অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৬
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
কাল নতুন বছর আসতে চলেছে। ২০২১ এর শেষ দিন আজ। ২৬ জুনের গল্প থেকে হুট করেই ডিসেম্বর ৩১ এ কীকরে চলে আসলাম? না, সময় দীর্ঘ-লম্ফ দেয় নি। আমিই অলস হয়ে পড়েছিলাম। মাঝের এই লম্বা সময়টার মধ্যে অনেক কিছু হয়ে গেলেও সেটা কলমে ফুটিয়ে তোলার সময় হয়নি। কাব্য সোসাইটির থার্টি ফার্স্ট নাইটের পিকনিকে গেছে, বাবা নিজের পার্টি অফিসের গেট টুগেদারে আছেন, আম্মু নিজের রুমে টিভি দেখছে। আজ রুমে একান্তে কিছুটা সময় পেয়ে লিখে ফেলার লোভটা সামলাতে পারলাম না। সোসাইটিতে হওয়া পিকনিকে আমারও যাওয়ার কথা কিন্তু মন টানছে না আজ। প্রথমত আপি আজ নেই এখানে। বিয়ের পর প্রথম নিউ ইয়ার তাই শ্বশুর বাড়িতেই কাটাচ্ছে। কাজিনরা সব ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই আমার নিউ ইয়ার একা রুমে চিপস আর চানাচুরের সাথে কোকাকোলার নেশা করতে করতে সোলো পার্টি করেই কাটছে। হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে আদ্রিয়ান ভাইকে নক করতে গিয়েও করলাম না। বেশ অনেকগুলো দিন হয়ে গেল লোকটার কোন খবরই নেই। নিউইয়ারে শরীয়তপুর নেই উনি। ২০২২ এর মাঝের দিকে রিসার্চের জন্যে আবার নাকি পাড়ি জমাবেন কেমব্রিজে। সেটার প্রস্তুুতি নেওয়ার জন্যেই উত্তরার নিরিবিলি ফ্ল্যাটে বিশাল বিশাল বইয়ের পাতায় ডুবে আছেন উনি। কিন্তু উত্তরা যাওয়ার পর থেকে কোন খোঁজখবরই নেই ওনার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে করলাম আদ্রিয়ান ভাই আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পরে মানে ২৬ জুনের পরের সময়টার কথা-
আদ্রিয়ান ভাইয়া চলে গেছেন বারো দিন হতে চলল। বারো দিনে বদলে গেছে অনেক কিছু। আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পর দু-দিন সব ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে মনে হল যেন সবটাই বদলে গেছে। আকাশ নিজের রং বদলেছে। প্রখর রোদের তান্ডব থেমে গিয়ে ধূসর মেঘের রাজত্ব হয়েছে সেখানে। ঋতু বদলে গেছে, হয়তো বদলেছে মানুষের মনও। উনি যাওয়ার দু-দিন পর থেকে একটু একটু করে অনুভব করলাম আদ্রিয়ান নামক মানুষটার কলে ইদানিং আমার ফোন বেজে ওঠেনা, হোয়াটসঅ্যাপের এতো টুংটাং আওয়াজে আসা মেসেজের মধ্যে ‘আদ্রিয়ান ভাই’ নামে কোন মেসেজ আসেনা। যদিও এটা নিয়ে আমার বিশেষ কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না। কিন্তু কেন হচ্ছে সেটা নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না। নিজের অবান্তর অনুভূতি নিয়ে নিজেই বিরক্ত হচ্ছিলাম। কিছুই আর ভালো লাগছিল না। রাত তিনটা বাজছিল তখন। নিজেকেই নিজের প্রচন্ড অসহ্য লাগছিল। আমি বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে নিজের অস্বস্তির সাথে পেরে উঠতে অক্ষম হয়ে ফোন করেই বসেছিলাম তাকে। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হল। বেশ ভারী কন্ঠে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বললেন,
” তোর মাথায় কি সারা দিন-রাত শয়তান নাচতে থাকে? রাত সাড়ে তিনটে বাজে মগজ ভাজার জন্যে আমাকেই পেলি?”
কী বলব সেটাই ভাবছিলাম। সত্যিই তো এতো রাতে ওনাকে কেন কল করলাম? কী বলে কাটাবো এবার ব্যপারটা? অজুহাত দেওয়ায় পিএইচডি করা আমি এর এখন কোন লেইম অজুহাতও মাথায় আসছেনা। গলা শুকিয়ে আসছে। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি ধমকে বলে উঠলেন,
” এতো রাতে তোর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কাউন্ট করাতে কল দিয়েছিস?”
তার ধমকে গলা আরও শুকিয়ে গেল। কোন উপায় না পেয়ে বেশ জোরে জোরে দুটো শ্বাস নিয়ে বললাম,
” ঘুম আসছিল না তাই আরকি..”
এইটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলাম। কী বলব? কেন করেছি? কী করেছি? নিজেই তো ঠিকভাবে জানিনা। অন্যকে ব্যাখ্যা দিতে গেলেও তো নিজেকে আগে বুঝতে হয়। আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারছিনা, হচ্ছেটা কী! উনি গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
” অনি! তোর এসব মিনিংলেস ফালতু বকবক শোনা ছাড়াও আমার আরো অনেক কাজ আছে। ফোন রাখ!”
ওনার কথায় আমার বেশ রাগ হল। এমন অসভ্য কেন মানুষটা? অনেকটা রাগ দেখিয়েই বললাম,
” আপনি সবসময় এমনভাবে কথা বলেন কেন আদ্রিয়ান ভাই? যেন আমি আপনার কোন জন্মের শত্রু! এতো রুডলি..”
আর কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে এক ভয়ানক ধমক শুনে গলার স্বর আটকে গেল।কথা আপনা আপনি থেমে গেল। উনি রাগী কন্ঠে বললেন,
” এক্ষুনি ফোন রাখ। স্টুপিড মেয়ে একটা! রাত সাড়ে তিনটে বাজে তোর বকবক শোনার ধৈর্য্য যার আছে তাকে গিয়ে ফোন কর আমায় করবি না।”
হঠাৎ করেই ভীষণ কান্না পেলো আমার। অভিমান নামক অনুভূতিরা দম বন্ধ করার মতো করে জাপটে ধরল আমাকে। দ্রুত ফোনটা কেটে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চোখ খুলে রাখলেই হয়তো চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু অকারণে অশ্রু বিসর্জন দিতে আমি মোটেও ইচ্ছুক নই। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে কখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি সেদিনের মতো মনে নেই!
পরেরদিন সকালে উঠেই রেগে গিয়ে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিলাম তাকে। আমি ডিস্টার্ব করি তাকে তাইনা? এবার কোন জায়গায় কানেকশনই রাখব না। না বাঁশ থাকবে আর না বাঁশি বাজবে। হোয়াটসঅ্যাপ, আর সিম থেকে ব্লক করার পর মেসেঞ্জারে মানিক আঙ্কেলের নামে খোলা আইডিটাও ব্লক করলাম। যেটা এক্টিভ হয়না বললেই চলে। তার ফেসবুক আইডি নেই না হলে সেখানে থেকেও ব্লক করে দিতাম। সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিয়ে রিল্যাক্স করে বসলাম। অবশেষে শান্তি!
তবে এই শান্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা আমার জন্যে! হঠাৎই সব অসহনীয় লাগতে আরম্ভ করল। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। সোস্যাল মিডিয়াতেও এক্টিভ থাকা বন্ধ করে দিলাম। বাড়িতে কাউকে কিছু না জানালেও বাইরে সবাই বুঝেছিল আমি অফ আছি। নিরন্তর সবাই খোঁজখবর চালিয়ে গেলেও আমার কোন রেসপন্স পাওয়া গেলোনা।
এমনি করেই এলো ১৪ জুলাই। বেলা অনেক হয়ে গেলেও বেশ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম আমি। হঠাৎ খুব জোরে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম স্বয়ং আদ্রিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর নিচে তাকিয়ে দেখলাম আমার ফোনটা নিচে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ঘুম থেকে উঠেই একসঙ্গে এতো ঝটকা নেওয়া যায়? আমি কিছু ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই মা ছুটে এলেন রুমে। এসে হাঁফানো কন্ঠে বলল,
” কী রে? কী পড়ল?”
সঙ্গে সঙ্গেই আদ্রিয়ান ভাই বললেন,
” দেখ, তোমার মেয়ে ফোনটা একদম টেবিলের কর্ণারে রেখে চার্জে দিয়েছে। তারে পা লেগে হাতে আটকে পড়ে গেল, আরেকটু হলে আমিও পড়তাম।”
মা রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” একটা কাজ যদি প্রপারলি করতে পারতো মেয়েটা। এতো অগোছালো মানুষ কীভাবে হয়?”
আরো নানারকম কথা বলতে বলতে মা প্রস্থান করলেন। আমি অসহায় মুখ করে ওনার দিকে তাকালাম। কিন্তু উনি কোনরকম পাত্তা না দিয়ে কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে। আমি কিছুক্ষণ ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফুলিয়ে নেমে ফোনটা হাতে নিলাম। স্ক্রিন পেপারটা কোণা দিয়ে হালকা ফেটে গেছে। ইচ্ছে করেই যে আছাড় দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রাগে দুঃখে নিজের চুলই ছিড়তে ইচ্ছে করছে এখন। জঘন্য লোক কোথাকার!
ফ্রেশ হওয়ার পর মায়ের ডাকে বাধ্য হয়েই গেলাম খাওয়ার জন্যে। গিয়ে দেখি উনিও খেতে বসে পড়েছেন। আমি ওখানে দাঁড়াতেই আমার দিকে একটা ঠান্ডা চাহনী দিল। এই চাহনী যে বড়সড় একটা হুমকি সেটা ভালো করেই বুঝে গেছি। আমি খাবার নিয়ে রুমে চলে যেতে নিলেই মা ধমক দিয়ে বললেন,
” চুপচাপ এখানে বসো সবসময় এতো রুমে কী?”
আমি কিছুই বললাম না। চোখ মুখ কুঁচকে ওখানেই বসে পড়লাম খেতে। এদিকে ওদিক না তাকিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে খেতে লাগলাম। না তাকিয়েও আদ্রিয়ান নামক মানুষটার হুমকিপূর্ণ চাহনী বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। সেগুলো হজম করতে করতে কোনরকম খেয়ে রুমে এসে শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কী ভয়ংকর লোক! এরপর ওখানে কী হয়েছে ঠিক জানিনা। শুনেছি খাওয়া-দাওয়া করে কাব্যর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেছেন। সারাদিন রুমে পায়চারী করেছি আর ভেবেছি কী করব। মাঝখানে কাব্য একবার এসেছিল ওর আদ্রিয়ান ভাই কী টিপস দিয়েছে সেটা শুনাতে। আমি এক ধমক দিয়ে বের করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। অসহ্য! অনেক ভাবনা চিন্তা করার পর ওনার সেই হুমকিপূর্ণ চাহনী আর ফোনের ফাটা স্ক্রিনকে অবহেলা করতে পারলাম না। ফোন আছাড় মারাটা নিশ্চয়ই আমার জন্যে ফার্স্ট ওয়ার্নিং ছিল। ওয়ার্নিং দেওয়ার মানুষ উনি নন, সবসময় ডিরেক্ট একশন নিতেই বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এবার দিয়েছেন। এবার ফোন আছাড় মেরেছে পরেরবার আমায় আছাড় মারতেই পারে। কোন বিশ্বাস নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রচন্ড বিরক্তি আর মনখারাপ নিয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সব জায়গা থেকে আনব্লক করলাম।
সময় নিজের গতিতেই এগোচ্ছিল। সামনে ঈদ-উল- আজহা। ঐদিনের পর আরও একবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম আদ্রিয়ান নামক মানুষটার কাছ থেকে। ইউকে থেকে ফেরার সময়তো শুনেছিলাম ওনার বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখা হচ্ছে। নতুন বিয়ের আনন্দেই হয়তো এই মনবদল। সেসব নিয়ে মাথাব্যথাও ছিলোনা আমার আর। মন খারাপ ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছিলাম। সোসাল মিডিয়াতে আগের মতোই আনাগোনার শুরু হয়েছিল। নিজের চেষ্টাতেই স্বাভাবিক হয়ে উঠছিলাম।
ঈদের তখন দু-দিন এর মতো বাকি। বাড়ির সবাই তখন গরু, গরুর হাট এসব নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। রাত তখন দেড়টা বা দুটো বাজবে হয়তো। হঠাৎ করেই ফোন বেজে ওঠাতে চমকে উঠলাম আমি। আরও বেশি চমকালাম স্ক্রিনে আদ্রিয়ান ভাই নামটা দেখে। অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেটে গেল। আমি ছোট্ট একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। একটু পর আবারও বেজে উঠল ফোন। আদ্রিয়ান ভাই! আমি এবার আর অপেক্ষা না করে ফোনটা রিসিভ করলাম। কিন্তু রিসভ করার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকেও ওপাশ থেকে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনতে পেলাম না। আমিও কিছু বললাম না। অনেকটা সময় পর নিজেই কেটে দিল। আমি অবাক হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। কী শুরু করেছেন কী উনি? আনুমানিক পাঁচ মিনিট পর উনি আবার কল করলেন। আমি একটু বিরক্ত হয়েই রিসিভ করলাম তার ফোন। এবারেও কোন কথা না বলাতে আমি নিজেই বললাম,
” কিছু বলবেন? ফোন করে এভাবে চুপ করে আছেন কেন?”
আরও ক্ষণিকের নিরবতার পর উনি বললেন,
” আব্ এক ফ্রেন্ডকে কল করেছিলাম। ভুলে চলে গেছে, সরি।”
বলে এক সেকেন্ডও দেরী না করে ফোনটা কেটে দিলেন। আমি বোকার মতো বসে আছি। তিন তিনবার ভুল করে কল চলে আসে? সিরিয়াসলি? আমাকে কি আসলেই এতোটা ডাম্ব মনে হয়? সেদিন প্রচন্ড রাগ হয়েছিল ওনার ওপর। এতোটাই রাগ হচ্ছিলো যে সবকিছুই ভেঙ্গেচুরে ফেলতে হচ্ছিলো একেবারে। আজ কতো ভালো একটা মুডে ছিলাম। সব বরবাদ করে দিল। আমার শান্তি ওনার কোনকালেই সহ্য হয়না। কী মনে করেন আমাকে উনি? কেন করেন এমন?
ভীষণ জোরে বাজি ফাটার আওয়াজে ভাবনা থেকে জেগে উঠলাম। বাইরে থেকে জোরে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ চিৎকার ভেসে আসছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম বারোটা বেজে গেছে। আরও একটা বছর পেরিয়ে গেল। শুধু বদলালো না ঐ মানুষটা। চোখ ফোনের স্ক্রিনে আটকে আছে। হয়তো অবচেতন মন কারো ছোট্ট একটা টেক্সট এর অপেক্ষায় আছে। ভালোবাসাময় কিছু শব্দের অপেক্ষায় আছে। অপেক্ষায় আছে অপেক্ষা শেষ হওয়ার।
.৭
[ রি-চেক করা হয়নি। আর নতুন উপন্যাস পেতে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রথম পর্বে কাল পরশুর মধ্যেই হাত দেব। আর শীঘ্রই আপনাদের কাছে পৌঁছে দেব। ততক্ষণ এই টুকরো টুকরো লেখাগুলোই উপভোগ করুন।]