অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
আমাদের কাজিন মহলের প্রত্যেকে গত তিনবছর যাবত যেই বিশেষ দিনটার জন্যে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম সেটা হল আপির বিয়ে। দীর্ঘ তিন বছর পর অবশেষে সেই সময়টা এলো। আপির এনগেইজমেন্টের আয়োজন করা হল আগষ্ট মাসের ত্রিশ তারিখে। আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল একপ্রকার। কতদিনের অপেক্ষা!
হিয়া আপি আর রায়হান ভাইয়ার পারস্পরিক আংটি বদলের কাজটা হয়ে গেছিল তিনবছর আগেই। সেটা হয়েছিল একান্তই পারিবারিকভাবে। কোনরকম কোন অনুষ্ঠান ছাড়াই। তিনবছর আগেই আপি মামুদের জানায় রায়হান ভাইয়ার কথা। কিন্তু আপির পড়াশোনা শেষ হয়নি বলেই পারিবারিকভাবে শুধু আংটি বদল সেরে রেখেছিল। এরপরই অপেক্ষা ছিল আপির অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটা শেষ হওয়ার। তবে এই তিনবছর দুজনের মধ্যে প্রেম ছিল ভরপুর। তাদের চুটিয়ে প্রেম করার অনেক ঘটনার সাক্ষী এবং সাহায্যকারী ছিলাম আমি নিজেও। অবশেষে এতোবছরের প্রণয়ের এবার পরিণয় হবে।আপির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই অবশেষে ওদের এবার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো দুই পরিবার।
কাল আপির এনগেইজমেন্ট। এটা আসলে পাত্র-পাত্রির মধ্যকার আংটি বদল নয়, কাল দুলাভাইয়ের বাড়ি থেকে গুরুজনসহ কিছু মানুষ আসবেন। তারাই আপিকে আংটি পড়িয়ে যাবেন আর বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক-ঠাক করে যাবেন। আজ রাত থেকেই রান্নার লোকেরা কাটাকুটি শুরু করে দিয়েছে। মামাবাড়ির বিশাল উঠানে বিভিন্ন সবজি, মশলা আর পেঁয়াজের গন্ধে ভরে গেছে। ভাইয়েরা সব বাজার-টাজারের কাজে ব্যস্ত। আপি আর আমি আপির রুমে বসে আছি। সৃষ্টি ভাবি চা বানাচ্ছে। আপির সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আমি জানালা দিয়ে মেইন গেইটের দিকে তাকাচ্ছি। আদ্রিয়ান ভাই কী আসবেন না আজ? মামা আর সোহেল ভাই যে বলল ফোন করে আসতে বলেছে? আপি ব্যালকনি দিয়ে উঠোনে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ এনগেইজমেন্টেই যদি এতো আয়োজন করে তো বিয়েতে কী করবে?’
আমি হেসে হেসে বললাম,
‘ রাজকীয় সব ব্যাপারস্যাপার হবে।’
আপির মুখে তীব্র অসন্তোষ দেখা গেল। আসলে ও এতো খরচের পক্ষপাতি মোটেও নয়। ওর ভাষ্যমতে বিয়েইতো করছি, এতো বাড়তি টাকা খরচের দরকার কী? কিন্তু মেঝ মামা কেন শুনবেন? একমাত্র মেয়ের বিয়ে যেমন-তেমন করে দিলে হয়? এমন সময় হিমু দৌড়ে এলো আমাদের কাছে। ওর দৃষ্টি আমার ফোনের ওপর পড়তেই আমি ফোন সরিয়ে বললাম,
‘ খবরদার না, দ্রুত চোখ সরাও।’
হিমু চোখ উল্টে ভ্রু কুঁচকে একবার তাকাল আমার দিকে এরপর আপির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমার টা দাও।’
আপিও নিজের ফোন সামলে নিয়ে বলল,
‘ ভুলেও না। এইটুক একটা মাইয়া। ফোন দিয়ে করিস টা কী হ্যাঁ?’
সৃষ্টি ভাবি চায়ের কাপগুলো নিয়ে ঢুকে আপিকে আর আমাকে চা দিতে দিতে বলল,
‘ স্ন্যাপচ্যাট করে। ফিল্টারে চেহারা দেখতে ভীষণ মজা। তাইনা হিমু?’
হিমু দ্রুত উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো যার অর্থ হ্যাঁ। তারপর একটা লাফ দিয়ে সুর টেনে বলল,
‘ আর ডিজে গানে নাচি।’
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভ্রু কুঁচকে ভেঙিয়ে বললাম,
‘ অ্যাঁ ডিজে গানে নাচি। তুই ডিজে কাকে বলে জানিস? ডিজের ফুল ফর্ম বল দেখি?’
হিমু বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ও কিছুই বোঝেনি, বোঝার কথাও না। আমি হেসে ভ্রু নাচালাম। ও বলাই হয়নি হিমুর এবার পাঁচ বছর হল। নার্সারিতে পড়ছে। প্রচন্ড চঞ্চল আর দুষ্টু হয়েছে। এমন সময় সজীব ভাইয়া চোখ ঢলতে ঢলতে এসে বলল,
‘ ডিজে এর ফুল ফর্ম তুই বলতো বুড়ি?’
আমি একটু থমকালাম। ডিজের ফুল ফর্ম যে ‘ডিস্ক জকি’ সেটা আমার জানা থাকলেও ঐ মুহূর্তে মোটেও মনে পড়ছিল না। মানে পেটে আছে কিন্তু মুখে আসছেনা টাইপ ব্যপার। সজীব ভাই হো হো করে হেসে উঠল সাথে যোগ দিল আপি আর সৃষ্টি ভাবি। হিমু কিছু না বুঝলেও ওদের দেখাদেখি হেসে দিল। আমি বোকা চোখে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে।
‘ ওর স্বভাবই এরকম। বোঝে কম চিল্লায় বেশি। না জেনেবুঝে বকবক করা ওর স্বভাব। ডিস্ক জকি বলে ওটাকে।’
কথাটা কে বলল দেখতে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘ একমাস পর ওনাকে দেখে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি ওনার দিকে। সেদিনের পর উনি নিজে থেকে ফোন-টোন আর করেনি আমাকে। আমিও করিনি। কেন করিনি তা জানিনা। কিন্তু করিনি। এরমাঝে সদরে যাওয়ার সুযোগটাও হয়ে ওঠেনি আমার। তবে ওনার এতোটা রেগে যাওয়ার কারণও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধুমাত্র উঁচু গলায় কথা বলেছি বলে এতো রাগ? সজীব ভাই হেসে এগিয়ে গেল। আদ্রিয়ান ভাইয়াকে হাগ করতে করতে বলল,
‘ ওর চিল্লাচিল্লি সব তোকে দেখলেই থামে। না হলেতো অটো ক্যাসেট বাজতেই থাকে।’
আমি মুখ ফুলিয়ে সজীব ভাইকে বললাম,
‘ আর তুমি যে বিয়ে বাড়িতে অলসের মতো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলে? সেই বেলা?’
সজীব ভাই কিছু না বলে হেসে স্নেহভরা হাতে আমার মাথার চুলগুলো নেড়ে দিল। এরপর আদ্রিয়ান ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘এতো দেরী হলো যে?’
আপিও বলল,
‘ হ্যাঁ আদ্রিয়ান ভাই, এতো দেরী করে এলেন কেন?’
ততক্ষণে হিমু দৌড়ে চলে গেছে ওর ‘দুলাই’ এর কাছে। হিমু ওনাকে দুলাই বলে ডাকে। প্রথম যখন এই নামে ডাকল আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম। ছোট মামি বলেছিল, ‘হুমায়রা! ভাইয়া হয় তোমার।’ কিন্তু হিমু মানতে নারাজ। ওর লজিক হল আজম ভাই, সবুজ ভাইকে দুলাই বলে ডাকে তাহলে আদ্রিয়ান ভাইও নিশ্চয়ই ওর দুলাই। কারণ ওনাদের দুজনের মতো আদ্রিয়ান ভাইও মাঝেমাঝে আসে এ বাড়িতে। প্রথমে রাগারাগি করলেও এখন আর কেউ এটা নিয়ে তেমন ভাবেনা। আদ্রিয়ান ভাই হিমুকে কোলে নিতে নিতে বলল,
‘ আসলে কিছুটা কাজ ছিল সদরে, তাই আসতে দেরী হয়ে গেল।’
সৃষ্টি ভাবি বলল,
‘ ভাইয়া চা দেই তোমাকে?’
আদ্রিয়ান ভাই সৌজন্যতার হাসি দিয়ে বলল,
‘ না ভাবি। আসার আগে কফি খেয়ে এসেছি। এখন আর চা খাবোনা।’
এরমধ্যেই হিমু আদ্রিয়ান ভাইয়ের কপালে পড়া চুলগুলো নাড়তে নাড়তে বলল,
‘ দুলাই, তোমার ফোন দাও।’
আদ্রিয়ান ভাই হেসে বলল,
‘ আমার ফোনে তো স্ন্যাপচ্যাট নেই। গান আছে। গান শুনবে?’
হিমু মাথা ঝাঁকালো। আদ্রিয়ান ভাই হেসে ফোনের লকটা খুলে গান চালিয়ে হিমুর হাতে দিয়ে বলল,
‘ রাখো তোমার কাছে। হারিয়ে ফেলোনা কিন্তু?’
হিমু মাথা নাড়ালো। আদ্রিয়ান ভাই সজীব ভাইয়ের উদ্দেশ্য বলল,
‘ ভাই, বের হবেনা?’
সজীব ভাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে দ্রুত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ। চা টা শেষ করি। দাঁড়াও।’
কয়েক চুমুকে চা-টা শেষ করে সজীব ভাই চলে গেল উঠানে। আমি ওনাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লাম। একবার সরাসরি কথাও বলল না আমার সাথে। রাগ দেখাচ্ছে! এরমধ্যেই রুমানা ভাবি, মলি আপু, মিলি আপু চলে এলো ও ঘর থেকে। সাথে মেঝ মামির বোনের দুই মেয়ে অর্পা আপু আর ঋতু আপুও এলো। শুরু হল আমাদের বোনদের চা-আড্ডা। এখন আর অন্যকিছু নিয়ে ভাবার সময় নেই।
দেখতে দেখতে ঘন্টা দুইয়ের মতো কেটে গেল। আমরা বোনেরা সব ব্যালকনি দিয়ে দেখছি ওদের কাজ। আমার দৃষ্টি আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে। কাল মেহমানরা সব এসে বসবে বাড়ির সাথে জয়েন্ট মেঝ মামুর নতুন দোকানে। যেটাকে এখন বড়সড় হলরুম বলা যায়। ওখানে সবগুলো সোফা সেট নিয়ে গিয়ে রাখার দায়িত্ব আদ্রিয়ান ভাই আর অর্ণব ভাইয়ার। আদ্রিয়ান ভাই শার্ট খুলে কোমরে বেঁধে নিয়েছে। ঘামে হালকা ভিজেও গেছেন। স্বাভাবিক। নানু বাড়িতে মোট তিনটে বিল্ডিং। বিল্ডিং তিনটা জোড়া দেয়া হলেও প্রতিটা বিল্ডিং এ ঢোকার দরজা আলাদা। তিন মামার জন্যে তিনটা বিল্ডিং বরাদ্দ। তিনটে বিল্ডিং থেকে মোট তিন সেট সোফা নিয়ে নিয়ে হল রুমে রাখা বেশ পরিশ্রমের কাজ। সবাই চুপচাপ বসে বসে খালি দেখছি-ই এদের কাজ। হঠাৎ অর্পা আপু গালে হাত দিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ ভাই! আদ্রিয়ান ভাইটা কী জোস রে। যতবার দেখি ততবার ক্রাশ খেতে বাধ্য। কিন্তু লোকটা পাত্তাই দেয়না। কী কঠিন মানব।’
বাকি আপুরা হেসে দিল অর্পা আপুর কথা শুনে। আমি শুধু বিরক্তি নিয়ে একবার তাকালাম আপুর দিকে। তারপর আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম শার্ট খুলে কোমরে বাঁধার কী দরকার ছিল? মেয়েদের নজর কাড়ার ধান্দা। খারাপ পুরুষমানুষ।
সবার কাজকর্ম শেষ হওয়ার পর ঠিক করা হল এখন যখন সবাই ফ্রি আছি তাহলে মামুর দোকানে অর্থাৎ বর্তমান টেম্পোরারি হলরুমে বসে চা আর পুরি খেতে খেতে আড্ডা দেব সবাই মিলে। সবাই সম্মতি দিতেই যেই ভাবা সেই কাজ। আপুরা চলে গেল পুরি আর চা বানাতে। পড়ে রইলাম আমি আর হিমু। আমি ব্যালকনি জুড়ে হাঁটছি আর আদ্রিয়ান ভাইকে দেখছি। হিমুর হাতে এখনো আদ্রিয়ান ভাইয়ের ফোন। আমি একবার ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি এখনো ব্যস্ত। আমি দ্রুত হিমুকে বললাম,
‘ হিমু, ফোনটা দেবে একটু? কাজ আছে। এক্ষুনি দিয়ে দেব।’
হিমু হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দিল ফোনটা। আমি ফোনটা নিয়ে দ্রুত মিউসিক অ্যাপ থেকে বেরিয়েই দেখলাম তার পাশেই নোটপ্যাড। ইচ্ছে ছিল গ্যালারিতে যাওয়ার কিন্তু নোটপ্যাড দেখে কী মনে করে ওখানেই ক্লিক করলাম। ক্লিক করতেই স্ক্রিনে একটা খোলা ফাইল-ই এলো। যেখানে লেখা আছে,
‘ নিজেকে এক্সপ্লেইন করতে অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের অবুঝ কারো প্রেমে পড়তে নেই। নিরন্তর পুড়তে হয়। সে এক অদ্ভুত দহন।’
আমি ব্যাক বাটনে ক্লিক করার আগেই কেউ ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে গেল। আমি হালকা চমকে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাই রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই উনি ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে চলে গেলেন। আমি মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি ফোনটা নিয়ে গেছেন বলে নয়। অন্যসময় হলে ভীষণ জোরে একটা ধমক মেরে দিতেন কিন্তু আজ কিছুই বলল না? এতো রাগ?
চায়ের সাথে পুরির আড্ডাটা বেশ জমিয়ে হল। বরাবরের মতোই আড্ডার মধ্যমণি আদ্রিয়ান ভাই। সেটা নতুন কিছু না। যেকোন আড্ডা জমিয়ে দিতে উনি পটু। কিন্তু আজকে কথায় কথায় আমায় পঁচানোর কাজটা সে মোটেই করছে না। এতোদিন যখন সকলের সামনে আমায় টিজ করতো তখন বড্ড বিরক্ত লাগতো অথচ আজ করছেনা বলে বিরক্ত লাগছে। কী অদ্ভুত!
আড্ডা শেষ হতে হতে বেশ রাত হল। সবাই এখন বেশ অনেকটা ক্লান্ত। এবার সবার ঘুম প্রয়োজন। তাই সবাই দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। আপির রুমে এসে দেখি আপি রায়হান ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। ভাবলাম এখন এই প্রেমিক জুটিকে ডিস্টার্ভ না করি। তাই ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চলে এলাম ওখান থেকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে এবার আদ্রিয়ান ভাইকে খুঁজছি। একটু কথা বলা দরকার। সাহেবের ভীষণ রাগ হয়েছে। দেখি চিড়ে ভেজাতে পারি কি-না। হঠাৎ দেখলাম আদ্রিয়ান ভাই কতগুলো চেয়ার নিয়ে ঐ দোকানে ঢুকলো। ওখানে তো এখন কেউ নেই। এটাই সুযোগ গিয়ে কথা বলে আসি। দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলাম ওখানে। দোকানটা বেশ অন্ধকার, লাইট অফ তাই। ভেতরে করছে টা কী? আমি ভয়ে ভয়ে পা টিপে ভেতরে গিয়ে দেখি উনি হ্যান্ডেল ছাড়া চেয়ারগুলো একটার পর একটা সাজিয়ে সাজিয়ে রাখছেন। আমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে গলা ঝাড়লাম। কিন্তু ওনার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। উনি নিজের মতো করে চেয়ার সেট করছে। আমি আরেকটু এগিয়ে বললাম,
‘ শুনছেন? কিছু কথা ছিল।’
উনি এবারও কিছু বললেন না। এখনো চেয়ার ঠিক করছেন নিজের মতো। আমি এবার একটু জোরে বললাম,
‘ আজবতো! আমি কথা বলছি শুনতে পাচ্ছেন না?’
উনি আমার দিকে দৃষ্টিপাত না করে নিজের কাজ করতে করতে বলল,
‘ একজন ক্যারেক্টারলেসের সাথে কথা বলতে একা একা দোকানে চলে এলি? কলিজা কাঁপলো না? এখান থেকে তুই গলা ফাটিয়ে চেঁচালেও কিন্তু কেউ শুনবেনা। আর না তোকে বাঁচাতে আসবে।’
শীট! সেদিন কথায় কথায় যে ওনাকে ক্যারেক্টারলেস বলেছিলাম সেটাতো ভুলেই গেছি। এইজন্যই তাহলে এতো রাগ? আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। এরপর নিচু কন্ঠে বললাম,
‘ সরি।’
উনি কিছু বললেন না খালি ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হাসলেন। এটাকে হয়তো তাচ্ছিল্যের হাসি বলা হয়। ঠিক জানিনা। আমি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি লাস্ট চেয়ারটা রেখে এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলেন। ওনার হাত ধরে আটকাতেই নিয়েছিলাম, কিন্তু এমন ঝড়ের বেগে গেলেন যে ধরতেই পারলাম না। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। আরে বাবা ভুল করেছি বকে দিলেই হয়। এভাবে কথা না বললে কার ভালো লাগে। এতো রাগের কী আছে বুঝতে পারলাম না। একমাস আগে কী না কী বলেছি সেটা নিয়ে এখনো পড়ে আছে। কী আজব!
সেদিন রাতে আদ্রিয়ান ভাই নিজের বাইক টেনে চলে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে। পরেরদিন ত্রিশ আগস্ট। বেলা অনেক হয়ে গেছে। আমি আর সৃষ্টি ভাবি আগেভাগে রেডি এবার আপিকে সাজাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই রায়হান ভাইয়াদের বাড়ি থেকে লোক চলে আসবে। মলি-মিলি আপি, রুমানা ভাবি অলরেডি সাজতে চলে গেছে। শুনেছি কিছুক্ষণ আগেই মানিক আঙ্কেল ওরা এসেছে। জাবিন এসেছিল এখানে দেখা করতে। আসার আগে নাকি দেখে এসেছে আদ্রিয়ান ভাই ঘুমোচ্ছে। মামণি ডাকাতে বলেছে, তোমরা যাও, আমি চলে আসব। এখন জাবিন, সারা ওরা অর্পা আপু আর ঋতু আপুর সাথে কাঠবাগান ঘুরে দেখতে গেছে। এমন সময় আপির ফোনটা বেজে উঠল। সৃষ্টি ভাবি তখন আপির চোখে আই লাইনার লাগাচ্ছে। আপি বলল,
‘ অনি, দেখতো কে?’
আমি স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি রায়হান ভাইয়া ফোন করেছে। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ কে আবার? তোমার বর। বিয়ের আগেই বউকে ছাড়া থাকতে পারছেনা। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করতে হবে। বিয়ের পর এই লোক কী করবে কে জানে।’
এসব বলতে বলতে পাশের রুমে এসে ফোনটা রিসিভ করে বললাম,
‘ কী ইয়ার জিজু। কাল সারারাত বউয়ের সাথে প্রেম করে মন ভরেনি? মানছি আজ তোমার এখানে আসা বারণ বলে মনে মনে একদিনের দেবদাস হয়ে গেছো। তাই বলে আজকে এই সময়ও ফোন দিতে হবে? সাজাচ্ছি তোমার বউকে। ডিসটার্ব করোনা তো। পরে কথা হবে।’
বলে রাখতে নিলেই ওপাশ থেকে অপরিচিত এক কন্ঠে কেউ বলে উঠল,
‘ এক্সকিউজ মি। তুমি হিয়া ভাবি নও?’
আমি ভ্রু কুঁচকে নাম্বারটা একবার চেক করে বললাম,
‘ আপনি কে? এটাতো রায়হান জিজুর নাম্বার।’
তখনই রায়হান ভাইয়ার গলার আওয়াজ পেলাম,
‘ আরে শালিকা, রাগ করোনা। ওরা আসলে মজা করছিল। ফোনে আমার ভাই আনভীর ছিল। হিয়ার সাথে মজা করতে চাইছিল।’
আমার বিরক্তি কয়েকগুন ছাড়িয়ে গেল। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
‘ তোমার ভাইয়েরা আর সময় পায়নি? সব আজাইরা কারবার।’
ওপাশ থেকে আবার সেই কন্ঠ ভেসে এল,
‘ আপনার কন্ঠ কিন্তু বেশ সুন্দর বেয়াইন সাহেবা। কন্ঠ শুনেই ইম্প্রেসড। দেখলেতো হার্ট অ্যাটাক করব।’
আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম,
‘ থ্যাংকস। আর জিজু রাখছি হ্যাঁ। কাজ আছে।’
রায়হান ভাইয়া হেসে বলল,
‘ আচ্ছা রাখ।’
আমি ফোন রেখে ঘুরতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাই। দেখেই বুকের মধ্যে ছোটখাটো ধাক্কা লাগল। এই লোক এতো সুন্দর কেন? এতো সুন্দর হওয়া ভালো? কিন্তু আমাকে একটা বিশাল ধমক দেওয়ার বদলে উনি সাইড কাটিয়ে চলে গেলেন। আমি একটা মুখ ভেংচি কাটলাম। হুহ ভাব। ওনার দেওয়া জামাটা পরেছি দেখলোও না। আমিও দেখি কীভাবে রেগে থাকে আজ।
রায়হান ভাইয়ের বাড়ি থেকে লোকেরা এলো বারোটার দিকে। মেহমান আসার পর প্রথমে ওনাদের ফল, মিষ্টি, নাস্তা ইত্যাদি দেওয়া হল। ওরা খাচ্ছে। আমি, জাবিন, সারা, অর্পা আপু, ঋতু আপু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আড়াল থেকে। অর্পা আপু বলল,
‘ অনু, এখান থেকে কোন একটা ছেলে দেখোতো ক্রাশ খাওয়ার মতো। আদ্রিয়ান ভাইতো এই জন্মে পাত্তা দেবেনা। অন্যকোথাও একটু ট্রাই মেরে দেখি।’
জাবিন হেসে বলল,
‘ ভাইয়ার কাছে পাত্তা আশা করে বুক ভারী করোনা। পাথরে গড়া হৃদয়। তারচেয়ে ঐ বেগুনি, অফ হোয়াইট আর ব্লু পাঞ্জাবী পড়া ভাইয়া তিনটাকে দেখো। যে কজন এসছে তাদের মধ্যে বেস্ট।’
আমরা সবাই তাকিয়ে দেখলাম হ্যাঁ বেগুনি, নীল, ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী পরা তিনটা ছেলে পাশাপাশি বসে আছে। জুস খাচ্ছে। বেগুনি আর ঘিয়ে পাঞ্জাবি পরা দুজন মোটামুটি ফর্সা, ব্লু পাঞ্জাবী পরা ছেলেটা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। তিনজনেরই হাইটও ভালো। হ্যান্ডসাম বলা চলে। অর্পা আপু মুখ কালো করে বলল,
‘ ছেলেগুলোতো সুন্দর। কিন্তু আদ্রিয়ান ভাইকে দেখে এখন আর কাউকে মনে ধরছেনা। কী জ্বালা। এমন হলে আমার বরের কী হবে?’
আমি অর্পা আপুর দিকে বিরক্তিভরা চোখে তাকালাম। দুনিয়াতে সুন্দর ছেলের অভাব? ওনাকেই চোখে পড়ল। আদ্রিয়ান ভাই সুন্দর ঠিক আছে, কিন্তু বিশ্বের সেরা সুন্দর তো অবশ্যই নয়। সারা হেসে বলল,
‘ কী আর হবে? আমার দা’ভাই টাকে দিনরাত বদদোয়া দেবে।’
এই নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতে করতে তারা এগিয়ে এলো। সবাই দরজা দিয়ে পাস করে চলে গেলেও দাঁড়িয়ে গেল বেগুনি পাঞ্জাবি পরা লোকটা। আমাদের সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
‘ তোমাদের মধ্যে অনিমা কে?’
আমি একটু অবাক হলাম। আমার নাম কীকরে জানে? আমি অবাক কন্ঠেই বললাম,
‘ জি আমি।’
ছেলেটা হেসে বলল,
‘ তাহলে তুমি-ই সেই কন্ঠসুন্দরী? ফোনে যেভাবে ঝাড়লে ভাইয়া ভেবে। আমি আনভীর। চিনেছো?’
আমি বুঝলাম যে এটাই সেই আনভীর। আমি হেসে দিয়ে বললাম,
‘ ওটা আপনি ছিলেন? সরি ভাইয়া। আসলে তখন বিরক্ত ছিলাম তাই_’
‘ উফফ দিলেতো ভাইয়া ডেকে মনটা ভেঙ্গে? বাই দা ওয়ে তোমার কন্ঠ কিন্তু জোস্ লেগেছে আমার। কন্ঠসুন্দরী নামটা পছন্দ হয়েছে?’
আমি বোকা চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ ওনার ঘাড়ে টোকা মারল। তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাই টিস্যু হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আনভীর ভাইয়া তাকাতেই বলল,
‘ তোমাকে হল রুমে ডাকছে।’
বলে উনি পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর দেখলাম ওনাকে। জামা বদলে ফেলেছেন। নরমাল টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়েছে। হয়তো সার্ভ করার কাজ করছে তাই। আনভীর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
‘ বাই।’
আমি সৌজন্যতার একটা হাসি দিলাম শুধু। মেহমানদের যেতে যেতে প্রায় বিকেল হল। এরমধ্যে চেষ্টা করেও আদ্রিয়ান ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারিনি। বলতে গেলেই উনি এড়িয়ে গেছেন। খাওয়াদাওয়া সেরে, গোছগাছের সব কাজকর্ম সারার পর এবার এলাকায় ঘনিষ্ঠ লোকেদের বাড়িগুলো খাবার দিতে হবে। সজীব ভাই আর অর্ণব ভাইয়া গেল একদিকে, শান্ত-সাম্য ভাইয়া গেল একদিকে। কিন্তু আরেকদিকে যাওয়ার মতো লোক নেই। কেউ নেই তাই আদ্রিয়ান ভাই নিজেই বলল যাবে। কিন্তু সমস্যা হল উনি বাড়ি চেনেন না। তখন মেঝ মামু বলল,
‘ অনি তুমিতো জানো কোন কোন বাড়িতে দিতে হবে?’
আমি দ্রুত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম। মেঝ মামু বলল,
‘ তাহলে আদ্রিয়ানের সাথে তুমি-ই যাও।’
আদ্রিয়ান ভাই আমার দিকে একবার তাকিয়ে খাবারের ব্যাগগুলো দুহাতে নিয়ে হাঁটা ধরলেই। আমি দ্রুত ওড়না ঠিক করে ওনার পেছন পেছন একপ্রকার দৌড় মারলাম। এটাই সুযোগ ওনাকে একা পেয়ে কথা বলার।
এলাকার মধ্যে মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আমরা। কিন্তু এই লোক হাঁটছে না দৌঁড়াচ্ছে বলা মুশকিল। কারণ ওনার সাথে আমায় রীতিমতো দৌঁড়াতে হচ্ছে। আমি বিরক্তি নিয়ে হাঁফানো কন্ঠে বললাম,
‘ একটু আস্তে হাঁটুন না আদ্রিয়ান ভাই। আমাদের কেউ তাড়া করেনি।’
আমার কথায় ওনার পায়ের গতি কমার বদলে বেড়ে গেল। আজব মানুষ তো! সবসময় ঘাড়ত্যাড়ামি। আমি এবার না পেরে দাঁড়িয়ে গিয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললাম,
‘ এতো জোরে হেঁটে আমার পেট ব্যথা করছে।’
এবার ওনার পায়ের গতি কমলো। আগের তুলনায় অনেকটাই আস্তে হাঁটলেন। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও সাহেব আমার সাথে কোন কথা বললেন না। কিছুক্ষণ পর আমি নিজেই বললাম,
‘ আপনি বিয়েটা করে ফেললেই ভালো করতেন আদ্রিয়ান ভাই। একসঙ্গে পরপর দুটো বিয়ে খাওয়া হতো। একটা ছেলের পক্ষের থেকে একটা মেয়ের পক্ষের। মিস করিয়ে দিলেন।’
কিন্তু উনি কোন রিঅ্যাকশনই দিল না। নিজের মতো হেঁটে চলেছে। ধুর! আমি একটু গলা ঝেড়ে পায়ের গতি বাড়িয়ে বললাম,
‘ একটা ক্যান্সেল হয়েছেতো কী হয়েছে? আমরা আবার খুঁজতে পারি। চলুন হাঁটতে হাঁটতেই মেয়ে খুঁজি। পেলেও পেতে পারি। কী বলেন?’
উনি এবারও উত্তর দিলেন না। এরপর আমি পথে যে মেয়ে দেখেছি তার দিকেই ইশারা করে গুনগান গেয়ে গেয়ে তাকে শুনিয়েছি কোনটা তার জন্যে বেটার। কিন্তু লোকটা শুনেছে কি-না বোঝার উপায় নেই। নিজের মতো হেঁটেই চলেছে। পথে আরেকটা মেয়ে দেখেই আমি বললাম,
‘ ভাইয়া দেখুন। একদম পরী। আপনার সাথে একদম…’
উনি ঘাড় বাঁকিয়ে এমন এক দৃষ্টিতে তাকালেন যে আমি থেমে গেলাম। এরপর উনি আবার হাঁটা ধরলেন আর আমিও। আচ্ছা আমি আবার কথা বললে কী উনি আমাকে তুলে পাশের পুকুরটায় ফেলে দেবে? নাকি চড় মারবে? দুই হাত তো আটকানো এখন। তারমানে আপাতত চাইলেও কিছু করতে পারবেনা। আমি সেফ? আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম ওনাকে। রাগতো কমিয়ে তবেই ছাড়ব। নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার গলা ঝেড়ে বললাম,
‘ আচ্ছা? একটাও পছন্দ হলোনা? আপনার নিজস্ব পছন্দ আছে? কেমন বলুনতো? বয়স কতো লাগবে? উনিশের কাছাকাছি হলে চলবে? এডমিশন সিকার? একটু বেশি ছটফটে? বলুননা?’
বলে হাঁটতে হাঁটতে ওনার দিকে একটু ঝুঁকে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে। নিশ্চয়ই হাসি আটকাচ্ছে? আমি এবার আরেকটু সাহস নিয়ে বললাম,
‘ তার সাথে শ্যামবতী হলে কেমন হয় আদ্রিয়ান ভাই?’
উনি এবার হেসে ফেললেন। হালকা শব্দ করে। ওনার ঐ চমৎকার হাসি দেখে আমার মনও শান্ত হল। যাক রাগ তাহলে ভ্যানিশ। কিন্তু এতো চমৎকার হাসি কেন দেন উনি? এমন একটা হাসি হেসে আমার বাচ্চা মনটাকে আহত করাতো অন্যায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, ঘোর অন্যায়।
.
.
[ অনেক বড় পার্ট দিয়েছি তাই রি-চেইক করা হয়নি। আর নতুন উপন্যাস আজকে নয়তো কালকে নিশ্চিত পাবেন।]