অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২৪
রমজান মাসের শেষের সময়। ঈদের তখনও পাঁচদিন বাকি। কিন্তু ইতিমধ্যে বাতাসে ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। আত্মীয়স্বজনের ভীড়, বিভিন্ন তোড়জোড় আশেপাশের পরিবেশটাকেও উৎসবমুখর করে তুলেছে। বেলা পাঁচটার দিকে সদরে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। আমরা বলতে আব্বু, আম্ম, কাব্য আর আমি। মানিক আঙ্কেলের বাড়িতে আজ ইফতারের দাওয়াত আছে। কিছু খাবার জিনিসপত্র কিনে মানিক আঙ্কেলের বাড়িতে রওনা দেব তখনই ফোন বাজল আমার। ইতু আপু ফোন দিয়েছে। আমি আব্বুকে বললাম, ‘আপনারা যান। আমি ফোনে কথা বলে, মিষ্টিটা নিয়ে আসছি।’
ওনারা কেউ আপত্তি করল না। আম্মু কাব্যকে রেখে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমিই বারণ করে দিলাম। আমার পৌঁছতে পৌঁছতে সোয়া পাঁচটা বেজে গেল। দরজায় নক করার এক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে দিল। নাকের পাশের ঘাম মুছতে মুছতে তাকিয়ে দেখলাম মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে। বাদামি রঙের থ্রিপিস পড়নে, ফর্সা। কেমন চেনা চেনা লাগল কিন্তু চিনতে পারলাম না। মেয়েটা মুচকি হেসে বলল, ‘তুমিই অনি তো?’
আমি খানিকটা ইতস্তত করে বললাম, ‘জি।’
মেয়েটার হাসি আরও প্রসারিত হল। বলল, ‘আমাকে চিনতে পারোনি? আমি শোভা। সেদিন হোয়াটসঅ্যাপে কথা হল। কেমন আছো বলো?’
এবার চিনতে পারলাম আমি। উনি মামণি মানে রিমা আন্টির ভাইয়ের মেয়ে। শোভা আপু। অনেক বছর আগে একবার দেখেছিলাম ওনাকে। আর দু একবার দেখেছি ছবিতে। শুনেছি এখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আছে। সৃষ্টি ভাবির ব্যাচমেট। হঠাৎ দেখায় চিনে উঠতে পারিনি। তাই এবার আমিও হেসে বললাম, ‘ভালো আছি আপু। আপনি?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। এসো ভেতরে এসো। ভেতরে তো তোমারই আলোচনা চলছে। সবাই প্রায় ভুলেই গেছে যে আমরাও আছি বাড়িতে। এতোদিন তো জানতাম আদ্রিয়ান যেখানে থাকে সেখানে এটেনশন জিনিসটা অন্যকারো কপালে জোটেনা। ও একাই নিয়ে বসে থাকে। এখন তো দেখছি তুমিও কম নও।’
আমি ভেতরে আসতে আসতে বললাম, ‘ওনার টপিক একবার উঠলে আমিও পাত্তা পাইনা আপু।’
শোভা আপু কিছু বললেন না। মুখে মিষ্টি হাসিটা ধরে রেখেই আমার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা নিলেন। আমিও আর কিছু না বলে ভেতরে গেলাম। বসার ঘরে পৌঁছতেই সারা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। পেছন থেকে ধরল জাবিন। মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে গেলাম একপ্রকার। সারা প্রায় চেঁচিয়ে বলল, ‘কেমন আছো? কতোদিন পর আসলা। কতো মিস করি তোমাকে।’
জাবিনও প্রায় একই কথা বলল। মানিক আঙ্কেল পাশে সোফাতেই বসা ছিলেন। হেসে দিয়ে বললেন, ‘আরে ছাড় মেয়েটাকে। এসে একটু বসতে তো দিতে হয় নাকি?’
আমি ওরা কেমন আছে জিজ্ঞেস করতে করতে ওদের হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত করলাম নিজেকে। এরমধ্যেই শোভা আপু বললেন, ‘কী ব্যপার পুঁটি-ছুটকি? আমিযে বছর খানেক পরে এলাম আমাকে দেখেতো এতোটা খুশি হওনি। সব ভালোবাসা অনিপুর জন্যে?’
জাবিন গিয়ে শোভা আপুর হাতের বাহু আকড়ে ধরে বলল, ‘তুমিতো আমাদের মিষ্টি আপুটা।’
আমি চারপাশে তাকিয়ে পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা করলাম।এখানে সবাই মানিক আঙ্কেলের আত্মীয় স্বজন। উপস্থিত বেশিরভাগ লোকের সাথেই আমার পরিচিতি নেই। সকলের মাঝে নিজেকে ভিনগ্রহের প্রাণী বলে মনে হল। পরিবেশটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। মামাদের বাড়ি থেকে কারো কারো আসার কথা ছিল। কেউ এখনো আসছেনা কেন? আব্বু অপরিচিত সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন আমার। আর সবার সাথে আলাপ করে বুঝলাম আমি এদের না চিনলে কী হবে? এরা সবাই আমাকে খুব ভালোভাবেই চেনে। হাসিমজার ছলে অতি উৎসাহিত হয়ে আমার ছোটবেলার কিছু ঘটনাও তুলে ধরলেন। আমারও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে ওখানেই বসে থাকতে হল। এরপরই এলো সেই চির পরিচিত কিন্তু বিরক্তিকর প্রশ্ন, ‘মেয়েকে কোথায় ভর্তি করেছেন?’ অর্থাৎ ইনডাইরেক্টলি এটাই জানতে চাইল আমার কোন পাবলিকে ঠাঁই হয়েছে কি-না। আব্বু বেশ চমৎকারভাবে আমার দিকটা তুলে ধরে উত্তর দিয়ে ওনাদের কৌতূহল নিবারণ করলেন।
প্রচন্ড বোরিং ঐ সময়টাতে জাবিন, সারা, শোভা আপু আর ওনাদের কাজিন সিস্টারদের সাথে টুকটাক কথা বলে সময়টা কিছুটা হলেও কাটছিল। না হলে দম আটকে আসতো হয়তো।
সকলের আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম বাড়ির ছেলেরা সব বেরিয়েছে। কেনাকাটা করে একেবারে ইফতারের আগ দিয়ে আসবে। এইজন্যই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দেখা নেই। তাইতো বলি, তার আদরের হাসান আঙ্কেল বাড়িতে এসছে। আর সে এখানো আশেপাশে আসেনি। ব্যপারটা বিস্ময়কর। বাড়িতেই নেই তাহলে। ইফতারের সময়ও হয়ে এলো। এখনই চলে আসবে নিশ্চয়ই। এরমধ্যেই শান্ত-সাম্য ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া আর বড় মামা এলো। ওদের দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। মন খুশি হয়ে উঠল। গোলক ধাঁধায় হঠাৎ পথ খুঁজে পেলে মন যেমন খুশি হয়ে ওঠে ঠিক তেমন। অবশেষে কাছের কারো দেখা পেলাম। মানিক আঙ্কেল এগিয়ে গিয়ে ওদের নিয়ে এলো ভেতরে। বড় মামাকে গলার আওয়াজেই গমগম করে উঠল বাড়ির হলরুমটা। ওনাকে আড়ালে আবডালে আমরা ‘লাউড স্পিকার’ বলে ডাকি। কিন্তু আমার সেই স্বস্তি টিকলো না বেশিক্ষণ। গমগমে পরিবেশটা শান্ত করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দাদাভাই। আদ্রিয়ান ভাইয়ের দাদা। গম্ভীর মুখ করে বেরিয়ে এলেন নিজের ঘরে থেকে। ওনাকে দেখেই গলা শুকিয়ে গেল আমার। জীবনে হাতে গোনা দু’তিনবারই দেখেছি আমি তাকে। তাতেই লোকটাকে ভয় ভয় লাগে আমার। কেমন সদা গম্ভীর, রাগী একটা লোক। শেষ বয়সে এসেও কী ভয়ানক দাপট। জোয়ান কালে কীরকম ছিল কে জানে? আদ্রিয়ান ভাইয়ের স্বভাবগুলো সম্ভবত দাদাভাইর কাছ থেকেই জেনেটিক্যালি এসেছে। দাদাভাই আসতেই মানিক আঙ্কেল বসতে জায়গা ছেড়ে দিলেন। আব্বু সালাম দিলো দাদাভাইকে। হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘তোমার ছেলে কই? আসেনি?’
আব্বু বলল, ‘এসেছেতো। আদ্রিয়ানদের কাছে গেছে বাইরে। একা একা ভালো লাগছিল না তাই।’
আমি মিনমিনে গলায় সালাম দিলাম দাদাভাইকে। আমার দিকে গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে সালামের জবাব দিলেন উনি। এরপর অন্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। না চাইতেও মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। উনি আমাকে তেমন পছন্দ করেনা বলেই আমার ধারণা। সবসময় কেমন এড়িয়ে চলেন। বোঝাই যায় যে আমার উপস্থিতি বিরক্ত করে ওনাকে। স্হান ত্যাগ করার তীব্র এক ইচ্ছা হলেও বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করলাম। বড়রা নিজেদের মতো কথা বলছে আর এদিকে আমরাও টুকটাক আলাপ আলোচনা করছি।
এরমধ্যেই শোভা আপু বলল, ‘তোমরা কথা বলো। আমি একটু কিচেন থেকে আসি। হেল্প লাগবে হয়তো।’
রিমা আন্টির ভাবি মানে শোভা আপুর মা বলে উঠলেন, ‘কী মেয়ে দেখো। ফুপুর বাড়ি বেড়াতে এসছে কোথাও একটু ঘুরবে। কাজিনদের সঙ্গে আড্ডা দেবে তা-না ফুপির সাথে সমানতালে কাজ করছে।’
শোভা আপুর বাবা টিককারির স্বরে বললেন, ‘ তা তুমি এখানে বসে আছো কেন? গিয়ে রিমাকে একটু সাহায্য করো গিয়ে।’
উনি জ্বলন্ত চোখে তাকালেন নিজের স্বামীর দিকে। কিন্তু জায়গা থেকে এক পাও নড়লেন না। ঠায় বসে রইলেন। এরমধ্যেই দাদাভাই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘এগুলো মনের ব্যপার-স্যপার। জোর করে হয় না। আজকালকার কিছু ছেলে-মেয়েতো সারাদিন লাফিয়ে বেড়ায়। কার্টেসী বলে কোন বস্তু তাদের মধ্যে নেই।’
হঠাৎ কেমন চুপসে গেলাম আমি। কথাটা কী আমায় উদ্দেশ্য করে বলল? বাচ্চারা তো দুষ্টুমি করবে সেটাই স্বাভাবিক। এখানে ইয়াংদের মধ্যে আমি ছাড়া লাফিয়ে বেড়ানোর মতো কেউ নেই। ব্যপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই নিচ্ছিলাম এমন সময় লোকজনে মুখরিত পরিবেশটা আরও মাতিয়ে দিয়ে হুরমুর করে এক ঝাঁক ছেলের দল এসে ঢুকলো ভেতরে। কাউকেই সেভাবে চেনা নেই আমার। দু একজনকে আগে দেখেছিলাম কখনও কখনও। সবার শেষে ঢুকলেন আদ্রিয়ান ভাই। দুই হাতে মস্ত বড় দুটো ব্যাগ। বাদামি রঙের পাঞ্জাবী পড়েছেন। মাথায় টুপি। আজও টুপি ভেদ করে সামনে এসে পড়েছে কিছু অবাধ্য চুল। কারো দিকে না তাকিয়ে হাঁক ছেড়ে ‘আম্মু’ বলে ডাকলেন উনি। ডাকার প্রায় পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই ওড়নায় মুখের ঘাম মুছতে মুছতে শোভা আপু বেরিয়ে এসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি দাও। সময় নেই বেশি।’
আদ্রিয়ান ভাই বিনাবাক্যে সবকিছু ধরিয়ে দিলেন শোভা আপুর হাতে। ছোট একটা প্যাকেট রয়ে গেল ওনার হাতে। সেটা দেওয়া আগে শোভা আপুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলে নিলেন। শোভা আপুর কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ওনার মুখের দিকে। এরপর কিছু না বলে চলে গেলেন ভেতরে। কোনকিছুই দৃষ্টি এড়ালোনা আমার। সেদিকে থেকে ফিরেই সোজা আমার দিকে তাকালেন উনি। আমি সঙ্গেসঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়ে জাবিনদের সাথে কথা বলায় মনোযোগ দিলাম। আদ্রিয়ান ভাই এসে দাদাভাইর সামনাসামনি বসে বলল, ‘কী বুড়ো? তুমিতো এই বয়সে এক লাফও দিতে পারবেনা। তাহলে কার লাফালাফির কথা বলছিলে?’
দাদাভাই তার লাঠিটা দিয়ে ওনার পেটে একটা খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘বেয়াদব। আমি বুড়ো? তোমার চেয়ে বেশি জোয়ান দেখতে আমি।’
আদ্রিয়ান ভাই শরীরটা খানিকটা বাঁকা করে নিলেন। এরপর পেট ডলতে ডলতে বললেন, ‘ হ্যাঁ সেতো দেখতেই পাচ্ছি। পুশ আপ হবে নাকি? আমি পঞ্চাশটা দেব। তারমধ্যে তুমি থেমে দশটা দিয়ে দেখাও দেখি?’
এতক্ষণ চুপচাপ দাদা-নাতির খুনশুটি দেখছিল সবাই। এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল। দাদাভাই বললেন, ‘এখন কী আমার সেই শরীর আছে? তোমার মতন এমন গরম রক্ত থাকলে দেখিয়ে দিতাম।’
আদ্রিয়ান ভাই মুখে মিষ্টি হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, ‘সেটাই। এখন যেমন তুমি চাইলেও আগের মতো অনেককিছুই করতে পারোনা। তেমনই একটা সময় চাইলেও আমরা লাফিয়ে বেড়াতে পারবোনা। ইচ্ছা থাকলেও গায়ের জোর থাকবেনা। লাফাতে পারছি যখন লাফাই না সমস্যা কী? সময়ের কাজ সময়ে করে রাখতে হয়। সো রিল্যাক্স।’
এরমধ্যেই শোভা আপু এসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি সবাই ওযু করে এসে বসে পড়ো। সময় নেই বেশি আর। ইফতার কিন্তু রেডি।’
ইফতারের সময়টাতে প্রাথমিক খাওয়া-দাওয়ার পরেই শোভা আপুর বাবা বেশ রসিয়ে আলাপ জুড়লেন। বছর খানেক আগে এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সম্বন্ধ নিয়ে এসছিল। কিন্তু বাবা সেই প্রস্তাব সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছিল। ব্যাপারটা এমন যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাত্র এনে হাজির করলেও উনি ওনার ছোট্ট রাজকন্যাকে এখনই কোন বন্ধনে জড়াতে দেবেন না। কিন্তু এতো ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া করে ফেলেছে সে নিয়ে ভীষণ আফসোস প্রকাশ করলেন লোকটা। রাবারের মতো টেনেই যাচ্ছিল ব্যপারটা। এমনিতেই সারাদিন রোজায় সবার অবস্থাই খারাপ। তাই কেউ তার কথায় বাঁধা দিলোনা, আবার সেরকম পাত্তাও দিলোনা। শেষমেশ ওনার কথার মানে এমন বোঝালো যে এর চেয়ে ভালো পাত্র আমার কপালে জুটবে না। ভুল করেছে বাবা। কিন্তু আদ্রিয়ান ভাইয়ের বোধ হয় পছন্দ হলোনা এতো কথা। তাই ওনার কথার সুতো ছিড়ে বললেন, ‘কী ব্যপার মামু? ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকতে তুমি ছোট ছোট বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের জন্যে ঘটকালি করছিলে? ব্যপারটা কী ভালো দেখায়? তোমাকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত।’
পিনপতন নিরবতা চলল কয়েক সেকেন্ড ঘরটাতে। লোকটা মেকি হেসে আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সকলে।
মাগরিবের নামাজ পড়ার পর মুড়ি মাখার ব্যবস্থা হলো। ঠিক করা হলো যে বড়রা সব নিচে খাক আর ছোটরা ছাদে চলে যাব। সেরকমই হলো। ছাদে চলে গেলাম আমরা। আমি গিয়ে চুপচাপ বসে পড়লাম শান্ত-সাম্য আর অর্ণব ভাইয়াদের কাছে। কাউকেই সেভাবে চিনিনা বলে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব চুপচাপই আছি। তখনই জাবিন কোলে করে নিয়ে এলো দুই বছরের বাচ্চা একটা ছেলেকে। ভয়ানক মিষ্টি দেখতে। ওকে নিয়ে জাবিন আমার পাশেই বসল। আমি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। আদ্রিয়ান ভাই টাইপ একটা ব্যাপার আছে ওর মধ্যে। অনেকটা তেমনই রং, চোখ, নাক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে ও?’
জাবিন হেসে ওর সাথে খেলতে খেলতে বলল, ‘আদ্র। ছোট চাচার ছেলে। ঘুমিয়ে ছিল এতক্ষণ।’
বাহ! নামেরও কত মিল! আমি হাত বাড়াতেই আদ্র খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বসল আমার কোলে। বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই চমৎকার ভাব হয়ে গেল ওর সাথে আমার। এখন আমার কোল ছাড়তে নারাজ সে। কেউ নিতে আসলেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে। এরমধ্যেই মুড়ি মাখা হয়ে গেছে। পেঁয়াজ-টেয়াজ সব শোভা আপু কাটলেও মুড়িটা আদ্রিয়ান ভাই মেখেছেন। তার মুড়ি মাখার হাত চমৎকার। মুড়ি খেতে খেতে বেশ সহজ হয়ে উঠলাম সবার সাথে। আদ্রিয়ান ভাইয়ের কাজিন ব্রাদারগুলো প্রত্যেকেই বেশ চমৎকার মানুষ। এক সেকেন্ডের জন্যেও অস্বস্তি বোধ করতে দিলোনা আমায়। আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে খুব সহজ স্বাভাবিক হয়ে উঠল আমার সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ জমে উঠল আড্ডাটা। একটা জিনিস দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। আমি ওনার ভাইদের কাউকে না চিনলেও ওনারা আমাকে ভালোভাবেই চেনেন। রীতিমতো মুখস্হ করে ফেলেছে আমাকে। কথায় কথায় ওনার এক চাচাতো ভাই পান্থ আদ্রিয়ান ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কয়েকমাসের জন্যে দেশে আসলি রেস্ট করার জন্যে অথচ বেশিরভাগ সময় বইয়ে মুখ গুজে রাখিস। কতো করে বললাম একটু ঘুরে-টুরে আসি। এটা কেমন রেস্ট?’
আদ্রিয়ান ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি রেস্ট করতে দেশে এসছি তোকে কে বলল?’
ওনার আরেক ভাই শাওন বলল, ‘ আরে দূর! রেস্ট না রিফ্রেশমেন্ট। ভুলে গেলি? তাইনা আদ্রিয়ান ভাই?’
পান্থ ভাইয়াও ভুল হয়ে গেছে এমন এক মুখভঙ্গি করে বলল, ‘ও হ্যাঁ। ভুলে গেছিলাম। মাই ব্যাড!’
আদ্রিয়ান ভাই চোখ ছোট ছোট করে ওনাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সবগুলোকে কলনীর মাঠের সামনের ঐ পুকুরটাতে চুবিয়ে আনব কিন্তু। ইডিয়টস্!’
ওনার মারাত্মক হুমকি শুনে আধ মিনিট চুপ রইল সকলে। এরপর উচ্চস্বরে হেসে ফেলল ভাইয়েরা ভাইয়েরা। কী বুঝে হেসেছে এরাই জানে। এদের হাসির কারণ বুঝতে ব্যর্থ হয়ে আদ্রকে নিয়ে খেলায় মনোযোগ দিলাম। এরমধ্যেই শোভা আপু বলে বসল, ‘অনিমা কোথায় ভর্তি হয়েছো বললে না?’
আমি তাকালাম আপুর দিকে। নির্বিকারভাবে কোন দ্বিধা ছাড়াই বলে ফেললাম, ‘ হইনি। ন্যাশনালে যদিও ভর্তি হয়ে আছি। তবে ক্লাস করছিনা।’
শোভা আপু অবাক মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘পাবলিকে হলোনা? কোন সমস্যা হয়েছিল? আমিতো ছোটবেলা থেকেই শুনেছি তুমি ব্রাইট স্টুডেন্ট। গনিত অলেম্পিয়াডে দুটো মেডেলও পেয়েছো শুনেছি।’
আমি এবারও একদম স্বাভাবিকভাবে বললাম, ‘ তা পেয়েছিলাম। ছোটবেলায় এরকম ব্রাইট কমবেশি সবাই থাকে। নট আ বিগ ডিল।’
অর্ণব ভাইয়া বলে উঠল, ‘ আরে ওর কথা কী শুনছেন? জগন্নাথেও সাবজেক্ট পেয়েছিল। সাবজেক্ট পছন্দ হয়নি বলে জেদ করে ভর্তি হয়নি। ঢাকার বাইরেতো কোথাও এপ্লাইও করেনি।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘ফাল্তু অযুহাত দেখাচ্ছো কেন ভাইয়া? যোগ্য ছিলাম না তাই সিট পাইনি। এতো এক্সপ্লেনেশনের কী আছে?’
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পান্থ ভাইয়া বলল, ‘শুনেছি সেকেন্ড টাইম দিচ্ছে ও। এবার নিশ্চয়ই চান্স হয়ে যাবে। তাছাড়া এবারতো আদ্রিয়ান পড়াচ্ছে ওকে। কেমব্রিজিয়ানের স্টুডেন্ট এখন ও। আর কী লাগে?’
এতক্ষণ বিভিন্ন কথায় পরিবেশটা মাতিয়ে রাখলেও উপরোক্ত আলোচনাটুকুতে কোন অংশ নিলেন না আদ্রিয়ান ভাই। নিরবে শুনে গেলেন সবটা। হঠাৎ উঠে এসে আমার মুখোমুখি এসে বসলেন। হাত বাড়িয়ে দিয়ে আদ্রকে বললেন, ‘অনেক কোলে চড়া হয়েছে এবার চলে আয়।’
আদ্র খিলখিলিয়ে হেসে মাথা নেড়ে আবার জড়িয়ে ধরল আমার গলা। আদ্রিয়ান ভাই চোখে-মুখে কৃত্রিম অবাক ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘ চমৎকার! এই বয়সেই হেব্বি রপ্ত করেছিস তো। কিন্তু লাইনটা ভুল জায়গায় মারছো গুরু। দেখি এদিকে এসো।’
কিন্তু আদ্র হেসে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আমার গলা। যেন সব বুঝে গেছে। আমাকেও আদ্রকে দু হাতে জড়িয়ে ধরতে দেখে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ভয়ানক কম্পিটিশন বোঝাই যাচ্ছে। চলে আয়! ওটা বুকড প্রপার্টি। বেয়াদব ছেলে।’
বলে আমার কোল থেকে নিয়ে নিলেন আদ্রকে। আদ্র তেমন আপত্তি করল না। হাত নেড়ে বাই বলল আমাকে। আমিও হেসে হাত নেড়ে বাই বললাম। আদ্রকে নিয়ে নিচে নেমে গেলেন উনি।
আড্ডার বিশাল এক পর্ব কাটতেই ক্লান্তি ভর করল সবার ওপরেই। কেউ কেউ রুমে গেল। আর কেউ কেউ ছাদেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোবাইল ঘাটছে। আমিও কিছুক্ষণ জাবিন আর সারার সাথে গল্প করে একপাশে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রোল করছিলাম। মনটা বড্ড চা চা করছে। কিন্তু এরা কেউ চা খায়না নাকি? মুখ ফুটে চাইতেও পারছিনা। বাড়িতে এতো মানুষ না থাকলে আমি নিজেই গিয়ে বানিয়ে নিতাম। কিন্তু সবার মাঝে একা একা খাওয়াটা ভালো লাগবেনা। তখনই ফোনে মেসেজ টোন বাজলো। আমি ওপেন করে দেখি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবই পাঠিয়েছেন। লেখা আছে, ‘নিচে আয়। তাড়াতাড়ি।’
আমি উঁকি দিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তায় তাকিয়ে দেখি উনি সত্যিই দাঁড়িয়ে আছেন। বাইরের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওনাকে। আমি অবাক ছাদ থেকেই হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম ‘কী?’ উত্তরে উনি চোখ রাঙালেন। অর্থাৎ আসতে বলছি আয়। এতো কথা কীসের!
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চারপাশে একবার তাকালাম। সকলেই ক্লান্ত এবং নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। সবাইকে এড়িয়ে ধীরপায়ে নিচে নেমে এলাম। বাইরে বের হয়ে দেখি আদ্রিয়ান সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এগিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। চারপাশে একবার তাকিয়ে আবার ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ কী হয়েছে?’
উনি পেছন থেকে একটা প্যাকেট বের করে দিলেন আমার হাতে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম প্যাকেটটা। এটাই তখন শোভা আপুকে আলাদাভাবে দিয়ে কিছু বলেছিল সে। আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। উনি বললেন, ‘তাকিয়ে তাকিয়ে আমার চেহারা না দেখে দ্রুত বের কর। গলে যাচ্ছে। এইমাত্র বের করলাম ফ্রিজ থেকে।’
আমি ওনার দিকে ভ্রু কুঁচকে ভেতরে হাত দিতেই একটা আইসক্রিম বক্স বেরিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে একবার আইসক্রিম আর একবার ওনার দিকে তাকাচ্ছি। উনি ভ্রু নাঁচিয়ে বললেন, ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? সকলেই দই খেয়েছে। কিন্তু আপনিতো এক্সেপশনাল। দই মুখেও তোলেন না। তাই দিস ইজ ফর ইউ। মেহমান বলে কথা। খাতির যত্নতো করতেই হয়।’
এরপর আইসক্রিমটার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘পছন্দের ফ্লেবার তো?’
আমি বোকার মতো ওনার দিকে তাকিয়ে থেকেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। উনি খানিকটা উঁচু আওয়াজেই বললেন, ‘তো তাকিয়ে আছিস কেন? খা?’
আমি আর কোন না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করে দিলাম। ইতিমধ্যে ঘেমে গেছে বক্সটা। উনি চারপাশে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘চল হাঁটা যাক।’
আমি বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, ‘ হাঁটব মানে? এক্ষুনি ডাক পরে যাবে।’
কিন্তু আমার কথায় পাত্তা দিলেন না উনি। আমার বাঁ হাতের কুনুই ধরে টেনে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। প্রায় দশ মিনিট যাবত হাঁটছি আমরা। আইসক্রিম শেষ আরও আগেই। হঠাৎ উনি বললেন, ‘চল চা খাই।’
সন্ধ্যা থেকেই তো চা চা করছিল মনটা। খেলে মন্দ হতো না। কিন্তু বাড়ির কথা মনে পড়তেই বললাম, ‘ ভুলেও না। এবার বাড়ি যাওয়া উচিত।’
কিন্তু এই মহা ঘাড়বাঁকা লোক এবারও শুনলেন না আমার কথা। নির্বিকারছন্দে আমাকে নিয়ে চললেন চায়ের দোকানে। যখন নিজের ইচ্ছেতেই সব করবে তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করার মানেটা কী? কাকে ফর্মালিটি দেখাচ্ছে? নিজেই নিজেকে? দুটো ওয়ান টাইম কাপে করে চা নিলেন উনি। এরপর ডানে হাঁটা দিলেন। আমাকেও যেতে হল ওনার পেছন পেছন। বেশ কিছুটা এগিয়ে একটা নির্জন জায়গায় বিজ্রের ওপর গিয়ে দাঁড়ালেন উনি। ব্রিজটা খুব ছোট। ব্রিজ না বলে বড়সর কালবাট বলা যায় এটাকে। এটা এখন পরিত্যক্ত। শ্যাওলা পড়ে গেছে। এই রাস্তাটাও এখন ব্লক করা। পায়ে হেঁটে যাতায়াত হয়। গাড়ি চলেনা। ফলে লোকজনও তেমন নেই। কারো বাড়ি যাওয়া আসার পথ পড়লেই কেবল মানুষের যাতায়াত দেখা যায়। উনি বসে পড়লেন ওটার ওপর। আমি ওনার পাশে বসতেই একটা কাপ এগিয়ে দিলেন উনি আমার দিকে। আমি কাপটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘ বাড়ি যেতে যেতে খাই?’
‘ চুপচাপ বসে থাক।’ গম্ভীর গলায় হুকুম করলেন উনি।
একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। আশেপাশের পরিবেশটা দেখছি আর চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। এমনই হয়। আমরা দুজন একসঙ্গে হলে একদম চুপ হয়ে যাই। কারো কোন কথা নেই। একে ওপরকে কিছুই বলার নেই। অদ্ভুত নিরব হয়ে যাই দুজনে।
নিরবতা কাটিয়ে উনি বলে উঠলেন, ‘ছোটবেলায় একটা মেয়ে আসতো আমাদের বাড়িতে। যেমন ছটফটে, তেমনই কিউট। গোলগাল সাড়ে তিন বছরের একটা বাচ্চা। ঐ সময় নতুন প্লাস্টিকের ঘড়ি উঠেছিল। খেলনা ঘড়ি। মাত্র পাঁচ টাকা দাম। আমি তার একটা কিনে দিয়েছিলাম জাবিনকে। তার দুদিন পর মেয়েটা এলো বাড়িতে। জাবিনের সেই ঘড়িটা দেখে বায়না করল ওরও চাই। চাই মানে চাই। মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করা যাকে বলে। বাধ্য হয়েই বাবা আমাকে বলল একটা এনে দিতে। রং পছন্দের হতে হবে তাই মেয়েটাকেও নিয়ে গেলাম সাথে করে। ঘড়ির দোকানটা এই চায়ের দোকানটা যেখানে আছে তার বাঁ পাশেই ছিল। কিন্তু এই ব্রিজটার কাছে এসেই হল বিপদ। পাঁচটা কুকুর দাঁড়িয়ে ছিল ব্রিজের ওপর। ক্ষেপা। আমি নিজেকে সামলে নিলেও মেয়েটা মারাত্মক ভয় পেল। আমি বারবার ওকে বলছিলাম, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। ভুলেও দৌড় না দিতে। একটা চাকাও তুলেছিলাম ওগুলোকে তাড়াবার জন্যে।’
আমি এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম কথাগুলো। হাসি পাচ্ছে। কারণ উনি আমার কাহিনী আমাকেই শোনাচ্ছেন। আসলে ওনার ধারণা আমার কিছুই মনে নেই। তাই মনের সুখে বলে চলেছে কথাগুলো। মনে মনে নিজের শার্প ম্যামরিকে কয়েকবার ধন্যবাদ দিলাম। জানি কি হয়েছির তবুও অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘বাপরে! তারপর?’
মৃদু হাসলেন উনি। তারপর বললেন, ‘তারপর! ঐ মেয়ে কী আর আমার কথা শোনে? দিলো ছুট। ওর দৌড় দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে কুকুরগুলোও দৌড়ালো ওর পেছন পেছন। ওদের অলাম্পিকের দৌড় দেখে কিছুক্ষণের জন্যে হাবা হয়ে গেলাম আমি। কপাল ভালো ছিল তাই আমার ছোটফুপি বেরিয়ে এসছিল। ওনার ছয় মাসের বাচ্চাটা কোলে নিয়ে কী কষ্ট করেই না কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে ছিল বেচারি।’
আমি হেসে ফেললাম। উনি অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘হাসছিস? ঐ মেয়ের আবদার মেটাতে কী কী না করত হতো আমাকে। কাঠালগাছে চড়ে বসে থাকতে হতো। পাতা পেরে দিতে হতো। ঘর বানিয়ে দিতে হতো। ইভেন ওর বরও সাজতে হতো। ভাবলে নিজেকেই বোকা বোকা লাগে।’
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললাম, ‘এখন কোথায় সেই মেয়ে?’
কিছুক্ষণ চুপ রইলেন উনি। হঠাৎই যেন ফিরে এলেন বাস্তবে। স্বপ্নের ঘোর কেটে গেল চেহারা থেকে। ভ্রু বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোকে কেন বলব?’
আমি চোখ ছোট ছোট করে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আজব! হিস্ট্রি বললেন জিওগ্রাফিটা বলবেন না?’
‘ আমার ইচ্ছা। তুই জেনে কী করবি?’ একগুঁয়ে কন্ঠে বললেন উনি।
‘ কিছুই না। বললেন বলেই বললাম। তবে মেয়েটার পছন্দের ওপর মারাত্মক করুণা হচ্ছে। বেচারি।’ মুখ দিয়ে ‘চু চু’ আওয়াজ করে হতাশ গলায় বললাম আমি।
উনি ঘাড় বাঁকিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। চোখে একরাজ্যের বিরক্তি। তিক্ত কন্ঠে বললেন, ‘তোমার মধ্যে হিংসা বলে কোন বস্তু নেই? এমন মনে হচ্ছে কোন মেয়ে আমার কোলে উঠে বসে থাকলেও তোমার কোন আপত্তি নেই।’
আমি ওনার চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘আপনি উঠতে দিলে আমার আপত্তি থাকবে কেন? যদি কোন মেয়েকে কোলেই না তুলতে পারলেন তাহলে এই লম্বা চওড়া শরীর বানিয়ে লাভটা কী হলো?’
উনি হতাশ শ্বাস ফেলে বললেন, ‘ ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।’
বলে উঠে দাঁড়ালেন উনি। আমিও কাপটা ফেলে নামতে যাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না। আমার হার্টবিট কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন উনি আমাকে। আমি হতভম্ব চোখে তাকালাম ওনার দিকে। ওনার চোখের অদ্ভুত চাহনী দেখে কেঁপে উঠলাম। হুশ ফিরতেই হন্তদন্ত হয়ে চারপাশে তাকিয়ে বললাম, ‘পাগল হয়ে গেছেন আপনি? কারো চোখে পড়ে গেলে কী হবে? নামান এক্ষুনি।’
উনি নির্বিকারভাবে বললেন, ‘ কেন কোলে উঠে আমার স্ট্রেন্থ চেক করার তো খুব শখ ছিল তাইনা?’
‘ আরে! আমিতো আপনার বউয়ের কথা বলেছিলাম। আমাকে তুললেন কেন?’
‘ বউকেই তুলেছি। এতো হালকা মানুষ হয়? এর চেয়েতো আমার ডাম্বেলের ওজন বেশি।’
কথাটা বলতে বলতে আশেপাশে চোখ বোলাচ্ছেন উনি। আমি বললাম, ‘ দেখুন, এটা মজা না। লোক চলে আসলে বিশ্রী কান্ড হবে।’
উনি উত্তর দিলেন না। চারপাশে ভালোভাবে একবার তাকিয়ে সামনের রাস্তার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘ঐ পর্যন্ত এখন কারো আসার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছেনা। চলো ঐ অবধি নিজের স্ট্রেন্থ চেক করে ফেলি।’
বলে আমাকে কোলে নিয়েই হাঁটা দিলেন উনি। আমি তীব্র বেগে ছুটতে থাকা হৃদস্পন্দন নিয়ে ভীত, বিমূঢ়, বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম নিষ্ঠুর, দুঃসাহসী, বেপরোয়া এই প্রেমিকপুরুষের দিকে।
…
[ এটা চাইতে চাইতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল সবাই। তাই একটা পর্ব দিলাম। সকলেই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। অন্তর্হিত কালকূট আজ রাতেই দেওয়ার চেষ্টা করব। নয়তো কাল দিনে। সবার জন্যে ভালোবাসা রইল।]