অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২৭
ফেব্রুয়ারি মাসটা নাকি ভালোবাসাময়। সে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহকে বলা হয় ভ্যালেন্টাইন উইক। ভালোবাসার সপ্তাহ! কিন্তু আমার জন্যে এবারের ভালোবাসার সেই এক সপ্তাহ মোটেও ভালোবাসাময় ছিলোনা। যদিও সেই বিশেষ মানুষটা সবসময়ই বলে, ‘আমি আলাদা করে ভালোবাসা দিবসে বিশ্বাসী নই। যেদিন থেকে ভালোবাসা নামক অনুভূতি আমাকে গ্রাস করেছে সেদিন থেকে প্রত্যেকটা দিনই আমার কাছে ভালোবাসার।’ কিন্তু তাই বলে ভালোবাসার গোটা সপ্তাহ জুড়ে কোথাও ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও থাকলোনা? সে না থাকুক। আমাদের দুজনেরই সেসবে বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু তার বদলে গোটা সপ্তাহ জুড়ে চলল রাগ, অভিমান আর শেষে অনিচ্ছাকৃত আমার হাতে পাওয়া একটা ব্যথা। বিষয়টা মন খারাপ করার মতো বৈ কী।
তারিখটা ফেব্রুয়ারির দশের কাছাকাছি কোন একটা সংখ্যা হবে। তবে দিনটাকে প্রপোজ ডে বলা হয়। লোকে তাই বলে। নিউজফিড স্ক্রোল করছিলাম বলে স্পষ্ট মনে আছে ব্যাপারটা। আমার জীবনের অফুরন্ত মজার ব্যপারগুলোর মধ্যে অন্যতম মজার ব্যপার এই ‘প্রপোজ’। জীবনে কয়েকটা প্রপোজাল পেয়েছিলাম এবং পাচ্ছি। সবগুলোই সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু প্রেম নামক অনুভূতিতে যার সাথে জড়িয়েছি সে কোনদিন কোনভাবেই আমাকে প্রপোজ করেনি। বিষয়টা মজারই বলা চলে। যাই হোক ঘটনায় আসা যাক। ঐদিন বিকেলবেলা আচমকাই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এলেন আমাদের বাড়ি। কোন একটা কাজে জাজিরা এসছিলেন। সদরে ফেরার আগে দেখা করতে এসেছেন। আম্মু যথারীতি ওনাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলেন। চাঁদের টুকরো ছেলে তাদের। দেখলেই টুকুস করে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করে। এই ছেলেটার মধ্যে এমন কী বিশেষ গুণ আছে আমি বুঝিনা। কেউ জাস্ট একঘন্টা ওনার সাথে কাটালে পরের মুহূর্ত থেকেই আদ্রিয়ান ভক্ত হয়ে যায়। লন্ডন থেকে হিপনোটাইজ করার বিদ্যা শিখে এসেছে না-কি? দূর আমিও কী ভাবছি! এই ধারাতো সেই ছোটবেলা থেকেই চলে আসছে। তাইতো সেই ছোটবেলা থেকেই ওনাকে এতো হিংসে করি আমি। যেটা লিখছিলাম, উনি আসার পরেই আমি একপলক ওনাকে দেখে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। আম্মু হয়তো আপ্যায়ন শুরু করে দিয়েছে। আর সে মুখে কিছু খাবোনা খাবোনা করলেও ঠিকই যা যা দেবে সব সাবাড় করে তবেই যাবে। এমনিতেই দুপুর থেকে খানিকটা অসুস্থ লাগছে তারওপর এসব নাটক। জীবনটাই নাটকীয় হয়ে গেছে আমার। নাটকের চেয়ে কোন দিক দিয়ে কম? আজ না-কি আবার প্রপোজ ডে। যেখানে অন্যসব বয়ফ্রেন্ডরা লুকিয়ে লুকিয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে যায়, কত প্লান করে সেখানে এই মহাশয় বুক ফুলিয়ে তার না হওয়া শাশুড়ির হাতে জামাই আদর খাচ্ছে। চমৎকার! আমিও যে তার অপেক্ষায় বিরহিনী হয়ে বসে ছিলাম ব্যপারটা সেরকমও নয়। সত্যিই কী অবাক করা প্রেমিক-প্রেমিকা আমরা। এই কাহিনী ইতিহাস গড়তে সক্ষম।
প্রায় আধঘন্টা কেটে যাওয়ার পর পানি পিপাসা পেয়ে বসল আমার। রুমে রাখা পানির বোতলটাও খালি। তাই পানি আনতে বোতল নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম বসার ঘরের দিকে। গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান ভাই বসে বসে পিঠা খাচ্ছেন, আম্মু পাশেই বসে আছে। কী যত্ন! আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আমায় দেখে একপলক তাকালেন উনি। দুই সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকলেন না। চোখ সরিয়ে নিলেন। আম্মু বললেন, ‘কী ব্যপার অনু? রুমে বসে আছো কেন? ভাইয়া এসছে, কথা বলো?’
আমি আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘ভালো আছেন ভাইয়া?’ তারপর ওনার উত্তরের অপেক্ষা না করেই আম্মুর উদ্দেশ্যে বললাম, ‘হয়েছে? আমার ঘুম পাচ্ছে। আমাকে ডিনারের আগে আর ডাকবেন না, শরীর ভালো লাগছে না।’
আম্মু কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন তার আগেই উনি আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মামণি! মেয়েকে চিড়িয়াখানায় রেখে এসো। চিড়িয়াখানার একদম প্রথম খাঁচায় থাকার জন্যে এলিগেবল হয়ে উঠছে দিনদিন।’
আম্মু হেসে ফেললেন। সে হাসি ওনার মুখেও সংক্রমিত হল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু। কী অসাধারণ দৃশ্য। আমার লেগ পুল করতে পেরে দুজনেই ভীষণ তৃপ্ত। শরীর ঠিক থাকলে দিতাম কয়েকটা শুনিয়ে। কিন্তু এখন কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই। আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বোতলটা নিয়ে রুমের দিকে এগোতে নিলেই সবটা ঝাপসা হয়ে উঠল আমার কাছে, শরীর ছেড়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে দ্রুত বসে পড়লাম আমি। শরীর এতোটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম যে বসে পড়াটাও পড়ে যাওয়ার মতো লাগল। আম্মু দ্রুত উঠে আমার পাশে বসে বলল, ‘অনু? কী_’
এটুকুই মনে করতে পারি আর মনে পড়ে ওনার হতভম্ব মুখ। ঐ সময়টুকুতে আর কিছু তেমন খেয়াল নেই আমার। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছিল। আম্মুর কথাগুলো অস্পষ্ট ভেসে আসছিল কানে। কেমন অদ্ভুত লাগছিল। কীভাবে লিখে প্রকাশ করব সেটাই বুঝতে পারছিনা। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে স্পষ্ট বুঝে গিয়েছিলাম আমার সুগার ফল করেছে। এইজন্যই দুপুর থেকে শরীর খারাপ লাগছে। যখন একটু বোধ হল দেখলাম আদ্রিয়ান ভাই আমার হাতের তালু ঘষে দিচ্ছেন। উনি ব্যস্ত কন্ঠে আম্মুকে বললেন, ‘ মামণি চিনির শরবত করে আনো। তোমাদের আদেরর দুলালির আবার সুগার ফল করেছে।’
আম্মু পাঁচ মিনিটের মধ্যে শরবত নিয়ে এলেন। শরবত খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কিছুটা ভালো লাগতে শুরু করল। কিন্তু শরীর তখনও দুর্বল ছিল। গায়ে জোর পাচ্ছিলাম না। সোফাতেই গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম চুপচাপ। শরীর হঠাৎই এতোটা খারাপ হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। এই গোটা সময়টা আমার দিকে তাকালেন না আদ্রিয়ান ভাই। শুধু আম্মুর সাথেই কথা বললেন। অদ্ভুতভাবে কথাগুলো সব আমার বিষয়েই হচ্ছিলো। কিন্তু কী কী কথা বলেছে স্পষ্ট মনে নেই এখন আমার। একটু পরে আম্মু আমাকে পাউরুটি আর কলা খেতে দিলেন। আমার এগুলো খেতে কোনকালেই ভালো লাগেনা। কিন্তু সেদিন আদ্রিয়ান ভাইয়ের গম্ভীর মুখ দেখে কী হল কে জানে? চোখ-মুখ সব বন্ধ করে খেয়ে ফেললাম সবটা। কিন্তু মহাশয়ের গাম্ভীর্যতা গেলো না। আমার সাথে কথা বলাতো দূর ঘুরেও তাকালেন না। এতো রাগ করার কী ছিল সেটাই বুঝলাম না। সন্ধ্যা প্রায় সাতটার সময় আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন উনি। উনি যাওয়ার পর নিজের রুমেই গা ছেড়ে বসে রইলাম চুপচাপ। শরীর ভালো লাগছেনা, দুর্বল লাগছে। তারওপর মনটাও ভালো নেই। শরীর খারাপ কী কেউ ইচ্ছে করে করে? আমি কী নিজে আমার ব্লাডের সুগারকে বলেছি ভাই তুই ফল করে যা। বলিনি তো? তাহলে আমার ওপর রেগে যাওয়ার লজিকটা কী ছিল সেটাই এখনো বুঝলাম না।
রাতে শুয়ে শুয়ে কয়েকবার ওনাকে ফোন করার কথা মনে হলেও ফোন করলাম না। কীরকম মেজাজে আছে কে জানে? যদি বকে? এই লোকটাকে আমি কোনদিনও বুঝে উঠতে পারিনা। সে কখন কী করে, কেন করে সেটা শুধুমাত্র সে আর আল্লাহ্ জানেন। এইতো গতবছর ডিসেম্বর মাসের কথা। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ হবে হয়তো সেটা। কোন একটা কারণে মন ভালো ছিলোনা আমার। আর আমার একটা অন্যতম সমস্যা হল মন-মেজাজ খারাপ থাকলে আমার কারো কল রিসিভ করতে ইচ্ছে করেনা। সে যত কাছের লোক হোক কিংবা যত জরুরী কলই হোক না কেন। আর সেরকম এক ভয়ানক অসুস্থতা আর মন খারাপের সময়ই আদ্রিয়ান ভাই ফোন করে বসলেন। আর যথারীতি আমি তার ফোন তুললাম না। না তোলার পেছনে কোন গ্রহণযোগ্য যুক্তি বা কারণ ছিলোনা। তবুও আমি রিসিভ করিনি। তার ঠিক দুদিন পর মন শরীর দুটোই ঠিক হল। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর আচমকাই তার সেই কলের কথা মনে পড়ল। সেদিন রিসিভ করিনি বলে মনে মনে ভীষণ আফসোস হলো। সময় নষ্ট না করে তখনই কল করেছিলাম ওনার নাম্বারে। কিন্তু এবার উনি ফোন তুললেন না। কিছুক্ষণ ট্রায় করার পরেও যখন তুললেন না তখন আমিও বিরক্ত হয়ে আর ফোন দিলাম না। দরকার হলে নিজেই আবার দেবে।
আম্মু তখন অফিস থেকে ট্রেনিংয়ের জন্যে ঢাকা গেছেন তিনদিনের জন্যে। বাড়িতে আব্বু, আমি আর কাব্য। রান্নার জন্যে একজন মহিলাকে রাখা হল। এই তিনদিন রেঁধে দিয়ে যাবে। আমাদের এলাকাতেই থাকেন সে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আব্বু বাড়িতে নেই। কাব্য ব্যাডমিন্টন খেলতে গেছে। কনকনে শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন খেলার চান্স খুব কম ছেলেরাই মিস করে। আমি নিজেও খেলি, তবে মাঝেমাঝে। বাবা-মা দুজনেই চাকরি করাতে বাড়িতে একা থাকার অভ্যাস আমার ছোটবেলা থেকেই হয়ে গেছে। খালি বাড়ি পেয়ে দরজা-জানলা সব বন্ধ করে আরামে ঘুমোচ্ছিলাম লেপ মুড়ি দিয়ে। ঘুম ভাঙল দরজায় নক পড়ার শব্দে। বেশিক্ষণ হয়নি ঘুমায়েছি। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে বিরক্ত হলাম প্রচুর। এমনিতেই সারাদিন কিছু খাইনি। কাব্য এসেছে ভেবে ওরকম আধপাগল অবস্থাতেই চলে গেলাম দরজা খুলতে। ছেলেটা বলেছিল আসতে রাত হবে সেইজন্যই তো ঘুমিয়েছিলাম একটু। অথচ সন্ধ্যাবেলা চলে এসে কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল আমার। অসভ্য ছেলে। কিন্তু আগন্তুককে দেখে আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে স্হির হয়ে গেলাম। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। এই মুহূর্তে ওনাকে এখানে মোটেও আশা করিনি আমি। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে আমার সেই দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে এলেন। এসে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন নির্বিকারভাবে। আমিও দরজা বন্ধ করে ভেতরে এলাম। এতোটাই অবাক হয়েছি যে কী বলব, কী করব বুঝতে পারছিনা। শুধু তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। অসহ্যকর নিরবতায় কেটে গেল পাঁচ মিনিট। নিরবতা কাটিয়ে উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘টাওয়েল দে।’
উনি হঠাৎ কথা বলাতে হালকা চমকে উঠলাম আমি। দ্রুত পদে গিয়ে একটা টাওয়েল এনে বাড়িয়ে দিলাম ওনার হাতে। উনি কোন কথা না বলে টাওয়েল নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি বোকার মতো স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানেই। উনি হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে আবার সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। চুল পানিতে ভিজিয়ে নিয়েছে অনেকটা। কপালে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে ভেজা চুল। স্নিগ্ধ মুখ আছে একরাশ গাম্ভীর্যতা। জ্যাকেটটা খুলে রাখলেন একপাশে। হাত বাড়িয়ে রিমোট টা নিয়ে টিভি অন করলেন। টিভির দিকে দৃষ্টি রেখেই আমাকে বললেন, ‘ভাত-টাঠ যা আছে নিয়ে আয়।’
আমি আরও একদফা অবাক হলাম। ভাত খাবে এখন? গিয়েছিল কোথায়? আর এলোই বা কোথা থেকে? আর এখানে কেন? মনে এতোগুলো প্রশ্ন থাকলেও কিছুই বলা হলোনা। সেইমুহূর্তে যেন বাচাল অনিও বোবা হয়ে গেছিল। একটা শব্দও না করে চুপচাপ ওনার জন্য ভাত নিয়ে এলাম। কিন্তু ভাত আনার পর উনি যা বললেন তাতে আমার চোখ কপালে। টিভির দিকে দৃষ্টি রেখেই উনি বললেন, ‘ চুপচাপ খেয়ে শেষ কর।’
আমার মুখ তখন হাফ ইঞ্চি হা হয়ে গেল। আমার জন্যে আনতে বলেছিল? বললেই হতো। তাহলে এতোগুলো ভাত আনতাম না। কিন্তু সেবারেও কিছুই বলতে পারলাম না আমি। খিদেও পেয়েছিল তাই চুপচাপ খেয়ে নিলাম। তবে পুরোটা খাওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। উনি তখনও টিভিতে মগ্ন। সেদিন আমার কী হয়েছিল কে জানে? আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না ওনাকে। কথা বলার সাহসই পাচ্ছিলাম না। সকল শব্দ যেন হারিয়ে গিয়েছিল আমার মস্তিষ্ক থেকে। তাই ওনাকে জিজ্ঞেস না করেই ওনার জন্যে কফি বানিয়ে ফেললাম। কফি, চানাচুর আর বিস্কুট নিয়ে দিলাম ওনার সামনে। কিন্তু এবারও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না উনি। ওনার সম্পূর্ণ মনোযোগ টিভিতে। আমি আর ওখানে দাঁড়ালাম না। নিজের রুমে চলে এলাম। উনি কেন এসছেন এখানে? মতলব কী? কিছু বলার হলে বল না হলে যা করতে এসছিস করে চলে যা না ভাই! এভাবে টেনশনে রাখার মানে হয়? বেশ কিছুক্ষণ এরকম অস্বস্তিকর অবস্থায় কেটে যাওয়ার পরেই বসার ঘর থেকে ওনার ডাক পড়ল। চমকে উঠলাম আমি। যাবো কী যাবোনা ভাবতে ভাবতেই আবার ডাক পড়ল। কোন উপায় না পেয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম বসার ঘরে। টিভি বন্ধ করে দিয়েছেন। কফি আর চানাচুর খাওয়া শেষ। বিস্কুট সেভাবেই পড়ে আছে। ওনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চেহারা থেকে গাম্ভীর্য সরেনি এখনো তবে চুলগুলো শুকিয়ে গিয়ে আরও এলোমেলো লাগছে। আমার দিকে এক টানা দশ সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে থেকে উনি বললেন, ‘ফোন জিনিসটা থাকে কেন মানুষের কাছে?’
আমি কোন জবাব দিলাম না। মাথা নিচু করে ফেললাম। গত তিনদিনের রাগ এবার একসঙ্গে ঝাড়বে। বুঝে গেছি। আমার কোন উত্তর না পেয়ে উনি একই গলায় বললেন, ‘সারাদিন গান শোনা আর ইউটিউব স্ক্রোল করার জন্যেই আছে ফোনটা? তাহলে শুধু সিমটা রেখে দিছিস কেন? ভেঙ্গে ফেল। নাকি আমি হেল্প করব?’
আমি মাথা তুলে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে সাথেসাথে চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি এবার গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে বললেন, ‘আর কফি দিয়ে রুমে চলে গেলি কেন? এখানে কী সার্কাস দেখাতে এসছি আমি?’
আমি হাত কচলাচ্ছি শুধু, দৃষ্টি ফ্লোরে আটকে গেছে। এবার থাম নারে ভাই! আর কত বকবি? আমাকে সেবারও নিশ্চুপ দেখে উনি আরও রেগে গিয়ে বললেন, ‘এখন চুপ করে থাকলেই আমার হাত চলবে। এমনিতেতো কথা থামানো যায়না। এখন কথা বল?’
আমি তখনও চুপ। এরকম অবস্থায় কী বলা যায়? এবার ঘর কাঁপিয়ে একটা ধমক দিয়ে বসলেন উনি। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। উনি অনেকটা জোরেই বললেন, ‘এমনিতেই তিন-তিনবার ফোন দেওয়ার পরেও রিসিভ করার নাম নেই। তারওপর দুদিন পর গিয়ে মনে পরল যে কল ব্যাক করা উচিত? আজ আমি নিজে এসছি আর উনি ভাব নিয়ে রুমে বসে আছে। ওই তোর স্কেল কই? স্কেল আন।’
আমি স্তব্ধ, মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ তুলে তাকানোর সাহসটুকুও আর রইল না আমার। আরেকটু কেঁপে উঠলাম আবার ওনার আওয়াজ শুনে। সেই রাগী আওয়াজেই বললেন, ‘আর এখন কটা বাজে? সারাদিন পর এখন খাওয়ার কথা মাথায় এসছে? সারাদিন এতো ঘুম আসে কোথা থেকে? সারারাত চুরি করিস নাকি?’
আমার কিছুক্ষণের নিরবতা চলল ঘরটাতে। আমিও ঠায় দাঁড়িয়ে আছি স্টাচু স্টাইলে। কিছুক্ষণের নিরবতার পর উনি এবার গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে বললেন, ‘পানি আন।’
আমি আর এক মিনিটও দাঁড়ালাম না। প্রায় দৌড়ে গেলাম পানি আনতে। লোকটার মাথা ঠান্ডা করা প্রয়োজন। নরমাল পানি আর ফ্রিজের ঠান্ডা পানি মিক্সট করে নিয়ে গিয়ে এগিয়ে দিলাম ওনার দিকে। হাত এখনো কাঁপছে আমার। উনি পানির গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকেই শেষ করে ফেললেন। জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে আবার গা এলিয়ে দিলেন সোফায়। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পরে রইলেন ওভাবেই। আমি অসহায় বালিকার মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার দেখা জগতের সবচেয়ে অদ্ভুত মানুষটাকে। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পর চোখ খুলে সোজা আমার দিকে তাকালেন উনি। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। গম্ভীর গলাতেই বললেন, ‘শরীর মন সব ঠিক আছে? আর ইউ ফাইন নাও?’
আমি একদম খাঁটি বলদে পরিণত হয়েছিলাম সেই মূহুর্তে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। এটা কোন কোয়ালিটির মানুষ! আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি ধমকে বলে উঠল, ‘কী সমস্যা? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? জীবনে দেখিস নি আমাকে?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কোন ভাষা খুঁজে না পেয়ে কেবল ‘হুঁ’ শব্দটাই বের হল আমার মুখ দিয়ে। উনি কিছু বললেন না। বসে রইলেন চুপচাপ। আমিও দাঁড়িয়ে রইলাম একই জায়গায়। লাস্ট কবে এক জায়গায় এভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম নিজেই ভুলে গেছি। কিছুক্ষণ পর সোজা হয়ে বসলেন উনি। হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে উঠে দাঁড়েলেন। তারপর বললেন, ‘দরজাটা লাগিয়ে দে।’
বলে এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে হনহনে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি অনেকটা ঘোরের মধ্যে থেকেই দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। এরপর ওখানেই অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলাম আমার সাথে এক্চুয়ালি এতক্ষণ হল টা কী? লোকটা এসে আমাকে মন মতো ঝেড়ে দিয়ে চলে গেল আর আমি অবলা নারীর মতো শুধু শুনলাম। কেন? কী হয়েছিল টা কী আমার? এমন খাজ বলদ হলাম কবে থেকে?
…
[ এই পার্টটা এখন শেষ হয়নি। আরো কিছু ঘটনা আছে। সব লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে তাই বাকি অংশ আরেকদিন দেব। ]