অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৮
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
আজ বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছি, তাও আম্মু ডেকে তোলার আগেই। সেটা নিয়ে আমার মায়ের অবাক হওয়ার শেষ নেই। এটা তার কাছে একটা আশ্চর্যজনক ঘটনাই বটে। একবার জিজ্ঞেসও করেছিল শরীর ঠিক আছে কি-না। কিন্তু আমার এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। সকাল থেকে বেশ চিন্তায় কাটছে। ঈদের দ্বিতীয় দিন ছিল সেটা।আমাদের আদ্রিয়ান ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার কথা। কিন্তু কারো মধ্যে তেমন কোন লক্ষণই দেখছি না। আম্মু নিজের মতো রান্নাবান্না কাজকর্ম করছে, বাবাও বাজারে গেছেন। কখন যাবে? আজ হয়তো প্রথমবার আমি আদ্রিয়ান ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্যে এতো ছটফট করছি। এর আগে সবসময় যাওয়া এড়ানোর চেষ্টাতেই থাকতাম। ব্যপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি। আজ যেনো বৃষ্টি বা কোন ঝামেলা না হয় সেটার জন্যে দোয়া করেই সারারাত কেটেছে আমার।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যাওয়ার পরেও যখন ওনাদের মধ্যে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা-ই দেখতে পেলাম না তখন মনটা বেশ খারাপ হলো। ওনারা কী না যাওয়ার প্ল্যান করেছে না-কি? চুপ করে বসে থাকতে না পেরে কিছুক্ষণ পরে আম্মুকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
‘ আম্মু তোমরা কী আজ যাচ্ছো মানিক আঙ্কেলের বাড়ি? গেলে যাওয়ার আধ ঘন্টা আগে থেকে আমাকে বলে দিও। হুটহাট বলে পরে তাড়া দিওনা।’
আম্মু যাতে সন্দেহ না করে তাই একটু বিরক্তি প্রকাশ করে একটু বাড়িয়ে বললাম,
‘ সবসময় আমাকে নিয়ে টানাটানির কী দরকার? তোমরা যাচ্ছো যাও না? আমি বাড়িতেই থাকি?’
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আম্মু বলে বসল,
‘ যেতে ইচ্ছে না করলে যাবিনা। সবসময় এতো জোরাজুরি ভালো লাগেনা।’
আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি। কী জ্বালা! এমনিতেতো যাবোনা বললে ধমক দিয়ে বসিয়ে দেয়। অথচ আজ আমি সত্যিই যেতে চাই আর আজ রাজি হয়ে গেল? এটা কোন কথা? সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। এখন যদি সত্যিই না যাই তাহলেতো ক্ষ্যাপা মহারাজ আরও ক্ষেপে যাবেন। কী করব বুঝতে পারছিনা ঠিক তখনই বাবা বলে উঠলেন,
‘ যাবেনা মানে কী? রোজ রোজ যেতে বলে নাকি তোমাকে। ঈদের সময় সবাই যাবো। যাওয়ার ঘন্টাখানেক আগে বলে দেব। রেডি থেকো।”
মনে মনে বাবাকে একশটা ধন্যবাদ দিয়ে রুমে চলে এলাম। আর অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন বলবে রেডি হতে। সারাদিন রুমে পায়চারি করে অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে বিকেলে আম্মু এসে রেডি হতে বলল। বলতে দেরী হয়েছে কিন্তু আমার রেডি হতে দেরী হয়নি। আদ্রিয়ান ভাইয়ের দেওয়া জামাটা পরেই তৈরী হলাম। হালকা সাজলামও সেদিন। তৈরী হয়ে আয়নায় বারবার দেখছিলাম নিজেকে। আজ সুন্দর লাগাটা অনিবার্য!
জাজিরা থেকে শরীয়তপুর সদর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হল। ওনাদের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই মাগরিবের আজান দিয়ে দিল। মানিক আঙ্কেল আর বাবা পাশের মসজিদে চলে গেলেন। আম্মুকেও মামণি সাথে নিয়ে গেল। সোফায় আমি, জাবিন আর সারা বসে আছি। ওদের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আশেপাশে তাকাচ্ছি। আদ্রিয়ান ভাইয়ের কোন দেখা পেলাম না। কিন্তু ঐ মুহুর্তে দু চোখ শুধু ওনাকেই খুঁজছিল। ওনারা সব নামাজ পড়ে আসার পর আন্টি আমাদের নুডুলস, দুরকম সেমাই, ডিমের পিঠা, হোম মেড কেক আর চা দিল। অথচ এখনো অবধি আদ্রিয়ান ভাইয়ের দেখা পেলাম না। তখনই কাব্য মামণিকে বলল,
‘ মামণি আদ্রিয়ান ভাই কোথায়? বাড়ি নেই?’
ইচ্ছে করছিল ভাইটার গালে একটা জোরে পাপ্পি দেই। মাঝমাঝে নিজের অজান্তেই আমার উপকার করে দেয়। মামণি বললেন,
‘ হ্যাঁ ঘরেই আছে। ঘুমোচ্ছিল। এখন মনে হয় উঠে পড়েছে। দাঁড়া দেখছি।”
মামণি ‘আদ্রি’ ‘আদ্রি’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। নিজের ঘর থেকেই উনি ‘আসছি’ বলে আওয়াজ দিলেন। ঠিক তার পাঁচ মিনিট পর এসে হাজির হলেন আদ্রিয়ান ভাই। এলোমেলো চুল, পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার। চোখে হালকা ঘুম ভাব স্পষ্ট। এসে বাবা-মাকে সালাম দিল। কাব্যর চুল হাত দিয়ে নেড়ে দিয়ে বলল,
‘ কেমন আছো ব্রাদার?’
কাব্য হেসে বলল,
‘ ভীষণ ভালো। তুমি?’
‘ এইতো ফিট আছি।’
বলে সোফার হ্যান্ডেলের ওপর বসল। অথচ আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। ওনার দেওয়া জামা পরে, সেজেগুজে এলাম। অথচ উনিই দেখছেন না। আজব! এতো রাগ করে কীকরে এই লোকটা? মুখ গোমড়া করে পিঠা চিবুতে চিবুতে এসবই ভাবলাম। একটু পরেই উনি বলে উঠল,
‘ আম্মু কফিটা রুমে পাঠিয়ে দাও। আমি পড়তে বসব।’
মামণি একটু রেগে বললেন,
‘ একটা থাপ্পড় মারব। মেহমান এসেছে না? সারাক্ষণ পড়ার প্যাঁচাল আমার সামনে করোনা। চুল কিন্তু এমনি এমনি পাকেনি আমার।’
আদ্রিয়ান ভাই মুখ ফুলিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘ আয়না দেখো। তোমার চুল পাকেনি এখনো।’
মামণি বেশ বিরক্তি নিয়েই তাকাল আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে। কিছু বলল না। বেশ অনেকটা সময় জুড়ে সবার গল্প-গুজব চলল। এরমধ্যে আদ্রিয়ান ভাই একবারও তাকান নি আমার দিকে। আজব মানুষ! কী এমন করেছি যে এতো রাগ করতে হবে? একসময় মানিক আঙ্কেল আর বাবা উঠে বাইরে গেলেন গল্প করতে করতে। আদ্রিয়ান ভাইও উঠে চলে গেলেন রুমে। মামণি জাবিন আর সারাকে বলল আমাকে ওদের রুমে নিয়ে যেতে। ওদের সাথে ওদের রুমে গেলেও আমার মন পড়ে আছে আদ্রিয়ান ভাইয়ের কাছে। কখন যে গিয়ে একটু দেখা করতে পারব কে জানে? জাবিন আর সারা টিভি দেখতে দেখতে এটা ওটা বলছে আর আমি শুধু হু হ্যাঁ করে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর আমি জাবিনকে বললাম,
‘ রুমে অনেক গরম পড়েছে। আমি বাইরে থেকে হেঁটে আসি। তোমরা যাবে?’
ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলেও মনে প্রাণে চাইছিলাম ওরা না বলুক। ভাগ্যক্রমে সেটাই হল। ওরা আমাকে হেটে আসতে বলল। কারণ দুজনেই টিভিতে মগ্ন। আমি খুশি মনে বেরিয়ে গেলাম। আদ্রিয়ান ভাইয়ের রুমে গিয়ে হালকা করে উঁকি দিয়ে দেখলাম উনি রুমে নেই। কোথায় গেল? ওনাকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদের কাছে আসতেই টুংটাং গিটারের আওয়াজ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম মহাশয় ছাদেই আছেন আর গিটার বাজাচ্ছেন। ছাদে গিয়ে দেখলাম ঠিক ধরেছি। ছাদের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে মনের আনন্দে গিটার বাজাচ্ছেন। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ওনার পেছনে দাঁড়ালাম। হালকা গলা ঝাড়তেই উনি গিটার বাজানো থামিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেও উনি যখন কিছু বললেন না তখন আমি বললাম,
‘কেমন আছেন?’
উনি কোন উত্তর দিলেন না। ওনার নিরবতা দেখে আমার ভয় লাগছে। কখন আবার বাঘের মতো গর্জে ওঠে। আমি দু’পা এগিয়ে কোনরকমে বললাম,
‘ জামাটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। চুড়িগুলোও আর কানের দুলটাও। সবগুলোই সুন্দর ছিল।’
কিছু বলার মতো না পেয়ে এটাই বললাম। উনি হঠাৎই উঠে দাঁড়াল। আমিই ভয় পেয়ে হালকা পিছিয়ে গেলাম। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে উনি চলে যেতে নিলে আমি দ্রুত বললাম,
‘ বিশ্বাস করুন আমি সত্যিই এগুলো কালকেই পড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু… এখন পরেছিতো দেখুন।’
উনি আমায় একবার স্ক্যান করে বললেন,
‘ ওও এগুলো পরার সময় হয়েছে আপনার? আমিতো ভেবেছিলাম ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন।’
আমি মাথা নিচু করে, ওড়নায় আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে মুখ গোমড়া করে করে বললাম,
‘আমি জানতাম নাকি আপনি তখন আসবেন? বলেছেন আমায়?’
উনি শক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ সন্ধ্যা থাকতে আঙ্কেল-মামণিকে জানিয়ে রেখেছি। কেন? আমার জন্যে বাড়ি ডেকোরেট করে রাখতে? ডাফার!’
আমি আগের মতই মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘ ওরা বলেনি আমায়।’
উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর চলে যেতে নিলেই আমি দ্রুত ওনার সামনে গিয়ে কানে হাত দিয়ে ননস্টপ কয়েবার সরি বলে ফেললাম। মাঝখানে নো ব্রেক। কী করলাম, কেন করলাম, নিজেও জানিনা। শুধু করে ফেললাম। উনি ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। যখন খেয়াল করলাম কানে হাত দিয়ে আছি সাথেসাথেই হাত নামিয়ে বললাম,
‘ সরিতো! আমি সত্যিই জানতাম না আপনি আসবেন।’
উনি এবার হালকা ধমকে বললেন,
‘ এতো রাতে গোসল করেছিলি কেন?’
এইরে! এখন এটার জন্যেও বকবে নাকি? আমি কথা ঘোরাতে বললাম;
‘ একটা গান শোনান না।’
উনি কয়েকসেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমার হাত ধরে পেছনে নিয়ে মুচড়ে ধরলেন। আমি ব্যথায় হালকা কুঁকিয়ে উঠলাম। উনি কঠিন স্বরে বললেন,
‘ নিজেকে খুব চালাক মনে করিস?’
পাগল আমি যে সিংহের সামনে হরিণ হতে যাব? আমি কাঁদোকাঁদো মুখ করে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ গানই তো শুনতে চেয়েছি এমন করছেন কেন?’
উনি আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। এরপর আমায় ছেড়ে দিয়ে আবার আগের মতো পা ঝুলিয়ে বসে পরলেন। আমিও আস্তে করে ওনার ঠিক পাশে গিয়ে বসলাম। উনি আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ গিটারে সুর তুললেন। ওনার কন্ঠে হিন্দি গান ‘যাব তাক’ টা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। এতোই মনোযোগ দিয়ে শুনেছি যে কখন শেষ হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি।
গান শেষ হয়েছে অনেক্ষণ। তবে উনি এখনো হালকা টুংটাং করছেন গিটারে। চারপাশে হালকা বাতাস বইছে। আর পাশাপাশি বসে আছি উনি আর আমি। দুজনেই নিরব। কিন্তু এমন মনে হচ্ছে এই নিরবতা দিয়েই আমরা অনেক কথা সেরে ফেলছি। যা হয়তো মুখে বলতে পারতাম না। দীর্ঘ সময়ের নিরবতার পর আমি বললাম,
‘ শুনলাম বিয়ে করছেন?’
উনি কোন উত্তর দিলেন না। আগের মতোই গিটারে টুংটাং করে যাচ্ছেন। যেন শুনতেই পাননি আমার কথা। আমার ভেতর থেকে একটা চাঁপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। আর উনি গুনগুন আওয়াজে গেয়ে উঠলেন,
‘You’re the light, you’re the night
You’re the color of my blood
You’re the cure, you’re the pain
You’re the only thing I wanna touch
Never knew that it could mean so much, so much’
আমি শুধু তাকালাম ওনার দিকে। সে এক গভীর দৃষ্টি। যাতে লুকিয়ে আছে অনেক কিছু। কিন্তু ওনার দৃষ্টি এখনো বাইরে। এরমধ্যেই মামণির ডাক শুনতে পেলাম। হয়তো রাতে খেতে ডাকছে। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে চলে গেলাম নিচে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে মনে হয় আধঘন্টা পর আমরা বেরিয়ে ছিলাম ঐ বাড়ি থেকে। আদ্রিয়ান ভাই নিজেই এগিয়ে অটোতে তুলে দিয়েছেন আমাদের।
অটোতে বসে আমি আমার ভাবনায় বিভোর হয়ে আছি। হঠাৎ ফোনে মেসেজের টোন আসলো। আমি ফোনটা নিয়ে মেসেজটা ওপেন করতেই স্ক্রিনে ভেসে এলো,
‘গোলাপি রঙটা মানাবে জানতাম, কিন্তু এতোটা মানাবে ভাবি নি। আমার কথা বরাবরই সত্যি হয়। শ্যামকন্যার শ্যামাঙ্গে আমার পছন্দ করা রঙটা নিজের সর্ব সৌন্দর্য দিয়ে ফুটে উঠেছিল। চুড়ির ওই ঝুনঝুন শব্দটা এখনও কানে বাজছে। ওই কাজল টানা চোখ! ইশ! মরে যাচ্ছিলাম আমি। আর কতবার মারবে শুনি? বারবার এভাবে খুন করতেই আসো বুঝি? এভাবে বারবার একটা মানুষকে মারার জন্যে তোমার তো কঠিন শাস্তি প্রাপ্য, খুব কঠিন।’
আমি বাইরে তাকিয়ে হালকা হাসলাম আমি। অটো চলছে নিজের গতিতে। বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাস এসে শীতলতা ছুঁইয়ে দিচ্ছে আমার শরীরে। তারসাথে একরাশ শীতলতায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে আমার মন-ও।
.
.
.