অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২১
ঈদ চলে গেছে। কাজিনরাও সব ঢাকা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ভার্সিটি, অফিস সব শুরু হয়ে যাবে শীঘ্রই। সব ঝামেলা চুকে যাওয়ায় ভাবলাম আবার আগের রুটিনে ব্যাক করব। রাত জেগে ফোন ঘাটা, বেলা অবধি পড়ে পড়ে ঘুমানো, আর খাওয়া। বাকি সময়টা কী করি নিজেও জানিনা। তবে মাস দু-এক হলো রুটিনে নতুন কাজ যুক্ত হয়েছে। সপ্তাহে তিনটে দিন বিকেল বেলা বাড়ি এসে হানা দেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। উদ্দেশ্য আমাকে পড়ানো। আব্বু নিজ দায়িত্বে এই গুরুদায়িত্ব তুলে দিয়েছেন তার হাতে। আর স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে আমার কোন বিরোধ খাটেনি।
সবে কালকেই ঈদ গেল। তাই দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য ছিল নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেব। শান্তির একটা ঘুমও নেমে এসছিল আমার চোখে। কিন্তু ঐ যে বলেছিলাম, আমার সকল শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করতে একজন মানুষ সদা প্রস্তুত থাকেন। সেদিনও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা খেয়ে ঝট করে উঠে বসলাম। আমার বোকা দৃষ্টি পুরো ঘরজুড়ে ঘুরে এসে স্হির হলো ঠিক সামনে দাঁড়ানো সুঠাম দেহী লোকটার দিকে। ওনার বা হাতে আমার নীল রঙের মামপট। বোঝাই যাচ্ছে ওখান থেকেই পানি নিয়ে ছিটিয়েছে আমার মুখে। রাগে, দুঃখে গা জ্বলে উঠল আমার। ইচ্ছে করল ঐ মামপট-টাই ওনার মাথায় মা’রি। ওনার মাথা ভাঙবে নাকি মামপট সেটা পরের বিষয়। ওনার মাথায় মারতে পারাটাই মুখ্য। কিন্তু আমার রাগকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উনি চেয়ারে বসলেন। নিজের ফোনে কিছু দেখতে দেখতে বললেন, ‘হা করে আমার চেহারা না গিলে চোখে-মুখে পানি দিয়ে আয়। ঈদের বাহানায় অনেক চিল-ফিল হয়েছে। নাও গেট ব্যাক টু ওয়ার্ক।’
আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। মনে মনে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করতে ভুললাম না। এই লোকটার মে মাসেই ইউকে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। সেটা পিছিয়ে কেন কোরবানির পর করল খোদা জানেন। তাও কত পরে যাবে কে জানে? গেলেই বাঁচি! এসব উদ্ভট কথা ভাবতে ভাবতেও ফ্রেশ হয়ে এলাম।
টানা দেড় ঘন্টা পড়ার পর আমার ঘাড়ে টনটনে ব্যথা শুরু হলো। চোখ-মুখে অন্ধকার দেখছি। মনে হচ্ছে আর একটা লাইন পড়তে হলেই নির্ঘাত মারা যাবো। কিন্তু আদ্রিয়ান ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে আরও দু-তিন ঘন্টা আরামছে পড়িয়ে দিতে পারবেন তিনি। কোন সমস্যা নেই। তার সামন্য দয়া পাওয়ার আশায় যতটা না ক্লান্ত, তারচেয়েও বেশি ক্লান্ত হওয়ার ভান করলাম। কিন্তু কোন লাভ হলোনা। উনি আমার অসহায় চাহনী, গোমড়া মুখ দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছেন। ওনার পাত্তা না দেওয়াটা যেন ব্যঙ্গ করে বলছে ‘ড্রামাকুইন’।
সেই সময় ওনার জন্যে চা নাস্তা নিয়ে এলেন আম্মু। আম্মুকে দেখে আদ্রিয়ান ভাই মুচকি হাসলেন। আম্মুও হাসিমুখে টেবিলে চা-নাস্তা রেখে বললেন, ‘আদ্রি, কাল জাজিরা আসবি তুই?’
‘কেন? কোন কাজ আছে?’
‘না। কালকে হিয়ার শ্বশুরবাড়ি যাবে অনি। পরশু আসতে আসতে বিকেল হবে। তুইতো রবি, মঙ্গল আর বৃহস্পতিবার আসিস। পরশুতো বৃহস্পতিবার। ঐদিন ও থাকবেনা। পারলে কাল সকালে একবার ঘুরে যাস। জানিস-ই তো কেমন ফাঁকিবাজ। একটু সুযোগ পেলেই মাথায় চড়ে বসে।’
আমার তখন ইচ্ছে হলো নিজেই নিজের মাথাটা টেবিলে ঠুকে দেই। কেন ভাই? একটা দিন পড়া মিস গেলে কী হতো? বলি হতোটা কী? পৃথিবী ঘোরা বন্ধ করে দিতো? নাকি সাগরের সব পানি শুকিয়ে যেতো? সবকিছুতেই বেশি বেশি। তবে প্রচন্ড গরমে দমকা হাওয়ার মতো শান্তি দিয়ে আদ্রিয়ান ভাই বলে উঠলেন, ‘কাল সকালে তো হবেনা মামণি। একটু কাজ আছে।’
আম্মু বললেন, ‘আচ্ছা, কাজ থাকলে আসতে হবেনা।’
বলে আম্মু চলে গেলেন। উফ, শান্তি! কিন্তু ঐ যে বললাম আমার সব শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করতে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জুড়ি নেই। সেই ধারাকে অব্যাহত রেখে উনি বললেন, ‘শুক্রবার ফ্রি আছি। ঐ দিন বিকেলে এসে পড়িয়ে দিয়ে যাব।’
ঠিক কাঁচের গ্লাস ভাঙার মতো করুণ শব্দ করে ভেঙ্গে গেল আমার কচি মনটা। ফাটা বেলুনের মতো চুপসানো মুখ নিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম। উনি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ ঐ বাড়ি যেতে হবে কেন?’
‘আপি বলল নিয়ে যাবে। প্রথমে যেতে চাইনি। রায়হান ভাই আর আপি দুজনেই জোর করল তাই_’
উনি কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। গম্ভীর মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চোখের ইশারায় পড়তে বললেন। আমি তাই করলাম।
পরেরদিন বিকেলবেলা আপির শ্বশুরবাড়ি পৌঁছলাম। রায়হান ভাই এসে নিয়ে গিয়েছিল। ঐ বাড়ির সবাই ভীষণ ভালো আর আন্তরিক। যাওয়ার পর থেকেই আদর-যত্নের কোন ত্রুটি রাখেনি। কী খাবো, কোথায় থাকব, কী লাগবে সবদিকেই বিশেষ দৃষ্টি। ঘন্টায় ঘন্টায় এসে জিজ্ঞেস করছে কিছু খাবো কি-না, কিছু লাগবে কি-না। সব জায়গাতেই একটা স্পেশাল ট্রিটমেন্ট পাওয়ার অভ্যেস আমার বরাবরই ছিল। কিন্তু ওখানে সবাই অপরিচিত হওয়াতে একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো। সন্ধ্যায় রায়হান ভাই পিৎজা, বার্গার নিয়ে এলো আমাদের জন্যে। আপির দেবর, ননদদের সঙ্গে আগেও ভালোই আলাপ ছিলো। তবে আলাদাভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়ে সহজেই মিশে গেলাম তাদের সাথে। বসে আড্ডা দিলাম। ওখানে আমি সবার ছোট। বাকি সবাই প্রায় সমবয়সী। আর সমবয়সী ভাই বোনেরা একসঙ্গে হলে আড্ডা জমজমাট হবে সেটাই স্বাভাবিক।
রাত তখন নয়টা বাজে। ছাদে বসে বসে টুকটাক গল্প করছি রায়হান ভাইয়ার ভাই বোনদের সাথে। রায়হান ভাইয়াও এখানেই ছিলেন। আপির ফোন আসায় নিচে চলে গেছেন একটু আগে। আমার একপাশে বসে ছিল আপির এক ননদ। নাম দোলা। কথায় কথায় এক পর্যায়ে দোলা আপু আস্তে করে বলল, ‘অনিমা? ভাবির বিয়ের দিন কালো পাঞ্জাবী পরা একটা ছেলে ছিল। ছেলেটা তোমার কাজিন হয়?’
সেদিন কালো পাঞ্জাবী তিনজন পরেছিল। সোহেল ভাই, অর্ণব ভাইয়া আর আদ্রিয়ান ভাই। কিন্তু আমি বুঝলাম কার কথা বলছে। এমন গদগদ হয়ে একজনের কথাই জিজ্ঞেস করতে পারে। তবুও বললাম, ‘কালো পাঞ্জাবী তো তিনজন পরেছিল। কার কথা বলছো?’
দোলা আপু একটু ভেবে বললেন, ‘ঐযে কালোর মধ্যে গোল্ডেন ডিজাইন করা পাঞ্জাবী। লম্বা করে ছেলেটা।’
ঠিক জানতাম! বললাম, ‘অহ! আদ্রিয়ান ভাই? না, কাজিন না। তবে পরিচিত। কেনো বলোতো?’
দোলা আপু একটু লাজুক হাসল। ইতস্তত করে বলল, ‘ওনার নাম্বারটা দেওয়া যাবে?’
বাহ! ওনার? আবার নাম্বারও! এতো দূর! এদের দেখে মনে হয় দুনিয়া অনেক আগে এগিয়ে গেছে। আমিই পেছনে পড়ে আছি। আমি দেঁতো হেসে বললাম, ‘অফ কোর্স! কেন না? এখনই দিচ্ছি।’
খুশি মনেই নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। আর বারবার করে বলে দিলাম ওনাকে যাতে না বলে নাম্বারটা কোথায় পেল। তারপর এই মেয়ে ওনাকে কীভাবে জ্বালাবে চিন্তা করেই মনে মনে হাসিতে লুটোপুটি খেলাম।
কিন্তু তারসাথে আরেকটা বিষয় ভাবলাম। ইদানিং আনভীর ভাইয়ার আচার আচরণ দেখে আমার কিছু একটা মনে হচ্ছে। ওনার সাথে কথা বলতে হবে এ বিষয়ে। আমি চাইনা কোন বিষয় কম্প্লিকেটেড থাক।
কিন্তু আমাকে আলাদা কথা বলার সুযোগ বের করতে হলোনা। আনভীর ভাইয়া নিজেই কথা আছে বলে একটু আলাদা ডেকে নিলেন আমায়। একটু স্বস্তি পেলাম। আমাকে আর খুঁজতে হবেনা। এখনই বলে দিতে পারব যা বলার। ছাদের রেলিং এর কাছে গিয়ে আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, ‘কিছু বলবেন ভাইয়া?’
উনি খানিকটা ইতস্তত করে চারপাশে তাকালেন। আমিও তাকিয়ে দেখলাম ওনার বোনেরা মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে এদিকে। আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। উনি বললেন, ‘তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল আমার।’
আমি অনুমান করতে পারলাম উনি ঠিক কী বলতে চান। তাই বললাম, ‘আমারও।’
উনি একটু অবাকই হলেন। আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো?’
‘আগে আপনার কথা শুনে নেই।’
উনি আবার খানিকটা ইতস্তত করলেন। বুঝলাম যা বলতে চান সেটা যে মোটেও সহজ কিছু নয়। সে সম্পর্কে তিনি অবগত। আমি তাড়া দিলাম না। সময় দিলাম তার কথা গুছিয়ে নেওয়ার। কিছুটা সময় পর আনভীর ভাইয়া এক নিঃশ্বাসে বললেন, ‘অনি, আই থিংক আই লাইক ইউ।’
আমি অবাক হলাম না। চমকালাম না। খুবই স্বাভাবিকভাবে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। উল্টে আমার এরকম স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখে আনভীর ভাইয়াই চমকে উঠলেন। ইতস্তত করে বললেন, ‘আমি সিরিয়াস অনি। লাইক মানে কী ধরনের লাইকের কথা বলছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?’
আমি সহজভাবেই বললাম, ‘পারছি।’
‘কিছু বলবেনা?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন আনভীর ভাইয়া।
আমি এবার সরাসরি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী বলব সেটা ডিপেন্ড করছে আপনি কেন আমাকে এসব বলছেন তার ওপর। শুধুই জানিয়ে দিচ্ছেন আপনি আমাকে পছন্দ করেন। নাকি এটা চাইছেন আমি সেটাতে সায় দিয়ে আপনার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কে জড়াই। যদি শুধুই জানিয়ে দিয়ে থাকেন তাহলে বলব, জানলাম। আর যদি সেরকম কিছু আশা করে থাকেন তাহলে বলব, সরি ভাইয়া। আমার পক্ষে আপনি যা চাইছেন তা সম্ভব নয়।’
খেয়াল করলাম ওনার চেহারা অনেকটা গম্ভীর হয়ে গেল। কিন্তু তাতে আমার কিছু করার নেই। উনি শান্ত গলায় বললেন, ‘কারণটা জানতে পারি?’
‘আমি জানি, সুন্দরী বলতে যা বোঝায় আমি তা নই। চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া রূপ আমার নেই। আর আহামরি কোন গুণও আমার মধ্যে নেই। বাড়ির সকলের অতি আদরে বিগড়ে যাওয়া একটা মেয়ে বলতে পারেন। কিন্তু মেয়েতো! আর একটা মেয়ে খুব সহজেই বুঝে ফেলে কোন ছেলেটা তাকে কী নজরে দেখছে। এটা সিনেমা নয় যে একটা ছেলে আমাকে মনে মনে পছন্দ করে যাবে কিন্তু আমি টেরই পাবোনা। আপনার সঙ্গে যে কদিনই দেখা হয়েছে তাতে আপনার মনে কী চলছে বুঝতে আমার বেশি সময় লাগেনি। আপনি না বললেও এ বিষয়ে আমি নিজেই কথা বলতাম আপনার সাথে। বলে দিতাম, এসব আর না ভাবতে। সম্ভব নয়। কারণ আমি আপনাকে সে নজরে দেখিনা। আর না দেখব।’
আমার কথাগুলো শুনে আনভীর ভাইয়া বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, ‘দেখো, আমি এটা বলবোনা তুমি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। কথাটা সত্যি নয়। তবে তুমি সুন্দরী। বিশেষকরে তোমার চোখদুটো। গালে পড়া টোল। এগুলো তোমাকে কতটা স্পেশাল করে তোলে তুমি নিজেও জানোনা। আর তুমি যা সেটার জন্যেই পছন্দ করি আমি তোমাকে। কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণটা কী আদ্রিয়ান?’
আমি চট করে একবার তাকালাম আনভীর ভাইয়ার দিকে। তারপর মৃদু হেসে বললাম, ‘না, উনি আমার জীবনে না থাকলেও আমার উত্তর বদলাতো না। আর ওনার সঙ্গে আমি কোন রিলেশশীপেও নেই। যদি আপনি সেরকম কিছু ভেবে থাকেন তাহলে ভুল ভাবছেন।’
‘ভালোবাসো ওকে?’
আমার হাসি প্রসারিত হলো। রেলিং এ দু হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে বললাম, ‘ভালোবাসা এতো সহজ নয় ভাইয়া। এতো সহজেই কাউকে ভালোবাসি বলে দাবী করতে পারব না আমি। আমি ওনাকে ভালোবাসিনা। কিন্তু অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারব না। আমি ওনাকে নিজের করে রাখতে চাইনা। কিন্তু নিজেকে অন্যকারো হতে দিতে পারব না। ওনার কাছ থেকে আমার কিছু চাওয়ার নেই। পাওয়ারও নেই। আপনিই বলুন। এটাকে ভালোবাসা বলা যায়?’
কিছুক্ষণ কোন উত্তর এলোনা। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই উনি বললেন, ‘অদ্ভুত মেয়ে তুমি অনিমা! এমন মেয়ে সত্যিই খুব কম দেখেছি আমি। নটরডেমে যখন আদ্রিয়ানের সঙ্গে আলাপ ছিল, সবসময় খেয়াল করতাম ও ওপরের চাকচিক্য দেখতো না। লাইব্রেরীতে গিয়ে যেখানে আমরা চকচকে নতুন বই তুলতাম। সেখানে ও কোন বইটা বেশি কাজে লাগবে সেটাই আগে দেখতো। আর আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেলো, ওর নজর সবসময় খাঁটি জিনিসের ওপরই পড়ে।’
আমার আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। আমি তাকালাম দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওনার বোনেদের দিকে। ফিসফিসিয়ে কথা বলছে, হাসছে। আমি বললাম, ‘ওনারা নিশ্চয়ই জানে আপনি আমাকে কী বলছেন? নিশ্চয়ই বলেছেন ওনাদের? আশা করি আমার উত্তরটাও বলবেন। কাউকে ভালোলাগা, ভালোলাগলে প্রপোজ করাটা যেমন স্বাভাবিক। রিজেকশনটাও সেরকমই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক তারাই যারা প্রপোজ করাটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে, কিন্তু রিজেক্ট করাটাকে না। আমি নিচে যাচ্ছি।’
কথাটা বলে কোনদিকে না তাকিয়েই চুপচাপ নিচে চলে এলাম। ভেতরটা হালকা লাগছে এখন। একটা বড় ঝামেলা ঘাড় থেকে নামাতে পারলাম। সেদিন আর বিশেষ কিছু ঘটল না। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই কাটল।
পরেরদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হলো। গরমে ঘেমে শরীর আঠালো হয়ে গেছে তাই গোসল করলাম। বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখ লেগে এলো। ঘন্টা দুই এর মতো ঘুমোলাম বোধ হয়। আগামীকাল আবার ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মাষ্টারগিরি করতে আসবেন। তাই পড়াটা একটু হলেও গুছিয়ে রাখা উচিত। রামধমক থেকে বাঁচার জন্যে। হাতমুখ ধুতে গিয়েই একটা জিনিস মাথায় আসতে চমকে উঠলাম আমি। আমার হাত ফাঁকা। হ্যাঁ! আমার হাতে ব্রেসলেট টা নেই। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল আমার। কিন্তু মনে হল গোসলের সময় হয়তো খুলে রেখেছিলাম। আর পরা হয়নি। তাই রুমে গিয়ে প্রথমে ড্রেসিংটেবিলটা খুঁজলাম, টেবিল খুঁজলাম, বালিশ সরিয়ে গোটা বিছানা খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। বাথরুমে গিয়েও চেক করলাম। সারা শরীর ঘেমে উঠল আমার। বিছানায় বসে কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। কোথায় গেল ব্রেসলেটটা? ঐ বাড়িতে ফেলে এসেছি? দ্রুত ফোনটা চার্জ থেকে খুলে আপির নাম্বারে কল করলাম। আপি রিসিভ করে বলল, ‘কীরে কী হয়েছে?’
‘আপি। তোমাদের বাড়িতে আমার একটা ব্রেসলেট ফেলে এসেছি বোধ হয়। একটু খুঁজে দেখবে প্লিজ।’
নিজের কাছেই নিজের কন্ঠটা কেমন লাগল। মনে হলো এক্ষুনি কেঁদে ফেলব। আপি বলল, ‘আচ্ছা। আমি দেখছি। ফেলে গেলে এখানেই থাকবে। কোথায় আর যাবে? তুই কাঁদছিস নাকি?’
‘না। কাঁদব কেন? তুমি তাড়াতাড়ি দেখে আমাকে একটু জানাও প্লিজ। আর্জেন্ট।’
এরপর শুরু হলো অপেক্ষা। ঘরে চুপচাপ বসে থাকলেও মনের মধ্যে একপ্রকার যুদ্ধ চলল আমার। দীর্ঘ দুই ঘন্টা পরে আপির কল এলো। আমি সাথেসাথেই রিসিভ করলাম। মনে হলো আপি বলবে, পেয়েছি। কাল তোর ভাইয়াকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আমাকে হতাশ করে আপি বলল, ‘কোথাও তো পেলাম না রে। মনে হয় এখানে নেই। তবুও আমি কাল আরও একবার খুঁজে দেখব সব জায়গা। তুই ঠিক করে সব চেক কর।’
আমি কিছু না বলে ফোনটা রেখে দিলাম। ভীষণ কান্না পেল আমার। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কাঁদতেও পারলাম না। পাবোনা জেনেও আরও একবার খুঁজলাম গোটা রুম। রুমের বাইরেও খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না। শেষে রাগে-কষ্টে সারা রুম এলোমেলো করে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লাম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো খুব। মনে পড়ল কাঠবাগানের সেই সকালের কথা। সেদিন প্রথম ওনার ঠোঁটের স্পর্শ লেগেছিল আমার কপালে। ওনার গালে লেগে থাকা হলুদ আমার গালে লেগেছিল। ওনার দেওয়া প্রথম উপহার ছিল ঐ ব্রেসলেট।
আম্মু খেতে ডাকতে এসে আমার অগোছালো রুম দেখে অবাখ হলো। আমার চোখমুখ দেখে বললেন, ‘কী হয়েছে? বিকেলবেলাই ঘর গুছিয়েছি। সব এলোমেলো করেছো কেন? কেঁদেছো নাকি?’
আমি নিজেকে স্বাভাবিক করলাম। একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললাম, ‘সরি। একটা কাগজ পাচ্ছিলাম না। সেটা খুঁজতে গিয়েই_। আমি গুছিয়ে নেব।’
‘তুমি খেতে যাও। আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।’
‘আমি খাবোনা আম্মু। রুচি নেই। আপনারা খেয়ে নিন। একটু ঘুমাবো এখন।’
আম্মু এসে আমার মাথায় হাত রেখে জ্বর চেক করলেন। কিন্তু স্বাভাবিক দেখে আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন। আমি দরজা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম বিছানায়। কাঁদছি না। কিন্তু চোখ জ্বলছে, বুকের মধ্যে কেমন ভার হয়ে আছে। এভাবে হারিয়ে ফেললাম জিনিসটা!
সেদিনরাতে ঠিকভাবে ঘুম হলোনা। ঘুমোলাম সকালবেলা। স্বাভাবিকভাবেই উঠতে উঠতে দুপুর হলো। শুক্রবার তাই আম্মু বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু ওভাবে ঘুমোতে দেখে আর ডাকেনি আমাকে। উঠে গোসল করে, খেয়ে নিলাম। আম্মু বললেন, আদ্রিয়ান ভাই আসবে পড়াতে। এখন আর না ঘুমোতে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম বিছানায়। অযথাই ফোন স্ক্রোল করলাম। ভালো লাগছিল না কিছু। চাপা মন খারাপে সবকিছুই প্রাণহীন লাগছিল।
যথাসময়ে আদ্রিয়ান ভাই এলেন পড়াতে। আজ সাদা একটা টিশার্ট আর নীল জিন্স পরে এসেছেন। আমি পরতে বসলেও একবারও ভালোভাবে তাকালাম না তার দিকে।তবে খেয়াল করলাম উনি বারবার আমার বাঁ হাতটার দিকে তাকাচ্ছেন। ইতিমধ্যে চোখ দিয়ে একবার ড্রেসিং টেবিল আর টেবিলেও চোখ বুলিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু যা খুঁজছেন সেটা যে পাবেন না।
ফিজিক্স, ইংলিশের পর উনি হাইয়ার ম্যাথে হাত দিলেন। কয়েকটা ম্যাথ মার্ক করে করতে দিলেন আমাকে। আমি চুপচাপ তিনটা করলাম। চতুর্থটা করতে গিয়ে থেমে গেলাম। ওটা পারব না। তাই তাকালাম ওনার দিকে। যখন করতে পারিনা এটাই করি আমি। আর উনি চুপচাপ খাতাটা নিজের দিকে নিয়ে, করে দেন। তারপর বোঝান। সেদিনও তাই করলেন। চুপচাপ খাতাটা নিজের দিকে নিয়ে করতে শুরু করলেন। করার এক ফাঁকে হালকা আওয়াজে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্রেসলেটটা কই?’
বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। অস্হির লাগল ভীষণ। হাতের তালু ঘেমে গেছে ইতিমধ্যে। ওনার হাত চললেও কান খাড়া করে রেখেছেন আমার উত্তর শোনার জন্যে। আমি একটা ঢোক গিলে নিচু গলায় বললাম, ‘হারিয়ে ফেলেছি।’
কলম থেমে গেল। চোয়াল শক্ত করে খাতার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। হঠাৎই আমার সামনে খাতাটা জোরে শব্দ করে রেখে ধমকে উঠলেন উনি। ওনার আচমকা আক্রমণে আমি চমকে উঠলাম। উনি ধমকের সুরেই বললেন, ‘একই ধরনের ম্যাথ কতবার করাতে হয়? গতদিন এই টাইপেরই কতগুলো ম্যাথ করিয়েছি হ্যাঁ? বাড়িতে ধরে দেখেছিলি এগুলো? সারাদিন লাফালাফি, নাচানাচি! পড়তে ইচ্ছে না করলে বলে দে। আমার সময়ের দাম আছে। সপ্তাহে তিনটা দিন দেড় দুই ঘন্টা করে পানিতে ফেলব না আর। এখানে সার্কাস দেখাতে আসিনা আমি। সবকিছু সবার জন্যে নয়।’
শেষের বাক্যটা বিশেষ জোর দিয়ে বললেন উনি। অপমানে কান গরম হয়ে উঠল আমার। ভেতরটা জ্বলে উঠল। ওনার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলোনা। উনি শব্দ করেই উঠে দাঁড়ালেন। আর একটাও কথা না বলে হনহনে পায়ে চলে গেলেন। আমি ওখানেই বসে রইলাম। কারো আসার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত চোখ মুছে ফেললাম। আম্মু ঘরে ঢুকলেন দ্রুতপায়ে। একবার বাইরে তাকিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে? ছেলেটা ওমন রেগে চলে গেল কেন? পড়া কম্প্লিট করোনি নাকি?’
বলতে বলতে আম্মু আমার কাছে চলে এলো। আমি কিছু না বলে চুপচাপ আম্মুর পেট জড়িয়ে ধরলাম। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা হয়েছে। মন খারাপ করেনা। আমি আদ্রিকে বলে দেব যাতে বকাবকি কম করে। আর তুমিও একটু পড়াশোনা করো।’
আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম। আমার মাথায় শুধু ওনার বলে যাওয়া একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘সবকিছু সবার জন্যে নয়।’
…
[ রি-চেইক করিনি। এটা গতকালকে দেব ভেবেছিলাম। সন্ধ্যায় লিখতেও বসেছিলাম। কিন্তু লিখতে লিখতে হঠাৎ মুড সুইং হলো। ভাবলাম একটা ঘুম দিয়ে উঠে তারপর লিখব। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখি বারোটা বাজে প্রায়। জনমের শিক্ষা হয়েছে! লিখতে বসে আর ঘুমাবো না। নো! নেভার! নাক্কো!]