অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১৭
সেদিন বাড়ি ফিরে এসেই দেখলাম নানুর শরীরটা ভালো না। বয়স হয়েছে। এমনিতেই নানারকম রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। তারওপর গতবার অ্যান্ডোসকপি করে পাকস্থলিতে মারাত্মক ঘা পাওয়া গেছে। ঔষধ চলছে। গতকাল রাতে না-কি শরীরটা বেশ খারাপ করেছিল তার। আমার ছোটবেলা নানুর কাছেই কেটেছে। বাবা-মা দুজনেই অফিসে থাকতো। তাই নানুর কাছেই রেখে যেতো আমাকে। নানুবাড়ি একদম কাছে হওয়াতে কোন অসুবিধা হতোনা। আমাকে খাওয়ানো, স্কুলে পাঠানো, যত্ন সব উনিই করতেন। আমার মতো ছটফটে মেয়েকে সামলানো কম কথা ছিলোনা। কত ছুটতে হতো তাকে আমার পেছন পেছন। সে এখন ঠিকভাবে চলাচল করতে পারেনা। বেশিক্ষণ হাঁটতে পারেনা। ব্যাপারটা ভাবলেই ভীষণ মন খারাপ করে আমার।
এমনিতেই বিষাদপূর্ণ মন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। তারওপর বসার ঘরে পা পড়তে না পড়তেই নানুর শরীরের অবনতির কথা শুনে তিক্ততায় ছেয়ে গেল মনটা। বিষণ্ন মন নিয়ে রুমে যেতে নিলেই আম্মু বললেন, ‘হাতে কী হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন?’
‘দরজার সাথে লেগে কে/টে গেছে। মেজর কিছুনা। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘যেখানেই যাও কিছুনা কিছু একটা বাঁধিয়ে আসো। বড় হচ্ছো অনি। এতো বেখেয়ালি হলে চলে?’
আমি কিছু না বলে রুমের দিকে পা বাড়ালে আম্মু আবার বললেন, ‘আদ্রিয়ান ভেতরে এলোনা? আসতে বলোনি ভেতরে?’
‘আমি একাই এসেছি।’
‘একাই এসছো? রিমা একা ছাড়ল?’
মেজাজ মারাত্মক খারাপ হল আমার। কাঁধ থেকে এক ঝটকায় ব্যাগটা হাতে নামিয়ে এনে বললাম, ‘না ছাড়ার কী আছে? বাচ্চা আমি? আপনাদের আদ্রিয়ানকে ছাড়া আমি চলতে পারিনা? সদর থেকে জাজিরার এই চল্লিশ মিনিটের পথটাও আমায় হাত ধরে পার করিয়ে দিতে হবে তার?’
আম্মু ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আরে, রিমা ভাবি তো তোমাকে একা ছাড়েনা। তাই বললাম। সামান্য কথায় এতো রেগে যাচ্ছো কেন?’
আমি তেজ দেখিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, ‘সমস্ত রাগের মালিকানাতো একজনই নিয়ে বসে আছে তাইনা? রাগ ভাগে পেলে তবেই না করব।’
আম্মু হতবাক কন্ঠে বললেন, ‘কী?’
আমি আওয়াজ ওপরে তুলে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে বললাম, ‘শখ হয়েছে আমার। রাগ করে দেখছি, কেমন লাগে।’
ভেতরে এসে একপাশে ছুড়ে রেখে দিলাম ব্যাগটা। বিছানায় বসে জোরে জোরে শ্বাস ফেললাম কয়েকটা। বিগত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো চোখের সামনে ভাসল। আদ্রিয়ান ভাইয়ের সেই ধারালো কথার তীরগুলো যে ক্ষ/ত সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো শরীর কাঁপিয়ে জ্বালা করে উঠল। বোকার মতো আবার কেঁদে ফেললাম। এতোটা কষ্ট হয়তো এর আগে কোনদিন হয়নি আমার। ছোট থেকে সকলেই ভালোবাসা আর স্নেহের শক্তিশালী বলয় দিয়ে যত্ন করে আগলে রেখেছিল আমাকে। অথচ আদ্রিয়ান ভাই নামক ঐ মানুষটা যেন আমার জীবনে এসেছেই আমাকে কষ্ট বোঝানোর জন্যে। আঘা/তে আঘা/তে আমাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করাই যেন তার জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু আমি তাকে সেই সুযোগ দেব কেন? তার দেওয়া কষ্টগুলোকে কেন মেনে নেব? আমার জীবনে এতোটা প্রভাব ফেলার অধিকার তাকে আমি দেইনি। আর যদি নিজের অজান্তে দিয়েও থাকি, নিজেই কেড়ে নিচ্ছি সে অধিকার। ঠিক করে নিলাম আর ভাবব না এসব নিয়ে। একদমই না। সত্যিই ভাবা বন্ধ করলাম। নাক টেনে লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ মুছে ফেললাম। চেঞ্জ করে ফেললাম। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে ভালোভাবে পানি দিলাম। রুমে এসে চুপচাপ ফোন নিয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ইউটিউব, নিউজফিড ঘাঁটাঘাঁটি করে ভালোই সময় কাটল। অন্যসবকিছু একপ্রকার জোর করেই দূরে সরিয়ে রাখলাম মাথা থেকে। সারাটাদিন ঘরেই ছিলাম। দুপুরে আম্মু খেতে ডাকলেও খেতে গেলাম না। বললাম পরে নিয়ে খাবো। আম্মু কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়ে গেলেও পরেটা ঠিক আর হলোনা। দরজা খুলিনি বিধায় আম্মু বেশি জোর করতে পারলেন না।
মোবাইলের ওপরেও একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গেলাম। তাই বিকেল বেলা জানালার কাছে বালিশ নিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম। গতরাতে ঘুম হয়নি। বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম নিজেও জানিনা। ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটনে। মেজাজটা মারাত্মক খারাপ হল। কেউ ঘুম ভাঙালে মোটেও ভালো লাগেনা আমার। চোখ বন্ধ রেখেই হাতরে ফোনটা হাতে নিলাম। রিসিভ করে লম্বা হাই তুলে বললাম, ‘হ্যালো?’
‘অনি, কেমন আছো?’
কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারলাম নূর ফোন করেছে। কোনমতে আরও একটা হাই তুলে বললাম, ‘আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো। মামা বলল, মামি নাকি ঢাকা আসছে? তুমিও যাচ্ছো?’
আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। ঘুম কেটে গেছে অনেকটাই, কিন্তু চোখ খুলিনি। আম্মু ঢাকা যাবে? কই আমাকেতো বলেনি। আমি বললাম, ‘জানিনা এখনো।’
‘আদ্রিয়ান ভাই আসবে?’
নামটা শুনতেই চোখের সব ঘুম পালিয়ে গেল আমার। চোখ খুলে বললাম, ‘সে কেনো যাবে? আর গেলেই বা আমি জানব কীভাবে?’
‘না, মাঝেমাঝেতো আসে তোমাদের সাথে তাই বললাম।’
কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে লজ্জায় মিইয়ে পড়ছে মেয়ে। অসহ্য! যেদিন আমার মেজাজ খারাপ থাকে সেদিন পুরো দুনিয়া উঠেপড়ে লাগে আমার মেজাজ আরও খারাপ করে দেওয়ার জন্যে। আমি বিরক্ত হয়ে উঠে বসে বললাম, ‘সেটা তোমার আদ্রিয়ান ভাইকে জিজ্ঞেস করলেইতো পারো। আমিতো তার পার্সোনাল সেক্রেটারি নই।’
ওপাশ থেকে নূর অসহায় কন্ঠে বলল, ‘মেসেজইতো সিন করেনা। কল রিসিভ করাটাতো স্বপ্ন।’
আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘নূর, আমার ফোনে চার্জ নেই। পরে কথা বলি হ্যাঁ?’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আর আদ্রিয়ান ভাই আসলে আমাকে একটু জানিও হ্যাঁ?’
‘ জানাব।’
বলতে বলতে কেটে দিলাম ফোনটা। বিরক্তি ধরে গেছে এসবে। জাহান্নামে যাক সব। আমার কী? আবার শুয়ে পড়তে যাবো তখনই দরজায় নক করল আম্মু। মুখ দিয়ে ‘চ্যাহ’ শব্দ করে ওঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দেখি আম্মু খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় আগাগোড়া একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে এভাবে পড়ে পড়ে ঘুমায় কেউ?’
আমি কিছু না বলে পথ ছেড়ে দিলাম আম্মুকে। ফোনটা হাতে নিয়ে সময় চেক করে দেখলাম সত্যিই রাত হয়ে গেছে। সাড়ে ন’টা বাজে। এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! ততক্ষণে আম্মু এসে বসেছেন বিছানায়। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাও তাড়াতাড়ি চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসো। খিদে পায়না তোমার?’
ফোনে সত্যিই চার্জ নেই। ফোনটা চার্জে লাগিয়ে চলে গেলাম ওয়াশরুমে। হাত-মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় আসাম করে বসলাম। আম্মু ততক্ষণে ভাত মেখে ফেলেছেন। আমি বসতেই ভাতের লোকমা মুখে তুলে দিয়ে বললেন, ‘হাতের কী অবস্থা? ব্যথা আছে এখনো?’
‘তেমন নেই। সেরে যাবে।’
‘যখন ঢাকা চলে যাবি, কীকরে থাকবি বলতো? অনিয়ম করে করেতো শরীরটা শেষ করে দিবি। আমারতো তোকে পাঠাতেই মন সায় দেয়না।’
আমি ভাত চিবুতে চিবুতে বললাম, ‘আমি গেলেতো পাঠাবে। শরীয়তপুর ছাড়ছিনা আমি। থাকতে পারব না।’
‘আগে পরীক্ষা দে। তারপর দেখা যাবে।’
বলে আরেক লোকমা তুলে দিল আমার মুখে। আমি বললাম, ‘শুনলাম ঢাকা যাচ্ছো না-কি?’
‘তোকে কে বলল?’
‘নূর।’
‘ হ্যাঁ। তোর নানুকে আরেকবার ডাক্তার দেখিয়ে আনতে হবে। কিন্তু তোর ফুপির বাড়ি যাবোনা তো। পোস্তগোলা যাবো। তোর খালামণির বাড়ি।’
আমি কিছু বললাম না। আম্মু বলল, ‘ও হ্যাঁ। আদ্রিয়ান ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করল বাড়ি পৌঁছেছিস কি-না। বলল তোকে নাকি ফোনে পাচ্ছেনা।’
আমি জবাব দিলাম না। জবাব না পেয়ে আম্মু বলল, ‘জিজ্ঞেস করল ঠিকমতো পড়ছিস কি-না। আসতে পারছেনা বলে হয়তো। কল দিস ওকে।’
আমি এবারও কিছু বললাম না। আম্মু আমাকে খাইয়ে উঠে দাঁড়াতেই আমি বললাম, ‘আমিও যাবো কাল তোমাদের সাথে। অনেকদিন বাড়ি বসে বসে বোর হচ্ছি।’
আম্মু মামপটটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তুই যাবি আমাদের সাথে? শরীয়তপুর ছেড়েতো বের হতে চাস না। তাই আর বলিনি। কাল লাঞ্চের পর বের হচ্ছি তাহলে।’
আমি মাথা নাড়লাম। আম্মু চলে গেলেন। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে বিছানায় হেলান দিলাম। ঐ লোকটাকে বিশ্বাস নেই। হুটহাট বাড়ি এসে হা/মলা দিতে পারেন। ওনার মুখোমুখি হতে চাইনা এখন আর আমি। আর তার জন্যে খালার বাড়ি যাওয়ার চেয়ে বেটার অপশন হতেই পারেনা।
*
পরেরদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে সত্যি সত্যি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। তখনও পদ্মা সেতু উদ্ভোদন হয়নি। লঞ্চ পার হতে হয়। পদ্মা নদীর মাঝে লঞ্চের ঐ ঘন্টাখানেক সময়টা বেশ উপভোগ করি আমি। নদীর ঠান্ডা শীতল বাতাসে মন কিছুটা হলেও ভালো হল।
খালার বাড়ি গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল প্রায় পেরিয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই শরবত দিল। শরবত খেয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। জার্নি করে ঘুম পেয়েছিল ভীষণ। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। খালা চটপটি কিনে এনে ডাকল আমায়। আমি হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি সুন্দরভাবে প্লেটে সাজিয়ে রেখেছে আমার জন্যে। আমি মুচকি হেসে বসে পড়লাম খেতে। দু চামচের মতো মুখে দিতেই আম্মু সেই রুমে এসে বলল, ‘তুমি আদ্রিয়ানকে বলে আসোনি, আমরা ঢাকা আসছি?’
আমি ভ্রু কুঁচকে খেতে খেতেই বললাম, ‘ওনাকে বলব কেন?’
‘কেন মানে? ছেলেটা নাকি আজ পড়াতে এসে ফিরে গেছে।’
আমার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা। খাওয়ায় ব্যস্ত থেকে বললাম, ‘সেতো দু সপ্তাহ আসবেনা বলেই গিয়েছিল। তার সব ব্যস্ততা কর্পূরের মতো উবে গেছে সেটা তো আমার জানার কথা না, তাইনা? বয়সতো কম হয়নি। তাকে বলে দিন কথা আর কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা শিখতে। না হলে খালি হাতেই ফিরতে হবে।’
আম্মু বোকার মতো তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। ইতস্তত করে ওনার হাতে থাকা ফোনটা দ্রুত কেটে দিয়ে বললেন, ‘এরকমভাবে কথা বলা কবে শিখলে অনি? লাইনে ছিল ছেলেটা। সব শুনলো। কী ভাবল বলোতো? ওকে নিয়ে সমস্যা কী তোমার?’
আমি উত্তর দিলাম না। উনি কলে ছিলেন শুনে চুপ হয়ে গেলাম। পরমুহূর্তে ভাবলাম ভালোই হয়েছে। ওনার শোনা দরকার ছিল। বোঝা দরকার ছিল সবকিছুই ওনার মনমর্জি মতো চলবেনা। উনি সস্তা ভাবলেও আমি সস্তা নই।
একবার মনে হল আম্মুকে বলে দেই ওনার পড়াতে আসা বন্ধ করার কথা। পরে ভাবলাম আম্মুকে বললেই হাজারটা প্রশ্ন করে মাথা নষ্ট করে ফেলবে। তারচেয়ে আব্বুকে কনভিন্স করা সহজ। বাড়ি গিয়ে আব্বুর সঙ্গেই কথা বলব। চটপটি খাওয়ার পর আম্মু চা করে এনে দিল। আমি চায়ের কাপ নিয়ে জানালার কাছে চলে গেলাম। কিন্তু আমার মন ভালো ঠেকছে না। অবর্ণনীয় শূণ্যতা অনুভব করছি। অদ্ভুত মন খারাপ, অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা। সব থেকেও ‘কী যেন নেই’ নামক অনুভূতি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে রইলাম মুক্ত আকাশের দিকে। আচ্ছা সত্যিই কী আকাশ বার্তা পাঠায়! অব্যক্ত কথা, অব্যক্ত ব্যথা, অনুভূতিগুলো পৌঁছে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার কাছে?
*
মানসিক শান্তির জন্যে ঢাকা এলেও দুদিন যেতেই বুঝতে পারলাম শরীয়তপুর থেকে দূরে গিয়ে শান্তির আশা করতে পারিনা আমি। আমার জন্মস্থান, আমার বেড়ে ওঠা ওখানেই। আমার সাড়ে উনিশ বছর বয়সের সকল সুখময় স্মৃতির ধারক ঐ জায়গা। আমার সকল শান্তির ঠিকানা ঐ শরীয়তপুরের মাটিতে, কাঠবাগানের ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাসে। এগুলো ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আমার অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ।
ক’দিনেই অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম আমি। আম্মু নানুকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করে ব্যস্ত থাকছে। খালামণি আর খালুও নিজেদের কাজে ব্যস্ত। ইতু আপু, লাবণী আপুও শ্বশুরবাড়ির থেকে একবার এসে ঘুরে গেছে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। এদিকে চার দেয়ালে সারাদিন আরাম আয়েশ করে পোষাচ্ছেনা আমার। কথায় আছে মন ভালো থাকলেই সব ভালো থাকে। যেখানে মনটাই বিষিয়ে আছে সেখানে অন্যসবকিছু অসহ্য লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। খালাবাড়ির সবাই বেশ অবাক হলেন আমার ওমন চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকাতে। খালাতো আম্মুকে বলেই ফেললেন, ‘মেয়েটা আসলেই আমার শান্ত বাড়িটা প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু এবার এতো চুপচাপ কেন? কী হয়েছে ওর?’ আম্মু কিছু বলতে পারলেন না। শুধু একপলক তাকালেন আমার দিকে। কারণটাতো উনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। তাই আমিই এটা-সেটা বলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি ঠিক আছি।
কিন্তু আমার অবস্থা তখন ভয়ানক খারাপ। মানসিক অবস্থার সঙ্গেসঙ্গে শারীরিক অবস্থারও অবনতি হচ্ছে। সেটা বেশ বুঝতে পারছি। এতোদিন কিছু না বললেও এবার আম্মুকে বারবার তাগাদা দিচ্ছি বাড়ি ফেরার জন্যে। কিন্তু চাইলেই তো ফেরা সম্ভব নয়। নানুর চেক আপ এখনো চলছে। সার্জারি হবে কাল পরশু। সেসব হওয়ার আগে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নেই ওঠেনা। খালু অসুস্থ মানুষ বের হতে পারেন না। হাসপাতালের এসব জটিলতায় তখন একজন পুরুষ মানুষের প্রয়োজনীয়তা বোধ করল আম্মু-খালা দুজনেই। বাধ্য হয়েই আব্বুকে ডেকে পাঠাল। গতদিন থেকে বাবার হালকা জ্বর। তবুও অবস্থা বিবেচনা করে রাজি হয়ে গেলেন তিনি।
কথাটা শুনেই মেজাজ ভয়ানক খারাপ হল আমার। এমনিতেই শরীরে জ্বর। তারওপর গতবছরের ব্রেইন স্ট্রোকের ধকলটা সারিয়ে উঠতে পারেননি এখনো। ডান হাতের কবজি নাড়াতে এখনো কিছুটা কষ্ট হয়। তবুও রাজনৈতিক চাপ, কাজের চাপে পিষ্ট থাকে মানুষটা। লোকজন তারওপর একটু বেশিই নির্ভরশীল। এতোসব প্রেশারে যদি আবার কিছু হয়ে যায়! কোন আক্কেলে আব্বুকে আসতে বলল আম্মু? এই নিয়ে আম্মুর সঙ্গে বেশ লম্বা সময়ের তর্কও হল আমার।
অথচ যে মানুষটার জন্যে প্রিয় জায়গা ছেড়ে এখানে এলাম। যার জন্যে এই বাড়তি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কোনভাবেই সেই আদ্রিয়ান ভাইয়ের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে পারছিলাম না আমি। রোজই কোন না কোনভাবে তার প্রসঙ্গ উঠে আসতো। কিংবা তাকে ঘিরে কোন না কোন ঘটনা ঘটতোই।
এইতো সেদিন সন্ধ্যার পর সবাই একসাথে আছে। কথাবার্তা বলছে। আমি চুপচাপ বিছানার এক কোণে বসে ফোনে এটা-সেটা দেখছি। তখনই জাবিনের মেসেজ এলো হোয়াটস্অ্যাপে। আমি মেসেজটা ওপেন করে দেখলাম আদ্রিয়ান ভাইয়ের ছবি। কিচেনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছেন। ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম পেঁয়াজ কা/টছেন। জাবিন মেসেজে লিখেছে, “দেখো মিস্টার শেফ। খিচুড়ি বানাচ্ছে। রাতের খাবার।” ছবিটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। বাহ্ ভালোইতো চলছে সবকিছু। কারো জীবনতো থেমে থাকছেনা। সবাই বেশ আমোদেই আছে। আমিই অযথা বোকার মতো গুমরে মরছি। রিপ্লেতে কিছু লিখলাম না। তিক্ত অনুভূতি গ্রাস করে ফেলল মনকে। সকলের হাসি, আনন্দ, আড্ডা আর সহ্য হলোনা। বিরক্ত হয়ে হনহনে পায়ে ছাদে চলে গেলাম। ওখানে কেউ নেই এখন। ছাদের ঐ একাকিত্ব-ই আমাকে কিছুটা শান্তি দিতে পারে।
তার ঠিক দুদিন পরের কথা। বিশেষ একটা কাজে কাব্যকে বাইরে পাঠাতে হল আমার। আমি শরীয়তপুর ছিলাম না বলেই ওকে যেতে হয়েছে। ও বেচারাও খাবার কিছু পাবে ভেবে গেল। কিন্ত ওর কপাল খারাপ বলে খাওয়ার কিছু পায়নি। সে নিয়ে কী মারাত্মক দুঃখ বেচারার। আমি আর কী বলব? টিটকারীপূর্ণ সান্ত্বনা দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। কিন্তু বিচ্ছু ছেলেটা আধঘন্টার মধ্যেই খুশিতে নাচতে নাচতে হোয়াটস্অ্যাপে ম্যাসেজ পাঠাল আমাকে। খোশ মেজাজে বার্গার খাচ্ছে সে তখন। আর সেই বার্গারটা এনে দিয়েছেন তার আদ্রিয়ান ভাই। আদ্রিয়ান ভাইয়ের প্রশংসায় তখন গলে গলে পড়ছে আমার ভাই। এপাশে আমার মা-খালারও একই দশা। রাগে, বিরক্তিতে গা রীতিমতো জ্বলে উঠল আমার। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। কাব্যর সঙ্গে আদ্রিয়ান ভাইয়ের সম্পর্কটা বাবার সুত্রে। আমার ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ওদের মধ্যকার সম্পর্ক বদলাবে সেটা ভাবাও বোকামি।
নানুর সার্জারি হল মে মাসের আঠাশ তারিখ রাতে। সেই রাতে আব্বু, আম্মু, খালা সবাই হাসপাতালে। আমি বাড়িতে একা বলে ইতু আপু ঐদিন আমার সঙ্গে ছিল। দুশ্চিন্তায় ঐদিন ঠিকভাবে ঘুম হয়নি আমাদের। মাঝরাতে আম্মু ফোন করে জানালো অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে, তারপরেই স্বস্তি পেলাম। কিন্তু ঐ রাতে আর ঘুম হয়নি আমার।
এদিকে টানা এক সপ্তাহ মনের বিরুদ্ধে ঢাকা থাকা, মানসিক চাপ আর অশান্তি, নির্ঘুম রাত, বিভিন্ন অনিয়ম মিলিয়ে শরীরের অবস্থা যে খুব বেশি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সে খেয়াল ছিলনা আমার। ফিরে আসার আগেরদিন রাতেই জ্বরজ্বর অনুভব করলাম। আম্মুও ব্যাপারটা খেয়াল করে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দিল। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যাবে। কিন্তু কে জানতো আমার নাটকীয় জীবনের নাটকীয়তা তখনও অনেক বাকি।
*
নানুকে খালার বাড়িতে রেখেই ফিরে এলাম শরীয়তপুর। মাসখানেক পর আবার ডাক্তার দেখাতে হবে। অসুস্থ শরীরে বারবার এতোটা জার্নি ওনার পক্ষে ঠিক হবেনা তাই। লঞ্চে ভীষণ ভীড় হয় তাই সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরে আসতেই অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলাম আমি। আদ্রিয়ান ভাই আর কাব্য একসঙ্গে বসে নাস্তা করছে। আব্বু বললেন, ‘কী ব্যপার? তুই এতো সকাল সকাল এদিকে যে?’
আদ্রিয়ান ভাই আব্বুর দিকে একপলক তাকালেন। মুচকি হেসে খেতে খেতে বললেন, ‘কাল রাতে ফরহাদের বাড়ি ছিলাম আমি। শুনলাম কাব্য বাড়িতে একা আছে। তাই ভাবলাম নাস্তা দুজন একসঙ্গেই করে ফেলি। তারওপর তোমরাও আসছো বললে। তাই সবার জন্যেই এনেছি। ফ্রেশ হয়ে চলে এসো। টায়ার্ড তো?’
আম্মু বললেন, ‘আমি এসে রান্না করতে পারতাম তো। তোর এগুলো করার কী দরকার ছিল?’
‘এ’কদিন এমনিতেই অনেক ঝামেলার মধ্যে ছিলে। এতোটা জার্নি করে এসে রান্না করতে ভালো লাগতো? এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে ধীরেসুস্হে দুপুরের রান্না করো।’
আমার ততক্ষণে মাথা ধরেছে এদের কথাবার্তায়। তাই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আম্মু আমার ঘুম পাচ্ছে। সকালে যা খেয়ে বেরিয়েছি তাতেই আমার চলবে। এখন আর কিছু খাবোনা। প্লিজ আমায় ডাকাডাকি করোনা।’
কথাটা বলে কারো দিকে তাকালাম না। রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঐ লোকটা যতক্ষণ আছে ভুল করেও দরজা খুলব না। চেঞ্জ করে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। সত্যিই শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। কেমন শীত শীত করছে। ভেতর থেকে কাঁপুনি ধরছে। অন্যকিছু নিয়ে আর ভাবতে ইচ্ছা করল না। মিনিটখানেকের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম আমি।
যখন ঘুম ভাঙল তখন আমার ভীষণ জ্বর। উঠে বসতেই বুঝতে পারলাম ব্যপারটা। প্রথমে কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছা করল না। ভেবেছিলাম এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হলোনা। সময় যত বাড়ল জ্বরের মাত্রাটাও বাড়ল। রাতে আর অসুখের কথা লুকিয়ে রাখতে পারলাম না আমি। আম্মু ধরে ফেলল ব্যপারটা। চেক করে দেখলেন জ্বর খুব বেশি। স্বভাবতই অস্হির হয়ে উঠল, সঙ্গে বাড়ির সবাইকে অস্হির করে তুলল। ঠিক সেকারণেই জানাতে চাইনি আমি।
কিন্তু দুটো দিন কেটে যাওয়ার পরেও জ্বর কমল না। মাথায় পানি ঢালা, জলপট্টি দেওয়া, শরীর মুছে দেওয়া সবই করল আম্মু। কিন্তু বিশেষ লাভ হচ্ছিলো না। ঔষধ খাওয়ার পর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসলেও ঘন্টাখানেক পরেই আবার তীব্র জ্বরে পু/ড়ে যাচ্ছে শরীর। ব্যাপারটাতে বাড়ির সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়ল। রাতেরবেলা মুজিবর আঙ্কেলকে ফোন করে পরামর্শ চাইলেন আব্বু। আঙ্কেল বললেন সেই রাতটা দেখতে। পরেরদিনও জ্বর না কমলে উনি এসে দেখে যাবেন।
আমার অবস্থা তখন করুণ। জ্বরে প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে শরীর। কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। সারামুখ তেতো হয়ে আছে। খাবারের বিন্দুমাত্র রুচি নেই। সে অবস্থাতেই ঠেসে ঠেসে খাওয়াচ্ছে আম্মু। খেতে না চাইলেই ‘ঔষধ খেতে হবে’ নামক চির পরিচিত সংলাপ আওড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর জ্বর মেপে আঁতকে উঠছে। এতো যত্ন, এতো ভালোবাসার মাঝেও সেরে ওঠার কোন লক্ষণ দেখা দিলোনা আমার মাঝে। মনে হচ্ছিলো জ্বর নয়, কোনকিছুর তীব্র অভাব আমাকে জ্বা/লিয়ে পু/ড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে।
পরেরদিন বিছানা থেকে ওঠা দ্বায় হল আমার। এমন দীর্ঘ সময়ের জ্বর শেষ কবে এসেছিল মনে নেই। সেদিন সারাদিন কীভাবে কেটেছে আমার নিজেরও ঠিকভাবে মনে নেই। অবস্থার উন্নতির বদলে অবনতি দেখতে পেয়ে অবশেষে মুজিবর আঙ্কেলকে ফোন করতে হল আব্বুর। উনি এলেন বিকেলবেলা। আমি তখন প্রায় আধমরা হয়ে বিছানায় পড়ে আছি। কোনকিছুই ভালো লাগছেনা। ব্যথায় টনটন করছে সারা শরীর। আঙ্কেল আমার পাশে বসে মুচকি হেসে বললেন, ‘কী ব্যপার আম্মু? কী অবস্থা?’
আমি ক্লান্ত চোখে আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে দুর্বল হাসলাম। আঙ্কেল প্রথমে হাত দিয়ে, পরে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপলেন। তারপর বললেন, ‘এমন জ্বর বাঁধালে কীকরে মা? নিজের যত্ন নিতে হয়তো।’
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। শরীর তখন সত্যিই ভীষণ খারাপ। তাকিয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছিনা।
‘কী অবস্থা এখন, আঙ্কেল?’
পরিচিত কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বর শুনে ঝট করে চোখ খুলে ফেললাম আমি। প্রথমে দৃষ্টিভ্রম মনে হল। কিন্তু না। সত্যিই মুজিবর আঙ্কেলের পেছনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রিয়ান ভাই। আঙ্কেল বললেন, ‘জ্বর ভালোই বাঁধিয়েছে। মেয়ে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কিছুই করেনি ঠিকমতো। অতিরিক্ত অনিয়মের ফল। তুমি এখানে যে?’
আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘পড়াতে এসছিলাম। এখন দেখছি ছাত্রী বিছানা নিয়েছে।’
‘ হ্যাঁ। উঠে বসার অবস্থা নেই। কী অবস্থা দেখোতো। বাচ্চা মেয়ে।’
সুযোগ পেয়ে আব্বু, আম্মু একরাশ অভিযোগের ঝুলি নিয়ে বসলেন আঙ্কেলের সামনে। আঙ্কেলও মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। যথারীতি কিছু উপদেশ দিল আমায়। কিন্তু কোন কথাতেই মনোযোগ দেওয়ার অবস্থা ছিলোনা আমার।
আঙ্কেল ঔষধ চেঞ্জ করে দিয়ে গেলেন। আর তারপরও জ্বর না কমলে আগামীকাল কিছু টেষ্ট করিয়ে নিতে বললেন। নিজের কাজ সেরে আঙ্কেল বেরিয়ে গেলেন। বাবা গেলেন ওনাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে। সবকিছুই কেমন ঝাপসা ঝাপসা দেখছি আমি। চারপাশে ঘটা সব দেখছিলাম, বুঝতেও পারছিলাম। তবুও মনে হচ্ছিলো আমি ওখানে নেই। অন্যকোন জগতে আছি। যা দেখছি, শুনছি সবটাই অবাস্তব, স্বপ্ন।
আম্মু আদ্রিয়ান ভাইকে বললেন, ‘তুই বস। আমি কফি-টফি কিছু নিয়ে আসি তোর জন্যে। একটু সময় লাগবে। না খেয়ে যাবিনা কিন্তু।’
আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘যাও তুমি। আমি আছি।’
ওনাদের কথাগুলোই কেবল শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। কারণ আমার দৃষ্টি ছিল সিলিং এর দিকে। আম্মু বেরিয়ে যাওয়ার পর উনি বসলেন আমার পাশে। আমি তখনও সরাসরি তাকাইনি ওনার দিকে। কিন্তু তাকাতে বাধ্য হলাম যখন উনি আমার হাত ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই পকেট থেকে কী যেন একটা বের করলেন। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম সেই ব্রেসলেট। অবাক হওয়ার ক্ষমতা তখন নেই আমার। শুধু পিটপট করে তাকিয়ে আছি সেদিকে। উনি ব্রেসলেটটা আমার হাতে পরিয়ে দিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন। আলতো করে হাত রাখলেন আমার মাথায়। সঙ্গেসঙ্গে চোখ বুজে ফেললাম আমি। সারা শরীরে অদ্ভুত প্রশান্তির অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। মনে হল দীর্ঘ সময়টা এই অভাবটুকুই গ্রাস করেছিল আমাকে। এই স্পর্শটুকুর জন্যেই ছটফট করছিল আমার অবচেতন মন। এইটুকুর, শুধু এইটুকুর অভাবেই ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। অতি আবেগে কখন আমার চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে নিজেও বুঝতে পারিনি। সেই মুহূর্তেই কপালে অদ্ভুত স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলাম আমি। সেটা ওনার ঠোঁটের স্পর্শ ছিল বুঝলাম কয়েক সেকেন্ড পর। কিন্তু তখনও চোখ খুলিনি আমি। এতোটা হালকা অনুভব করিনি এর আগে কোনদিন। উনি সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার মাথায়। কিন্তু হঠাৎই ওনার বলা সেই তিক্ত বাণী, নির্মম ব্যবহার প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিল আমার আত্মসম্মান বোধকে। চোখ খুলে ফেললাম। প্রচণ্ড জ্বর আর মানসিক চাপে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আমি। অসুস্থ অবস্থাতেও সমস্ত ইচ্ছাশক্তিকে একত্রিত করে চেঁচিয়ে ডাকলাম আম্মুকে। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠলেন আদ্রিয়ান ভাই। দ্রুত আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি এরমধ্যে আর দু-তিনবার আম্মু বলে চেঁচিয়ে ফেললাম। জোরে ডাকার কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার। আম্মু দ্রুতপায়ে ঢুকলেন রুমে। উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে? কোন সমস্যা হচ্ছে আম্মু?’
আদ্রিয়ান ভাই তখনও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি তার থেকে চোখ ফিরিয়ে লম্বা শ্বাস নিতে নিতে বললাম, ‘তোমার কী কাণ্ডজ্ঞান নেই আম্মু? যাকে-তাকে নিজের মেয়ের রুমে একা রেখে বেরিয়ে যাচ্ছো!’
তারপর ঠিক কী হল মনে নেই আমার। ঐদিন বিকেলের স্মৃতির পাতা ঘাটলে এই অবধিই মনে পড়ে। তারপর সবটাই শূন্য, অন্ধকার।
…
[ রি-চেইক করিনি।]