অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১৬
জুন মাসে পা পড়তেই শুরু হল বর্ষণের প্রকোপ। যদিও বর্ষাঋতু শুরু হতে তখনও কিছুদিন বাকি। তবে মে মাসের অসহ্য গরমে তপ্ত পরিবেশকে শীতল করে দিয়ে নেমে এলো বৃষ্টি। ব্যক্তিগতভাবে বর্ষাঋতু ভীষণ পছন্দ আমার। বৃষ্টিবিলাসী নামটা তারই প্রমাণ। তাছাড়াও এইসময়টা যখন খুব মন খারাপ থাকে। ধূসর মেঘলা আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যায়। মনে হয় আকাশেরও আমার মতোই মন খারাপ। তাইতো এমন গুমরে আছে। ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ হাতে নিয়ে বিরতিহীন বর্ষণ উপভোগ করা যায়। সামান্য বৃষ্টির ছাঁট, অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে মৃদু মেঘের গর্জন, বৃষ্টিভেজা সবুজ দৃশ্যপট দেখতে দেখতে ভেতরটা কেমন ভার হয়ে আসে। বিষণ্ন মনটাকে যেন আরও বিষণ্নতায় ঘিরে ধরে। তবে সেই বিষণ্নতাটুকুও ভালোলাগার। মন কেমন করার মতো ভালোলাগার।
তবে বর্ষণকে ভালোবাসার আরেকটা কারণ আছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব! বড্ড অকারণেই বর্ষণকে ওনার আর আমার মধ্যকার সংযোগ সেতু মনে হয় আমার। ব্যপারটা কিছুটা নাটকীয়। তবে জীবনটা নাটকের চেয়ে কম কী? কোথায় যেন শুনেছিলাম জীবনটা জগতের সবচেয়ে বড় নাট্যমঞ্চ। সেখানে দু একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সেই বিকেলের পর দুটো দিন পার হয়ে গেছে। সেদিন সন্ধ্যার অনেকটা সময় পর আম্মুর ডাকে চোখ খুললাম। দৃষ্টি পরিষ্কার হতে বুঝলাম শরবত করে নিয়ে এসেছে আমার জন্যে। মাথার খানিকটা পাশে ফোন চার্জে লাগানো। হাত বাড়িয়ে সময় দেখে বুঝলাম সাড়ে সাতটা বাজে। আস্তে করে উঠে বসতেই আম্মু জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন লাগছে এখন?’
আমি দুর্বল গলায় বললাম, ‘বিকেলের চেয়ে ভালো।’
বিকেলের চেয়ে ভালো হলেও তখনও শরীর খুব একটা ভালো না আমার। প্রচন্ড দুর্বল লাগছিল। শীতও করছিল ভীষণ। হঠাৎ মনে পড়ল বিকেলের ঘটনাগুলো। ওনার আমার কপালে হাত রাখা, কপালে আলতো করে চুমু দেওয়া, হাতে ব্রেসলেট পরিয়ে দেওয়া, হঠাৎ আমার হাইপার হয়ে গিয়ে চিৎকার করা। এরপর? এরপর কিছুই মনে নেই আমার আর। মনে হল যেন সবটাই স্বপ্ন। কিন্তু আমি জানি বিকেলে সত্যিই এ ঘটনা ঘটেছে। হাতে থাকা ব্রেসলেটটাই তার প্রমাণ। সন্দিহান দৃষ্টিতে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম উনি ব্যাপারটা কীভাবে নিয়েছে।
আম্মু শরবত এগিয়ে দিল আমার দিকে। কিন্তু আমার ঐ ব্যবহার, তারপর কী হয়েছে, আদ্রিয়ান ভাই কোথায় গেলেন এসব নিয়ে তখনই কোন কথা বলল না। শরবত খেতে খেতে শুনলাম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কোনমতে জ্ঞান ফেরানোও হয়েছিল। তবে তারপর নাকি ক্লান্তিতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি।
শরবত খাইয়ে জ্বরটা মেপে দেখল জ্বর একটুও কমেনি। মাথায় পানি ঢেলে, শরীর মুছে দিলো আম্মু। মনটা খারাপ হয়ে গেছে তার। শরীর মোছার সময় আম্মু এক ভয়ানক প্রশ্ন করে বসল, ‘অনি? আদ্রিয়ান তখন তোমার সঙ্গে কোনরকম অপ্রত্যাশিত আচরণ করেছিল?’
আমি চমকালাম। আমার করা ঐ আচরণটা যে এমন একটা অর্থও বহন করে এতক্ষণে সেটা মাথায় এলো। ওনার প্রতি তীব্র রাগ, অভিমানে আমার মনটা বিষিয়ে আছে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে ওনার সম্পর্কে এ ধরণের ধারণা জন্মাবে কারো মনে, তাও আমার জন্যে। তা আমি মানতে পারবনা। তাই নিচু গলায় বললাম, ‘উনি এমন না, আম্মু।’
‘ও কেমন তা আমি জানি। তবে মানুষ তো। তাই তোমার কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে নিলাম। কিন্তু তোমার এরকম আচরণের কারণটা এখনো বুঝিনি।’
আসল সত্যিটা আম্মুকে বলা সম্ভব না। মিথ্যা বলতে বিবেকে আটকাচ্ছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বললাম, ‘কী করেছি বুঝিনি তখন। জ্বরের মধ্যে মাথা ঠিক ছিলোনা। ইচ্ছাকৃত ছিলোনা ব্যাপারটা।’
কথাটা পুরোপুরি সত্যি না হলেও পুরোপুরি মিথ্যাও না। আসলেই ঐসময় সজ্ঞানে কিছু করিনি আমি। ঠান্ডা মাথায় আর যাই হোক আম্মুর সামনে সেরকম কোন ব্যবহার করতাম না আমি। আম্মু হতাশ কন্ঠে বলল, ‘ছেলেটা নিশ্চয়ই ভীষণ অপমানিত বোধ করেছে। আমি খেয়াল করে দেখেছি মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল। হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঠিকভাবে তাকালোও না আমার দিকে। তোমার জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল। তুমি তাকাতেই কোনরকমে কাজের বাহানা দিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। তোমার ব্যবহারে আমি নিজেই হকচকিয়ে গেছি যে ওকে কিছু বলার ভাষা পেলাম না। মানিক ভাই এসব জানলে কী ভাববে বলোতো? আদ্রিয়ান সেরকম ছেলে নয় বলে মানিক ভাই জানবেন না কিছু। যথেষ্ট ভদ্র ছেলে ও। একটু আগে ফোন করেছিলাম। বলেছি মেয়েটা জ্বরের ঘোরে এসব বলে ফেলেছে। ও উল্টো আরও আমায় বোঝালো এসব নিয়ে না ভাবতে। ও বুঝেছে ব্যপারটা। কিন্তু তোমার বাবার কানে গেলে কী হবে? তোমার কাছ থেকে এ ধরণের ব্যবহার আশা করিনা আমি অনি।’
হঠাৎ জ্বলে উঠলাম আমি। আম্মুর দিকে তাকিয়ে কিছুটা তেজ নিয়েই বললাম, ‘আমার সব ব্যবহার সবসময় তোমাদের আশা অনুরূপ হবে সেটা কেন ভাবো আম্মু? অসুস্থ ছিলাম, মাথা ঠিক ছিলোনা, করে ফেলেছি। ফাঁসি দেবে আমায়?’
আম্মু হতবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কিছু বলতে নিয়েও বলল না। গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল রুম থেকে।
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল আমার। আম্মুর স্বাভাবিক চিন্তাটাও আমার কাছে অতিরিক্ত মনে হলো। ঐ ছেলেটাকে এতো ভাও দেওয়ার কী আছে? কী এমন সে? তাদের এই চরম বিনয়ী, ভদ্র, ভালো ছেলেটার ব্যবহার যে কতটা নিকৃষ্ট সেটাতো কেবল আমি জানি। কথায় আছে মানুষ শতভাগ খাঁটি হয়না। প্রত্যেকের মাঝেই কমবেশি নেগেটিভ বিষয় থাকে। কিন্তু ওনার অভদ্রতা আর উগ্রতার মতো ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো যেন একমাত্র আমার জন্যেই তুলে রাখা। আমি ছাড়া অন্যকারো সামনে ভুল করেও সেই দিকটা প্রকাশ পায়না। যেন আমায় আঘা/তে জর্জরিত করে পৈশাচিক আনন্দ পান উনি। কীসের এতো রাগ আমার ওপর ওনার? হাতের দিকে তাকাতেই ব্রেসলেটটা চোখে পড়ল। এটা হারানো নিয়েই সব ঘটনার সুত্রপাত। এই জিনিসটাকে বাহানা বানিয়েইতো আমার কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন উনি। মুক্ত হতে চেয়েছিলেন আমার কাছ থেকে। তাহলে আবার কেন? আর এটা উনি পেলেনই কোথায়? মাথাটা ধরে এলো আমার। এসব নিয়ে ভাবার ধৈর্য্য রইল না আর। রাগে, জেদে চোখে জল চলে এলো। হাত থেকে ব্রেসলেটটা নিয়ে ছুড়ে মারতে গিয়েও পারলাম না। হাত আটকে গেল। আস্তে করে রেখে দিলাম বালিশের নিচে। ওনার জিনিস ওনাকেই ফিরিয়ে দেব আমি।
রাতে অরুর সঙ্গে কথা হল। আমার আর আদ্রিয়ান ভাইয়ের বিষয়ে কিছুটা ওর জানা। আমার শরীরের খোঁজ নেওয়ার পর নতুন পাগলামী শুরু করল ও। ওর ধারণা আদ্রিয়ান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে, সুস্থ হয়ে যাব আমি। অনেক কষ্টে সামাল দিতে পারলাম ওকে।
জ্বরটা পরেরদিন সকালেই কমে গেল। ডাক্তার বলেছিলেন জ্বর না কমলে কিছু টেস্ট করানোর কথা। কিন্তু জ্বর কমলেও বাবা জোর করে হসপিটালে নিয়ে গেলেন আমাকে। তবে রিপোর্ট সব ঠিকঠাকই ছিল। কেবল র/ক্তে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্রায় অনেকটা কম আছে। ব্যস! এইটুকুই যথেষ্ট ছিল গোটা পরিবারের মাথায় বাজ ফেলার জন্যে। দুই ঘন্টার মধ্যেই আমার গোটা গোষ্ঠী জেনে গেল আমি অসুস্থ। এই দু’দিনে আপি, রায়হান ভাই, ভাইয়েদের, বোনেদের ফোনে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
পাশের ঘর থেকে বাবার ডাক শুনে ভাবনায় ছেদ ঘটল। বৃষ্টি দেখতে দেখতে কখন গত দুদিনের ঘটনায় হারিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতে পারিনি। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে চুপচাপ বসার রুমের দিকে পা বাড়ালাম। গিয়ে দেখলাম বিছানায় বসে আছেন আব্বু। আম্মুও একপাশে বসে চা খাচ্ছেন আর সিরিয়াল দেখছেন। কাব্য সোফায় শুয়ে শুয়ে গেইমস্ খেলছে। দুনিয়া উল্টে গেলেও ও এখন বলতে পারবেনা। আমাকে দেখে হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন আব্বু। আমি বিনাবাক্যে গিয়ে বসলাম। বাবা চমৎকার হেসে বললেন, ‘শরীর কেমন লাগছে মা?’
উত্তরে আমিও হেসে বললাম, ‘ভালো। জ্বরটা আর নেই এখন। ফিট লাগছে।’
আম্মু টিভির দিকে তাকিয়েই বলল, ‘আর ফিট! র/ক্তে হিমোগ্লোবিনের অবস্থা দেখেছো? ভালো কিছু খেতে দিলেই নাক ছিটকায়! দুধ, ডিম, শাকসবজিতো শত্রু তোমার!’
আব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘সমস্যা নেই আমি খাইয়ে দেব আজ রাতে। এখন চা দাও ওকে। টিভি দেখতে দেখতে খাবে।’
আমি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেললাম। আম্মু ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি কাপটা নিতেই আব্বু বলল, ‘আদ্রিয়ানকে বললাম ওর যদি খুব বেশি প্রেশার বা কাজ থাকে, তাহলে আর পড়াতে আসার দরকার নেই।’
কথাটা শুনে টিভি থেকে চোখ সরিয়ে তাকালাম আব্বুর দিকে। পরমুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে চায়ের কাপে ফুঁদ দিতে দিতে বললাম, ‘উনি কী বললেন?’
‘কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা”। হয়তো একটু বিব্রত হয়েছে। পরে আমি বুঝিয়ে বলেছি। ও শুধু শুনলো, কিছু বলল না। মনে হয় না করাটা ঠিক হলোনা।’
আব্বুর কন্ঠে অসন্তোষ। আম্মু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমাদের বাপ-বেটির কান্ডকারখানা আমি বুঝিনা। মানুষ ভালো টিচার পায়না। ভালো ভালো ভার্সিটির স্টুডেন্ট খোঁজে পড়ানোর জন্যে। সেখানে কেমব্রিজ থেকে মাস্টার্স করা ছেলের কাছে পড়া নাকি মেয়ের পোষাচ্ছে না। মঙ্গলে খোঁজ করো। তোমার মেয়ের উপযুক্ত টিচার পেলেও পেতে পারো।’
কাব্য ফিক করে হেসে ফেলল। আমি চোখ কটমট করে তাকাতেই বাঁদরের মতো মুখ ভ্যাঙচালো ও।
চা-টা শেষ করে রুমে চলে এলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। তাই বিছানায় এসেই বসলাম। টেবিলের ওপর রাখা ব্রেসলেটটার দিকে চোখ যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। গতরাতে আব্বুকে বলেছিলাম আমি, আদ্রিয়ান ভাইয়ের খুব প্রেশার পড়ে যাচ্ছে। আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে কেমব্রিজ ফিরে যাবেন। অনেক কাজ। আব্বু বলেছে বলেই হয়তো পড়ানোর ব্যপারে না করতে পারছেন না। আমারও এমন সীমিত সময় তার কাছে পড়ে পোষাচ্ছে না। আব্বু যাতে ওনাকে বারণ করে দেয়। তাছাড়াও বিনা পয়সায় কেউ এভাবে এতোদিন যাবত পড়াচ্ছে। ভালো দেখায় না সেটা। আব্বু শুরুতে একটু আপত্তি করলেও পরে মেনে নিয়েছিলেন।
আর উনিওতো রাজি হয়ে গেলেন। রাজি হবেনইতো। পেছন ছাড়ানোর এতোবড় সুযোগ হাতছাড়া করা যায় নাকি? হঠাৎ অকারণ ব্যথায় চিনচিন করে উঠল বুকটা। শ্বাস নিতে গিয়ে বুঝলাম আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
*
কেটে গেল আরও ছ’টা দিন। গোটা সপ্তাহজুড়ে আকাশে ছিল মেঘের ঘনঘটা। তবে বৃষ্টি আসব আসব করেও আসেনি। কেমন অদ্ভুত গুমট ভাব। প্রকৃতি যেন আমার মনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজিয়ে তুলেছে নিজেকে। গত কয়েকদিন যতটা সম্ভব নিজের ঘরে আবদ্ধ ছিলাম আমি। দিনের বেশিরভাগ সময় বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে ছিলাম। বাকি সময়টা সোশাল মিডিয়া, আর ইউটিউবে অযথা ঘাঁটাঘাঁটি। নিজেকে, নিজের মনকে ব্যস্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছি আমি।
আদ্রিয়ান ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনরকম দেখা, সাক্ষাৎ, যোগাযোগ হয়নি আমার। আমাদের বাড়িতেও আসেন নি উনি আর। ওনার কোন আলোচনাও হয়নি আমার সামনে। মোটকথা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলাম তার কাছ থেকে। সম্পূর্ণ।
কিন্তু যখনই অঙ্ক করতে গিয়ে আটকে যেতাম ওনার কথা মনে পড়তো। ফিজিক্সের থিওরী গুলিয়ে ফেললেও ওনার কথা মনে পড়তো। আরও কিছু মাধ্যম আছে, যেসব কারণে চাইলেও ভুলতে পারছিলাম না আদ্রিয়ান নামক মানুষটাকে। বুকের মধ্যে ভার হয়ে থাকা, হঠাৎ হঠাৎ কান্না পেয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি থেকে বাঁচতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছি আমি।
রাতের খাবারটা খেয়ে এসে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সেদিন আর পড়ার মুড ছিলোনা। কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করার পর হঠাৎ কী মনে করে হোয়াটস অ্যাপটা ইন্সটল করলাম। রাগ করে আনস্টল করে দিয়েছিলাম মাঝে। কিছুক্ষণ পরেই কল বেজে ওঠায় চমকে উঠলাম আমি। স্ক্রিনে জাবিন নামটা জ্বলজ্বল করছে। জাবিন ফোন করা মানেই ঘন্টাখানেক অবধি ও বাড়ির বিশাল গল্পের ঝুলি চলবে। এতোদিন কথা হয়নি। নিশ্চয়ই সব একসঙ্গে শোনাবে আমায়। লম্বা কাহিনী শোনার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে ফোনটা রিসিভ করে বললাম, ‘কেমন আছো, পুঁটি?’
ওপাশ থেকে জাবিন বলল, ‘আমি ঠিক আছি। কিন্তু তোমার কী হয়েছে? সেইযে বাড়ি থেকে গেলে। আর কোন খবরই নাই। হোয়াটস্ অ্যাপে সেদিন তোমাকে ছবি পাঠালাম। নবাবজাদা রান্না করছে। তুমি রিপ্লাইও দিলেনা। এরপরতো হোয়াটস অ্যাপে পেলামই না তোমাকে। পরীক্ষা চলছে বলে আমার ফোনে টাকা দেয়না। নয়তো কল করতাম তোমাকে। আজ হঠাৎ তোমাকে এক্টিভ দেখে চট করে কল দিয়ে ফেলেছি। কী খবর তোমার?’
আমি মৃদু হেসে ফেললাম। মেয়েটা এতো কথা বলতে পারে! বললাম, ‘ভালো। একটু ব্যস্ত আসলে। পড়াশোনার চাপটা বেশি। তোমাদের কী খবর। বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘ হ্যাঁ সবাই ভালো। কিন্তু ভাইয়া তোমাকে এখন আর পড়াতে যায়না? জাজিরাতো যেতেই দেখিনা।’
আমি একটু চুপ থেকে বললাম, ‘কেন? বলেনি তোমাদের?’
‘সেদিন আম্মু জিজ্ঞেস করেছিল। রেগে একদম ফায়ার হয়ে গেল। কিছুই বলল না। বোকা বনে গিয়েছিলাম আমরা। কী ব্যপার বলোতো?’
আমি কী বলব বুঝলাম না। তাই কথা ঘুরিয়ে বললাম, ‘সারা কোথায়?’
জাবিন অধৈর্য্য হয়ে বলল, ‘আরে ছুটকিতো ঘুমাচ্ছে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে আজ। তুমি আমার কথা শোন। সেদিনতো তোমাকে কল করেও হোয়াটসঅ্যাপে পেলাম না। সবে নবাবজাদার রান্নার ছবিটা পাঠিয়েছি! কাহিনীইতো বলা হলোনা।’
আমি একটা লম্বা শ্বাস ফেললাম। ওর নবাবজাদা ভাইয়ের ফূর্তির কাহিনী শোনার বিন্দুমাত্র রুচি আমার নেই। কিন্তু ওকে বললে শুনবেনা। বলেই যাবে। তাই নিরস গলায় বলল, ‘কী কাহিনী?’
‘আরে, মাসখানেক ধরেই পাগল কেমন ক্ষেপে ক্ষেপে ছিল। কাউকে কিছু না বললেও বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু আমার জন্মদিনের পরেরদিন থেকে কী হল কে জানে? ঐদিন দুপুরে খেতে বসে দেখলাম হাতের আঙুলের উল্টোপিঠের চামড়া একেবারে থেতলে গেছে। কিন্তু কেউ কিছু বললেই তেঁতে ওঠে। ধরতে দেওয়া তো দূরে থাক। সারাদিন ঘরের দরজা লাগিয়ে রাখে। হুটহাট রাত নেই, দিন নেই বাইক নিয়ে ভোঁ। ছেলের চিন্তায় চিন্তায় মা অর্ধেক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।’
আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। জাবিন আবার বলতে শুরু করেছে, ‘উফ, যেটা বলছিলাম! যেদিন তোমাকে রান্নার ছবি পাঠালাম সেদিন কী হয়েছে শোন। আম্মু তখন রাতের খাবার বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে ছুটে এসে বলল, সরো আমি রান্না করব। আম্মুতো আকাশ থেকে পড়েছে একদম। সোফার রুম থেকে আমাদেরও চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। আম্মুর কোন কথাই কানে তুলল না। রান্না সেই করবে মানে করবেই। ঘোষণা করল সবাইকে খিচুড়ি খাওয়াবে রাতে। এই অবধি ঠিক ছিল। আমরাও খুশি, ভাইয়ার হাতের খিচুড়ি খাব। কিন্তু তারপর ভাইয়া যা করল, আমাদের হার্ট ফেইল হওয়ার জোগাড়।’
‘কী করল?’ চেষ্টা করেও কৌতূহল দমাতে পারলাম না আমি।
‘পেঁয়াজগুলো চপিং বোর্ডে ফেলে এমনভাবে কা/টছিল। যেন এক্ষুনি নিজের হাত কে/টে ফেলবে। ইচ্ছে করে জানো? তিন-চারবার হাতে লেগেও গেল। আম্মু এতোবার না করল। কারো কথাই কানে নিলোনা। খিচুড়ি রান্না করে গরম পাতিলটা অবধি খালি হাতে ধরে নামালো? সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখলাম পুরো ঘটনাটা। সবার জন্যে খিচুড়ি করে শেষে নিজেই খেলোনা। রুমে গিয়ে ঠাস করে লাগিয়ে দিল দরজা।’
বিরক্ত হলাম আমি। আমায় জ্বালিয়ে পোষায় না? বাড়ির মানুষগুলোকেও জ্বালাতে হবে এভাবে? বললাম, ‘কেন এমন করছে সে?’
‘সেটা বললেতো হতোই।’
‘ ডাক্তার দেখাও।’
‘আম্মুরও তাই ধারণা। তার মনে হয় বেশি পড়াতে গিয়ে ছেলের মাথা নষ্ট করে ফেলেছে। তবে এখন আর চিন্তা নেই। সপ্তাহখানেক হলো উল্টাপাল্টা কাজ করছেনা আর। শান্ত আছে। কিন্তু আম্মু তবুও শান্তি পাচ্ছেনা। তার মনে হচ্ছে তার ছেলে চরম অসুস্থ। কী একটা অবস্থা বলো?’ বোকা বোকা কন্ঠে বলল জাবিন।
আরও কিছুক্ষণ মানিক আঙ্কেল, মামণি, সারাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা করল জাবিন। প্রায় ঘন্টাখানেক পর ছাড়ল আমাকে। ফোন রেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। এতো অশান্তি কীসের তার! সপ্তাহখানেক যাবত শান্ত আছে? তারমানে আমায় আর সহ্য করতে হবেনা জানার পর থেকেই সব অশান্তি দূর হয়ে গেছে। এদিকে শুধুশুধুই গুমরে মরছি আমি।
*
ঠিক তার পরেরদিন। এখনো মনে আছে আমার। দিনটা ছিল এগারোই জুন। সকাল থেকেই ঘন মেঘে আবৃত ছিল আকাশ। মাঝেমাঝে মৃদু ‘গুরুম গুরুম’ শব্দ। দুপুরের দিকে একপ্রকার আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। হঠাৎ বৃষ্টির মতোই আমাকে অবাক করে দিয়ে বাড়িতে এসে হাজির হলেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। আধভেজা অবস্থায়। মেরুন রঙের একটা শার্ট আর কালো জিন্স পরে আছেন। জানা গেল জাজিরা নিজের কাজে এসেছিলেন উনি। হঠাৎ বৃষ্টির কারণে আটকে গেছেন। ওনার বন্ধু ফরহাদরা বাড়িতে কেউ নেই। তাই এখানে আসতে হলো।
ওনাকে দেখেই নিজের রুমে চলে এসেছি আমি। বৃষ্টির ওপর খানিকটা রাগ হল আমার। উনি জাজিরা আসার পরেই কেন নামতে হল? আর সময় ছিলোনা? হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই বুকের মধ্যে ধক করে উঠল আমার। বৃষ্টি ওনার আর আমার মধ্যকার সংযোগ সেতু! হঠাৎ ব্রেসলেটটার কথা মনে পড়ল। ভালোই হয়েছে এসেছেন। এটা ওনাকে ফিরিয়ে দেব। আর জিজ্ঞেস করব এসবের মানে কী! কিন্তু বাড়িতে সেটা সম্ভব হবেনা বুঝতে পারলাম। কিছুতেই ফেরত নিতে চাইবেননা উনি এটা। দানের জিনিস ফেরত নেয়না কি-না। আর তখন বাড়িতে কোন সিনক্রিয়েটও করতে পারব না আমি। কী করব সেই চিন্তাতেই অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। অবশেষে ঠিক করলাম ওনাকেই বলব আলাদা কথা বলার কথা। দেখি কী বলে।
দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসতে হল আমাদের। তবে ওনার দিকে একবারের জন্যেও তাকাই নি আমি। শুধু সুযোগ খুঁজছিলাম আলাদা কথা বলার। সুযোগটা পেলাম খাওয়ার পর হাত ধুতে যাওয়ার সময়। উনি যখন হাত ধুতে গেলেন পেছন পেছন গেলাম আমি। হাত ধুয়ে পেছন ঘুরতেই আমাকে দেখতে পেয়ে থেমে গেলেন। শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমিও তাকিয়ে ছিলাম একদৃষ্টিতে। যেন কতযুগ পরে কাঙ্ক্ষিত জিনিস দেখতে পাচ্ছি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘আপনার সঙ্গে আলাদা কথা আছে আমার। বাড়িতে বলা যাবেনা।’
ওনার কাছ থেকে একটা ত্যাড়া কোন উত্তর আশা করেছিলাম আমি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি বললেন, ‘চারটায়, কাঠবাগানে।’
বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। আমি যেন বোকা বনে গেলাম। এতো তাড়াতাড়ি মেনে নিলেন!
*
ঠিক চারটায় কাঠবাগানে গিয়ে হাজির হলাম আমি। আকাশ এখনো মেঘলা, চারপাশটায় অন্ধকারভাব। মৃদু ঠান্ডা বাতাসও বইছে। প্রথমে না দেখতে পেলেও একটু খুঁজতেই দেখতে পেলাম আমি তাকে। একেবারে অপরপাশের খালপাড়ে একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কাদার ওপর দিয়ে পা টিপে টিপে হেঁটে সেদিকে গেলাম আমি। উনি গাছে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। আমাকে দেখতে পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন আমার দিকে। জিন্সের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভ্রু নাচালেন। বুঝলাম জানতে চাইছেন, কেন ডেকেছি।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হাতের মুঠি খুললাম। ব্রেসলেটটা ওনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘এটা আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে আসার মানে কী?’
উনি স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘আমার জানামতে ব্রেসলেটটা তোরই। তবে গায়ে হাত দেওয়াটা ঠিক হয়নি। আমার ছোঁয়াটা তোর পছন্দ হয়নি বুঝতে পেরেছি। তারজন্যে সরি।’
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম আমি ওনার দিকে। সমস্যা কী এই ছেলের? চাইছেটা কী! লম্বা একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে বললাম, ‘দেখুন আপনার সঙ্গে ঝগড়া, তর্ক করার ধৈর্য্য আমার আর নেই। আর এটা আমার না আপনার ব্রেসলেট। যদি আপনি এটাকে সত্যিই আমার বলে ভাবতেন তাহলে এটা হারিয়ে যাওয়াতে আমাকে এভাবে ব্লেইম করতে পারতেন না। বুঝতেন যে আপনার মতো এটা আমারও খুব_’
এইটুকু বলে থেমে গেলাম আমি। বুঝলাম কান্না পাচ্ছে আমার। কিন্তু কাঁদলেতো চলবেনা। কিছুতেই না। ওনার চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘এটা আপনার জিনিস। আপনিই রাখুন।’
বলে ওনার এক হাত তুলে ব্রেসলেটটা ওনার হাতে ধরিয়ে দিলাম। উনি পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। উল্টো ঘুরে ফিরে আসতে গিয়ে বাঁধা পেয়ে থেমে গেলাম। বিস্মিত হয়ে পেছনে ঘুরে দেখলাম আমার বাঁ হাত শক্ত করে ধরে আছেন উনি। আমি খানিকটা অবাক হলেও শক্ত কন্ঠে বললাম, ‘হাত ছাড়ুন।’
উনি ছাড়লেন না। এখনো একই দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছেন আমার দিকে। আমি কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করেও ছাড়াতে পারলাম না নিজের হাত। আমাকে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিয়ে এক ঝটকায় নিজের দিকে টেনে নিলেন উনি। আরেক হাতে আমার ডান হাতের বাহু ধরে বললেন, ‘সবসময় চারলাইন বেশি বোঝাটা তোমার জেনেটিক রোগ?’
মেজাজ খারাপ হল আমার। নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, ‘ইঞ্জিনিয়ার মানুষ ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে থাকুন। মেডিকেল সাইন্স ঘাঁটতে আসবেন না। ওটা অরুর কাজ।’
‘তোমার চেয়ে অরুর মাথার ঘিলু যথেষ্ট উন্নত।’
‘তো আমার কাছে কী? ওর কাছেই যান। এমনিতেও ভাই বলতে অজ্ঞান সে। হাত ছাড়ুন বাড়ি যাব।’
উনি আরও শক্ত করে হাতটা ধরে ব্রেসলেটটা পরিয়ে দিতে শুরু করলেন আমার হাতে। আমি হকচকিয়ে গেলাম। হাত টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললাম, ‘আরে! এসব কী? দেখুন ভালো হচ্ছেনা কিন্তু! আমি পরবোনা এটা।’
ততক্ষণে উনি পরিয়ে ফেলেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে রেখেই বললেন, ‘পরেরবার এটা যদি কারো বাড়ির ছাদের ওপর পড়ে থাকে তাহলে কী হবে জানিস? তাহলে আর নরমালি পরিয়ে দেব না। সুঁই সুতা দিয়ে হাতের মধ্যেই সেলাই করে দেব। ঝামেলাই শেষ।’
ওনার কথায় ছটফটানি থেমে গেল আমার। ছাদে পড়ে ছিল! কোথাকার ছাদে? হিয়াপির শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটা আমার হাতে ছিল। ফিরে আসার পর থেকেই খুঁজে পাইনা এটা আর। তারমানে আপির শ্বশুরবাড়ির ছাদে পড়ে ছিল এটা? আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপিদের বাড়ির ছাদে ছিল এটা? তাহলে আপনার কাছে কীকরে এলো ওটা?’
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওনার। যেন কিছু মনে পড়ে গেছে। আমাকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘সেটা আপনার না জানলেও চলবে। তবে পরেরবার আর পরাবোনা। সেলাই করে দেব। মনে থাকে যেন।’
হঠাৎ ওনার করা ব্যবহারগুলো মনে পড়ল আমার। মনে পড়ল সেই নিষ্ঠুর আ/ঘাতগুলো। হাতটা আরেকবার ঝাঁকি দিয়ে ছাড়াতে চেয়ে বললাম, ‘মগের মুল্লুক নাকি?’
‘উহু আদ্রিয়ানের মুল্লুক।’
মেজাজ চুড়ান্ত খারাপ হলো আমার। অতিরিক্ত রাগে চোখে জল চলে এলো। ওনার দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম, ‘সমস্যা কী আপনার? শারীরিক বা মানসিক আর কোনভাবে আঘাত করা বাকি আছে?’
হঠাৎই কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল ওনার মুখটা। অপর হাত দিয়ে আমার চোখ মুছতে এলে আমি হাত সরিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু উনি শুনলেন না। জোর করে মুছে দিলেন চোখদুটো। নরম গলায় বললেন, ‘খুব কষ্ট হয়েছিল?’
ওনার করা আদুরে প্রশ্নে আমার অনুভূতির সমস্ত বাঁধ ভেঙ্গে গেল। আর পারলাম না শক্ত হয়ে থাকতে। ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘আপনার কোন করুণার দরকার নেই আমার। আপনিতো মনে মনে এটাই চেয়েছিলেন আমি আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাই। সেইজন্যই ব্রেসলেট হারানোর মতো একটা ব্যাপারকে কেন্দ্র করে এতো ঘটনা ঘটালেন আপনি। আপনার উদ্দেশ্যতো পূর্ণ হয়েছে। আর কী লাগবে?’
উনি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। অতঃপর বললেন, ‘শুধুমাত্র ব্রেসলেট! ডু ইউ থিংক সো? বাচ্চা মনে হয় আমাকে তোর?’
ওনার কথার মানে বুঝলাম না আমি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কোনমতে উচ্চারণ করলাম, ‘তাহলে?’
এবার উনি যেন আমার ওপরেই রেগে গেলেন। খানিকটা তেড়ে এসে বললেন, ‘আমার নাম্বারটা পাবলিক প্রপার্টি মনে হয় তোর। দান বীরের মতো যে চায় তাকেই দিয়ে বেড়াস!’
সবকিছু ভুলে ভাবনায় মশগুল হয়ে গেলাম আমি। রিসেন্টলি কাকে ওনার নাম্বার দিয়েছি আমি? কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করতেই মনে পড়ে গেল দোলা আপুর কথা। হ্যাঁ, ওনাকেই দিয়েছিলাম। আমি আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘যাকে-তাকে কোথায়? আপির ননদকে দিয়েছিলাম। এক মিনিট! এই সামান্য ব্যপারে আপনি_। আর তারপরও বলছেন আপনি বাচ্চা না? নাম্বার দেওয়াতে কী এমন হয়েছে। তাছাড়া দোলা আপু যথেষ্ট ভালো মেয়ে।’
উনি ওনার সেই আড়াআড়ি স্টাইলে ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন, ‘ভালো মেয়ে!’ এরপর পকেট থেকে ওনার ফোনটা বের করতে করতে বললেন, ‘দেখাচ্ছি আপনার ভালো মেয়ের কীর্তি।’
আমি মনে মনে ভাবলাম। নিশ্চয়ই মেসেজ-ফোন করে জ্বালিয়েছে। কিন্তু তাতে কী এমন হয়েছে! বিরক্তই করেছে না হয়। ব্লক করে দিলেই হতো। তবে মুখে বললাম, ‘আপনাদের প্রেমালাপ দেখার শখ নেই আমার।’
উনি একহাতে আমাকে ধরে রেখে আরেকহাতে ফোনে কিছু একটা বের করতে করতে বললেন, ‘তা বললে হবে সোনা? নাম্বার দিয়ে প্রেম করার ব্যবস্থা করে দিয়েছো আর প্রেমালাপ দেখবে না?’
বলে আমাকে টেনে কাছে এনে ফোনের স্ক্রিন তুলে ধরলেন আমার চোখের সামনে। স্ক্রিনে ভালোভাবে তাকাতেই আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি আমি। ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে। যেন গিলে খাবে আমাকে। আমি শুকনো একটা ঢোক গিললাম। বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে আরও দুবার স্ক্রোল করলেন উনি। আর দেখার রুচি রইল না আমার। হাত দিয়ে ফোনটা সরিয়ে দিলাম। চোখে জল চলে এসেছে আমার। নিচের ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে। অপরাধীর মতো ওনার দিকে তাকাতেই উনি ভ্রু নাচিয়ে শক্ত কন্ঠে বললেন, ‘এখন চোখে পানি কেন?’
আমি কিছু বলতে পারলাম না। মাথা নিচু করে ফেললাম। আস্তে করে বসে পড়লাম গাছের শেকড়ের ওপর। এটা যদি আমার ওপর ওনার রাগের কারণ হয় কারণটা মোটেও ছোটখাটো কোন কারণ না। এরজন্যে রেগে গিয়ে আমায় পুঁতে ফেললেও সেটা অযৌক্তিক হতোনা।
উনি প্রথমে ফোনে কী যেন করলেন। এরপর কিছুক্ষণ পায়চারী করলেন আমার সামনে। নাক ঘষছেন বারবার। বুঝলাম নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ পায়চারীর পর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘প্রথমে কল আর মেসেজ করেছে। অতিরিক্ত করার পরে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়েছি। হিয়ার ননদ বলে ঠান্ডা মাথায় ব্যপারটা ট্যাকল করব ভেবেছিলাম। কিন্তু ভাও না পেয়ে শেষে এসব পাঠিয়েছে। ক্যান ইউ বিলিভ দিস? এসব! তোকে দেখাব বলেই এই অসহ্য জিনিসগুলো ফোনে রেখে দিয়েছিলাম। এখন ডিলিট করলাম।’
আমি একদম ভেজা বেড়ালের মতো বসে রইলাম। কিছু বলার সাহস হচ্ছেনা। দোলা আপুকে নাম্বারটা দেওয়ার জন্যে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে এখন। মানুষ এতো ডেসপারেট হতে পারে! ছিহ্! উনি হতাশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এই নিয়ে কতবার হল অনি? বারণ করিনি আমি? আগেরগুলো তাও ঠিক ছিল। কিন্তু এইসব কী ছিল! আমি মানুষ অনি, ফেরেস্তা নই। শয়তান ঘাড়ের কাছেই থাকে। মাথা নষ্ট হতে সময় লাগেনা। ছাব্বিশ বছর হতে যাচ্ছে আমার। তুই এতোটাও ছোট নস যে এইটুকু বোঝার বুদ্ধি তোর নেই। নিজের জিনিস নিজেকেই আগলে রাখতে হয়।’
আমি কাঁপা গলায় বললাম, ‘সরি।’
উনি কিছু বললেন না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কেবল। আমি গোমড়া মুখ করে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কথাটা আগে বললে কী হতো?’
উনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দু সেকেন্ড দেখলেন আমাকে। তারপর আমার সামনে এক হাঁটু ভেঙ্গে বসলেন। আমার দুটো হাত একসঙ্গে কোলের ওপর নিয়ে বললেন, ‘যেদিন তুই বললি ব্রেসলেট হারিয়ে গেছে। সেদিন কেবল ব্রেসলেটের জন্যেই রেগে গিয়েছিলাম আমি। তারপরের দিন_’
এইটুকু বলে থামলেন উনি। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘যাই হোক, তখনও মেয়েটার জ্বালাতন চলছিল। আমি ব্যাপারটা তেমন পাত্তা দেইনি। কিন্তু জাবিনের জন্মদিনের আগেরদিন। রাত তিনটে হবে। আমি পড়ছিলাম। তখনই আসে এগুলো। ঐ মুহূর্তে আমার অবস্থা কী হয়েছিল তোর আইডিয়া আছে! ইচ্ছে করছিল বাড়ি গিয়ে থাপড়ে আসি মেয়েটাকে। ঐমুহূর্তেই কল করে ধমক দিলাম। ওমা! এক ধমকেই মেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছিল আমার। ফোন কেটে ব্লক করলাম। এই কাজটা আরও আগে না করার জন্যে নিজেই নিজের গুষ্ঠির পিণ্ডি চটকালাম। তুই ঐ বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই মেসেজিং শুরু হয়েছে। তাই আসল কীর্তিটা কার বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার। সব রাগ গিয়ে পড়ল তোর ওপর। কারণ ঐ মেয়েকে ধমকে আমার মন ভরেনি। থাপড়াতে না পারার আফসোস তো আছেই।’
চোরের মতো আবার মাথা নিচু করে ফেললাম আমি। উনি একটু থেমে বললেন, ‘তবুও ভাবলাম ধমক আর ব্লক খেয়ে মেয়ে হয়তো থেমে যাবে। কিন্তু একি! সকালবেলাতেই আরেক নাম্বার দিয়ে একই কান্ড করল। মেজাজ কার ঠিক থাকে? রাগে সাধের ফোনটাকেই আছাড় মারলাম। ফোনটার লাক ভালো যে তেমন কিছু হয়নি। শুধু স্ক্রিন ফেটেছে। ব্যাপারটা এতো সেনসেটিভ যে কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। আফটার অল ওও একটা মেয়ে। হুটহাট কিছু করা যাবেনা। বাধ্য হয়ে ভেতরে রাগটা পুষে রাখতে হল। বারুদে আগুন জ্বালাতে আপনি এসে উপস্থিত হলেন রাতে। ঘরে এসে সাফাই গাইতে শুরু করলেন। যেটা আমার সবচেয়ে অপছন্দ। ব্যস! সব একসঙ্গে বেরিয়ে এলো।’
একটা শ্বাস নিয়ে আবার বললেন, ‘ আমার জায়গায় যদি তুই থাকতি। আমি কোন ছেলেকে তোর নাম্বার দেওয়ার কারণে যদি তোর সঙ্গে একই ঘটনা ঘটতো, আ’ম শিওর। এ জীবনে আমার মুখ দেখতেও রাজি থাকতি না। পা থেকে মাথা অবধি আত্মসম্মানে ভরপুর কি-না। আত্মসম্মানবোধ থাকাটা ভালো। কিন্তু অপরদিকের মানুষটারও যে একই জিনিস আছে, সেটা ভুলে যাওয়াটা অন্যায়।’
আমি চোখ তুলে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সেদিন ভোরে ছাদে শোভা আপুর সামনে ওসব কেন বললেন?’
উনি আমার হাতদুটোকে হালকা চাপ দিয়ে বললেন, ‘প্রচন্ড রাগ জমে ছিল ভেতরে। সারারাত না ঘুমাতে পেরেছি। না পড়তে পেরেছি। বারবার ঐগুলো_জাস্ট ডিজগাস্টিং। তারপর আনভীর_মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছিল একদম।’
আমি বিস্মিত কন্ঠে বললাম, ‘আনভীর ভাইয়া কী করল?’
উনি তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন, ‘কিছু না। সব মিলিয়ে পাগল পাগল লাগছিল নিজেকে। তোকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো। কারণ অজান্তে হলেও সবকিছুর মূলেতো তুই! কিন্তু শোভার সামনে ওভাবে বলে ঠিক করিনি আমি। ইটস্ মাই ব্যাড। মাথাটা খারাপ হয়ে ছিল একদম।’
শেষের কথাটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন উনি। যেন অনেকদিনের চেপে রাখা কথাগুলো প্রকাশ করে হাঁফ ছাড়লেন। আমারও ভেতরটা কেমন করে উঠল। ওনার হাতের দিকে তাকালাম আমি। বা হাতের উল্টোপিঠের আঙুলগুলোতে কালচে দাগ হয়ে আছে। ঘা শুকিয়ে গেলেও দাগ যায়নি। দাগগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে বললাম, ‘এগুলো কেমন বাচ্চামো?’
‘মায়াবিনীর অঙ্গে আঘাত করলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অঙ্গগুলোও বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সুস্থ থাকতে চায়না।’
আমার চোখ দিয়ে পরপর দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। উনি তাকালেন আমার দিকে। সযত্নে আমার চোখদুটো মুছে দিয়ে বললেন, ‘এখনো রাগ আছে আমার ওপর?’
আমি না বোধক মাথা নাড়লাম। মুখে কিছু বললাম না। উনি একটু আয়েশ করে নড়চড়ে বসে বললেন, ‘তা অভিমানী ম্যাডাম অভিমান করে আমার সঙ্গে দেখা, সাক্ষাৎ, কথা সব বন্ধ করে আমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। সে অবধি ঠিক আছে। যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে আমার। কিন্তু নিজের বাবাকে বলে যে আমার সপ্তাহে তিনটে দিন জাজিরা আসার বাহানাটা বন্ধ করে দিয়েছেন তার কী হবে?’
আমি মুখ গোমড়া করে ভাবতে বসলাম। সত্যিতো! উনি থুতনিতে হাত দিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে দেখছেন আমায়। যেন আমাকে ভাবতে দেখে মজা নিচ্ছেন। হঠাৎই আমার মুখে হাসি ফুটল। আমি হাস্যজ্জ্বল মুখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমার কোন পড়াই মাথায় ঢুকছেনা। ভেবেছিলাম নিজে নিজে পারব। কিন্তু কিছুই পারছিনা। সব এক্কেবারে গুলিয়ে যাচ্ছে। এখন একমাত্র ভরসা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।’
উনি হেসে ফেললেন। আমার মাথায় একটা চাটা মেরে বললেন, ‘ঘিলু হচ্ছে তাহলে! কথায় আছে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস।’
আমি একটা ভেংচি কাটলাম। হঠাৎ মনে পড়তেই বললাম, ‘বললেন না তো ব্রেসলেটটা আপনার কাছে কীকরে গেল?’
উনি বললেন, ‘বলার হলে এতক্ষণে বলে দিতাম। সিক্রেট।’
আমি হতাশ হলাম। যদিও ‘আনভীর’ নাম শুনে কিছুটা অনুমান করছি। কী জানি সত্যিটা কী? ইনিতো কিছু বলবেন না। তাই হাল ছাড়লাম। উনি ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে কিছুক্ষণ দেখলেন আমায়। হঠাৎ আমার যে হাতটা কেটেছিল সে হাতটা তুলে একটা চুমু খেলেন। কেঁপে উঠলাম আমি। হতভম্ব দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। উনি মুচকি হাসতেই আমি উঠে চলে যেতে চাইলাম। কিন্তু উনি হাত ধরে রাখায় যেতে পারলাম না। পরপর আরও কয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়ালেন আমার হাতে। সারা শরীর শিরশির করে উঠল আমার। চোখ বন্ধ হয়ে এলো আপনাআপনি। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলললাম, ‘কী করছেন?’
‘ব্যথা দেওয়ার অধিকারটা আমার হলে আদর করার অধিকারটাও আমার হওয়া উচিত।’
বলতে বলতে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন উনি আমাকে। তখনও চোখ বন্ধ করে আছি আমি। অনিয়মিত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। কানে ওনার আঙুলের ছোঁয়া লাগতেই সারা শরীর ঝংকার দিয়ে উঠল আমার। ঝট করে চোখ খুললাম। ওনার হাতে দুটো সাদা জবা। আরেকটা আমার কানে গুঁজে দিচ্ছেন। আমি অবাক চোখে তাকালাম তার দিকে। ফুরফুরে বাতাসে ওনার কপালের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে দিতে মন চাইছে আমার। উনি বাকি দুটোও আমার কানের পিঠে গুঁজে দিলেন। এরপর আমার কপালের চুল সরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘জিন্সের পেছন দিকে গুঁজে রেখেছিলাম বলে চুপসে গেছে। তবে অনুভূতিটা কিন্তু তাজা। একদম সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো।’
আমি হেসে চোখ নামিয়ে দিলাম। উনি ঝুঁকে একদম আমার কানের কাছে এসে বলল, ‘এভাবে হেসোনা মায়াবিনী। নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। চারবছর আগেও এই জায়গাতেই একটা ছোট্ট ভুল করেছিলাম। আজকের ভুলটা বড় হয়ে গেলে আমায় দোষ দিতে পারবেনা।’
সর্বাঙ্গ জমে গেল আমার। তার অসহনীয় ভয়ানক বাক্যে আপনা আপনি চোখ বুজে ফেললাম। অতি আবেশে কখন যেন খামচে ধরেছি তার ফর্সা হাত।
…
[ মাঝরাতে হুট করেই আদ্রিয়ানকে নিয়ে হাজির হলাম। রি-চেইক করিনি। টাইপিং মিস্টেকগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ]