অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১৯
আদ্রিয়ান ভাই ওভাবে ওনার রুম থেকে বের করে দেওয়ার পর আর ছাদে গেলাম না। বসার ঘরে এসে চুপচাপ সোফায় বসে পড়লাম। হাতের আঙুলগুলো ভীষণ জ্বালা করছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জ্বলছে ভেতরটা। অভিমান, অপমানে কান ঝিঁ ঝিঁ করছে। মনে হচ্ছে অদ্ভুত কোন ঘোরে আছি আমি। উনি আমার সাথে এমন নিকৃষ্ট ব্যবহার করলেন! আমার সাথে? কথাটা বিশ্বাস করতে গিয়ে বারবার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। গা গুলিয়ে উঠছিল। বাঁ হাতের আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম র’ ক্ত বের হচ্ছেনা। অনেকক্ষণ পানি দিয়ে ধুয়েছি। তবে সাদা আর লালের সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক ক্ষ’ ত তৈরী হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও অপরাধবোধে ভুগছিলাম আমি। ওনার দেওয়া উপহারটা আমি যত্ন করে রাখতে পারিনি। নিজের এই ব্যর্থতা ভীষণভাবে পোড়াচ্ছিল আমাকে। কিন্তু এখন মারাত্মক সংশয়ে ভুগছি। সত্যিই কী আদ্রিয়ান নামক মানুষটার কাছে আমার কোন মূল্য আছে? মনে তীব্র ঘৃণা না থাকলে কারো সাথে এতো জঘন্য ব্যবহার করা যায়? এতোটা ঘৃণা করেন উনি আমাকে!
ছাদ থেকে জাবিন, সারার পায়ের আওয়াজ শুনে হুশ ফিরল। তাড়াতাড়ি চোখের কোণে জমা অশ্রুকণা মুছে ফেললাম। কখন চোখে পানি এসে ভীড় করেছে নিজেই বুঝতে পারিনি। ওরা দুজনে একসঙ্গেই ঘরে ঢুকল। সারা বলল, ‘অনিপু, আর ছাদে এলেনা কেন? এখানে একা একা বসে আছো!’
আমি একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘হঠাৎ মাথাটা একটু ধরেছিল। তাই আর যাইনি। ভাবলাম তোমরা তো চলেই আসবে।’
জাবিন খানিকটা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কী বলো! বেশি ব্যথা করছে?’
আমি ওদের আশ্বস্ত করে বললাম, ‘না। তেমন কিছু না। এখন কমে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আর ইউ শিওর?’
আমি হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাঁকালাম। যতটা সম্ভব হাতটা ওদের থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। সারা বলল, ‘শোভাপুরা চলে এসেছে। ছাদ থেকে দেখলাম। এখনো ভেতরে এলোনা কেন?’
সারা কথাটা শেষ করতে করতে আঙ্কেল, মামণি ভেতরে ঢুকলেন। সঙ্গে শোভা আপু আর শাওন ভাইয়া আর ওনাদের ছোট ভাই। ওর নামটা এখন মনে নেই আমার। জাবিন সারা উঠে ওদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। শাওন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যপার অনি? কেমন আছো?’
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘ভালো আছি। আপনারা ভালো আছেন?’
শাওন ভাইয়া হেসে মাথা নেড়ে বোঝালেন ‘ভালো’। শোভা আপু এতক্ষণে খেয়াল করলেন আমাকে। একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমিও এসেছো?’
আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। তবুও মুখে হাসি ধরে রেখে বললাম, ‘মানিক আঙ্কেল নিয়ে এলেন জোর করে।’
শোভা আপু কাঁধ ঝাঁকালেন। মামণি ওদের সবাইকে বসতে বললেন। শাওন ভাইয়া বলল, ‘আমাদের দ্য গ্রেট ইঞ্জিনিয়ার কোথায়?’
মামণি হতাশ হয়ে বললেন, ‘আবার কোথায়? নিজের রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। দুই সপ্তাহর জন্যে কী একটা কোর্স করছে খাওয়ারও সময় নেই তার। আমায় পইপই করে বলে দিয়েছে কেক কা’টা’র আগে যাতে ডাক না দেই। কেক কা’টি’য়ে খাবার নিয়ে আবার সে রুমে চলে যাবে।’
বলতে বলতে ওনার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঐ যে। দেখেছিস? দরজাটাও বোধ হয় ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে।’
শোভা আপু বলল, ‘আমরা এসেছি জানলে নিশ্চয়ই বের হবে। ডেকে দেই?’
শোভা আপু উঠতে গেলে শাওন ভাইয়া বলল, ‘একটু প্রেশারে আছে বোধ হয়। থাক আপাতত ডিস্টার্ব করতে হবেনা।’
মামণি বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, ‘ও বললেই শুনব না-কি? খাওয়ার সময় কান ধরে টেবিলে বসাবো না!’
শাওন ভাই বলল, ‘তবে ফুপি, তোমার হবু বউমাটার কথা ভেবে আমার মারাত্মক দুঃখ হয়। ঐ পাগলের পাগলামি হজম করতে পারবে এমন মেয়েতো দূরবীণ দিয়ে খুঁজতে হবে।’
সারা বলল, ‘ভাগ্যিস আমি আর আপু দা’ভাইর মতো অতো এক্সট্রা অর্ডিনারী নই। তাহলে আম্মুকে আর খুঁজেই পাওয়া যেতোনা।’
সকলেই হেসে ফেলল। মামণি বললেন, ‘হাসিস না তোরা। এই একটা ছেলের কথা ভেবে ভেবেই আমার চুল সব পেকে গেল। কেন যে এতো পড়াতে গেলাম। পড়তে পড়তেই ছেলেটা বোধ হয় এমন হয়ে গেছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। কখন কী করে, না করে ও জানে আর আল্লাহ জানেন। কোন কিছুর ঠিক নেই। পা থেকে মাথা অবধি ইগো। সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খেলেও বলবেনা আমি সমস্যায় আছি। কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দেয়না। এইজন্যই এতো চিন্তায় থাকি। কী চলে মনের মধ্যে কে জানে। কে যে ওর এই উল্টাপাল্টা কাজকর্ম হজম করতে পারবে খোদা জানেন।’
মানিক আঙ্কেল এতক্ষণ চুপচাপ ফোন স্ক্রোল করছিলেন। মামণির কথার পৃষ্ঠে বললেন, ‘এটা ভালো দিক। নিজের সমস্যার সাথে নিজেই ডিল করে। অহেতুক কাউকে জড়ায় না। যাই হোক, তোমার পাগল ছেলেকে খাওয়ানোর জন্যে হলেওতো রান্নাটা করতে হবে না-কি? বিরিয়ানি করবে না না-কি? বারোটা বাজতে চলল তো।’
মামণির যেন হুঁশ ফিরল। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তাইতো। কত রাত হলো। যাই, রান্নাটা বসিয়ে দেই।’
শোভা আপু বলল, ‘আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে। চলো। অনিমা যাবে?’
যাবো ভাবলেও নিজের হাতের অবস্থা মাথায় আসতেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। মাথা নেড়ে না করলাম। মামণি আর শোভা আপু চলে গেল রান্নাঘরে। মানিক আঙ্কেল উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। শাওন ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাব্য আসেনি?’
আমি বললাম, ‘এসেছে। ওর বন্ধুর বাড়ি গেছে। চলে আসবে।’
‘ছেলেটা কিন্তু দারুণ। ওর সঙ্গে কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। ছটফট ছটফট করে কথা বলে।’
আমি কিছু বললাম না। শাওন ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কী ব্যপার অনি? মন ভালো নেই তোমার?’
শাওন ভাইয়ের আচমকা প্রশ্নে খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। আমি কিছু বলার আগেই জাবিন বলল, ‘আমিও দেখছি। তখন থেকে কেমন চুপ হয়ে। অনিপু কখনও এতো চুপচাপ থাকে না-কি?’
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কোনরকমে বললাম, ‘ঐযে বললাম না মাথা ধরেছিল ঐজন্যই। তোমরা গল্প করোনা। আমি শুনছি।’
এরমধ্যেই আদ্রিয়ান ভাইয়ের রুমের দরজা ফাঁক হলো। উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘শাওন, রুমে আয়।’
শাওন ভাইয়া একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে গেলেন আদ্রিয়ান ভাইয়ের রুমে। মাথা ব্যথা না করলেও হাতের ঐ তিনটে আঙুল জ্বলে যাচ্ছে আমার। স্বাভাবিকভাবে বসে থাকতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। সারা আমার পাশে বসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি চুপচাপ থাকলে ভালো লাগেনা অনিপু। কী হয়েছে?’
আমি মুচকি হেসে সারার গালে হাত রাখলাম। জীবনে একটা জিনিস খুব বেশি পেয়েছি আমি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা। একটা বিশাল সংখ্যার মানুষ অকারণেই ভালোবাসে আমাকে। বড্ড বেশি ভালোবাসে। তারা কেন আমাকে ভালোবাসে আমি জানিনা। সত্যি বলতে এখন আর জানতে চাইও না। তাদের ভালোবাসা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি সেই অভ্যাসেই অভ্যস্ত থাকতে চাই। এতো অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার চাদরে মোড়া মায়াবিনী হয়ে থাকতে চাই।
বারোটা প্রায় বাজতে চলেছে। কাব্য আরও আগেই চলে এসেছে। আদ্রিয়ান ভাইয়ের রুমে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে এখন। মামণি আর শোভা আপু মিলে ডাইনিং টেবিল সাজালেন। কেকের সেটআপ, ঘর ডেকোরেট করা আর জাবিনকে সাজানোর দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। সারার সাহায্য নিয়ে যতটা পারি করলাম। জাবিনকে রেডি করে আমি আর সারা চলে গেলাম ডাইনিং ঐ। এইটুকু সময়ে আমার অবস্থা শোচনীয়। হাতের যন্ত্রণায় চোখে অন্ধকার দেখছি। সব করার পর দেখলাম কাটা জায়গাটা দিয়ে হালকা র’ ক্ত বেরিয়েছে। তাই আরেকবার হাতের র’ ক্ত ধুয়ে এলাম। তারপর আর র’ ক্ত বের হয়নি। একবার ভাবলাম মামণিকে বলে ফার্স্ট এইড নেব কি-না। কিন্তু পরমুহূর্তে চিন্তাটা বাতিল করে দিলাম। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার অদ্ভুত এক জেদ চাপল মাথায়। জেদের বশেই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলাম এই যন্ত্রণা।
শোভা আপু গিয়ে আদ্রিয়ান ভাই, শাওন ভাই আর কাব্যকেও ডাকল। শাওন ভাই আর কাব্য প্রথমে বেরিয়ে এলো। তারও প্রায় চার পাঁচ মিনিট পর বেরিয়ে এলেন আদ্রিয়ান ভাই। সেই কপাল ভর্তি হয়ে ছড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একই পোশাক। আদ্রিয়ান ভাইয়ের চোখে-মুখে ভীষণ ক্লান্তি। দিন-রাত এক করে পড়ার ফল হয়তো। শোভা আপু ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘এভাবেই চলে এলে? চেঞ্জ করে এসো।’
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘তোর বিয়ে লেগেছে না-কি?’
শোভা আপু হয়তো বুঝলেন উনি চটে আছেন। তাই আর কথা বাড়ালেন না। শাওন ভাই বললেন, ‘বিয়ে তো তোর লাগছিল। নিজেই তো ভেস্তে দিলি। বেরসিক মানুষ।’
আদ্রিয়ান ভাই দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাঁজ করে বললেন, ‘তো তুই এতো রসিক হয়ে কী উদ্ধার করলি? দুই বাচ্চার বাপ হয়ে কাকা ডাক শোনাতে পারতি তাহলে মানতাম না হয় যে কিছু একটা করেছিস লাইফে।’
শাওন ভাইয়ের মুখটা দেখার মতো হলো। উনি হতাশ হয়ে বললেন, ‘আমাদের মেয়ে পটিয়ে নিতে হয় গুরু। তোমার আর কী? ইউকে থেকে বাংলাদেশ যেখানেই যাও সেখানেই কম করে একজন করে মজে আছে। আর আমাদের খুঁজতে হয়।’
শোভা আপু শাওন ভাইকে বলল, ‘ভাই তোর গার্লফ্রেন্ড আনব্লক করেছে? পরশুই না লা’ থি মেরে ব্লক করল?’
হাসির রোল পড়ে গেল ঘরটাতে। উনি আসতেই যেন আসরটা প্রাণ ফিরে পেল। বাকি সবার সঙ্গে হাসিমজা, দুষ্টুমি সবকিছুই করলেন আদ্রিয়ান ভাই। কিন্তু একবারও ফিরে তাকালেন না আমার দিকে। আরও বেশি অপমানিত বোধ করলাম আমি। ইচ্ছে করল ছুটে বেরিয়ে যাই এই বাড়ি থেকে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে ওনার এই চরম অবজ্ঞা সহ্য করে নিতে হলো আমাকে।
অবশেষে বারোটা বাজল। হৈ হৈ করে জাবিনের জন্মদিনের কেক কা’টা হলো। সবাই মিলে উইশ করলাম ওকে। এক এক করে আমাদের সবার মুখে কেক তুলে খাইয়ে দিলো। আদ্রিয়ান ভাইকে কেক খাওয়ানোর পর উনিও খাওয়ালেন। একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে। জাবিন প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে প্যাকেটটা খুলে দেখল একটা ল্যাহেঙ্গা আছে। খুশিতে ওনাকে জড়িয়ে ধরল জাবিন। আদ্রিয়ান ভাইও হেসে জড়িয়ে ধরলেন বোনকে। জাবিন বলল, ‘এটাতো সেদিনই অনলাইনে দেখে পছন্দ করেছিলাম। তুমি জানলে কীভাবে?’
আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘ফোনটা এখন দিচ্ছিনা। সামনে এইচএসসি। পরীক্ষাটা শেষে হলে আমি ইউকে থেকে পাঠিয়ে দেব।’
‘লাভ ইউ ভাইয়া।’
আদ্রিয়ান ভাই হেসে জাবিনের মাথার চুলগুলো নেড়ে দিলেন। অপর সাইড দিয়ে সারাও এসে জড়িয়ে ধরল ওনাকে। আমি কিছুক্ষণের জন্যে সব ভুলে গেলাম। মুগ্ধ চোখে দেখলাম এই অপূর্ব দৃশ্য।
কেক কা’টা পর্ব শেষে ছবি তোলা হলো। কিছুক্ষণ আনন্দ করার পর মামণি খেতে দিলেন সবাইকে। আদ্রিয়ান ভাই খাবার নিয়ে রুমে যেতে চাইছিলেন। সত্যিই সত্যিই কান ধরেই টেবিলে বসালেন মামণি। খাওয়ার মাঝেই মামণি বলে উঠলেন, ‘কীরে আদ্রি? আজ বিরিয়ানি ভালো হয়নি?’
আদ্রিয়ান ভাই চমকে উঠলেন। যেন অন্য জগতে ছিলেন উনি। একটু হেসে বললেন, ‘তোমার বিরিয়ানি খারাপ হয় কখনও? আনবিটেবল।’
মামণি এগিয়ে এসে ওনার কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা চেক করলেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন, ‘সবসময়তো মুখে তুলেই দু লাইন বেশি প্রশংসা করিস। কী হয়েছে বাবা? শরীর ঠিক আছে? আগেই বলেছি সারাদিন এতো খাটতে হবেনা। না খেয়ে না দেয়ে খালি বই আর বই।’
উনি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এতো অল্পেই এতো হাইপার হয়ে যাও কেন আম্মু? আমার কিছু হয়নি। সবদিনই সবাই একরকম রিঅ্যাক্ট করে? মানুষ আমি, কম্পিউটার না।’
মামণি কিছু বলতেই যাচ্ছিল। মানিক আঙ্কেল থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এতো কথা বলছো কেন? খেতে দাও ওকে শান্তিতে। তোমার খাবারের প্রশংসা পরে না হয় করবে। তুমিও বসে পড়।’
খাওয়ার সময় উল্লেখযোগ্য কোন কথা হলোনা। টুকটাক গল্পই চলল। সকলে হাত ধুয়ে আসার পর আমি গেলাম হাত ধুতে। হাত ধোয়ার সময় কা’টা জায়গাটা থেকে আবার র’ ক্ত বেরিয়ে এলো। জাবিন ওয়াশরুমে ছিল আমি জানতাম না। বেরিয়েই আমার হাতে র’ ক্ত দেখে চমকে উঠল ও। দ্রুত এসে হাত ধরে বলল, ‘একি! কা/ট/ল কীকরে?’
একটু জোরেই বলল কথাটা। আমি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে চুপ থাকার ইশারা করলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘আস্তে। প্লিজ কাউকে বলোনা। অযথাই সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে। তেমন কিছুই হয়নি। অল্পই কে/টে/ছে।’
জাবিন আমার হাতটা ধরে ভালোভাবে পরখ করে বলল, ‘মোটেও অল্প না। ইশ! হলো কীকরে এটা?’
আসল ঘটনা ওকে কীকরে বলি! কোনরকম ইতস্তত করে বললাম, ‘দরজার চিপায় লেগে গেছে ভুল করে। ফার্স্ট এইড বক্স হবে?’ ইচ্ছে করেই কথাটা ঘুরিয়ে দিলাম।
‘হ্যাঁ হবে। ভাইয়ার রুমে আছে। তুমি আমার রুমে গিয়ে বসো। আমি নিয়ে আসছি।’
আমি তাই করলাম। জাবিন ফার্স্ট এইড বক্স এনে ঔষধ লাগিয়ে, ব্যান্ডেজ করে দিল। ঔষধ লাগানোর সময় জ্বালায় প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছিল আমার। কোনরকমে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলাম। কিন্তু আমায় কষ্ট পেতে দেখে জাবিন মেয়েটার চোখ ভিজে উঠল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেটা। জাবিন বলল, ‘তুমি এতোখানি কা’টা জায়গা নিয়ে এতক্ষণ বসে ছিলে? পাগল তুমি? এতক্ষণ সহ্য করলে কীকরে?’
তোমার ভাইকেই চারটা বছর যাবত সহ্য করছি। সেখানে এটাতো শুধু একটা ক্ষ’ ত। কথাটা মনে মনে বললেও মুখে কিছু বললাম না। ওকে অনুরোধ করলাম যাতে আঙুল কা/টা/র কথাটা এখন কাউকে না বলে। আমি নিজেই সকালে বলব। জাবিন একটু অবাক হলেও মেনে নিল। হয়তো আমি বলেছি বলে।
ওড়নার নিচে কৌশলে বাঁ হাত লুকিয়েই বের হলাম। বসার ঘরে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল আমার। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে, হাসিমজা করছে। এটা হয়তো পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে একটা। আমি আর জাবিনও গিয়ে বসলাম। কিন্তু ওদের আড্ডা বা মজায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না আমি। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। কতটা সময় পার হয়েছিল কে জানে। ভাবনা থেকে ফিরে এলাম মামণির ডাকে। উনি আমার আর আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোদের দুজনের কী হয়েছে বলতো? একজনও কথা বলছিস না। এমন করলে হয়? তোদের ছাড়া আড্ডা জমেছে কখনও?’
আদ্রিয়ান ভাই আলসেমি ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলেন। নিরস গলায় বললেন, ‘তুমিইতো জোর করে বসিয়ে রেখেছো আমায়। আমার এখন এসবের মুড নেই। ঘুম পাচ্ছে। আমায় ছেড়ে দাও, আমি যাই।’
শাওন ভাই বললেন, ‘আচ্ছা। কিন্তু একটা গান অন্তত গা? আবরার বাড়িতে আসর হচ্ছে আর আদ্রিয়ান মহাশয় গান গাইবে না? সেটা হয় নয় না-কি? না এর আগে কখনও হয়েছে? একটা গান গা। এরপর ছেড়ে দিচ্ছি।’
সবাই, এমনকি আঙ্কেল আর মামণিও বলল। উনি রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু জাবিন বলাতে রাজি হয়ে গেলেন। হয়তো আজ ওর জন্মদিন বলে। সারা ওনার প্রিয় গিটারটা নিয়ে এলো। ওনার হাতে দিয়ে বলল, ‘পুরো গান গাইবে কিন্তু দা’ভাই। কয়েক লাইন গেয়ে থেমে যাবেনা।’
মৃদু হেসে সারার মাথায় আলতো করে চাটা মারলেন উনি। কিছুক্ষণ হতাশ হয়ে দেখলেন গিটারটা। অনেকটা বাধ্য হয়েই গিটারে সুর তুললেন। কিছুক্ষণ নিজের মতো টুংটাং করে গান ধরলেন,
আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি
বলে দিতে পারো তা আমায়।
হয়তো আমার কোনো প্রয়োজন নেই
কেন লেগে থাকি একটা কোণায়।
তুমি বলে দিতে পারো তা আমায়
চিঠি লিখবো না ঐ ঠিকানায়
আমারও তো মন ভাঙে
চোখে জল আসে
আর অভিমান আমারও তো হয়
অভিমান আমারও তো হয়।
যদি এই মুঠো ভরা শিউলি ফুল
যদি এই খুলে রাখা কানের দুল
লক্ষ্মীটি একবার ঘাড় নেড়ে
সম্মতি দাও, আমি যাই ছেড়ে।
এত কথা বলি
পাখি হয়ে উড়ে যায় সব
তোমাকেই ছুঁতে পারে না
এতবার আসা যাওয়া একই পথ দিয়ে
কই তোমার তো চোখে পড়ে না
তাহলে কি আমি কেউ নই
যেন অজানা ভাষায় লেখা বই
আমারও তো মনে হয়
মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখি
সুযোগ টা পাচ্ছি কই?
আমি সুযোগ টা পাচ্ছি কই?
যদি মুঠো ভরা শিউলি ফুল
যদি খুলে রাখা কানের দুল
লক্ষ্মীটি একবার ঘাড় নেড়ে
সম্মতি দাও, আমি যাই ছেড়ে
আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি…
সকলেই মৃদু শব্দে হাত তালি দিল। কিন্তু উনি আর বসলেন না। কারো কোন মন্তব্য না নিয়েই হনহনে পায়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। শোভা আপু সেদিকে মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মামণিকে বলল, ‘এই ছেলেকে কী খেয়ে জন্ম দিয়েছো ফুপি? সত্যি বলছি তিন বছর হলো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছি। এতো জায়গায় গেছি, এতোরকমের ছেলে দেখেছি। কিন্তু এরকম দ্বিতীয় একজন দেখিনি।’
মামণির চোখ আদ্র হয়ে উঠল। আদ্রিয়ান ভাইয়ের ঘরের দিকে তাকিয়ে রইলেন চুপচাপ। সেই দৃষ্টি সাধারণ কোন দৃষ্টি নয়। গর্বে জ্বলজ্বল করা এক ধন্য মায়ের দৃষ্টি।
জাবিন, আমি, সারা আর শোভাপু এক রুমেই ঘুমালাম। বিছানাটা বড়। চারজন শোয়া গেল। শোয়ার সময় সারা আর শোভা আপু দেখে ফেলল আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ। কোনমতে সামাল দিলাম আমি। রাত অনেক হয়েছে। আর সকলেই ক্লান্ত থাকায় তেমন কথা হলোনা তখন আর।
রাতে তেমন ভালো ঘুম হলোনা আমার। তবে শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমোলাম। ঘন্টা খানেকের জন্যে। ভোর ভোরই সেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাকিয়ে দেখলাম বিছানায় আমি বাদে সারা আর জাবিন আছে। শোভা আপু নেই। আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। আস্তে করে উঠে বসলাম। মনে পড়ল, আমি আর আদ্রিয়ান ভাই যখনই এক বাড়িতে রাত কাটাতাম। সেই সব ভোরগুলোতে আদ্রিয়ান ভাই আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিতো। আমার কাছে চা-কফি খাওয়ার বায়না করতো। আমি হাজারো বকা দিতে দিতে বানিয়েও আনতাম। তারপর একসঙ্গে বসে বসেই খেতাম। সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে। আজই হয়তো প্রথম তার অন্যথা হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নামলাম বিছানা থেকে। আঙুলগুলো এখনো ব্যথা করছে। ব্যথা আরও বেড়েছে মনে হলো। চোখেমুখে পানি দিয়ে ভাবলাম একটু ছাদে যাই। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভোর দেখলে হয়তো মনটা ভালো লাগলে। ভেতরে জমা বিষাদের মেঘ কিছুটা হলেও হালকা হবে।
কিন্তু ছাদের দরজার কাছে পৌঁছতেই আমার পা দুটো থমকে গেলো। মাথাসহ সারা শরীরে যেন ঝিম ধরে গেল। কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে কী হচ্ছিল আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। আদ্রিয়ান ভাইয়ের ক্যারি টেবিলটা রাখা ছাদে। মুখোমুখি বসে কফি খাচ্ছেন আদ্রিয়ান ভাই আর শোভা আপু। আদ্রিয়ান ভাইয়ের সামনে ওনার একটা বইও আছে। কিন্তু উনি পড়ছেন বলে মনে হচ্ছেনা। জমিয়ে আড্ডা চলছে। বাহ্! আমাকে পড়াতে যাওয়ার সময় নেই। আমার সাথে কাঠবাগানে দেখা করতে যাওয়ার সময় নেই। আসতে পারছেনা সেটাও না-কি বলার সময় নেই। এতোটাই ব্যস্ত সে। এই তার ব্যস্ততার নমুনা! শোভা আপুকে নিয়ে জেলাস ফিল করার প্রশ্নেই ওঠেনা। অতো সস্তা জেলাসী আমার মধ্যে কাজ করেনা। আর না আমার মানসিকতা এতো ছোট।
কিন্তু আমি ওনার জীবনে এতোটা গুরুত্বহীন কবে থেকে হলাম? আমায় এতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য কবে থেকে করতে শুরু করলেন উনি? আম্মু একবার বলেছিল, পুরুষের মন নাকি গিরগিটির রঙের মতো বদলায়। তবে কী সত্যিই তাই? তাই বোধ হয়, আমার সঙ্গে তৈরী করা দীর্ঘদিনের অভ্যেসটাও ভুলতে পারলেন উনি। হঠাৎ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো আমার। ঘন ঘন ঢোক গিললাম।
আমি চলে আসছিলাম তখনই শোভা আপু দেখে ফেলল আমাকে। বলে উঠল, ‘একি অনিমা? তুমি উঠে পড়েছো? চলে যাচ্ছো কেন? এখানে এসে বসো? কফি খাবে?’
আমি পেছন ঘুরলাম। কিছু বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু আদ্রিয়ান ভাইয়ের কথা শুনে থমকে গেলাম। উনি আমার দিকে না তাকিয়েই কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘এসেছিল হয়তো কারো সঙ্গে প্রেমালাপ করতে। আমাদের সামনেতো করতে পারবেনা। তাই ফিরে যাচ্ছে। সব কথাতো আর আমাদের সামনে বলতে পারবেনা। বাট চাইলে এক সাইডে গিয়ে বলতে পারে। ওর প্রেমালাপ শোনার জন্যে এখানে কেউ বসে নেই।’
আমি অবাকের চেয়েও বেশি কিছু হলাম বোধ হয়। চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। শোভা আপু বলল, ‘কীসব বলছো?’
উনি ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘তোর বিশ্বাস হচ্ছেনা? আরে প্রেমালাপের জন্যেতো ছাদ আদর্শ জায়গা। বিশেষকরে আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে মনের সুখে, মনের কথা আদান-প্রদানের জন্যে পার্ফেক্ট। আর সেটা আমার চেয়ে ভালো ও জানে। প্রচুর এক্সপেরিয়েন্স আছে। জিজ্ঞেস কর ওকে?’
আমি পাথরের মতো জমে গেলাম। হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। ভেতর থেকে কাঁপুনি ধরে গেল যেন। নিজের চোখ আর কানকে ভীষণভাবে অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। এটা যেন স্বপ্ন হয়। এক্ষুনি যেন আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু তা হলোনা। নিষ্ঠুর সত্যি হল, ঘটনাটা বাস্তব ছিল। সত্যিই উনি আমাকেই এসব বলল। শোভা আপু ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আদ্রি? কী হয়েছে? বাচ্চা একটা মেয়েকে কী সব বলছো?’
আদ্রিয়ান ভাই আমার দিকে একপলক তাকালেন। আমার ছলছল দৃষ্টি দেখে চোখ সরিয়ে নিলেন। আচমকাই শব্দ করে হাসলেন উনি। শোভা আপুকে বললেন, ‘বাচ্চা? ওকে বাচ্চা মনে হচ্ছে তোর? কোন লেভেলের শেয়ানা জানিস? আর মেশেও সেরকম মেয়েদের সাথেই। নট অনলি দ্যাট! আমাকেও ওরকমই সস্তা মনে করে। উদার হস্তে আমার নাম্বার বিলি করে বেড়ায়। ভাবে দুনিয়াতে সবাই ওরই মতো।’
‘ আদ্রি..’
শোভা আপু কিছু বলতো হয়তো। আমি শোভা আপুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘যার মনে যা আছে সেটা বলে ফেলাই ভালো শোভা আপু। বলতে দাও। আমিও শুনি।’
তারপর ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আর কোন সার্টিফিকেট দেওয়ার আছে আপনার? থাকলে বলুন আমি অপেক্ষা করছি।’
আদ্রিয়ান ভাই একপলক তাকালেন আমার দিকে। সঙ্গেসঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিলেন। কিছু বললেন না। শোভা আপু অবাক চোখে আমাদের দুজনকে দেখছে। আমিও আর ওখানে না দাঁড়িয়ে ফিরে এলাম। চলে আসার আগে বলে এলাম, ‘একটা কথা ঠিক বলেছেন। প্রেমালাপের জন্যে ছাদ আসলেই আদর্শ জায়গা।’
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বুঝলাম টাল সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে আমার। এই মুহূর্তে নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হচ্ছে। নিজেকে সত্যিই সত্যিই ভীষণ সস্তা মনে হচ্ছে। রাগ, অভিযোগ, অভিমান, অপমান সবকিছু মিশ্রিত হয়ে সব অনুভূতিই ভোঁতা হয়ে গেছে। আদ্রিয়ান নামক মানুষটা আমায় এভাবে ছোট করতে পারে! কথাটা বিশ্বাস করতে গিয়ে আমার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তার মন গিরগিটির রঙের মতোই বদলেছে। না হলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তার মায়াবিনীকে এভাবে আ/ঘা/ত করতে পারতোনা। কখনও না। আ/ঘা/ত করাতো দূরের কথা। সেতো সমস্ত আ’ঘা’ত থেকে তার মায়াবিনীকে আগলে রাখতো। সেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হারিয়ে গেছে। সত্যিই হারিয়ে গেছে। বেশ! আজ থেকে উনিও আমার মধ্যে কেবল অনিমাকেই পাবেন। কেবল অনিমাকে। মায়াবিনীকে উনি আর খুঁজে পাবেন না। কোনদিন না।
…
[ বিশাল পর্ব দিয়েছি। মন্তব্যগুলোও বিশাল বিশাল লাগবে আমার ]