অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২৫
শবে বরাতের নামাজ শেষ করে এসে রুমে এসে বসলাম। আম্মুর নামাজ শেষ হল তার দশ মিনিট পরে। নামাজ শেষ করে ছুটলেন রান্নাঘরে খাবার গরম করতে। সাথে আরেকটা কী রান্না করবেন। রান্নাটা বাড়ির কারো জন্যে নয়। মানিক আঙ্কেল আর তার বিলেতী পুত্র আসছেন বাড়িতে। যদিও বিষয়টা নতুন কিছু নয়, তবে আজকের ব্যপারটা স্পেশাল। আজ রাতে দুজনেই থাকছেন আমাদের বাড়িতে। কারণটা হল শবে বরাত। এমনিতে সব নামাজ সদরের মসজিদে পড়লেও শবে বরাত আর শবে কদরের নামাজটা ওনারা জাজিরা পুরান বাজার বড় মসজিদে এসেই পড়েন। আমি সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি ব্যপারটা। প্রতিবার নামাজ পড়ে মানিক আঙ্কেল আমাদের বাড়ি চলে আসেন। গাড়িতেও প্রায় পৌনে এক ঘন্টার পথ পেরিয়ে অতো রাতে আর ফিরে যান না সদরে। কিন্তু এবার যেহুতু আদ্রিয়ান ভাই বাংলাদেশে আছেন আর শরীয়তপুরেই আছেন তাই মানিক আঙ্কেল ভেবেছিলেন এবার বাড়ি চলে যাবেন। আদ্রিয়ান ভাইয়ের বাইক আছে তাই কোন সমস্যা হবেনা। কিন্তু আব্বুও নাছোড়বান্দা। দুজনকে কিছুতেই যেতে দেবেনা। এতো রাতে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা পারি দিয়ে আবার সদরে ফিরতে হবে কেন? এটা কী পর মানুষের বাড়ি? আব্বুর অকাট্য যুক্তির সঙ্গে হয়তো আর পেরে ওঠেনি মানিক আঙ্কেল। হার মানতে হয়েছে। আব্বু, আঙ্কেল, কাব্য আর আদ্রিয়ান ভাই চারজন একসঙ্গেই আসবেন। তাই মা জননীর রান্নার এতো তোরজোড়। আমার আর কী? নামাজটা পড়ার পর বেশ ফ্রেশ লাগছে। কয়েকদিন পরেই রমজান মাস শুরু হবে। হঠাৎই স্মৃতির পাতায় ফিরে গেলাম। রমজান এলেই খুশিতে নেচে ওঠা, রোজার প্রত্যেকটা দিন নানারকমভাবে উপভোগ করা, ঈদের দিনটার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় করার দিনগুলোকে ভীষণ মিস করলাম। ছোটবেলার করা অবুঝ বোকামো, অপ্রয়োজনীয় কৌতূহল, অস্বাভাবিক আনন্দগুলোকে ফিরে পেতে চাইলাম। ফিরে যেতে ইচ্ছে করল দশ বছর পেছনে। ইশ! যদি সত্যিই একটা টাইম মেশিন থাকতো আমার কাছে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয় ব্যপারটা উপলব্দি করে লম্বা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বিছানা শুয়ে কিছুক্ষণ ফোন নাড়াচাড়া করে মেসেঞ্জারে ঢুকলাম। অনেক পুরোনো এক বন্ধু নক করেছে। লক ডাউনের পর আর যোগাযোগ হয়নি। আজ অনেকদিন পর মেসেজ করল। আমিও টুকটাক কথা বলছিলাম ওর সাথে। এরমধ্যেই দরজায় টোকা পড়ল। বুঝলাম এসে গেছে ওরা। আম্মু রান্নাঘরে ব্যস্ত তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই যেতে হলো দরজা খুলতে। খুলে দেখলাম আব্বু আর মানিক আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই একগাল হাসলেন আঙ্কেল। আমিও হেসে বললাম, ‘ আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।’
মানিক আঙ্কেল ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’ বলে আমার মাথায় হাত রাখলেন। মধুর কন্ঠে বললেন, ‘কেমন আছো মামণি?’
‘ভালো। তুমি ভালো আছো?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ্।’
‘ একটু কম কম আসছো আজকাল।’
‘ একটু ব্যস্ত থাকিরে মা। এইতো এলাম।’
‘ আচ্ছা, এসে বসো আগে।’
আব্বু আর মানিক আঙ্কেল দুজনে ভেতরে এসে বসলেন পাশাপাশি। আম্মু ততক্ষণে পানি নিয়ে এসছে দুজনের জন্যে। আমি রুমে এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালাম। আম্মু দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আদ্রি আর কাব্য কই?’
মানিক আঙ্কেল পানি খাচ্ছেন তাই আব্বুই বললেন, ‘আসছে দুজন। খাবার বিলি করা হচ্ছেতো সেই কাজেই হেল্প করছে। শান্ত, সাম্য আর অর্ণবও আছে ওদিকে।’
আম্মু বললেন, ‘ মানিক ভাই এখনই ভাত দেব নাকি একটু জিরিয়ে নেবেন?’
মানিক আঙ্কেল সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল, ‘একটু রেস্ট নেই। ততক্ষণে ছেলে দুটোও আসুক।’
আম্মুও বসলেন ওনাদের পাশে। আমি দেয়ালে হাত ভাঁজ করে কিছুক্ষণ দেখলাম এদের। তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে আবার ডুব দিলাম ফেসবুকের দুনিয়ায়। প্রায় দশমিনিট পর আম্মু তাদের আলাপের তাল কেটে বলে উঠলেন, ‘এসে গেছিস তোরা? আয় তাড়াতাড়ি আয়।’
আমি ফোন থেকে চোখ তুলে দেখলাম। তাকিয়ে দেখি কাব্য আর আদ্রিয়ান ভাই এসছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই মৃদু হাসলেন উনি। এক সেকেন্ডের হাসি। এরপর চোখ সরিয়ে আম্মুর সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবি পড়েছেন আছ। সুঠাম দেহে সাদা পাঞ্জাবীটা সেঁটে আছে। মাথায় টুপি আছে এখনো। টুপির নিচ দিয়ে সামনে নেমে এসছে কিছু মসৃণ চুল। এই লোককে সবসময়ই সুন্দর লাগে তবে আজ স্নিগ্ধ লাগছে। অদ্ভুত পবিত্রতা আছে আজকের সৌন্দর্যে। টুপি-পাঞ্জাবির গুন হয়তো। দেখলাম কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে এসছে দুজন। হয়তো মসজিদ বেঁচে যাওয়া খাবারের প্যাকেট থেকেই এনেছে। দেখেই মন খুশি হয়ে উঠল। আমি একটা হাতাবার জন্যে পা বাড়াতে নিলেই আম্মু চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘আগে ভাত খাবে তারপর এসব।’
আম্মু বলতে বলতে একটা পলিথিন ব্যাগ হাতে নিয়ে নিয়েছি আমি। কিন্তু আম্মুর নিষেধ বাণী শুনে মেকি এক হেসে বললাম, ‘হাতে যখন নিয়ে ফেলেছি। একটু খাই?’
‘ একদম না। এগুলো খেয়ে পেট ভর্তি করে পরে আর ভাত ছুঁয়েও দেখবেনা। তোমাকে ভালোকরেই চিনি আমি।’
‘ বললাম তো অল্প খাবো। পেট ভরবে না। আমার পেটে অনেক জায়গা। আপনি ভাত বারুন।’
আব্বু, আঙ্কেল হেসে ফেললেন আমার কথায়। আম্মু কিছু বলল না। জানে আমি কারো কথা শোনার পাত্রি নই। কাব্য বলল, ‘জীবনে খাস নাই? খাবার দেখলেই এক মাস না খাওয়া বেড়ালের মতো লাফাস কেন?’
আমি কপাল কুঁচকে প্যাকেট খুলতে খুলতে বললাম, ‘তোর তাতে কী? এক মাস না খেয়ে কোন বেড়ালকে লাফাতে দেখেছিস তুই? নিজে আসতে আসতে যে দুই প্যাকেট ফাঁকা করে ফেলেছিস সেটা কেউ না বললেও আমি জানি। যেই লেভেলের খাদক তোরা!’
কথাটা বলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দিকে আড়চোখে তাকালাম একবার। দীর্ঘসময় পর। উনি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। অতঃপর কাব্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কাব্য, আমারতো খাদক তাই এতো লম্বা, ফিট। কিন্তু গান্ডেপিন্ডে গিলেও কেউ যদি পাটকাঠির মতো শুকনা আর মাসে তিনবার সুগার ফল করে পড়ে যাওয়া পেসেন্ট হয়। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে?’
শব্দ করে হেসে ফেলল কাব্য। আমোদিত কন্ঠে বলল, ‘একদম ঠিক বলেছো, আদ্রিয়ান ভাই।’
আদ্রিয়ান ভাই কাব্যর দিকে তাকিয়ে শব্দহীন হাসি হাসলেন। আমি সেদিকে পাত্তা দিলাম না। ওনার দিকে দৃষ্টি রেখেই মুখ ফুলিয়ে প্যাকেটে হাত ঢোকাতে নিলেই চোখ রাঙালেন উনি। এর অর্থ একটাই। ভাত খেয়ে তারপর এগুলো খাওয়ার হুকুম করছেন চোখের ইশারায়। বাড়ির সবার সামনে কিছু বলতে পারবেন না বলেই চোখ দিয়েই কাজ সেরে নিলেন। আমি মুখে এক সমুদ্র মায়া এনে করুণ চোখে তাকাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাতে কোনরকম কোন লাভ হলোনা। ওনার দৃষ্টি কঠোর। আমি গোমড়া মুখ করে রেখে দিলাম প্যাকেটা। ওরা সবাই বেশ অবাক হল। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললাম, ‘ভাত খেয়েই খাই। সত্যিই পরে আর ভাত খেতে পারব না এগুলো খেলে।’
কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। তবে একটু অবাক নিশ্চয়ই হয়েছে। তাও ঠিক আছে। যদি জানতো তাদের সবার কঠোর নিষেধ যেটা করতে পারেনি সেটা এই ঘরেই উপস্থিত একজনের চোখের চাহনী করে ফেলেছে। তাহলে চরম মাত্রায় অবাক হতো। এতো বেশি মাত্রায় অবাক হওয়ার চেয়ে একটু অবাক হওয়া ঢের ভালো।
খাওয়ার সময় উল্লেখযোগ্য বিশেষ আর কোন কথোপকথন হলো না। আব্বু, আম্মু আর আঙ্কেল নিজেদের মতো কথা বলছিল। আদ্রিয়ান ভাই কাব্যর সাথে ছোটখাটো দুষ্টুমি আর মজার আলোচনা করছিল। আমিই একমাত্র ভদ্র মেয়ে, যে কি-না চুপচাপ খেয়ে উঠলাম। পেটে যথেষ্ট জায়গা রেখে দিলাম মসজিদ থেকে আসা খাবারগুলো খাওয়ার জন্যে।
খাওয়া শেষে একটা প্যাকেট নিয়ে আর হাতে ফোনটা নিয়ে সোজা ছাদে চলে গেলাম। মাঝরাতে মুক্ত মেঘলা আকাশ, ফুরফুরে হাওয়া, নিরব পরিবেশটা ভালো লাগছিল বেশ। প্যাকেটটা খুলে রেলিং এ রাখলাম। একটা নিমটি হাতে নিয়ে খেতে খেতে আবার মেসেঞ্জারে ঢুকলাম। সেই বন্ধুর মেসেজের রিপ্লে করে বিরতিতে থাকা কথোপকথন আবার চালু করলাম। এই ছেলের একটা সমস্যা আছে। কথা বলতে শুরু করলেই নিজের ইতিহাস, ভূগোল সব ব্যাখ্যা করা শুরু করে দেয়। তো এই দুই বছরে কী কী হলো সব বলল আমাকে। ওর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেক আপের মর্মান্তিক কাহিনীটাও ব্যাখ্যাসহ বিশ্লেষণ করল। ইচ্ছে করছিল এক ধমকে চুপ করিয়ে দেই। কিন্তু দুই বছর পর কথা হচ্ছে বলে কিছু বলতেও পারছিলাম না। সে কী করুণ বিরহের কাহিনী। শেষে লিখল,
‘আমি কখনোই কাউকে এতোটা ভালোবাসিনি। বাসতেও চাই নি। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেলো। এতটা ইমোশনাল আমি সেটা আমিও জানতাম না। ইমোশনাল ফুল হয়ে গেছি!’
এমনই সময় আচমকাই আমার হাত থেকে ফোনটা ফসকে গেল। না, নিচে পড়েনি। একজন টেনে নিয়ে গেছে। আমি চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম আমার পাশে আদ্রিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে আছে। ফোনটা তারই হাতে। মাথার টুপি খুলে ফেলেছেন। যার ফলে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। উনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন, ‘এতো কার সাথে চ্যাটিং করিস? তাও এতো রাতে?’
কথাটা বলতে বলতে তাকালেন ফোনের স্ক্রিনে। মুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল তার। আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘এই ছেলে তোকে প্রোপোজ করেছে? কবে? আজকে? নাকি আগেই? আগে করলে বলিস নি কেন?’
আমি হতাশ দৃষ্টিতে তাকালাম তার মুখের দিকে। হয়তো শেষ মেসেজটুকু পড়েই ক্ষেপে গেছে। আগে পিছে কিছু দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। উনি আবার বললেন, ‘এই তোর পেছনে আর আশিক আছে বলতো। সমস্যা কী? আইডিতে এতো ছেলে কেন? ঘরের পাগলই ভাত পায় না। এগুলো কোথ থেকে আসে?’
আমি হাত ভাজ করে ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘আমার একশটা আশিক থাকুক। তাতে আপনার কী? আপনিও এক ডজন গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে ফেলুন। আমি কী বারণ করেছি?’
কথাটা বলে নিমটিতে কামড় বসালাম আমি। রাগে কড়মড় করে উঠলেন উনি। বুঝতে পারলাম ফোনটা সর্বশক্তি দিয়ে আছাড় মারার ইচ্ছাটা বহু কষ্টে দমন করলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘তোর সব চ্যাটলিস্ট আজকেই আঙ্কেলকে দেখাব। এরপর ফোনও বন্ধ, চ্যাটিংও বন্ধ। এখন থেকে খালি পড়াশোনা করবি। বাকি সব বন্ধ।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার মুখের দিকে। দুনিয়ার সবার কাছে ম্যাচিউরিটিতে পিএইচডি করা ছেলেটা আমার ব্যাপারগুলোতে এমন বাচ্চা হয়ে যায় কেন? ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘আব্বুকে দেখানোর আগে নিজেও একবার পড়ে দেখুন। এক্সপ্লেইন করতে সুবিধা হবে। এছাড়াও কার কার সাথে কী কী প্রেমালাপ করছি সেটাও দেখে নিন। ভালো করে দেখে নিন সব পড়বেন। কিচ্ছু বাদ রাখবেন না। না হলে ভালোভাবে বলবেন কীকরে?’
আদ্রিয়ান ভাই আমার দিকে ‘খেয়ে ফেলবো’ টাইপ একটা দৃষ্টি উপহার দিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালেন। আমি রেলিং এ হেলান দিয়ে হাত ভাঁজ করে দেখছি তার তামাশা। মেসেজ পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে তার কোঁচকানো ভ্রু জোড়া সোজা হল। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে তাকালেন আমার দিকে। ফোনটা বাড়িয়ে দিলেন এক হাতে। আমি ফোনটা হাতে নিতে নিতে বললাম, ‘কী হল বলবেন না? চলুন আমিও যাই আপনার সাথে।’
জবাব দিলেন না উনি। গুনে গুনে ঠিক দু সেকেন্ড পড়েই সামান্য গলা ঝেড়ে একদম স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, ‘চা বানাবি?’
আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম তার দিকে। শেয়ানাগীরিতেও যে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে ফেলেছে বুঝতে অসুবিধে হলোনা। কী দারুণ স্টাইলে টপিক বদলে ফেলল! যেন কিছুই হয়নি। দম ফাটা হাসি পেল আমার। কিন্তু হাসিটাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেললাম মুহুর্তেই। হাত দুটো পেছনে নিয়ে একত্রিত করে ওনার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘কেন? চা খেতে খেতে বলবেন?’
আবার সেই কটমটে দৃষ্টিতে তাকালেন উনি। এতক্ষণ ধরে পুশে রাখা ধমকটা দিয়ে বললেন, ‘আমার যখন সময় হবে আমি বলব। যা, চুপচাপ গিয়ে চা বানিয়ে আন।’
ঠোঁট চেপে ধরে দ্বিতীয়বার হাসি নিয়ন্ত্রণ করলাম আমি। এখন হাসলেই ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই ওনাকে আর না ঘাটিয়ে মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে নিচে চলে এলাম চা বানাতে।
রাতে আদ্রিয়ান ভাই ঘুমালেন কাব্যর রুমে। মানিক আঙ্কেল বাবার সাথে। নানু যে রুমটাতে থাকে আম্মু গিয়ে সেই রুমটাতে শুয়ে পড়লেন। খুব দরকার না হলে আমার রুমে আমি ছাড়া আর কেউ ঘুমায় না। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকতেই দেখলাম সেই ফ্রেন্ডের মেসেজ। আমি রিপ্লেতে লিখলাম, ‘ ভাই তোমার ব্রেকআপ স্টোরির শুনতে গিয়ে এদিকে একজন মিনি ছ্যাঁকা খেয়ে বসছিল।’ মেসেঞ্জারে চ্যাট গ্রুপে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাতের প্রায় শেষ প্রহরে গিয়ে ঘুমোলাম সেদিন।
সকালে পায়ের নিচে আলতো সুরসুরি অনুভব করে লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। এমনিতেই আমার সারা শরীরে মারাত্মক লেভেলের সুরসুরি। কেউ ধরতে আসলেই রীতিমতো লাফিয়ে উঠি। সুতরাং পায়ের নিচের কথাতো আর আলাদাভাবে বলার দরকার নেই। প্রথমত সুরসুরি, দ্বিতীয়ত হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠা, তৃতীয়ত সেটা ছিল আবার কাঁচা ঘুম। অবস্থা আমার বেগতিক। বুকে হাত রেখে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজের অবস্থানটা বুঝতেই লেগে গেল এক মিনিট। যথাসম্ভব স্বাভাবিক হয়ে তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে আছে পায়ের কাছে। থুতনিতে এক হাত রেখে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মৃদু হাসছেন উনি। ব্যপারটা বুঝতে সময় লাগল না আমার। আমি এক ড্রাম বিরক্তি নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম আরও কিছুক্ষণ। এরপর উঠে দুই হাটুতে ভর করে বসে বললাম, ‘এক কাজ করুন। আদালতের কোন একটা এপিসোডে যেন দেখেছিলাম ইনজেকশন দিয়ে হার্ট ফেইল করায়। ওগুলো একটা এপ্লাই করুন। শিওর কাজে দেবে। যা করার একবারেই করুন। এই হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণ করে হার্ট ফেইল করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে কী লাভ বলুন?’
আমি কথাগুলো বলার সময়ও হাঁপিয়েছি একপ্রকার। উনি এমন একটা ভাব করলেন যেন শুনতেই পান নি আমার কথা। ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে বললেন, ‘একটু চা বানাতো। ঘাড় ম্যাচম্যাচ করছে। বাইরে উঠোনে আছি আমি।’
কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না উনি। ঠিক নিজের বিয়ে করা বউয়ের মতো অর্ডার করে দিয়ে চলে গেলেন। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে তাকালাম তার যাওয়ার দিকে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ফোনটা হাতে তুলে সময় দেখলাম সাড়ে ছ’টা বাজে। এবার সত্যি সত্যিই হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল আমার। এমনিতেই ঘুমোতে ঘুমোতে চারটের বেশি বেজে গেছিল। তিন ঘন্টাও ঘুমোতে পারলাম না। একটা বাচ্চার ওপর এরকম টর্চারের কোন যুক্তি আছে? সকাল সকাল তার চা খেতে ইচ্ছে করল। শালা, তুই বউ হারা হবি। ওনাকে একটানা বউ সংক্রান্ত সমস্তরকম দুর্ভাগ্যের অভিশাপ দিয়ে একটু হালকা বোধ করলাম। এরপর এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করে ঘুমে ঢলতে ঢলতে রান্নাঘরে গেলাম। ভাগ্যিস চা, কফি ছাড়া জীবনে কিছুই বানাই নি নিজের হাতে। তাই রান্না করতেও জানিনা। জানলে না জানি আর কী কী অর্ডার করে বসে থাকতো এই নবাবজাদা।
দু হাতে দু কাপ চা নিয়ে উঠোনে গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাই হাঁটছেন উঠোন জুড়ে। জিন্সের পকেটে হাত গুজে দিয়েছেন। পরনে শুধু একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। চুলগুলো অতিরিক্ত এলোমেলো। সকালে উঠে আঁচড়ায় নি বোধ হয়। সকালের সিগ্ধতার পাতলা ঠোঁটজোড়ার বেবি পিঙ্ক রঙটা যেন আরও ফুটে উঠেছে। সব বিরক্তি, রাগ জল হয়ে গেল অজানা কোন কারণে। আমি ওনার ওপর থেকে নিজের গভীর মনোযোগ সরিয়ে এগিয়ে গেলাম দ্রুত পায়ে। নিজের কন্ঠে যথাসম্ভব বিরক্তি ঢালার চেষ্টা করে বললাম, ‘নিন, ধরুন আপনার চা।’
উনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। হয়তো দুটো কাপ দেখে। একটা কাপ নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘কেউ জেগেছে এখনো?’
আমি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখে বললাম, ‘না।’
আদ্রিয়ান ভাই এগিয়ে গেলেন। আমিও ওনাকে অনুসরণ করেই হাঁটছি। বাড়ির সামনের চার ফুটের দেয়ালটায় উঠে বসলেন উনি। ওনার দেখাদেখি আমিও উঠে বসলাম। এক হাত ধরে সাপোর্ট দিয়ে বসতে সাহায্য করলেন উনি আমাকে। দেয়ালের ওপর পাশাপাশি বসে কেটে গেল কিছু নিরব মুহূর্ত। সামনে প্রায় জনশূণ্য রাস্তা, ডান পাশে ক্ষেত, সামনে কিছুটা দূরে বাঁশঝাড়। সকালের স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় চমৎকার লাগছিল সবটা। নিরবতা কাটিয়ে উনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তো ঢাকা কবে যাওয়া হচ্ছে?’
আমি দূরের ক্ষেতের দিকে দৃষ্টি ফেলে বললাম, ‘ হয়তো ঈদের পরে।’
‘ মোহাম্মদপুর বাসা দেখছিস নাকি হোস্টেল?’
আমি চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললাম, ‘যাবো কি-না এখনো সেটাইতো জানিনা।’
‘ ইনকোর্সটা দিলে কী হতো?’
‘ কী পরীক্ষা দেব। বই-ই কিনিনি। আপনি জানেন সেটা।’
না তাকিয়েও বুঝলাম উনি এবার আমার দিকে তাকিয়েছেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘কী চাইছিস কী তুই?’
আমি এবার তাকালাম ওনার দিকে। ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘মানে?’
উনি নিজের কাপটা নামিয়ে পাশে রেখে বললেন, ‘মেডিকেলে ফর্ম তুলেও এক্সাম দিলিনা। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েও ভর্তি হলিনা। যেখানে মনেপ্রাণে চেয়েও পরীক্ষার ফর্মটাও তুলতে পারেনা অনেকে মার্কস কম থাকায়। বাকিগুলো ছাড়। ন্যাশনালে এডমিট হয়েও ক্লাসটা অবধি করছিস না। ইনকোর্স দিলিনা। কী সমস্যা?’
আমি তাকিয়ে রইলাম ওনার মুখের দিকে। এই প্রথম হয়তো পড়ার ব্যপারে এতো ঠান্ডা গলায় কথা বললেন আমার সঙ্গে। তবুও আমি মজা করে বললাম, ‘সমস্যা হল কনফিউশন। কী হতে চাই সেটাই ঠিক করতে পারলাম না। তাই ভাবলাম কোনটাই না হই। কল্পনায় যা খুশি হয়ে নেব। যেদিন যেটা হতে মন চাইবে।’
‘ আ’ম সিরিয়াস।’ আরও গম্ভীর হল ওনার কন্ঠস্বর।
‘ ষাট সত্তর বছরের জীবনে এতো সিরিয়াস হয়ে কী হবে? তারপর যদি হয় আবার অকাল মৃত্যু। ভাবুন কত বড় লস। পুরো সিরিয়াসনেসটাই পানিতে।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘ইচ্ছে করছে চড়িয়ে গাল লাল করে দেই।’
বুঝলাম সত্যিই অনেক কষ্টে থাপ্পড় মারা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন উনি। আমি গলা ঝেড়ে হালকা একটু দূরে সরে বসার ভান করলাম। কিন্তু সরলাম না। উনি এবার সবকিছু ইগনোর করে বললেন, ‘এনিওয়ে, এবার যা করার করেছিস। সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দিচ্ছিস তুই। এন্ড এবার তোর মর্জিমতো কিছুই হচ্ছেনা। আমরা যা বলব তাই হবে। গট ইট?’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। কিছু বললাম না। কারণ কিছু বলে কোন লাভ নেই। নিঃশব্দে কাটল আরও কয়েকটা মিনিট। অনেক কিছু ভাবলাম মনে মনে। অনেক কল্পনা জল্পনা চলল মস্তিষ্ক জুড়ে। সেসবের মাঝেই ওনার একহাত আকড়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিলাম তার ওপর। আনমনেই বলে বসলাম, ‘আমি হয়তো অতিরিক্ত অদ্ভুত তাইনা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব? স্বাভাবিক নই। অবাধ্য, বেপরোয়া হয়তো পাগলও।’
উনি আমার এক হাত তুলে নিলেন নিজের হাতের মুঠোয়। আমি ধীরে ধীরে দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। আদ্রিয়ান ভাই আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, ‘তোমার এই বেপরোয়া, অবাধ্য, পাগল টাইপ ব্যক্তিত্বের জন্যেই তো তুমি আমার। স্বাভাবিক কোনকিছুর প্রতি আমি আকৃষ্ট হইনা। স্বাভাবিক কারো আদ্রিয়ানের প্রেয়সী হওয়ার যোগ্যতা নেই। তুমি অস্বাভাবিক বলেই তুমি মায়াবিনী, আদ্রিয়ানের মায়াবিনী।’
আমি মৃদু হাসলাম। অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম নিরবে। উপলব্ধি করলাম পাশে থাকা পুরুষটির কাছে আমি কতটা বিশেষ। উপলব্ধি করলাম আমার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বলা বাক্যটাকে, ‘তুমি অস্বাভাবিক বলেই তুমি মায়াবিনী, আদ্রিয়ানের মায়াবিনী।’
…
[ রি-চেইক করিনি। সেহেরির পর ঘুম আসছিল না তাই লিখে ফেললাম। ভালোবাসা রইল। হ্যাপি রিডিং ]