অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২৩
রমজানের ইফতার পার্টির সন্ধ্যাগুলোর মতো মজাদার সন্ধ্যা হয়না। সকলে মিলে গল্প, আনন্দ, হাসি-মজা। সারাদিনের ক্লান্তি ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনা। গতকাল মানিক আঙ্কেলদের বাড়িতে ইফতার খাওয়ার পর আজ নানাবাড়িতে ইফতার পার্টির আয়োজন করা হলো। তবে এবারের ঈদটাই আমার জন্যে খুব স্পেশাল। আত্মীয় স্বজন সকলেই এবার শরীয়তপুর আছেন। সকলের সঙ্গে হৈ হৈ করে ঈদ উদযাপন করা যাবে। আজ রায়হান ভাইয়াও এসেছে। আপিকে নিয়ে যেতে। কাল আপিকে নিয়ে চলে যাবে তার শ্বশুরবাড়ি। তাই আজ, কদরের দিনেই আয়োজন করা হল। আপি প্রেগনেন্ট তাই এখন মামাবাড়িতেই থাকে। শুধু মাস্টার্সের পরীক্ষাগুলো দিতেই ঢাকা যায় মাঝেমাঝে।
বড় মামার আমন্ত্রণে মানিক আঙ্কেলও এসছেন। একা আসেন নি। সঙ্গে জাবিন, সারাকেও নিয়ে এসছেন। রিমা আন্টি আসতে পারেন নি। উনি ওনার ভাইয়ের বাড়িতে আছেন আজ। আর ওরা সবাই এসছে মানে আরেকজনের আসাটাতো নিশ্চিত ছিল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা বলছি।
বিকেলের দিকে আমি একটু আমার বাড়ি এসেছিলাম। ইফতারের আধঘন্টা আগে আবার মামাবাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ভেবেছিলাম গিয়ে দেখব সবাই চলে এসছে। কিন্তু সবাইকে দেখতে পেলেও তার দেখা পেলাম না।
পনেরো মিনিট আগে সবাই বসে পড়লাম ইফতারের উদ্দেশ্যে। আমি শুধু আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছি। কিন্তু ওনার দেখা নেই। কেউ তুলছেও না ওনার কথা। তাহলে উনি কী আসবেন না? অন্যকোথাও দাওয়াত আছে? কথাটা চিন্তা করতেই মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। আমাকে এভাবে চারপাশে তাকাতে দেখে আপি বলল, ‘কাউকে খুঁজছো?’
আমি মৃদু চমকে আপির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। এরপর হিমুর সাথে হাতে হাতে দুষ্টুমি করায় ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। চিমটি কাটা, খোঁচা মারা ইত্যাদি চলছেই। আরও পাঁচমিনিট কেটে গেল। হঠাৎই এক হাতে চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে এসে উপস্থিত হলেন আদ্রিয়ান ভাই। আমি থমকে গেলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। পাঞ্জাবি, চুল হালকা ভিজে গেছে। সারামুখে বিন্দু বিন্দু পানি। অপর হাতে কীসের একটা প্যাকেট। মজার ব্যপার হলো, এরকম উদ্ভট অবস্থাতেও তাকে ভয়ানক সুন্দর লাগছে। বড় মামা তার ভারী কন্ঠে বললেন, ‘আরে! দেখলে আবহাওয়া খারাপ একটা ছাতা নিয়ে যাবেনা? ভিজে গেছো। বললাম তোমাকে এগুলো আনার দরকার নেই। এই, তোয়ালে দাও ওকে কেউ।’
ছোট মামি উঠে ওনার হাত থেকে প্যাকেটটা নিলেন। আর আম্মু তোয়ালে এনে দিলেন। ছোটমামি প্যাকেট থেকে বাটিভর্তি রসমালাই বের করলেন। দেখে মানিক আঙ্কেল বললেন, ‘একি! তোমাকে না দই আনতে বললাম? রসমালাই এনেছো কেন?’
আদ্রিয়ান ভাই চুল মুছছিলেন। আঙ্কেলের কথায় থেমে গেলেন। দুই সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন, ‘আসলে দই দেখে আমার ভালো মনে হলোনা। তাই আনিনি। তাছাড়া হিমুও তো দই খায়না। তারওপর হিয়া আর মলি প্রেগনেন্ট। আনহাইজিনিক কিছু খাওয়া ঠিক হবেনা।’
মেঝ মামা বললেন, ‘ কিন্তু এখানকার দইতো ভালো। আমরা সবসময় ওখান থেকেই আনি। আজ কী হল?’
উত্তরে আদ্রিয়ান ভাই কাঁধ ঝাকালেন। অর্থাৎ সে কিছু জানেনা। আমি মনে মনে হাসলাম। নাটকবাজ একটা! বড় মামা বললেন, ‘আচ্ছা হয়েছে। আদ্রিয়ান দ্রুত বসে পরো। আজান দিয়ে দেবে এক্ষুনি।’
আদ্রিয়ান ভাই মাথায় টুপি পরতে পরতে বসে পড়লেন। হিমু আমার পাশ থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে ওনার কোলে চড়ে বসল। আমি সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললাম। যা যা, সারা দুনিয়া ওনার কোলে উঠে যা। আমি কে? কেন আছি?
ইফতার, নামাজ শেষ করে বড়রা নিজেদের মতো গল্প আড্ডা দিতে বসল। আমরা ছোটরা মেঝ মামার ফাঁকা সেই দোকানটাতে বসলাম। আপাতত বসার মত আর জায়গা নেই। কথাবার্তার বিষয়বস্তু হলো কার কতদিন ছুটি পড়েছে, কে কতদিন থাকছে, কে কবে ফিরে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আড্ডার মাঝে কথায় কথায় আমপান্নার কথা মনে পড়ল সবার। সোহেল ভাই বলে উঠল, ‘তোরা বস। আমি বানিয়ে আনি। হেব্বি হয়।’
সোহেল ভাই স্বভাবতই গম্ভীর টাইপের মানুষ। আচমকা নিজেই এমন প্রস্তাব দেওয়াতে একটু অবাক হলাম সকলেই। রুমানা ভাবি বলল, ‘তোমার যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি। সাথে না হয় সৃষ্টি আসবে।’
সোহেল ভাই হালকা ধমকে উঠল, ‘আরে যাবো আর আসব। বসো তোমরা।’
সোহেল ভাই চলে যাওয়ার পর শয়তানীর মাত্রা কয়েকগুন বেড়ে গেল। কারণ সোহেল ভাই আমাদের সকলের বড় আর একটু গম্ভীর টাইপ। তাই ওনার সামনে দুষ্টুমি আমরা একটু লিমিট রেখেই করি। সজীব ভাই বলল, ‘ইশ! আমাদের ফ্যামলির বিয়ের সিজনটা কয়েক বছরের জন্যে ভ্যানিশ!’ শান্ত, সাম্য আর অর্ণব ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ এই তিন গাধার পড়াশোনা শেষ করতে এখনো বহুত দেরী।’ এরপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এরপর আসে ইনি। এতো নিজেই পিচ্চি। এর বিয়েরও বহুত দেরী। মোটকথা নিরামিষের মতো কাটাতে হবে কয়েকবছর।’
আমি হেসে বললাম, ‘এতো আফসোস না করে নিজে আরেকটা বিয়ে করে নাও। তুমিও ইনজয় কর আর আমরাও করি।’
সবাই হেসে ফেলল। অর্ণব ভাইয়া আর শান্ত ভাইয়া হৈ হৈ করে আমার কথায় সম্মতিও দিল। সজীব ভাই ভয়ানক চমকে গিয়ে বলল, ‘ আমার কপালে কী সিল মারা আছে আমি পাগল? একটা সামলাতে গিয়ে জীবন শেষ আবার আরেকটা!’
সৃষ্টি ভাবি সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘হ্যাঁ আমিতো মানুষদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি তাইনা? ভ্যাম্পেয়ারের মতো রক্ত শুষে খাচ্ছি। তাই তার জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
দোকান ঘরটা আমাদের অট্টহাসির শব্দে মুখরিত হয়ে গেল। অর্ণব ভাইয়া বলল, ‘আদ্রিয়ান ভাই মাঝেতো তোমার বিয়ের খবর শুনেছিলাম। না করলে কেন। তুমি বিয়েটা করে ফেললেই পারতে। তাহলে নিরামিষে একটু হলেও আমিষ যোগ হতো।’
আদ্রিয়ান ভাই এতক্ষণ ফোনে কিছু করছিলেন। অর্ণব ভাইয়ের কথায় চোখ তুলে বললেন, ‘সেচ্ছায় ফাঁস পরার শখ আমার নেই ভাই। এখানে বিবাহিত পুরুষ যারা আছে তাদের জিজ্ঞেস কর। সবার ভয়াবহ পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স আছে। সুতরাং আমি সিঙ্গেলই ঠিক আছি।’
রায়হান ভাই বললেন, ‘ দেখ ভাই, তুই বিয়ে করবিনা ভালো কথা। করিস না। আমাদের সংসারে আগুন লাগাচ্ছিস কেন? আর নিজেকে সিঙ্গেল দাবী করার মতো মহাপাপ করিস না। পাপ লাগবে।’
সজীব ভাই বলল, ‘ হ্যাঁ সেটাই। প্রেম জমে এতোটাই ক্ষীর, সরি রসমালাই যে নামকরা মিষ্টির দোকানের ভালো মানের দইতো নষ্ট হয়ে যায়।’
আজম ভাই বলল, ‘ একটু বেশিই কথা বলো তোমরা। দই খারাপ সেটা যে বানিয়েছে তার দোষ। আদ্রিয়ান এখানে কী করবে? আমরা কেউ কিছু শুনিনি, বুঝিও নি।’
সকলেই কৌতুকপূর্ণভাবে সম্মতি জানালো। আদ্রিয়ান ভাই হেসে ফেললেন। সঙ্গেসঙ্গে আবার সেই অট্টোহাসির ঝড় উঠল ঘরটাতে। আমি নির্বিকারভাবে ফোন স্ক্রোল করতে করতে ছানায় কামড় বসালাম। যেন কিছু শুনতেই পাইনি। এক্সপ্রেশন দিলেই এরা পেয়ে বসবে। আদ্রিয়ান ভাই বলল, ‘আসল কথা হচ্ছে ধরো তোমাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বিয়ে করে ফেললাম। এরপর ইউকে ব্যাক করব কীকরে? সঙ্গে বউ নিয়ে যাবো? তারওপর প্রেগনেন্ট হলে? বাপ হয়ে শরীয়তপুরেই বসে থাকবে হবে। আর আমার রিসার্চের রফাদফা।’
গলা কেটে যাওয়ার ইশারা করে বোঝালেন উনি। শান্ত ভাইয়া বলল, ‘ কথা ঠিক। এইযে এক নমুনা আমাদের পাশেই বসে আছে। গতবছরের অক্টোবর বিয়ে হলো। আর এবছর? দুমাস পরেই ডেলিভারী।’
রায়হান ভাই একটা চাটা মারলেন শান্ত ভাইয়ার মাথায়। এই বিষয় নিয়েও আরও কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা হল। আপি লজ্জা পেয়ে আর কিছু বলছেনা। ফোনে মুখ গুঁজে বসে আছে। একটু পরে আপি বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘এই মেয়ে পাগল করে দেবে।’
আমি আস্তে করে বললাম, ‘কার কথা বলছো?’
আপি বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, ‘আরে অর্পা। তখন থেকে হোয়াটস্ অ্যাপে মেসেজের পর মেসেজ। আদ্রিয়ান ভাইকে কেমন লাগছে। কী কালার পোশাক পরেছে। কী পরেছে। পাগল হয়ে গেছে এই মেয়ে। ছবি তুলে পাঠাতে বলছে। ভাব! এসব পাগলামোর মানে হয়! আদ্রিয়ান ভাই জানলে কী ভাববে বলতো?’
আমি একবার তাকালাম আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে। উনি ভাইয়াদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত। আপির থেকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলাম। মেসেজগুলো পড়ে হাসি পেল আমার। এতো আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিওয়ানি হয়ে বসে আছে। আমি লিখলাম, ‘ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। ভুল করে ফ্লাশ লাইট অন হয়ে গেছে। ছবি তুলছি বুঝতে পেরে ঘর কাঁপানো এক ধমক দিয়েছে। আর বলেছে, এমন ছ্যাঁচরামো তার পছন্দ না।’
মেসেজটা সেন্ট করে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। অলস ভঙ্গিতে ফোনটা দিয়ে দিলাম আপির কাছে। আপি কৌতূহল নিয়ে দেখল কী লিখেছি আমি। লেখাটা দেখে বোকার মতো তাকাল আমার দিকে। আমি চোখ টিপ মারলাম। আপিও হেসে ফেলল।
একটু পরেই সোহেল ভাই কাঁচা আমের শরবত নিয়ে এলো। দেখতে ভালোই ছিল। রুমানা ভাবি আর সৃষ্টি ভাবি মিলে সার্ভও করল সবাইকে। কিন্তু খেতে গিয়ে সবার অবস্থা খারাপ। সবই ঠিক ছিল কিন্তু ঝালের মাত্রাটা অতিরিক্ত ছিল বলে দু ঢোকেই সবার অবস্থা খারাপ। আমাদের অবস্থা দেখে সোহেল ভাই হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তোরা এইটুকু ঝাল সহ্য করতে পারিস না? আমাকে দেখ!’
একটু ভাব নিয়েই এক গ্লাস জুস ঢকঢক করে অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলল সোহেল ভাই। আমরা প্রবল আগ্রহ এখন বসে আছি তার রিঅ্যাকশনের আশায়। পাঁচ-ছয় সেকেন্ড পরে সোহেল ভাই আমাদের সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে অসহায় গলায় বলল, ‘এখন আমার সব জ্বলে!’
ব্যাস! এই ঘটনাটুকুই যথেষ্ট ছিল আমাদের সারা সন্ধ্যা মন খুলে হাসার জন্যে। রাতে কদরের নামাজ পড়তে ছেলেরা সবাই মসজিদে চলে গেল। আমরা মেয়েলা সবাই বাড়িতে এক জায়গায় পড়লাম।
নামাজের পর রাতে খাওয়ার সময় রায়হান ভাইয়ের দুজন ভাই এলেন। তাদের মধ্যে আনভীর ভাইও ছিলেন। আমি তার সাথে শুধু হাই-হ্যালো টুকুই করলাম। ফরমাল আলাপ যাকে বলে।
ঐদিন সাহরি খেতে একটু বেশিই তাড়াতাড়ি বসলাম আমরা। কারণ সকলেই জেগে ছিলাম। কেউ ঘুমাই নি। শুধুমাত্র আপি আর মলি আপুকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কারণ দুজনেই প্রেগনেন্ট।
খেয়ে-দেয়ে ক্লান্ত হয়ে দোকান ঘরটাতেই যে যার জায়গায় চিটপটাং হয়ে শুয়ে পড়লাম। হিমু আমার পাশেই শুয়ে ছিল। স্নাপচ্যাটে খেলছিল। কিন্তু যেই না আদ্রিয়ান ভাই এসে শুলেন ওমনি লাফিয়ে চলে গেলেন ওনার কাছে। আমি আবার হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। এমনিসময় আমার কাছ থেকে নড়বেনা। যেই ল্যাপটপ বা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে দেখবে ওমনি দৌড়। পাল্টিবাজ মেয়ে!
এমনিতেই সারাদিন রোজা, তারপর ইফতারের পর থেকেতো কেউ এক সেকেন্ডের জন্যেঔ স্হির হয়ে বসিনি কেউ। তাই শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই মোটামুটি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি এখনো জেগে। দিনে অনেক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম। তাছাড়া রাত জেগে মোবাইল স্ক্রোল করার অভ্যেস হয়ে গেছে বলে চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছিনা। আবার ফোনেও হাত দিতে পারছিনা কারণ সোহেল ভাই আর ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। দেখলেই জ্ঞান ঝাড়বে। তাই চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। অনেকটা সময় পর চোখ লেগেই এসছিল। তখন হঠাৎ করেই ফিসফিস গলার আওয়াজে ঘুম কেটে গেল। মনে হল হিমু আর আদ্রিয়ান ভাই কথা বলছেন। চোখ খুলে উঠতেই যাচ্ছিলাম তখনই আদ্রিয়ান ভাইয়ের গলার আওয়াজ পেলাম। উনি নিচু গলায় বললেন, ‘ঘুমোও। অনেক ফিসফাস হয়েছে।’
হিমুর কী যেন বলল। আমি বুঝতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করেই আছি। আদ্রিয়ান ভাই চেষ্টা করছে হিমুকে ঘুম পাড়ানোর। কিন্তু বিচ্ছু মেয়েটা ঘুমোচ্ছেই না। দুষ্টুমি করছে। হালকা করে চোখ খুলে দেখলাম, উনি হিমুকে নিজের বুকের ওপর নিয়ে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। এরমধ্যেই ও বায়না ধরল গল্প শুনবে। আদ্রিয়ান ভাই অসহায় গলায় বলল, ‘এতো রাতে এখন গল্প বলতে গেলে সবাই জেগে যাবে বাবু। কাল শোনাই?’
হিমু ঘুম ঘুম কন্ঠে জেদ ধরে বলল, ‘না, এখনি।’
আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘একদম বোনের মতো হয়েছে। বিচ্ছু!’ এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘একটা শর্তে বলব। পুরোটা গল্প চোখ বুঝে শুনতে হবে। আর কথা বলা যাবেনা। মনে থাকবে?’
হিমু কিছু বলল কি-না শুনতে পেলাম না। এবার আমি নিজেও ছটফট করছি ওনার মুখে গল্প শোনার জন্যে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মুখে ছেলেদের গল্প শুনতে কেমন লাগে জানাটা জরুরি। এর আগে কোনদিন কাউকে গল্প শুনিয়েছেন বলে আমার মনে হয়না। প্রায় দুই মিনিটের মতো চুপ থাকলেন। এরপর মৃদু আওয়াজে বলতে শুরু করলেন, ‘অনেক বছর আগের কথা। পাশাপাশি দুটো রাজ্য ছিল। দুই রাজ্যের রাজার মধ্যে অনেক গভীর। ছোটবেলা থেকেই তারা একসঙ্গে বড় হয়েছে। প্রায় সবসময়ই একসঙ্গে থাকতো তারা।’
হিমু বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ রাজকন্যা ছিলোনা? ঐ রাক্ষুসীর গল্পের মতো।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলেন উনি। এরপর খানিকটা অন্যরকম গলায় বললেন, ‘ছিলোতো। ছোট্ট একটা রাজকন্যা ছিল। রাজা রাজপুত্র আর রাণীকে নিয়ে গিয়েছিল রাজকন্যাকে দেখতে।’
‘রাজকন্যা কী আকাশ থেকে পড়েছিল? আমার মতো?’
‘ হ্যাঁ। এলিয়েনরা আকাশ থেকেই পড়ে।’ হতাশ গলায় বললেন উনি।
হিমু কৌতুহলী গলায় বলল, ‘ রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকতো। জাদুকাঠি দিয়ে? আম্মু বলেছিল।’
আদ্রিয়ান ভাই হেসে ফেললেন। বললেন, ‘ হ্যাঁ সেই রাজকন্যাও ঘুমিয়েই থাকে। তবে তার ঘুমাতে কোন জাদুকাঠির দরকার হয়না। সে এমনিই ঘুমিয়ে পড়ে। অটোমেটিক।’
হিমু কিটকিটিয়ে হেসে ফেলতে নিলে আদ্রিয়ান ভাই মুখ চেপে ধরে বলল, ‘আস্তে। জেগে গেলে দুজনকেই ধরে মারবে।’
ওদের কথা শুনতে শুনতে কখন চোখ খুলে ফেলেছিলাম খেয়ালই করিনি। দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেললাম। প্রায় এক মিনিট পর হিমু ঘুম ঘুম কন্ঠে টেনে বলল, ‘রাজকুমার রাজকুমারীর বিয়ে হয়নি? ঐ কাঠির গল্পের মতো?’
কথাটা শুনে আমি শক্ত হয়ে গেলাম। কান নিজের অজান্তেই খাড়া হয়ে গেল। প্রায় দশ সেকেন্ডের নিরবতার পর আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘ না। এই গল্পের রাজকন্যা অন্যসব গল্পের রাজকন্যাদের মতো না। এই রাজকন্যা কোন দুষ্টু রাক্ষসের বন্দি নয়। সে মুক্তির জন্যে কোন রাজপুত্রের আসার অপেক্ষা করেনা। তাকে উদ্ধার করতে কারো প্রয়োজন নেই। এই রাজকন্যার ব্যক্তিত্ব আকাশ আর সাগরের মতোই বিশাল। মায়াবী। সে সমস্ত স্বাভাবিক নিয়মের উর্ধ্বে। তাকে নিজের বলে দাবী করা যায়না। বলা যায়না সে আমার ব্যক্তিগত।’
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। এতক্ষণ খুব মজা নিয়ে শুনলেও এবার অস্বস্তি হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে চোখ বন্ধ করে রাখলাম আমি। নিজেকে স্হির রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। উনি আবার বললেন, ‘এই গল্পে রাজপুত্রের রাজকন্যাকে প্রয়োজন। নিজেকে শান্ত রাখতে প্রয়োজন। বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন। খুব প্রয়োজন। বেপরোয়া রাজপুত্রের সবটা ধারণ করার ক্ষমতা একমাত্র তার মধ্যেই আছে। কিন্তু_’
এর চেয়ে বেশি কিছু শোনার ধৈর্য্য রইল না আমার মধ্যে। চোখ বন্ধ রেখেই মৃদু গলায় বলে উঠলাম, ‘আপনার গল্পের রাজপুত্র আর রাজকন্যার মহা কম্প্লিকেটেড স্টোরি ছয় বছরের বাচ্চা মেয়েটা বুঝবে না, আদ্রিয়ান ভাই।’
বলে চোখ খুলে সরাসরি তাকালাম ওনার দিকে। উনি হতভম্ব হয়ে গেছেন। হিমুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়েছেন আদ্রিয়ান ভাই। হিমুকে আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বললেন, ‘ক’টা বাজে? এখনো জেগে আছিস কেন?’
আমিও ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে গেছি। গলা ঝেড়ে বললাম, ‘আপনার গল্প শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ভেবেছিলাম ইন্টারেস্টিং কিছু বলবেন। কিন্তু ডাহা বোরিং।’
‘বোরিং? আমা-‘ গলার স্বর কিছুটা উঁচু হয়ে গিয়েছিল ওনার। সজীব ভাই খানিকটা নড়ে উঠতেই থেমে গেলেন। আবার গলা নামিয়ে বললেন, ‘স্কেলের দুটো বারি পড়লে ঢপবাজি জানালা দিয়ে পালাবে। এতোগুলো মানুষের ঘুম ভাঙলোনা তোর মতো লেডি কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙ্গে গেল? এইটুক আওয়াজে। আই হ্যাভ টু ট্রাস্ট দিস নাও?’
আমি ভীষণ বিরক্ত হওয়ার ভান করলাম। কপাল কুঁচকে বললাম, কী সমস্যা? ঝগড়া করে সবাইকে জাগাবেন না-কি?’
উনি কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেলেন। ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিলেন। নিজের এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়ে নিয়ে বললেন, ‘ইম্পসিবল লেডি।’
আমি মুচকি হাসলাম। আস্তে করে উঠে, দুই হাঁটু গুটিয়ে বসে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। পরিপাটি চুলের চেয়ে এলোমেলো চুলেই ওনাকে বেশি ভালো লাগে। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনিও তাকালেন আমার দিকে। পাঁচ সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে থেকে ভ্রু নাচিয়ে বোঝালেন, কী?
আমি একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম যেহেতু আজ অনেক তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়েছি। তাই এখনো আধঘন্টার মতো বাকি। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘চা?’
উনি উত্তর দিলেন এক মিনিট পরে। তাও মুখে না। অদ্ভুত কিউট ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন। সত্যি বলছি, তখন ইচ্ছে করছিল গালটা টেনে দেই।
ওনার সম্মতি পেয়ে আর অপেক্ষা করলাম না। দোকানটা থেকে বেরিয়ে সোজা মেঝ মামার ঘরে ঢুকলাম। সবাই যে যার ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে স্বস্তি পেলাম। আজানের আগে কেউ উঠবেনা। তাড়াতাড়ি করে কিচেনে চলে গেলাম। খোলা চুলগুলো হাত ক্ষোপা করে নিয়ে গ্যাসে চা বসালাম। কিছুক্ষণ পর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি কিচেনের দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আদ্রিয়ান ভাই। হাত ভাঁজ করে। আমি আবার গ্যাসের দিকে ফিরলাম। চা পাতি দিতে দিতে মুচকি হেসে বললাম, ‘আজকাল ধরা পড়ে যাচ্ছেন। আগেতো পড়তেন না? সতর্কতা কমে যাচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।’
উত্তরে উনি বললেন, ‘আজকাল তুমিও লুকিয়ে লুকিয়ে কথা শুনছো। আগেতো শুনতেনা? আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে মায়াবিনী।’
আমি উত্তর দিলাম না। তবে হাত দ্রুত চলছে এবার। উনি চলে যেতে গিয়েও থেমে গেলেন। বললেন, ‘চা নিয়ে দোকানে এসোনা।’
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তাহলে কোথায়?’
উনি আমার দিকে তাকালেন না। চলে যেতে বললেন, ‘কাঠবাগানে পুকুরপাড়ে।’
…
[ রি-চেইক করিনি। ভুল থাকতে পারে। অনেকদিন পরে লিখলাম এটা। একটু অগোছালো লাগতে পারে। কষ্ট করে ম্যানেজ করে নেবেন। ]