অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২০
মে মাসের মাঝামাঝি সময়। প্রচণ্ড গরমে সবার অবস্থাই নাজেহাল। কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠলাম। দুপুর বারোটার দিকে ঘুমিয়েছিলাম। আম্মু ডেকে তুলল কিছুক্ষণ আগে। আদ্রিয়ান ভাই পড়াতে আসবেন তাই। ঘুম কাটানোর জন্যে এক কাপ কফিও করে দিলেন। কফির মগটা হাতে নিয়ে দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিলাম। জানালার পাশে দাঁড়ালাম একটু বাতাসের আশায়। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম দখিনা বাতাস এখন পাওয়া যাবেনা। গাছের একটা পাতাও নড়ছেনা। সবকিছু কেমন স্হির শান্ত হয়ে আছে।
রবিবারের বিকেল। ভ্যাঁপসা গরম। কিছুদিন আগেই ঈদ গেল। লম্বা ছুটি কেটেছে। সবাই এখন নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আপি আর রায়হান ভাইও ফিরে গেছেন ঢাকায়। কিছুক্ষণ আগেই কথা বললাম আপির সাথে। প্রেগনেন্ট অবস্থায় প্রায় প্রতিদিন গিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ঢাকা ভার্সিটির ক্যাম্পাসে। বেশ প্রেশার যাচ্ছে মেয়েটার ওপর। আপিটা একদম পার্ফেক্ট। সংসার, প্রেগনেন্সি, পড়াশোনা সবকিছুই কত সুন্দরভাবে সমানতালে সামলে নিচ্ছে। আমার দ্বারা এসব একদমই হতোনা। সবকিছু ঘেঁটে ফেলতাম। না নিজের যত্ন নিজে করতে জানি, না প্রিয় জিনিসের আর না প্রিয় মানুষের।
চোখ পড়ল নিজের ফাঁকা বাঁ হাতটায়। ব্রেসলেটটার কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভীষণ প্রিয় ছিল ওটা আমার। তারচেয়েও বড় কথা, কারো খুব ভালোবেসে দেওয়া উপহার ছিল ওটা। আমার হাতে ওটার উপস্থিতি কোন একজনকে স্বস্তি দিতো। খুশি করতো। অথচ আমি সেটাকে যত্নে রাখতে পারিনি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা ভাবলাম। সেদিন রেগে বেরিয়ে গেলেন। এরপর নিয়ম করে আমাকে পড়িয়ে দিয়ে গেছেন ঠিকই। কিন্তু প্রয়োজনের বেশি একটা শব্দও উচ্চারণ করেন নি। মোট চারদিন এসেছিলেন। চারটে দিন এভাবেই কেটেছে। আমিও ওনাকে ঘাঁটাই নি। উনি রেগে থাকা অবস্থায় কেউ মানাতে গেলে আরও বেশি রেগে যান। তেঁতে ওঠেন একেবারে। তাই একটু শান্ত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। ভাবলাম আজ একটু কথা বলার চেষ্টা করে দেখব।
সেদিন নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে একটু দেরী করেই এলেন উনি। আজ নেভী ব্লু একটা পাঞ্জাবি পরে এসেছেন। সুঠাম, ফর্সা শরীরে মারাত্মকভাবে ফুটে উঠেছে রঙটা। সবকিছুই ওনার গায়ে কী চমৎকার ফিট হয়ে যায়। ভীষণ হিংসে হয় আমার।
বিগত চারদিনের মতো আজও গম্ভীরভাবে বসলেন নিজের চেয়ারে। আজকেও পড়ানোর সময় একটাও অপ্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার করলেন না। ধমকালেন না, রেগে গেলেন না, বকলেনও না। আমি অসহায় মানবী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কেবল ঘন ঘন তাকালাম তার দিকে। কিছু বলার সাহস হলোনা। সেটা নিয়ে তিনি কোনরকম ভ্রুক্ষেপও করলেন না।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আজান দেবে। আজকের মতো পড়া শেষ। উনি ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। অনেকটা সাহস সঞ্চার করে ওনাকে কিছু বলতে নিচ্ছিলাম। কিন্তু উনি ঝট করে উঠে হনহনে পায়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি বোকা বনে গেলাম ওনার ব্যবহারে। এটা কী হল! আমি কিছু বলব বুঝতে পেরেই এভাবে বেরিয়ে গেল?
যাওয়ার সময় ওনাকে জেঁকে ধরলেন আম্মু। গরম গরম পেঁয়াজু ভাজবে। চা আর পেঁয়াজু না খেয়ে যেতে দেবেন না কিছুতেই। প্রথমে নানান বাহানা দিয়ে আম্মুকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন উনি। কিন্তু আম্মু নাছোড়বান্দা। অবশেষে আম্মুর জেদের কাছে হার মানতে হলো ওনাকে। বললেন, বড় মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে তারপর আবার আসছেন। আম্মুও হাসিমুখে সম্মতি দিলেন। আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম সবটাই। উনি আবার আসছেন শুনে মনে মনে খুশিই হলাম।
আম্মুর কথা রাখতে নামাজ পড়ে ফিরে এলেন আদ্রিয়ান ভাই। সঙ্গে কাব্যও এলো। দুজনের কোথায় দেখা হয়েছে কে জানে? ওনাকে আর কাব্যকে চা আর পেঁয়াজু দিলেন আম্মু। দুজনে পাশাপাশি বসেছে। আমি বাঁ হাতে চায়ের কাপ আর ডানহাতে তিনটে পেঁয়াজু নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। আমি দরজায় হেলান দিয়ে খাচ্ছি আর দেখছি। এখন চেহারায় কোন গাম্ভীর্য নেই ওনার। কী সুন্দর প্রাণোচ্ছলভাবে হেসে হেসে কথা বলছেন। ঐ হাসি দেখে যুগের পর যুগ পার করে দেওয়া যায়। কথায় কথায় আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘মামণি, একটা কথা ছিল।’
আম্মু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সাগ্রহে বললেন, ‘হ্যাঁ বল?’
উনি ভদ্রতাসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, ‘আসলে আমি দুই সপ্তাহ আসতে পারব না। জানোতো, অক্টোবর থেকেতো কেমব্রিজে আমার রিসার্চ শুরু হবে। সেজন্যই একটু ঘাঁটাঘাঁটি, পড়াশোনা করছি। অনলাইনে ছোট্ট একটা কোর্স আছে। দু সপ্তাহের। সপ্তাহে একবার করে একটা পরীক্ষাও দিতে হবে। একটু বেশিই প্রেশার। এই দুই সপ্তাহ একটু বেশি পড়তে হবে। বের হতে পারব না।’
আম্মু বলল, ‘এটা আবার বলতে হয়? আগে নিজের পড়াশোনা। নিজের ক্ষতি করে ওকে পড়াতে আসতে হবেনা। তবে একটু বেশি করে পড়া দিয়ে রেখে যাস। না হলে সারাদিন ঘুমিয়ে আর ফোন টিপে কাটাবে।’
কাব্য সায় দিয়ে বলল, ‘একদম। পড়ার সাগরে ডুবিয়ে রেখে দিয়ে যাবে, আদ্রিয়ান ভাই। যাতে উঠতে না পারে। জানো সারাদিন ফোনটা হাতে নিয়ে রুমের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে। অটিস্টিক একটা!’
আমি আস্তো একটা পেঁয়াজু মুখে পুরে তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। ঘর শত্রু বিভীষণ বোধ হয় একেই বলে। আদ্রিয়ান ভাই মৃদু হেসে বললেন, ‘তুই পড়িস?’
কাব্য মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘রোজ।’
‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ। কথাটা ইংলিশে ট্রান্সলেট কর।’
কাব্য বোকার মতো তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে। আদ্রিয়ান ভাই ভ্রু নাচাল। কাব্য অসহায় গলায় বলল, ‘এটা ঠিক না আদ্রিয়ান ভাই। তুমি সাইন্সের ছাত্র। আর্টসের ছাত্রদের প্রশ্ন করবে কেন?’
উনি হেসে ফেললেন। আম্মু কাব্যকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘সেটা অন্যকে খোঁচানোর সময় মনে থাকেনা? নিজে পড়ে একেবারে বিদ্যার সাগর মহাসাগর পার করে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে পড়তে বসো। ফাঁকিবাজ।’
খাওয়া শেষে আদ্রিয়ান ভাই আবার এলেন আমার রুমে। এক্সট্রা পড়া দিতে। উনি চুপচাপ বই মার্ক করছেন। চোখ-মুখ আবার গম্ভীর হয়ে উঠেছে। এতো রাগ করার কী হল বুঝলাম না। আমি খানিকটা ইতস্তত করে বললাম, ‘কথা ছিল।’
‘কান খোলা আছে।’ বই মার্ক করতে করতে একগুঁয়ে কন্ঠে বললেন উনি।
‘আমি আসলে_’
কথাটা শেষ করার আগেই উনি বলে উঠলেন, ‘ডিফারেন্সিয়েশনের চ্যাপ্টারটা পুরো দিয়ে গেলাম। আমি এসে টেস্ট নেব। ভুল হয়না যেন।’
কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না। বইটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। আমি অবাক হওয়ার সময় পেলাম না। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম ইচ্ছে করেই আমার কথা শুনতে চাইছেনা। ফালতু এক্সপ্লেনেশন পছন্দ করেন না উনি। কিন্তু আমার এক্সপ্লেনেশন মোটেও ফালতু না। আমিতো সত্যিই ইচ্ছে করে হারাইনি। কোথায় কীভাবে ব্রেসলেটটা হারিয়ে গেলো নিজেই ঠিক করে বুঝতে পারছিনা। ভুল হয়ে গেছে। তাই বলে এতো বাজেভাবে এড়িয়ে যাওয়ার মানেটা কী? এখন দুটো সপ্তাহ ওনার দেখা পাবোনা। কান্না পেলো আমার। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ঢুকে মনটাকে ডাইভার্ট করার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।
এক সপ্তাহ পরের কথা। মে মাসের একুশ কিংবা বাইশ তারিখ বোধ হয়। এই এক সপ্তাহে আদ্রিয়ান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা বা কথা হয়নি আমার। আমি দু’বার কল করেছিলাম। উনি রিসিভ করেন নি। উল্টো কেটে দিয়েছেন। লোকটার রাগ ভয়ংকর। তার রাগ প্রকাশের ধরণ দু রকমে। হয় একদম চুপ হয়ে যাবেন, সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাবেন। নয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে জঘন্য খারাপ ব্যবহার করে কাঁদিয়ে ফেলবে সামনের মানুষটাকে।
এমনিতেই অতি প্রিয় ব্রেসলেটটা হারিয়ে ফেলায় মন ভেঙ্গে গেছে আমার। তারওপর ওনার কথা না বলা, রুক্ষ ব্যবহার। মানসিকভাবে অসুস্থবোধ করছি আমি। অপরাধবোধ কয়েকগুন বেড়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহে অবস্থাটা এরকম দাঁড়িয়েছিল যে মনে হচ্ছিলো ওনাকে একবার চোখের দেখা দেখলেই মন শান্ত হবে। ওনাকে নিজের অবস্থাটা বোঝাতে পারলেই সুস্থ বোধ করব আমি। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধে কোনভাবেই জিততে পারলাম না। ওনাকে মেসেজ করে ডাকলাম আমার অতি প্রিয় কাঠবাগানটাতে। উনি মেসেজ সিনও করেছিলেন। মেসেজে বিকেলে আসার কথা ছিল। আমি বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি পুকুরপাড়ে বসে বসে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু উনি এলেন না। এই কয়েকদিন কিছুটা দুঃখ আর অপরাধবোধে ভুগলেও সেদিন ভয়ানক কষ্ট পেলাম আমি। কষ্ট, অভিমান, রাগ, অপমানবোধের মিশ্র অনুভূতি হলো। ওনার এড়িয়ে যাওয়াতে কষ্ট হলেও, ওনার এভাবে অবহেলা করাতে অপমানিত বোধ করলাম। নিজেকে অনেকটা ছোট মনে হলো। বুক ভার হয়ে কান্না পেলো। হয়তো দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জনও দিলাম। উদাস দৃষ্টিতে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময়।
বাড়ি ফিরে আসতে আসতে অন্ধকার হয়ে এলো। বাড়ি ফিরতেই আম্মু প্রশ্ন করলেন, ‘এই সন্ধ্যাবেলা কোথায় ছিলে?’
‘কাঠবাগানে।’
আম্মু চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘সন্ধ্যার সময় বাগানে জঙ্গলে ঘুরতে বারণ করিনা আমি? কথা শোননা কেন অনি?’
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, ‘বাগানের সাথেই তো নানুবাড়ি আম্মু। কী হবে? চা করলে ঘরে পাঠিয়ে দিন একটু।’
আম্মু কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলেন। হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমার মন ভালো নেই। এই দিকটায় আমার আম্মু ভীষণ ভালো। যখন বুঝতে পারে আমার মেজাজ ঠিক নেই তখন অযথা আমাকে ঘাঁটায় না। সময় দেয় নিজের মতো করে সামলে ওঠার জন্যে।
সেদিন ঠিক করেছিলাম আমি আর যেচে কথা বলতে যাবোনা ওনার সাথে। ব্রেসলেটটা নিশ্চয়ই আমি ইচ্ছে করে হারাই নি। এই সামান্য একটা কারণে এতোটা বাড়াবাড়ি করার কোন মানে হয়না। সবসময় ওনার অকারণ রাগ, জেদ আমি কেন সহ্য করব? আমার কীসের দায়?
ঘটনা ঘটল তার পরের দিন। মানিক আঙ্কেল এসেছিলেন জাজিরা বাজার। আব্বু আর যেতে দেন নি। সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া আমাদের বাড়িতেই করলেন। খেতে খেতে মানিক আঙ্কেল বললেন, ‘জাবিনের জন্মদিন আগামীকাল। বায়না ধরেছে আজ রাত বারোটায় কেক কাটবে। আমি না করেছিলাম। পরে আদ্রিয়ান বলল শখ হয়েছে যখন কাটো। রাতে রান্নাবান্না হবে, ছেলে-মেয়েরা আনন্দ করবে। অনি-কাব্যকে নিয়ে যাই। অনেকদিন যায়না আমাদের বাড়ি।’
আব্বু বললেন, ‘ কাব্যকে বললে ও যাবে। আদ্রিয়ানের ভীষণ ভক্ত ও। সুযোগ পেলেই ছুট লাগায়। কিন্তু আমার মেয়েতো কোথাও যাওয়ার কথা হলেই নাক কুঁচকে ফেলে। অনি যাবে?’
মানিক আঙ্কেল বললেন, ‘আরে যাবে যাবে। আমি বলছিনা। যাবেতো আম্মু?’
আমি একটু ভেবে বললাম, ‘আচ্ছা।’
আম্মু বেশ অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার? আজ ভূতে পেয়েছে নাকি? তুমি ধমক না খেয়েই যাবে বলছো?’
অন্যসময় হলে হয়তো আমি যেতে চাইতাম না। কিন্তু সেদিন রাজি হয়ে গেলাম। কেন যেন মনে হল ওনার সাথে দেখা করাটা জরুরি। তখন রাগের মাথায় আর কথা বলব না চিন্তা করলেও একবার ব্যপারটা নিয়ে কথা বলার ঝোঁক সামলাতে পারলাম না।
বিকেলের পর আমাকে আর কাব্যকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন মানিক আঙ্কেল। সদরে গিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকতেই আমায় দেখে ভীষণ খুশি হলো জাবিন আর সারা। আমাদের নিয়ে আসার জন্যে মানিক আঙ্কেলকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালো। মেয়েদুটো অকারণেই আমাকে ভীষণ পছন্দ করে। আমি দুজনের গাল টেনে দিয়ে মুচকি হাসলাম।
মামণি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। দু বাহুতে হাত রেখে বললেন, ‘এতো শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন? খাওয়া-দাওয়া বেশি করে করতে হবেতো। ময়নাকে ফোন করে শাসাতে হবে দেখছি। আমার মেয়েটাকে ঠিকমতো যত্ন করছেনা। এতো সাহস কেন তার?’
আমি হেসে ফেললাম। ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘সুজি আছে বাড়িতে?’
মামণি বললেন, ‘হালুয়া খাবি?’
মামণি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বস। করে দিচ্ছি।’
‘এখন খাবোনা। রাতে খাবো। বানিয়ে ঠান্ডা করে ফ্রিজে রেখে দেবে। ঠান্ডা ঠান্ডা বেশ লাগে।’
মামণি হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
বসার ঘরে সবাইকে দেখতে পেলেও আদ্রিয়ান ভাইকে দেখতে পেলাম না। মামণী নাস্তা দিলেন। আমিতো চারদিকে শুধু ওনাকে খুঁজছিলাম। একটু পর যখন কফি, নাস্তা নিয়ে আন্টি ভেতরে গেল। তখন বুঝতে পারলাম সাহেব নিজের রুমে আছেন। নিশ্চয়ই বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। ভেতর থেকে ফিরে এসে মামণি সোফায় বসলেন। ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘এই ছেলে নিজেও অসুস্থ হবে। আমাকেও অসুস্থ করে দেবে। একটা সপ্তাহ যাবত সারটাদিন খালি বই আর কাজ। সেই রাত দুইটা তিনটায় এক ঘুম দিয়ে উঠে দেখি ওর ঘরের লাইট জ্বলছে। খাবারটাও রুমে দিয়ে আসতে হয়। কোন বেলা খায়, কোন বেলা যেমনটা তেমনই পড়ে থাকে। মাঝেমাঝে জোর করে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে আসি। এভাবে শরীর টেকে? ওর চিন্তায় আমি এবার অসুস্থ হয়ে যাব।’
মানিক আঙ্কেল বললেন, ‘এতো চিন্তা করছো কেন? ওতো বাচ্চা না। ছয় বছরতো লন্ডন একাই ছিলো। একা থেকেছে, একাই খেয়েছে। হয়তো পড়াশোনার চাপ বেশি এখন। রিসার্চটাতো মুখের কথা না। ওকেও তো একটু বুঝতে হবে আমাদের।’
মামণি হতাশ গলায় বলল, ‘ওখানেও এমনই অনিয়ম করে তাইনা?’
আঙ্কেল হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। জাবিন সকৌতুকে বলল, ‘এইজন্যই বলি ছেলের বিয়ে দিয়ে দাও। এবার বউ নিয়ে যাক। বউ পুরো টেক কেয়ার করবে তোমার আদরের খোকাকে।’
সারা ফিক করে হেসে ফেলল। আমিও হাসি চেপে বললাম, ‘ভুল বলেনি কিন্তু মামণি। তোমার টেনশনও শেষ। ওনারও একটা সঙ্গী হবে। সব দিক দিয়েই ভালো।’
‘মজা করিস না তো। বিয়ের কথা ওঠাতে কেমন সব ভেঙ্গে বাড়িঘর মাথায় তুলেছিল মনে আছে?’
সারা হাসিতে লুটোপুটি খেতে খেতে বলল, ‘আরেকটু হলেতো দাদাকেই আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিচ্ছিল, দা’ভাই।’
সেসব উদ্ভট ঘটনার কথা মনে করে সকলেই মন খুলে হাসল। আমারও হাসি পেল। সাথে সেইদিনগুলো আমার কেমন ভয়ংকরভাবে কেটেছিল সেটাও মনে পড়ল।
আটটার পর মামণী আর আঙ্কেল একসঙ্গে গেলেন ওনাদের ভাইয়ের বাড়ি। কাছেই বাসা। বারোটায় কেক কাটা হবে তাই ওনার ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবেন। হঠাৎই সব আয়োজন করায় আগে থেকে কাউকে বলা হয়নি। কাব্যর স্কুলের বন্ধু শিফাতের বাড়ি কাছেই। ও সেখানে গেছে। এরমধ্যে একবারের জন্যেও নিজের রুম থেকে বের হননি আদ্রিয়ান ভাই।
আমি,জাবিন আর সারা ঐসময় ছাদে চলে এলাম। টুকটাক গল্প করছি কিন্তু কথায় খুব একটা মনোযোগ দিতে পারছিনা আমি। আদ্রিয়ান ভাইয়ের সাথে কীকরে একটু কথা বলা যায় সেটাই ভাবছি। লোকটাতো রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। কী করছে এতো? অসহ্য! একটু ভাবতেই একটা উপায় খুঁজে পেলাম। জাবিন আর সারাকে ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে নিচে চলে এলাম। ওয়াশরুমে যাব তাই ওরাও আর কিছু বলেনি বা ভাবেনি।
আদ্রিয়ান ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছি। দরজা ভিড়িয়ে রাখা। ভেতরে কী করছে কে জানে? দু’বার টোকা দিলাম। কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেলোনা। বাধ্য হয়েই হালকা ফাঁক করে উঁকি দিলাম। নিজের টেবিলে বসে আছেন উনি। সামনে খোলা ল্যাপটপ, খাতা। বাঁ হাতে মাউস চালাচ্ছেন। আর ডান হাতে কিছু টুকছেন। আমি আস্তে করে ঢুকে গেলাম ভেতরে। কিন্তু ওনার কোনরকম হেলদোল নেই। আমার উপস্থিতি টের পান নি সেটা হতে পারেনা। আমার জানামতে ওনার ইন্দ্রিয় যথেষ্ট সজাগ। তবুও নিজের উপস্থিতি জানাতে হালকা করে গলা ঝাড়লাম। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হলোনা। উনি নিজের কাজে ব্যস্ত। আমি এবার একটু খুঁটিয়ে দেখলাম ওনাকে। কালো একটা স্যান্ডো গেঞ্জি, আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। বাড়িতে এ ধরনের পোশাক-ই বেশি পরেন উনি। চুলগুলো এলোমেলো, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছে, অযত্নে। আমার রাগ, অভিমান কোথাও হারিয়ে গেল। পড়ে রইল কেবল সেই দুঃখটুকু। আমি আস্তে করে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘শুনছেন?’
উনি অতি স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘হুম।’
কিন্তু আমার দিকে তাকালেন না। নিজের কাজও থামালেন না। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘কিছু বলার আছে।’
‘শুনছি।’ একই ভঙ্গিতে বললেন উনি।
আমি নিজের কন্ঠে খানিকটা অভিযোগ ঢেলে বললাম, ‘কাল কাঠবাগানে এলেন না কেন?’
‘সময় ছিলোনা।’
‘সেটা একবার বলা যেতো না?’
‘প্রয়োজন মনে করিনি।’
আমি বোকা বনে গেলাম। প্রয়োজন মনে করেনি! একটা মেয়ে বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি তার জন্যে অপেক্ষা করে বসে রইল আর সে প্রয়োজন মনে করেনি? আমি এতোটা তুচ্ছ তার কাছে। রাগে, অপমানে গা জ্বলে উঠল। জেদে কান্না পেল। নাক টেনে কান্নাটাকে রোধ করে বললাম, ‘ব্রেসলেটটা আমারও ভীষণ প্রিয় ছিল। সবসময় একপাক্ষিক চিন্তাভাবনা করবেন না।’
উনি জবাব দিলেন না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেও উত্তর পাওয়া গেলো না। আমি বললাম, ‘আমি আপনার সাথে কথা বলছি।’
উনি এবারেও নিরুত্তর। রেগে গেলাম আমি। অনেকটা জোরেই বললাম, ‘আ’ম টকিং টু ইউ।’
এতক্ষণে উনি তাকালেন আমার দিকে। রাগী কিন্তু নিচু গলায় বললেন, ‘আওয়াজ নিচে।’
আমি জেদ ধরে বললাম, ‘করব না আওয়াজ নিচে। কারণ আপনি আমার কথা শুনছেন না।’
উনি ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে ল্যাপটপটা বন্ধ করলেন। চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী চাই?’
আমি অবাক হলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘বুঝতে পারছেন না কী চাই?’
উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, ‘পারলে জিজ্ঞেস করতাম না।’
আমার মনে হলো আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। অস্হির গলায় বললাম, ‘সেদিনের পর থেকে ঠিকভাবে কথা বলছেন না। বাজেভাবে ইগনোর করছেন। এমন একটা ভাব করছেন যেন আমি কোন মহাপাপ করে ফেলেছি।’
উনি ওনার হাতের কলমটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘আমার সাথে এক্সট্রা কথা বলা কিংবা আমার এটেনশনের কোন প্রয়োজনীয়তা আছে তোমার?’
‘নেই? ডু ইউ থিংক সো?’
‘আই নো সো।’
আমি ‘হাহ্’ করে একটা শ্বাস ফেললাম। সারা ঘরময় একবার ঘুরে এলো আমার দৃষ্টি। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওনার বিছানার ওপর বসে পড়লাম। ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার মনে হচ্ছেনা আপনি ওভার রিঅ্যাক্ট করছেন?’
উনি বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আমি কোন রিঅ্যাক্টই করছিনা। প্রয়োজন নেই আসলে। আর কিছু?’
অনেকক্ষণ যাবত ওনার এরকম একগুঁয়ে উত্তর শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। আর ধৈর্য্যে কুলালো না। রাগে চোখে জল চলে এলো। উঠে দাঁড়িয়ে আবারও গলা চড়িয়ে বললাম, ‘আপনার কী মনে হয়? ব্রেসলেটটা খুলে রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছি আমি। নাকি কোন ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি। ফেলার হলে চরবছর আগেই ফেলতে পারতাম। কোথাও একটা ভুলে ফেলে এসেছি। এখন পাওয়া যাচ্ছেনা। এখন কী শূলে চড়াবেন আমায়? সামান্য একটা ব্যপার নিয়ে_’
আমাকে চমকে দিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন উনি। আমার বাঁ হাতের কনুই ধরে টেনে নিলেন নিজের কাছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘কিপ ইউর ভয়েজ ডাউন।’
আমি হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। এতক্ষণের শান্ত ভাবটা খসে পড়েছে ওনার চেহারা থেকে। উনি আমার কনুই আরও শক্ত করে ধরে বললেন, ‘ডাস্টবিনে ফেলার চেয়ে কম কিছু নয় এটা। এটা কানের দুল, চুলের ক্লিপ বা পায়েল না যে হুটহাট কোথাও খুলে পড়ে যাবে আর টের পাওয়া যাবেনা। আর এতোগুলো দিন যাবত হাতে পরে থাকা জিনিসটা হঠাৎই পড়ে গেলে বা কোথাও রাখলে যদি টেরই পাওয়া না যায় যে জিনিসটা হাতে নেই। তাহলে সেটার গুরুত্ব কতটা ছিল, তা বোঝার জন্যে ল্যাবে গিয়ে টেস্ট করতে হয়না। আর তারচেয়েও বড় কথা ইট’স নট জাস্ট এবাউট দ্য ব্রেসলেট। ইট’স_’
এইটুকু বলে থেমে গেলেন উনি। ঘাড় ঘুরিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেললেন। তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এন্ড ইউ নো হোয়াট? “হয়ে গেছে এখন কী করব” “সামান্য একটা ব্যপার” তোমার এ ধরনের এটিটিউডই বলে দিচ্ছে এতোকিছুর পরেও ইট ওয়াজ নট আ বিগ দিল টু ইউ। হোয়াটএভার। বলা আর শোনা শেষ? নাউ গেট লস্ট।’
বলে অনেকটা ধাক্কা দিয়েই ছেড়ে দিলেন উনি আমাকে। আমি নিজের কনুই ধরে কেঁদে ফেললাম। ভাঙা গলায় বললাম, ‘সত্যিই আমি_’
উনি ধমক মেরে বললেন, ‘অনি! পড়া আছে আমার। ব্যস্ত আছি। এখন আর কিছু শোনার নেই। গেট আউট!’
আমি আবার কিছু বলতে নিলে উনি আমার দিকে তেড়ে এলেন। ভয় পেয়ে গেলাম আমি। আমার হাতের বাহু ধরে টেনে দরজার কাছে নিয়ে এলেন উনি। ঠেলে বের করে দিলেন রুম থেকে। মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করার সময় খেয়াল করলেন না-কি করলেন না যে আমার বাঁ হাতের আঙুলগুলো দরজার ফাঁকে রাখা আছে। ভাগ্যক্রমে সময়মতো হাতটা সরিয়ে নিয়েছিলাম বলে আঙুলগুলো থেতলে যায়নি। কিন্তু যেটুকু চাপ পড়েছে তাতে কে’টে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারেনি। তিনটে আঙুল কে’টে গেল। মাঝের আঙুলটা বেশ ভালোভাবেই কে’টেছে। ডান হাত দিয়ে আঙুলগুলো চেপে ধরে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিলাম। কিন্তু কাঁদলাম না। নীরবে হেঁটে চলে গেলাম। বেসিনের কল ছেড়ে আঙুলের র’ক্তগুলো পরিস্কার করতে করতে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালাম। তখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না আমি। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম। নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে। আর কখনও যাবোনা আমি ওনার সাথে কথা বলতে। ওনার সামনেও আর পড়তে চাইনা আমি। এমন জঘন্য একটা মানুষের কোন প্রয়োজন নেই আমার। একদমই না।
.
.
.
[ পর্বটা দুই পার্টে দেব ভেবেছিলাম।পরে ভাবলাম অতো ঝামেলা না করে এক পার্টেই দেই। হ্যাপি রিডিং।]