অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৩
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
মানিক আঙ্কেলের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর থেকে দুদিন ভালোই কাটলো। তবে মাঝেমাঝেই মনের কোণে ‘আদ্রিয়ান’ নামক মানুষটা উঁকি দিতো। কিন্তু ঐ সময় ঐ বয়সে এটাকে অন্যকোন ভঙ্গিতে ভাবতে পারিনি আমি। তবে তার প্রতি জন্মেছিল আমার প্রচুর কৌতূহল। ভাবতেই অবাক লাগছিল যে এই ছেলেটার সাথেই আমি ছোটবেলায় বর-বউ খেলেছি। তাও ছোট ছোট হাড়ি-পাতিল, বাঁশ-কলাপাতার ঘর, কাঁঠাল গাছকে বিদেশ বানিয়ে। সত্যিই হাসি পাবার মতই ঘটনা। যাই হোক, যেহেতু সে বড় হওয়ার পর এবং বিদেশ থেকে ছুটিতে আসার পর প্রথম শরীয়তপুর এসেছেন তাই স্বাভাবিকভাবে প্রায়ই তার আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু হলো। আর সেসময় আমিও এক ভীষণ অদ্ভুত কাজ করতাম। সেটা কেন করতাম তার ব্যাখ্যা আমি আজও মানে এই চারবছরেও নিজেকে দিতে পারিনি। সে যখনই বাড়িতে আসতেন আমি দরজার আড়ালে গিয়ে বা পর্দার আড়ালে থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতাম। তারচেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ওই সময় তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে আমার ওপরে এসেই পড়তো। আমি আড়ালে লুকিয়ে থাকতাম তবুও কোন না কোনভাবে আমাকে দেখেই ফেলতেন। চোখাচোখি হতেই আমি চট করে লুকিয়ে পড়তাম দরজা বা পর্দার আড়ালে। কিন্তু বিশেষ কোন লাভ হতোনা তার চোখে পড়েই যেতাম। এরকমই একবার সন্ধ্যাবেলায় মানিক আঙ্কেল আর আদ্রিয়ান ভাই এসেছিলেন বাড়িতে। আর তার আসার খবর পেয়েই নিয়মমতো তাকে আড়াল থেকে দেখার ইচ্ছে জেগেছিল মনে। আমি বরাবরের মতই দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম তাকে। বাবা আর মানিক আঙ্কেল কথা বলছেন। হঠাৎ করেই তার চোখ পড়েছিল আমার দিকে আমি সাথেসাথেই পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছিলাম। তবে বরাবরের মতো সেবারেও দেখে ফেলেছিলেন আমাকে। কিন্তু সেবার কী মজা পেয়েছিলেন জানিনা, আমাকে ওভাবে চোরের মতো লুকিয়ে পড়তে দেখে ফিক করে হেসে ফেলেছিলেন। ঐ হাসিটা যেনো দমকা এক হাওয়ার মতো বয়ে গেছিল আমার কিশোরী মন ভেদ করে। তার হাসির আওয়াজ শুনে বাবা আর মানিক আঙ্কেল কথা থামিয়ে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। তাদের তাকাতে দেখে আদ্রিয়ান ভাই হাসি থামিয়ে হালকা করে গলা ঝেড়ে বললেন, ‘সরি, তোমরা কনটিনিউ কর।’
সে কথাটা বলার পর বাবা আর আঙ্কেল আবার কথায় মনোযোগ দিলেন। আর আদ্রিয়ান ভাই পর্দা হালকা ফাঁক করে তাকিয়ে থাকা আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলেন। আমি লজ্জা পেয়ে দৌড়ে দ্রুত ঐ স্হান ত্যাগ করে নিজের রুমে চলে এলাম। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে এটাই ভাবছিলাম যে এমন এতো অদ্ভুত কেনো এই ছেলেটা। তবে বাঁকা প্রিমোলার দাঁত ওয়ালা ঐ হাসিটা বেশ সুন্দর!
বেশ কয়েকদিন কেটে গেছিল মাঝখানে। এই কদিন তার আর আমার সম্পর্ক ঐ চোখাচোখি আর উঁকিঝুঁকির মধ্যেই সীমিবদ্ধ ছিল। এরপর এলো সোহেল ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। যেহেতু মানিক আঙ্কেলের সাথে বড় মামারও একটা সম্পর্ক আছে তাই ওনাদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সোহেল ভাইয়ার বিয়ের হলুদের রাতে আদ্রিয়ান ভাইও এসেছিলেন। ভাইয়ার হলুদের প্রোগ্রাম শেষ করে আমরা বাড়ির ইয়াং যারা আছি তারা সবাই মিলে কাঠবাগানে চলে গিয়েছিলাম। আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে বসে খিচুড়ি খেতে খেতে বিভিন্ন মজা করছিলাম আমরা। সে আমার অপজিটে বসেছিলেন পুরো। তো এবার ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার পালা এলো। আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে বোতল যাওয়ায় উনি ট্রুথ নিয়েছিলেন। আপি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘প্রেমে পড়েছ কখনও?’
‘এইতো কিছুদিন আগেই পড়লাম। তবে এখনও জানাই নি। জানানোর ইচ্ছেও নেই।’
আমার কাজিনরা সবাই উল্লাসের চিৎকার দিয়েছিল সেসময়। আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। এরকম একটা ছেলে প্রেমেও পড়তে পারে? অবিশ্বাস্য! এভাবে কিছুক্ষণ পর আবার আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকেই বোতল পড়ল। সজীব ভাই ডেয়ার দিল,
‘যার প্রেমে পড়েছ তাকে ডেডিকেট করে কয়েকটা লাইন গাও।’
সবাই একই কথা বলেছিল। আমিও একপ্রকার হা করে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। সে কুছ কুছ হোতা হ্যা গানটার দ্বিতীয় কলিটা গেয়েছিল। ওনার গানের গলা শুনে আরো এক দফা অবাক হয়েছিলাম। এই ছেলে এতো ভালো গানও গায়? বেশ রাত অবধি মজা করার পর আমরা বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।আদ্রিয়ান ভাই তার বাইকে করেই চলে গিয়েছিলেন নিজেদের বাড়ি। আমার মামার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের পথ। রাতে তাই আমি আমাদের বাড়িতেই ঘুমিয়েছিলাম। এমনিতেই আমি ঘুমকুমারী তারওপর রাত করে শোয়াতে সকালে উঠতে দেরী হয়ে গেছে। ওই বাড়ি গিয়ে খালপাড় থেকে কলসিতে পানি এনে ভাইয়াকে আবার গোসল করাবে, সেটাও তো দেখতে হবে। তাই কোনরকম ফ্রেশ হয়ে হলুদ চেকের একটা শাড়ি পড়ে চুলগুলো খোলা রেখেই একপাশে এনে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। কোনরকম কোন সাজ ছাড়াই। একটু আগে ঘুম থেকে ওঠায় চোখ মুখে সেই ঘুম ভাব তখনও ছিল। আমি তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলাম মামু বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম আপুরা ভাইয়ারা সব রেডি হয়ে গেছে। মামাতো ভাইরা আর ইফাজ ভাই ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, সবগুলোই জিন্স আর চিকন হাতার সাদা গেঞ্জি পড়ে আছে। বলা বাহুল্য আদ্রিয়ান ভাইও ছিলেন ওখানে। সেও একই পোশাক পড়া। তাকে দেখে মনে একটাই প্রশ্ন জেগেছিল, এই খবিশটা এত সকাল সকাল এখানে কী করছে? লোকেতো নিজের আপন আত্মীয়ের বাড়ির অনুষ্ঠানেও এতোটা তাড়াতাড়ি উপস্থিত থাকেনা যতোটা সে ওনার এই বহুত দূরের বলতে গেলে মুখে মুখে আত্মীয়ের বাড়ির অনুষ্ঠানে থাকেন। যদিও মুখে মুখে হলেও এই দুটো পরিবারে সম্পর্ক আপন আত্মীয়ের মতোই গভীর। সে যাই হোক, হঠাৎই সে এক অদ্ভুত কাজ করলেন নিজের বুকের বা পাশে হাত রেখে জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘ভাইয়া তোমার এই বোন একদিন আমাকে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে মারবে।’
স্বাভাবিকভাবেই ভাইয়ারা মিটমিটিয়ে হাসছিলেন ওনার কথায়। আমি কেন জানিনা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি এগোতে গিয়ে শাড়ির সাথে পা আটকে পড়ে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান ভাই আমার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘আস্তে হাঁট বলদ। বিয়ে বাড়িকে শোকবাড়ি বানাবি নাকি?’
আমি কিছু না বলে দ্রুত পদে চলে গিয়েছিলাম আপুদের কাছে। এরপর আমরা সব কাঠবাগানের পাশের খালপাড় থেকে কলসে করে পানি নিয়ে উঠে আসার সময় দেখেছিলাম সে নারিকেল গাছের সাথে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম। সোহেল ভাইয়ার সকালের তেল হলুদ লাগিয়ে গোসল করানোর রীতিটাও ভালোভাবে মিটে গেলো। কিন্তু গোসল শেষ হতেই সবাই সবাইকে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছিল। এরকম হলুদ রঙ মাখামাখি খুব বেশি পছন্দ না আমার একটু এড়িয়ে চলি। তাই কাঠবাগানের দিকে চলে গেছিলাম। আগেই বলেছি এই কাঠবাগান আমার শান্তির ঠিকানা। ঠান্ডা বাতাস, নিরবতা আর ছায়া সব মিলিয়ে দারুণ। কিন্তু কে জানতো আমার ঐ শান্তির জায়গাটাও অশান্তি নিয়ে আসবে আমার জন্যে। আমি মনের আনন্দে বাতাস উপভোগ করতে করতে হাঁটছিলাম হঠাৎই কেউ আমার হাত টেনে ধরে গাছের সাথে আটকে ফেলল। আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সামনে তাকিয়ে অবাকটাই বেশি হয়েছি। কারণ স্বয়ং আদ্রিয়ান ভাই ছিলেন সেটা। তার মুখে একটা দুষ্টু বাঁকা হাসি ছিল। আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে বলেছিলাম, ‘আপনি এখানে?’
সে একহাত আমার মাথার ওপর দিয়ে গাছের ওপর রেখে ঝুঁকে বলেছিলেন, ‘এখানে একা একা কী করছিস? প্রেমিক আসবে না কি দেখা করতে?’
কথাটা শুনে অবাকই হয়েছিলাম আমি। তাই মুখ ফুলিয়ে চোখ নামিয়ে রেখে বলেছিলাম, ‘আমার কোন প্রেমিক নেই।’
‘ তাই না? কিন্তু এভাবে একাএকা কখন ঘোরে জানিস? যখন মনে প্রেম আসে, প্রেম প্রেম পায় তখন।”
আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। কী অদ্ভুত কথা! আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, ‘নিজের দোষ আমার ঘাড়ে চাপাবেন না। প্রেমে তো আপনি পড়েছেন। কালকেই বললেন।’
সে মুচকি হেসে ওনার পেছনে লুকিয়ে রাখা হাতটা সামনে এনে আলতো করে প্রথমে আমার ডান গালে পরে বা গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। আমাকে আরও অবাক করে আমার দিকে ঝুঁকে আমার হলুদ মাখা গালের সাথে নিজের গাল ঘষে নিয়েছিলেন। যার ফলে তার মুখেও হলুদ লেগে গিয়েছিল। ওনার হালকা খোঁচা দাঁড়িতে একটু ব্যাথাও পেয়েছিলাম। সে আমার মুখে ফুঁ দিতেই আমি চোখ বন্ধ করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। অদ্ভুত শিহরণ খেলে গিয়েছিল সারা শরীরে। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়েছিলাম তার দিকে উনি লাল রঙের একটা গোলাপ আমার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে শক্ত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘এবার পার্ফেক্ট লাগছে। দুপুরে গোসলে যাওয়ার আগে চেঞ্জ করবি না হলুদও মুছবি না। মনে থাকবে?’
আমি ভয়ে তাড়াতাড়ি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়েছিলাম। কারণ তখন আমার মধ্যে চঞ্চলতা থাকলেও কিছুটা সাদামাটা ছিলাম। সে আবারও মুচকি হেসে পকেট থেকে একটা ব্রেসলেট বের করেছিলেন। আমার হাত সামনে নিয়ে ওটা পরাতে পরাতে বলেছিলেন,
‘ আজকে যেটা পরে বরযাত্রী যাবি তার সাথে খুব মানাবে। আর হ্যাঁ এটা খুললে মার একটাও মাটিতে পরবে না।’
কথাটা বলেই সেই ভয়ংকর কাজটা করে বসেছিলেন। যেটা আমার মনে গভীরভাবে দাগ কেটে দিয়েছিল। আচমকাই আমার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে আমার হাতের ব্রেসলেটের ওপর দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে একপলক আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। এরপর একপ্রকার ঝড়ের বেগেই ঐ স্হান ত্যাগ করেছিলেন। আর আমি? আমিতো একদম জমে স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানে। এই ঘটনাটা আমায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ওটাই ছিল আদ্রিয়ান নামক ঐ মানুষটার কাছ থেকে পাওয়া প্রথম স্পর্শ। এই ঘটনার জন্যে সোজা বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটিও করেছিলাম। এরকম অভিজ্ঞতা এর আগে কোনদিন হয়নি কি-না। তখন একটা কথাই মনে হয়েছিল সে একটা জঘন্য লোক, খুব খারাপ লোক। তার সামনেও কোনদিন যাবোনা আমি আর। কান্না করায় চোখমুখ অন্যরকম হয়ে ছিল আমার। আপুরা, ভাইয়ারা জিজ্ঞেস করেছিল যে কী হয়েছে কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারিনি শুধু কথা কাটিয়ে গেছি। তার দেখা পেয়েছিলাম একেবারে বরযাত্রী যাওয়ার সময় গাড়িতে। তখন একপলক তাকিয়ে ছিলেন সে আমার দিকে। এরপর আমি তার দিকে কয়েকবার তাকালেও সে কিন্তু একবারও আমার দিকে তাকায়নি। সেসময়ে আমি ভেবেছিলাম না তাকালেই ভালো। এই খারাপ লোকটা আমার কাছ থেকে যতো দূরে থাকবে ততই ভালো। কিন্তু হাতের ব্রেসলেটটা ঠিকই পরেছিলাম তার ভয়ে। না পরলে যদি আবার ভুলভাল কিছু করে বসে। সারাটাদিন-ই মন খারাপ ছিল আমার। রাতে আরেকদফা কান্নাও করে দিয়েছিলাম সকালের ঘটা ঘটনা ভেবে। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। পরেরদিন আবার ওনার সম্মুখীন হলাম বউভাতের অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেদিনও সে আমার থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলল। আমি যদি দক্ষিণ দিকে থাকি সে থাকতো উত্তর দিকে। যেনো আমার কাছে আসলেই ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে যাবে। আমার দিকে ঠিক করে তাকাচ্ছিল পর্যন্ত না। তবে তার চোখে-মুখে কিছু একটা ছিল যেটা আমার বোধগম্য হয়নি। মেহমান খাওয়ানোর পর যখন আমরা সবাই মিলে খেতে বসেছিলাম তখন ভাইয়ারা সার্ভ করছিল তার মধ্যে আদ্রিয়ান ভাইও ছিলেন। সে সবাইকে নিজ হাতে খাবার সার্ভ করলেও যখনই আমার কিছু দরকার হতো তখনই অর্ণব ভাই নয়তো শান্ত ভাইকে দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতো। আমার ব্যপারটা একটু অন্যরকম লাগলেও আমি গুরুত্ব দেইনি। বিয়ের বিভিন্ন ব্যস্ততায় ঐ দিনটাও পার হয়ে গেল। সোহেল ভাই আর ভাবিকে সোহেল ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে যে যার মত বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
মাঝে কেটে গেল আরও একটা দিন। আদ্রিয়ান ভাই আর কাঠবাগানের ঐ ঘটনা কোনটাই ভুলতে পারছিলাম না আমি। তার প্রতি রাগ আর বিরক্তিও কমেনি কোন অংশে। তবে কেন জানিনা মনে হতো আমি জোর করে রেগে থাকার, বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। আসলে আমি ততটাও রাগি নি। আজ বুঝতে পারলেও সেদিনতো আর বুঝতে পারিনি যে ঐ ঘটনাটা আমার কাছে যতটা না আকস্মিক ছিল তার কাছেও ততটাই আকস্মিক ছিল। তবে এটাও ঠিক ঐ ঘটনার পর আমি তাকে আর অন্য সবার মতো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি কখনও।
একদিন পর সোহেল ভাই আর ভাবিকে আনার জন্যে আমাদের যেতে হয়েছিল। আমি রেডি হতে হতে আপুদের আগেই বলে রেখেছিলাম যে আমি ভাড়া করা গাড়িটার সামনের সিটে বসবো। বরযাত্রী যাওয়ার সময় আমায় সামনে বসতে দেয়নি এবার না দিলে চলবে না। আপুরা শুরুতেই রাজি হয়ে গেছিল কিন্তু তবুও আমি বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম আমিই সামনে বসব। গাড়ি চলে এসছে শুনে আমরা সবাই একসাথেই বের হয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ির কাছে গিয়ে ভীষণ চমকেছিলাম আমি। কারণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে আদ্রিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বুঝতে পারছিলাম না আজকের দিনেও এই লোক এখানে কী করছে? পরে জেনেছিলাম যে বাড়ির ইয়াং ছেলেরা আগের দিনই সোহেল ভাইয়ের সাথে চলে গেছে ঐ বাড়িতে। শুধু আমরা মেয়েরাই পরে ছিলাম। কিন্তু আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে কাউকে প্রয়োজন ছিল। অনেক ভেবে বড় মামু মানিক আঙ্কেলকে ফোন করে বলেছিলেন আদ্রিয়ান ভাইকে পাঠিয়ে দিতে। সে নাকি শুরুতে আসতে চায়নি। মানিক আঙ্কেলের জোরাজুরি আর শেষে বড় মামু ফোন করাতেই বাধ্য হয়েই এসেছেন। গাড়িটা উনিই চালাবেন সেটা শুনে আমার ফ্রন্ট সিটে বসার তীব্র ইচ্ছেটুকু মিটে গিয়েছিল। আমি আপির কাছে গিয়ে বলেছিলাম,
” আপি। আমি না পেছনের সিটেই কমফরটেবল থাকি। পেছনে বসি?”
আপি কিছু না বলে শুধু আমার দিকে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ব্যস! আমি সুরসুর করে গিয়ে সামনের সিটেই বসে পড়েছিলাম। তবে সেদিন তার আমায় এড়িয়ে চলার মাত্রাটা আরও বেশি ছিল। আড়চোখেও একবার তাকায়নি আমার দিকে। যাওয়ার সময় ব্যপারটা আমায় স্বস্তি দিয়েছিল। ঐ বাড়িতে থাকাকালীন বাকি সময়টাও সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন আমাকে। হঠাৎ করেই এতো ভদ্র হয়ে যাওয়ার কারণ মোটেও বুঝতে পারছিলাম না। ফেরার সময় কেমন জেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল আমার। হঠাৎ ওনার এই এড়িয়ে চলাটা অজানা কারণেই ভালো লাগছিল না আমার। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি আমার তার এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই খারাপ লাগছে। আমাকে ড্রপ করে দিয়ে মামীর জোরাজুরিতে একটু স্ন্যাকস মুখে দিয়েই ফিরে গিয়েছিলেন উনি।
সেদিনের পর প্রায় ন-দিন কেটে গেল। তার সাথে আমার আর কোন দেখা বা কথা আর হয়নি। কিন্তু মাঝেমাঝেই ওনাকে দেখার অস্পষ্ট ইচ্ছা জাগতো মনে। যেটা না আমি তখন স্বীকার করেছি আর না আজ স্বীকার করতে চাই। কিন্তু এটাই সত্যি। ন-দিন পর মানিক আঙ্কেলের সাথে আমাদের বাড়িতে আবার পা পড়ল তার। নিয়মের কোনরকম ব্যতিক্রম না করে সেবারেও পর্দার আড়াল থেকে লুকিয়ে তাকে দেখেছিলাম আমি। কিন্তু নিয়মের ব্যতিক্রম করেছিলো সে। প্রতিবারের মতো ঐদিন আর আমার দিকে তাকায়নি সে। যেনো বুঝতেই পারেননি আমি দেখছি তাকে। কিন্তু আমার কেনো জানিনা মনে হচ্ছিল উনি সেদিন ও বুঝেছিলেন আমি লুকিয়ে তাকে দেখছি। একে ওপরকে বুঝে ফেলার এই প্রক্রিয়া কীভাবে চলতো এবং চলে আসছে সেটা আজও জানিনা আমি। হয়তো এটাকেই টেলিপ্যাথিক কানেকশান বলে।