অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৩০
সন্ধ্যা ছিল তখন। মাগরিবের আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। দিন-তারিখ কিছুই মনে নেই। তবে আপির এনগেইজমেন্টের কয়েকদিন পরের কথা। সে যাই হোক, সেদিন আমার মন ভালো ছিলোনা একদম। না তখনও অবধি মন খারাপের কারণটা আসলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলোনা। সবসময় সব দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া মোটেও ঠিক নয়। সম্ভবত সেবারের মন খারাপের কারণটা ছিল পিরিয়ড টাইমের মুড সুইং। টেবিলের বসলেও পড়ায় মন বসছিল না একদম। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টেও কিছু মাথায় ঢুকলো না। যখন বুঝলাম আজ আর পড়া হবেনা তখন চার্জার থেকে ফোনটা খুলে স্ক্রোল করতে শুরু করলাম। কিন্তু ফোনেও তেমন কিছুই পাচ্ছিনা। প্রচন্ড একঘেয়ে লাগছে সবকিছু। হোয়াটস অ্যাপে গিয়ে দেখলাম আদ্রিয়ান ভাই স্টেস্টাস এ নিজের একটা সেলফি দিয়েছেন। গাল ফুলে উঠল আমার। এদিকে আমি চরম বোরিং সময় পার করছি আর উনি চিল করছেন। বাহ! নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবছি কী করা যায়। এমন সময় আনভীর ভাইয়ের মেসেজ এলো। উনি লিখেছেন, ‘ কী বেয়াইন সাহেবা? সন্ধ্যা সন্ধ্যা অনলাইনে কী করেন?’
‘ প্রেমিকের সাথে প্রেম করছি। আপনি কী করেন?’ নির্বিকারভাবেই রিপ্লে করলাম।
‘ ইশ! কী শোনালে? হার্ট ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল তো।’
সাথে একটা হৃদয় ভাঙা ইমুজিও দিলেন। আমি তিনটে লাফিং ইমুজি পাঠিয়ে বসে রইলাম। কিন্তু নিজে হাসিনি। হাসি পেলোনা কেন জানি। উত্তরে উনি বেশ মজার একটা GIF পাঠালেন। আমি এবার সত্যি হেসে দিলাম। লোকটা হাসাতে পারে, মানতেই হবে। আমি লিখলাম, ‘আপনি সত্যিই ভীষণ মজার মানুষ।’ উনিও হাসলেন। কিছুক্ষণ কথা বললাম। যদিও কথা বলার টপিকটা আপি আর রায়হান ভাইয়াকে নিয়েই ছিল। ওনার সাথে কথা বলে পরে আপিকে ফোন দিলাম। আপি আর রায়হান ভাইয়া দুজনের সাথেই কথা হয়ে গেল। কারণ দুজনেই কলে ছিল আমায় এড করে নিয়েছে। আপির নামে রায়হান ভাইয়ার গাল ফোলানো একগাদা অভিযোগ শুনে হেসে ফেললাম আমি। রায়হান ভাইয়া আহত কন্ঠে বলল, ‘তুই হাসছিস অনু? তা তো হাসবিই। যারটা তারই। তুই তো তোর বোনের সাপোর্ট-ই করবি। আমি কে? আমি তোকে বোন ভাবলে কী হবে? তুই মোটেও আমায় ভাই ভাবিস না।’
আপি বলে উঠল, ‘অবশ্যই! তুমি ওকে চেনো চারবছর হল। আর আমি ওকে জন্ম থেকে চিনি। আমার বোন ও। সুতরাং আমার অধিকার বেশি।’
আমার ওপর কার অধিকার বেশি এই নিয়ে বেশ অনেক্ষণ ঝগড়া চলল ওদের। দুজনেরই কী ভয়াবহ যুক্তি। জয়টা অবশ্য আপিরই হল। তবে এদের বাচ্চা টাইপ ঝগড়া শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার জোগাড় হল আমার। কথা শেষ করার পর দেখলাম ভেতর থেকে অনেক হালকা লাগছে। মন অনেকটাই ভালো হয়ে গেছে। স্ক্রিনে আবার আদ্রিয়ান ভাইয়ের সেই সেলফি চোখে পড়তেই খুশি মনে তিনটে ‘ফেস উইথ রোলিং আইস’ ইমুজি পাঠিয়ে বসে রইলাম চুপচাপ। কী করব সেটাই ভাবছি। পড়াতো হচ্ছেনা। আধ মিনিটের মধ্যেই ফোন বেজে উঠলো আমার। আদ্রিয়ান ভাই ফোন করেছেন। আমি ভাবলাম আবার কী হল? কয়েকদিন যাবত তো কোন যোগাযোগ হয়নি আমাদের। আজ হঠাৎ ফোন করল যে? আমার যতটুকু মনে পড়ে আজতো কোন উল্টাপাল্টা কাজ করিনি আমি। আর যতবার উনি ফোন করেন কথা শুরুই হয় ধমক দিয়ে। এটা যেন অবধারিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। সেই ধমকটার জন্যে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করেই রিসিভ করলাম ফোনটা। অবধারিত সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল না আজকেও। উনি ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘ সন্ধ্যাবেলা অনলাইনে কী করিস? পড়তে বসিস নি?’
আমি মুখ ছোট করে বললাম, ‘হুম, বসব এখন।’
উনি শক্ত গলায় বললেন, ‘অলরেডি অনেকটা সময় হয়ে গেছে সন্ধ্যার। কখন বসবি শুনি? পড়াশোনা লাটে তুলে সারাক্ষণ অন্যের সাথে হাহা হিহি করে বেড়াতে এতো ভালো লাগলে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে সেটাই কর। নিজেকে লোক দেখানো শিক্ষিত প্রমাণ করার তো কোন প্রয়োজন নেই।’
আমার মন খারাপ হল কিছুটা। লোকটা সবসময় এমন কেন করে? উনি কী বুঝতে পারছেনা আজ আমার মন খারাপ? সবসময় সব কিছু বলে দিতে হয়? কিন্তু আমিতো বলতে পারিনা। বিষণ্ন গলায় বললাম, ‘এতোদিন পর মনে পড়ল কল করার কথা? তাও তো আমি নিজে নক দিলাম পরে কল করলেন।’
এমন নিব্বি টাইপের ন্যাকা কথা আমি কখনই বলি না। ঐদিন কেন বলে ফেললাম আমি নিজেও জানিনা। হয়তো সত্যিই আমার মনটা বেশিই খারাপ ছিলো। কিন্তু আদ্রিয়ান নামক ঐ নিষ্ঠুর লোকটা বুঝলেন না আমার মনের অবস্থা। সেই কঠোর গলাতেই বললেন, ‘রোজ রোজ কল করার কথা ছিল না-কি? এমন কোন এগ্রিমেন্ট ছিল তোর সাথে আমার? আমারতো মনে পড়ছে না। তোকে কল ছাড়া আমার আর কোন কাজ নেই?’
আমার এবার রাগ হল। সবসময়ই ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলতে হবে। প্রথমত মন খারাপ ছিল দ্বিতীয়ত ওনার গা জ্বালানো কথাবার্তা। কার মেজাজ ঠিক থাকে? তবে কন্ঠে সেই তীব্র রাগটাকে প্রকাশ না করে স্বাভাবিকভাবেই বললাম, ‘হ্যাঁ সেটাই। আমিতো আপনার গার্লফ্রেন্ড বা বউ নই। সেটা হলে না হয় করতেন।’
উনি চুপ থাকলেন কিছুক্ষণ। এরপর একদম স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন, ‘তাইতো! তাহলে ওরকম কিছু এক্সপেক্ট করিস কেন? তাছাড়া এমনিতেও তুই যথেষ্ট ছোট একটা মেয়ে, আমার বউ বা গার্লফ্রেন্ড হওয়ার কথাও না তোর।’
আমি থমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্যে। একদম নিরব হয়ে যাওয়া যাকে বলে। এরপর একটা শব্দও না করে কেটে দিলাম ফোনটা। ভীষণ ইচ্ছে করছিল চেঁচিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করতে, তাহলে এতো জোর কেন খাটান আমার ওপর? সময় অসময় ছুটে এসে কেন জ্বালাতন করে আমাকে? আমার সবকিছুতে কেন আপনার আধিপত্য থাকে? কেন সেই কাঠবাগানে আমার জীবনের প্রথম প্রণয় স্পর্শ দিয়েছিলেন? কেন এতো এতো প্রেমবার্তা লিখেছিলেন আমার নামে? গত চারবছর যাবত তাহলে কেন করেছেন এই অনধিকারচর্চা? এসব করার সময় মনে হয়নি আমি যথেষ্ট ছোট একটা মেয়ে। আমার সাথে এসব করা যায় না। আজ মনে পড়ল আমার বয়সটা? কিন্তু পারলাম না জিজ্ঞেস করতে। কেন পারলাম না? হঠাৎ দেখলাম চোখ ভিজে উঠেছে আমার। দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আশ্চর্য! কেঁদে ফেললাম কেন আমি? আমি তো এতো কাঁদতাম না। আমাকে কাঁদানো ভীষণ কঠিন। কিন্তু এই লোকটা কত সহজেই কাঁদিয়ে দেয় আমাকে। কেন এমন করেন উনি? যখনই আমার মন ভালো থাকে, তখনই আমাকে বিষণ্নতার সাগরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। বেশ আনন্দ নিয়ে আমায় হাবুডুবু খেতে দেখেন সেই সাগরে। কী লাভ হয় এমন করে? কীসের প্রতিশোধ এটা? কী করেছি আমি? চোখ মুছে ঐ মুহুর্তেই স্বাভাবিক করে ফেললাম নিজেকে। যেন কিছুই হয়নি। শুধু শুধু কারো জন্যে কাঁদার কোন মানেই হয়না। এসব ঘটনাকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত রাখলাম নিজেকে।
পরেরদিন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিল না একদম। পেটে ফাঁপা ব্যথা ছিল। জ্বর জ্বর লাগছিল কিছুটা। সারাদিন একটা দানাও তুলতে পারলাম না মুখে। গা গুলিয়ে উঠছিল। ভালো লাগছিল না কিছুই। সন্ধ্যাবেলা আম্মু একপ্রকার জোর করেই ভাত মেখে কয়েক লোকমা খাইয়ে দিয়ে গেছে। শরীরটা হঠাৎ এমন খারাপ হয়ে যাওয়াতে হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল আমার। খুব দুর্বল মনে হচ্ছিলো নিজেকে।
রাতে হল আরেক ঝামেলা। ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছেন আদ্রিয়ান ভাই। কিন্তু আমি রিসিভ করছিনা। শরীর-মন কোনটাই ভালো নেই। তখন ওনার সাথে কথা বলে মনটাকে আরও বিষিয়ে দিতে চাইছিলাম না আমি। ঐদিন কেন জানি মনে হচ্ছিলো আদ্রিয়ান মানেই মন খারাপের সূচনা, আদ্রিয়ান মানেই বিষণ্নতা, আদ্রিয়ান মানেই চাপা কান্না। কিন্তু রিসিভ না করে পারলাম না আমি। পরপর আটবার ফোন করার পর নবম বারের সময় ধরতে হল আমাকে। রিসিভ করে বললাম, ‘ হ্যালো?’
‘ কতবার কল করেছি আমি?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন উনি।
আমি নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘এতোবার কল কেন করেছিলেন? কোন দরকার ছিল?’
‘চড়িয়ে কান লাল করে দেব। দরকার ছাড়া এমনি এমনি ফোন দেব আমি?’
হয়তো দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন কথাটা। তেমনই লাগল শুনতে। কিন্তু ওনার রাগকে আজ পাত্তা দিলাম না আমি। কোন অনুভূতি কাজ করছিল না সেদিন। নির্বিকার কন্ঠে বললাম, ‘বলুন কী দরকার ছিল?’
চুপ হয়ে গেলেন উনি। হঠাৎ থমকালে যেমন হয়, ঠিক তেমন। কয়েকসেকেন্ডের নিরবতার পর বললেন, ‘কিছুনা।’
এরপর কলটা কেটে দিল। তবুও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না আমি। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে নির্বিকারভাবে বসে রইলাম। জানালাটা খোলা ছিল। সেটা দিয়ে তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে। ভ্যাপসা গরম লাগছিল। মৃদু বাতাস এসে চোখে-মুখে লাগতেই কেমন চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। নিজের মনের মধ্যে থেকে যেন কেউ বলে উঠল, ‘মায়াবিনীর প্রাণখোলা হাসির কারণ যদি আপনি হন, তার নিরব কান্নার একমাত্র কারণও শুধুমাত্র আপনি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব।’
.
[ এরবেশি লিখতে ইচ্ছে হলোনা। ছোট বলে কেউ লজ্জা দিও না ]