অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৫
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
২৬ জুন ২০২১, শনিবার। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন কাটানোর পর আজ স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির সকলের মানে বাবা-মার অফিসে বেরিয়ে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। আজ সবাই বাড়িতেই আছে। না অফিস বন্ধ না, ওনারাই ছুটি নিয়েছেন আজ। কাব্য পর্যন্ত আজ বাড়িতে বসে আছে যেখানে এই ছেলেকে ঘরে বসিয়ে রাখতে একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয় সবাইকে। আম্মু সেই সকাল থেকে রান্নাঘরে রান্না করেই যাচ্ছে এটা-সেটা, নিয়মমতো সাথে আপিও হেল্প করছে। বাবা কিছুক্ষণ আগে আবার বাজারে গেছেন। এই নিয়ে তিনবার বাজারে গেলেন। কী রেখে কী কিনবেন সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না। সবাই ভীষণ উত্তেজিত আর ব্যস্ত থাকলেও আমি তাদের দলে একদমই নেই। আমি রিল্যাক্সে খাটে হেলান দিয়ে বসে ফোন স্ক্রোল করছি। বেশ অনেকক্ষণ ফোন স্ক্রোল করতে করতে অবশেষে কিছুটা বোর ফিল করলাম। তাই মুড একটু চেঞ্জ করতে রুম থেকে বের হলাম। বসার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি কাব্য সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে গেমস খেলছে। আপাতত এই ছেলে আমাকে পাত্তা দেবেনা। সুতরাং কিছু বলে কোন লাভ নেই। তাই আমি হেঁটে রান্নাঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি মা রান্না করছে। আপি সবজি কাটছে। টেবিলের একপাশে তাকিয়ে দেখলাম রসমালাই রাখা আছে। আমার অন্যতম পছন্দের মিষ্টি। দেখেই জিবে জল চলে এলো। বাটির দিকে হাত বাড়াতেই খুন্তির আলতো মার পড়ল আমার হাতের কব্জিতে। আমি সাথেসাথেই হাত সরিয়ে নিয়ে মুখ ফুলিয়ে তাকালাম মায়ের দিকে। অসহায় কন্ঠে বললাম,
” টেবিলে এতো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছো আর আমি খেতে পারব না? এটা কেমন অবিচার?”
মা পুনরায় তরকারি নাড়াতে নাড়াতে বলল,
” এখন না। এটা ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা হতে দেব। আদ্রিয়ান ঠান্ডা রসমালাই বেশ পছন্দ করে খায়।”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ পারলে প্রপার্টিটাও ওনার নামে লিখে দাও। তোমারই ছেলে কি-না। আমায়তো কুড়িয়ে পেয়েছো?”
মা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই নিজেকে বাঁচাতে বললাম,
“আচ্ছা তাহলে কয়েকটা কিসমিস নিলাম।”
মা কিছুই বলল না। আমি মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ মেনে নিয়ে এক মুঠো কিসমিস নিয়ে একপ্রকার পালিয়ে আপির কাছেএলাম। ভাবছেন কী এমন বিশেষ আজ যে সবাই এতো উত্তেজিত আর ব্যস্ত? আহামরি কিছুই না। মানিক আঙ্কেলের সেই বিলেতি পুত্র মানে আদ্রিয়ান ভাই গতকাল ইউকে থেকে বাংলাদেশে এসেছে। শুনেছি এমএসসি পরীক্ষা-টরিক্ষা শেষ করে বেশ লম্বা সময়ের জন্যেই এসেছে। পার্মানেন্টলি চলে এসছে না-কি আবার যাবে সেটা জানিনা। আর গতকাল আসতে না আসতেই আজই আসছে এ বাড়িতে। আমি বুঝিনা এই বাড়িতে এমন কী আছে যে এসে একটা দিনও নিজের বাড়িতে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারলেন না উনি? আর আমার বাড়ির লোকজনও আছে,একে নিয়ে এতো নাচানাচির কী আছে সেটাই বুঝতে পারিনা। আপির পাশের চেয়ারটা টেনে বসে কিছুটা অভিযোগের সুরে বললাম,
” কী আজব দুনিয়ায় বাস করছি তাইনা? নিজের বাড়িতে, নিজের মায়ের কাছে আমার কোন দামই নেই। কেমন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল দেখলে? “
আপি হেসে ফেলল। সবজি কাটতে কাটতেই বলল,
” এখনই এতো অধৈর্য্য হয়োনা সোনা, ধৈর্য্য কিছুটা বাঁচিয়ে রাখ।”
আমি মুখে কিসমিস পুরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম,
” কেনো?”
আপি কিছু বলার আগেই আমার মেঝো ফুপির গলার আওয়াজ পেলাম। সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আর বুঝতে পারলাম আপির কথার মানে। চোখ খুলে আপির দিকে তাকালাম অসহায় একটা মুখ করে। আপি চপিং করতে করতে হেসে বলল,
” সকাল সকালই এসেছে। বেরিয়েছিল একটু।”
” দূর সব ঝামেলা একদিনে।”
আমি তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে এলাম। মেঝ ফুপি আমার অপছন্দের না হলেও পছন্দের মোটেও নন। কারণ একটাই। ওনার সমস্ত আলোচনা ঘুরেফিরে বিয়ে, বাড়ির কাজ, মেয়ে মানুষের উচিত অনুচিত এসবেই আটকে যায়। এর বাইরে আর বের হতে পারেন না।আর দুর্ভাগ্যবশত এগুলোই আমার সবচেয়ে অপছন্দের টপিক। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাকে এড়িয়ে চলার শতভাগ চেষ্টা থাকে আমার।রুমে এসে বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে ভালোভাবে কানে ইয়ারফোন গুঁজে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে রুমে আমার ফুপাতো বোন নূরনাহার এলো। ওকে আমরা নূর বলেই ডাকি। আমি আর নূর সমবয়সী। তবে ও আমার এক ক্লাস জুনিয়র। নূর এসেই আমাকে জাপটে ধরল। আমি ওকে ধরে হেসে বললাম,
” তুমি কখন এলে? ফুপিও এসেছে? কেমন আছো?”
যদিও জানি কখন এসেছে। কিন্তু ওকেতো আর বলতে পারব না ওর মায়ের থেকে বাঁচতেই রুমে চলে এসেছি। নূর বলল,
” হ্যাঁ আমরাতো সকালেই এসেছি। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই ডাকিনি।”
” ও আচ্ছা।”
এরপর দুজনে কিছুক্ষণ কথা বলার পর কথার মাঝে নূর বলে উঠল,
” আচ্ছা আজতো আদ্রিয়ান আসবে বাড়িতে তাইনা?”
আমি ফোন থেকে চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
” আদ্রিয়ান?”
নূর হেসে দিয়ে বলল,
” আদ্রিয়ান ভাই। ঐ একই হলো!”
উত্তরে আমি শুধু ঠোঁট প্রসারিত করে জোরপূর্বক একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। নূর আবার বলল,
” সেই লাস্ট সোহেল ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছিলাম। মানুষ এতো কিউট কীভাবে হয়?”
আমি নূরের দিকে তাকিয়ে আগের ভঙ্গিতেই হাসলাম। কিউট? ওনাকে কোন দিক দিয়ে কিউট লাগল এই মেয়ের? লাগলে লাগুক আমার কী? এরপর নূরের সাথে যতটুকু সময় কথা হয়েছে ওর কথার টপিক ঐ আদ্রিয়ান ভাই-ই ছিলেন। আর আমি শুধু হু হা করে গেছি। একপর্যায়ে প্রচন্ড হাসি পাচ্ছিল আমার এই মেয়ের কথা শুনে। ও তো ‘আদ্রিয়ান’ নামের দু-ঢোক বেশি জল খাচ্ছে। ওর আর কী দোষ আমার নিজের বাড়ির লোকই খায়।
কিছুক্ষণ পর ফুপির সাথেও কথা হল। আর যথারীতি এতো বেলা করে কেন ঘুমাই? কাজ কেন করিনা? মেয়ে মানুষদের এভাবে থাকতে নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও ভদ্র বাচ্চার মতো চুপচাপ সব শুনে গেছি। এটা ছাড়া কিছু করারও ছিলোনা।
বেলা বারোটার পর মানিক আঙ্কেল আর আদ্রিয়ান ভাই এলেন বাড়িতে। ওনাদের আসার আওয়াজ পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে এলাম। মা ডাকতেই আপি চলে গেল ওখানে। আমি এসে বিছানায় বসলাম। এতক্ষণ হু কেয়ারস একটা ভাব নিয়ে চললেও বুকের মধ্যে কেমন একটা করে উঠছে। বারবার শুকনো ঢোক গিলছি। কেন এমন হচ্ছে নিজেও বুঝে উঠতে পারছিনা। আমার রুম থেকেই আদ্রিয়ান ভাইয়ের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এতে অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ নিজের হাতের দিকে চোখ পড়তেই হাতে পড়ে থাকা ব্রেসলেটটা দেখতে পেলাম। কালোর মধ্যে গোল্ডেন ডিজাইন করে। তার সাথে ডিজাইনার ইংরেজি এ (A) অ্যালফাবেট টাও ঝুলিয়ে লাগানো। আমি উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে হাত থেকে ব্রেসলেটটা খুলে রাখলাম। এমনিতেই নিজেকে কিং মনে করে যদি দেখে ওনার দেওয়া ব্রেসলেট আমি সত্যি সত্যিই সারাক্ষণ হাতে পরে ঘুরি তাহলে কী ভাববে কে জানে? কিছুক্ষণ পরপরই ওনার কন্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। আস্তে আস্তে দরজার কাছে গিয়ে পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিলাম বসার ঘরে। চোখ সোজা গিয়ে আদ্রিয়ান ভাইয়ের ওপরেই পড়ল। কালো টিশার্ট, এস কালার জিন্স পড়ে আছেন। ডার্ক ব্রাউন চুলগুলো সেই আগের মতোই কপালে পড়ে আছে। ফর্সা মানুষ এতো কালো কেন পড়বে? বেশিই হ্যান্ডসাম লাগে তো! দূর কী সব বলছি। কিছুক্ষণ পরপর যেভাবে জুসের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে মনে হচ্ছে যেন জুসের গ্লাসটাকেও প্রেম নিবেদন করছে। আচমকাই ওনার চোখ দরজার কাছে পড়তেই আমি দ্রুত ভেতরে চলে এলাম। রুমে এসে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। প্রায় চারবছর পর আবার সেই পর্দা-কান্ডের পুনরাবৃত্তি!
পুরোটা সময় আমি আমার রুমেই ছিলাম। যাকে বলে পালিয়ে বেড়ানো। আজ কেন জানিনা ওনার সামনে পড়তে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। দুপুরে খাওয়ার সময়ও আমি ওখানে গেলাম না। আপি রুমেই খাবার দিয়ে গেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আপি রুমে চলে এলো। কিন্তু নূর আসেনি, ওখানেই রয়ে গেল। আমি আর আপি দুজনেই অবাক এই মেয়ের এক্সাইটমেন্ট দেখে। প্রায় আধঘন্টা রুমে বসে বোর হওয়ার পর আব্বুর ডাক পড়ল। এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। নিশ্চয়ই মানিক আঙ্কেল ডেকেছেন? দূর! এখন না চাইতেও ওনার সামনে যেতে হবে। আপিও এলো আমার সাথে। ওখানে যেতেই আমার চোখ একপ্রকার ছানাবড়া। নূর, আদ্রিয়ান ভাইয়ের একদম পাশ ঘেঁষে বসে আছে। আর কী সব বলে চলেছে। কিন্তু আদ্রিয়ান ভাই ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। নূরের কোন কথা শুনছে কি-না বোঝা মুশকিল। আমি আর আপি একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। নূরতো এমন না। আজ হঠাৎ কী হল? সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে মানিক আঙ্কেলকে সালাম দিলাম। মানিক আঙ্কেল সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
” কেমন আছো, মা?”
” জি ভালো। আপনি?”
” ভালো। পড়াশোনার কেমন চলছে?”
” ভালো।”
এরমধ্যেই ফুপি বলে উঠল,
” ভাইজান আমাদের নূর তো এবার নূর মোহাম্মদে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। এসএসসি তে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এইচএসসিতেও ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাবে। আজকালকার ছেলেমেয়ে তো দেখেনই। পড়াশোনায় ভালো হলে কাজকর্মের খবর থাকেনা। কিন্তু আমার নূর সবই পারে। বাড়িতে থাকলেতো আমাকে কিছু করতেই হয়না। আর ওর রান্নার হাতও মাশাল্লাহ্। আচ্ছা আদ্রিয়ানের বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছেন নাকি? ছেলেতো বড় হয়েছে!”
সবাই চুপ হয়ে আছে। আমি আপির দিকে বোকার মতো তাকালাম। আপিও অনেকটা বোকা স্টাইলেই তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড নিরবতার পর ফোনে চোখ রেখেই আদ্রিয়ান ভাই বলে উঠলেন,
” বাবা, বাড়ির জন্যে কাজের মেয়ে দেখছো বলো নি তো?”
নিরাবতা যেন আরও প্রবল হল। ফুপির মুখটা একদম দেখার মতো হয়েছে। নূরও বোকার মতো তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে। আমি অনেক কষ্ট করে হাসি আটকে রেখে দিয়েছি। আপি দু আঙুলে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বাবা গলা ঝেড়ে বললেন,
” মানিক, চল বাজার দিয়ে হেঁটে আসি। কতদিন পর জাজিরা এলি।”
বাবা আর মানিক আঙ্কেল চলে যাওয়ার পর আমি রুমে আসতেই নিচ্ছিলাম তখনই নূর আদ্রিয়ান ভাইকে বলল,
” আদ্রিয়ান ভাই, একটা সেলফি তুলি?”
আদ্রিয়ান ভাই ভ্রু বাঁকা করে তাকালেন ওর দিকে। কিন্তু উনি কিছু বলার আগেই নূর সেলফি তুলে নিল একটা। এরপর বলল,
” ভাইয়া আপনার ফেসবুক আইডি নেই?”
আদ্রিয়ান ভাই আবার ফোনে চোখ দিয়ে সোজাসাপ্টাভাবে বললেন,
” আমি ওসব ইউজ করিনা।”
নূর অবাক হয়ে বলল,
” ইন্সটা ওয়াটসঅ্যাপ কিছুই নেই?”
” উমহুম। আমি ফোনে শুধুমাত্র গেমস খেলি, খুকি।”
আরেকদফা হাসি আটকানোর পূর্ণ প্রচেষ্টা চলল আমার আর আপির। তাই দুজনেই দ্রুত রুমে ঢুকে আওয়াজ করেই হেসে দিলাম। আপি হাসতে হাসতে বলল,
” আজ এই মেয়ের হয়েছে কী? এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন?”
আমি হাসি থামিয়ে বললাম,
” কী জানি। আর আমার বাড়ির লোকও আছে। একে এতো মাথায় তোলার কী দরকার? কেমব্রিজ থেকেই তো বিএসসি, এমএসসি করছে। তাই বলে এতো ভাও?”
আপি আমার পাশে বসে বলল,
” কেমব্রিজ তোর কাছে হাতের মোয়া মনে হয়?”
” প্রতিবছরই তো কতলোক এবরোড পড়তে যায়। তো?”
আপি আমার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
” এবরোড পড়তে যাওয়া আর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে চাঁদ। সবার পক্ষে সম্ভব না। ওয়ার্ল্ডের টপ লেভেলের ভার্সিটি ওটা। তারওপর শুধু এমএসসি না বিএসসিটাও ওখানে করেছে। অনেক বড় ব্যাপার এটা। আর ফুপা ময়নাপ্পি ওনাকে শুধু এইজন্য ভাও দেয়না। ছেলের মতো দেখে ওনাকে তাই এতো ভালোবাসে।”
হায়রে! এখন আপিটাও শুরু করে দিল। আমি কথা ঘোরাতে বললাম,
” আচ্ছা আপি ওনারা কতক্ষণ থাকবে?”
” সেটাতো জানিনা। কেন?”
” না কিছুনা।”
আপি আর আমি মিলে গল্প করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। বিকেলে আপি আম্মুর কোন হেল্প লাগবে কি-না দেখতে গেল। ড্রয়িংরুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। একা একা ভালো লাগছেনা তাই ছাদে চলে গেলাম। কিন্তু আমি যেখানেই শান্তির খোঁজে যাই সেখানেই অশান্তি হয়ে আদ্রিয়ান ভাই এসে হাজির হন। সেটা কাঠবাগান হোক বা ছাদ। এবারও তাই হল। আমি ছাদের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম। হঠাৎ পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকিয়ে দেখলাম আদ্রিয়ান ভাই। এতক্ষণ সামনেই তাকিয়ে ছিলেন। এবার আমার দিকে তাকিয়ে অবাক চেহারা করে বললেন,
” তুই বাড়িতে আছিস? আমিতো ভেবেছিলাম আঙ্কেল বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দিয়েছে। ভেবেছিলাম বড়সর একটা বিয়ে খাওয়া মিস করে গেছি। যাক মিস হয়নি!”
আমি ভ্রু কুঁচকে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
” আমার বাবাকে আপনার ডুল হেডেট মনে হয়? এইবয়সে আমার বিয়ে দিয়ে দেবে?”
” না, ঠিক তা না। আমার আঙ্কেল যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিন্তু তোর ওপর ভরসা করা যায় না। একদিন ভোরবেলা উঠে হয়তো দেখবে পোটলা বেঁধে পালিয়ে গেছিস।”
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” আপনার মতো উদ্ভট লোকেরাই এসব ভাবতে পারে।”
আদ্রিয়ান ভাই রেলিং এ ভর দিয়ে এক হাতে তার সিল্কি চুলগুলো নেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
” এটাকে উদ্ভট বলে না, ওয়ান এন্ড অনলি বলে। এরকম এক পিসই পাবি। যদিও তুইও একপিসই। ওয়ান এন্ড অনলি পেঙ্গুইন উইথ হিউম্যান বডি।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে ওনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিয়েও বললাম না। চলে আসতে নিলেই উনি আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি ওনার দিকে তাকাতেই টেনে নিজের কাছে নিয়ে গেল। আমি চোখ বড়বড় করে তাকাচ্ছি ওনার দিকে আর বারবার ছাদের দরজায় দেখছি কেউ চলে আসছে কি-না। দরজায় দেখতে দেখতে হাতে কিছুর স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখি সেই ব্রেসলেট টা যেটা খুলে রেখে এসেছিলাম রুমে। ওনার হাতে কীকরে এলো? আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি আরও শক্ত করে ধরে পরাতে পরাতে বললেন,
” একটু নড়াচড়া করলে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দেব।”
ওনার এরকম হুমকি শুনে আমি থেমে গেলাম। যদি সত্যিই ফেলে দেয়? ব্রেসলেটটা পরানো হলে আমার দিকে তাকালেন। আমি নিচের নিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে বললেন,
” এবার একদম ঠিকঠাক লাগছে। এবার বলুনতো মহারানির মন খারাপ ছিল কেন? সেদিন ফোনে এতো শান্ত-ভদ্রভাবে কথা বললেন যে?”
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে অভিমানী কন্ঠে বললাম,
” মহারাণীর মহারাজের ওপর বড্ড অভিমান হয়েছে। সে গোটা রাজ্যের খেয়াল রাখে শুধু মহারাণীর মনের খেয়ালটাই রাখেনা।”
আদ্রিয়ান ভাই হাসলেন। কিন্তু ওনার ঐ হাসি আমার অভিমানকে আরও বাড়িয়ে দিল। উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
” প্রেম ভীষণ ভয়ানক রোগ মায়াবিনী। এটা ক্যান্সারের চেয়েও ভয়ানক। যত সময় যাবে অসুস্থতা বাড়তে থাকবে। রোগ বাড়তে থাকবে, অসুস্থ হতেই থাকবে কিন্তু মৃত্যু হবেনা। ভয়ানক না?”
আমি এবার চোখ তুলে তাকালাম ওনার দিকে। ওনার ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসি লেপ্টে আছে। যেটা দেখে আমার ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটলো। মানিক আঙ্কেলের ডাক শুনে দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। উনি ‘আসছি’ বলে চেঁচিয়ে আমার দিকে একপলক তাকিয়ে চলে গেলেন। আমিও হালকা হেসে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণভরা একটা শ্বাস নিলাম। কানে বাজছে ওনার বলা ঐ লাইনটা ‘ প্রেম বড্ড ভয়ানক রোগ, মায়াবিনী।’
৫.
[ অনেকদিন পর লিখলাম। তাও এই মাঝরাতে এসে। তাই যাদের কাছে লেখাটা পৌঁছাবে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। আর মতামত জানাবেন।
নতুন উপন্যাসের আপডেট শীঘ্রই দেব। থিম সাজাতে একটু সময় লাগছে। তবে দ্রুতই পাবেন ইনশাআল্লাহ।]