশুই জেনেছে। তাও এটা জানতোনা যে কালকেই মেয়ে দেখতে যাবে।’
আমি রীতিমতো ভিমড়ি খেলাম। মানে কী? ওনার বিয়ে অলমোস্ট হয়ে যাচ্ছিল আর উনি জানতো-ই না? পরশু জেনেছে? আচ্ছা পরশুইতো আমাকে ফোন করেছিল না? আমি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বললাম,
‘ হ্যাঁ তারপর?’
‘ আজ সন্ধ্যার দিকেই চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে আমি আর সারা সোফার রুমে গিয়ে দেখি ভাইয়ার মেজাজ তুঙ্গে। কাল মেয়ে দেখতে যাচ্ছে শুনেই ভাইয়ার মাথায় বাজ পড়েছে। সে কী ভয়ানক রাগারাগি! দাদু তো একবার বলেইছিল বিয়ে করতেই হবে। একটু ইমোশনাল প্রেশারও দিচ্ছিল। পরে ভাইয়া রেগেতো টি-টেবিলটাই উল্টে ফেলে দিল। এরপর সব চুপ। আব্বু আম্মু আর কী দাদু পর্যন্ত ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিল।’
সারাও উত্তেজনাময় কন্ঠে বলল,
‘ দাদুকে কী বলেছে জানো?’
আমি খাটে বসে পড়ে উৎসাহি কন্ঠে বললাম,
‘ কী বলেছে?’
‘ বলেছে, এতো বিয়ের শখ থাকলে নিজে একটা বিয়ে করে নাও। যতদিন জীবিত থাকবে ততদিন তোমার। তুমি মরে গেলে আমি দেখবনি।’
বলে সারা খিলখিলিয়ে হেসে দিল। এই সিরিয়াস কথাবার্তায় ও আমার একটু হাসি পেল এবার। কিন্তু ঘটনার সিরিয়াসনেস বুঝতে পেরে আমি নিজেকে সামলে বললাম,
‘ তা তোমার ভাইয়া বিয়ে করবে না কেন? সমস্যা কী?’
জাবিন বলল,
‘ আব্বু জিজ্ঞেস করেছিল। ভাইয়া বলেছে, আমি এখন রিসার্চের চিন্তা করছি আর তোমরা এসব বিয়ে-টিয়ে ফালতু জিনিস নিয়ে পড়ে আছো? এখন আমি বিয়ে-টিয়ে করছিনা। আরেকবার আমার সামনে বিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করলেই আমি সোজা উত্তরা চলে যাব। লকডাউনের জন্যে তো আর ইউকে ফিরতে পারবনা। ফ্লাইট চালু হলে আর থাকবোনা। এরপর আর কেউ কিছু বলার সাহসই পায়নি।’
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম,
‘ তোমার ভাই জানলো কীকরে কাল-ই মেয়ে দেখতে যাবে?’
‘ সন্ধ্যার আগ দিয়ে আম্মু তোমার সাথেই নাকি কথা বলছিল এটা নিয়ে। তখন শুনেছে নাকি।’
সারা অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ দা’ভাই রাতে খায়ও নি আজ।’
জাবিন বলল,
‘ হ্যাঁ। যা একটু ঠান্ডা হয়েছিল কথা বলে। রুমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর কী হল কে জানে? আবার ভাঙচুর শুরু করল। কেউ আশেপাশেও যাওয়ার সাহস পাইনি আমরা। এমনিতেও দরজা বন্ধ। মনে হয়না আজ আর দরজা খুলবে।’
আমি অনেকটা বোকা হয়ে গেছি। ওদের মুখে এই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা শুনে আমার রিঅ্যাকশন ঠিক কী হওয়া উচিত সেটাই ভাবছি। সকাল থেকেই আজ অবাক হয়েই যাচ্ছি! আজকে কী আমার অবাক হওয়া দিবস?
.
.
[ মন্তব্যগুলো অবশ্যই গঠনমূলক এবং গল্পকেন্দ্রিক চাই। আর যারা যারা পড়বেন সবাই অবশ্যই রিঅ্যাক্ট করবেন।]