অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৯
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
.
দিনের শুরুটা যেমন আলো নিয়ে আসে ঠিক তেমনই সন্ধ্যা নিয়ে আসে অন্ধকার। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আলোর পর অন্ধকার আসবেই। কোন এক দিন যদি তোমাকে হাসিয়ে দিয়ে যায়, তাহলে অন্য একটা দিন এসে তোমাকে কাঁদিয়ে যাবেই। এটাই যেন চিরকাল ধরে চলে আসা এক শাশ্বত নিয়ম।
দিনটা জুলাই মাসের ২৫ তারিখ। ঐদিন বিকেলটা বেশ ভালো কেটেছে আমার। অনেকদিন পর বাইরে মন খুলে ঘুরতে পেরেছি। লকডাউনের পর থেকে সেভাবে কোথাও যাওয়ার সুযোগই হয়নি। তবে বিকেলে অরুমিতা, নাহিদ, ফরহাদ, ইমন এসছিল বাড়িতে। উদ্দেশ্য আমায় নিয়ে বাইরে যাওয়া। ওদের সাথেই সারা বিকেল ঘোরাঘুরি করেছি। যদিও বেশি দূরে যাওয়া হয়নি। জাজিরা শিল্পকলা একাডেমির পাশের শহীদ মিনারেই ছিলাম। পুরা বিকেলটাই লাফালাফি, হাসাহাসি আর মজার মধ্যে দিয়ে কাটলো। চারজন মিলে বেশ আনন্দ করেছি। নাহিদ তো ছোটখাটো একটা লাইভও করে ফেলেছিল। সারারাত না ঘুমিয়ে চেহারার অবস্থা ছিল করুন। তাই ভুল করেও লাইভে মুখ দেখাতে দেইনি। তবে আমার ছটফটানি দেখে যে সবাই টাস্কিত ছিল সেটা নিশ্চিত।
সারাবিকেল এতো ভালো কাটার পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বেশ ভালো একটা মুডেই ছিলাম। রাতে আম্মু পাশে বসে টিভি দেখছে সাথে সবজি কাটছে। আর আমি ফোন স্ক্রোল করছিলাম। তখনই মায়ের ফোন বেজে উঠল। আমি একবার তাকিয়ে আবার ফোন দেখাতে মনোযোগ দিলাম। কানে যেটুকু আওয়াজ আসছিল তাতে বুঝতে পারছিলাম যে মামণি ফোন দিয়েছেন।
‘ মেয়েটা কে? ঐ যে বাবুল ভাইয়ে ভাতিজি? ঐযে মানিক ভাইয়ের সাথে এসেছিল সেদিন, সেই বাবুল?’
কথাটা শুনে আমি থেমে গেলাম। চোখদুটো ফোনে থাকলেও কান খাড়া করে রাখলাম। বাবুল আঙ্কেলের ভাতিজির কথাইতো বলছিল না সেদিন? আদ্রিয়ান ভাইয়ের জন্যে? তারমানে কী সত্যি সত্যিই বিয়ে নিয়ে ভাবছে ওরা? ওপাশ থেকে কিছু বলার পর আম্মু বলল,
‘ তা কবে যাচ্ছো মেয়ে দেখতে?’
আমার ভেতরটা কেমন করে উঠল। মেয়ে দেখতেও যাচ্ছে? এতোদূর ভেবে ফেলেছে? আর আদ্রিয়ান ভাই? উনি জানেন এসব? আম্মু হেসে দিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা সমস্যা নেই। আমরা আছিতো এখানেই। যেদিন যাবে বলে দিও। আমরা তৈরী থাকবো। আর কে যাবে?’
ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল কিন্তু আমি সেটা শুনতে পাইনি। শোনার ইচ্ছেটাও আর নেই। কথাগুলো বড্ড বিষাক্ত মনে হচ্ছে আমার কাছে। কথাতেও বিষ থাকে তাহলে? ফোনটা রেখে আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ রিমা ভাবি কী বলল শুনলে? ঐ যে সেদিন বাবুল আঙ্কেল এসেছিল না তোমার? তার ভাতিজিকে আদ্রির জন্যে দেখতে যাবে। এই সপ্তাহেই যাবে হয়তো। গিয়ে যদি পছন্দ হয় তাহলে এ মাসেই পাকা কথা।’
আমি এখনো ফোন থেকে চোখ সরাই নি। ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছি। কাব্য ওখানেই বসে গেমস খেলছিল। ও গেমস খেলতে খেলতে বলল,
‘ ওনারা এতো তাড়াহুড়ো করছে কেন? ভাইয়ার সবে এমএসসি হয়েছে। পঁচিশ বছরেই কে বিয়ে করে?’
আম্মু সবজি কাটতে কাটতে বলল,
‘ আদ্রি আর পাঁচটা ছেলের মতো হলে এতো তাড়াহুড়ো কেউ করতো না। কিন্তু এই ছেলেকেতো কেউ ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনা। কখন যে কী করে? কেন করে?বেশি ব্রিলিয়ান্ট হলে আবার এই একটা ঝামেলা। মাঝেমাঝেতো এমনভাবে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকে বোঝা মুশকিল ও স্বাভাবিক মানুষ কি-না। ওর চিন্তাধারাও যথেষ্ট আলাদা। পরীক্ষা শেষ করে দাদার ধমক আর মায়ের কান্নাকাটিতে দেশে এসেছে। যেকোন সময় আবার ফুড়ুৎ করে উড়াল দেবে কেমব্রিজে। তাই এখনই একটা বিয়ে-টিয়ে করিয়ে রাখাটাই ভালো ভাবছে ওরা। অন্তত পিছুটানতো থাকবে। দরকারে বউ নিয়েই যাবে।’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছি। চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে আমার। কষ্ট হচ্ছে না-কি রাগ হচ্ছে নিজেই বুঝে উঠতে পারছিনা। তবে বুঝতে পারছি আমি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরেই শ্বাস নিচ্ছি। আম্মু আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আর শোন, রিমা ভাবি তোমাকেও যেতে বলেছে, আমিও যাচ্ছি। পরে বলোনা আগে থেকে জানাও নি কেন?’
আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম,
‘ আমি যেতে পারবোনা। আমার পড়া আছে।’
আম্মু সবজি কাটতে কাটতেই বলল,
‘ সারাদিন কত পড়াশোনা করে দেশ উদ্ধার করছিস দেখতেই পাচ্ছি। একদিনে কিছুই হবেনা। অজুহাত দিবিনা।’
আমার এবার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল। কী ভাবে কী আমাকে ওনারা? সব ওনাদের মর্জিতেই হবে? আমি কী মানুষ না? পাপেট মনে হচ্ছে দেখে? আমি ফোন থেকে চোখ সরিয়ে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ আমি কোন দুঃখে যাবো? আমি কী আদ্রিয়ান ভাইয়ের বোন লাগি? না আত্মীয় লাগি? সব জায়গায় আমাকে টানো কেনো আম্মু? তোমাদের তো যেতে নিষেধ করছিনা। আমি বলছি আমি যাবোনা। ‘
আম্মু সবজি কাটা থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এসব বেয়াদবি কোথায় শিখলে অনি? অসভ্যতামিতে দেখছি আজকাল খুব উন্নতি করছো।’
আমি কোন কথা না বলে উঠে নিজের রুমে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে খাটে এসে বসলাম। এবার একটু বেশি জোরেই শ্বাস নিচ্ছি। শরীর ঘেমে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে পাশ থেকে মামপটটা নিয়ে প্রায় অর্ধেক পট খালি করে ফেললাম। এরপর আরও কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম। বুঝতে পারলাম আম্মুর সাথে ওভাবে কথা বলাটা মোটেও ঠিক হয়নি। কীসের ফ্রাস্টেশন কোথায় বের করছি নিজেই বুঝতে পারছিনা। মাথা ধরে যাচ্ছে আমার। কান্না জিনিসটাও আসছেনা। ভেতরেই দলা পাকিয়ে বসে আছে। সেদিন রাতে আর খাওয়া হলোনা। নিজের মনের মধ্যেই ছটফট করতে করতে রাত বারোটার বেশি বেজে গেল। একবার আদ্রিয়ান ভাইয়ের নাম্বারটা বের করতে গিয়েও থেমে গেলাম। আমি কেন করব কল? ওনার জন্যে মেয়ে দেখতে যাচ্ছে। কবে দেখতে যাবে সেই দিনও ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আর উনি জানেন না সেটা নিশ্চয়ই হতে পারেনা। ওনার পার্মিশন ছাড়া নিশ্চয়ই এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছেনা। করুক না বিয়ে? আমার কী? বিয়ে করুক বউ নিয়ে পার্মানেন্টলি ইউকে গিয়ে থাকুক। আমি কেন ভাবছি এসব নিয়ে? আমি আর ভাবব না। নিজের মনেই এসব আওড়ে নিয়ে আপিকে একটা ফোন করলাম। এখন ওর সাথে কথা বলেই মনটা হালকা করতে পারব। তারপর একটা ঘুম দেব। শান্তির ঘুম।
পরের দিনটা আমি একপ্রকার ঘুমিয়েই পার করলাম। সারাদিনে একবেলাই খাবার মুখে রুচলো আমার। মন কেমনের দিনগুলোতে যেন আরও একাকিত্ব এসে ভর করল। ঐদিন সোশ্যাল সাইটেও যাওয়া হলোনা তেমন আর না কারো সাথে ঠিকমতো কথা হল। আবছা অন্ধকার রুমটাতে পার করলাম দীর্ঘ অনেকগুলো ঘন্টা। রাত তখন এগারোটা কী বারোটা বাজছে হয়তো। ফোন বেজে ওঠার শব্দে কিছুটা চমকে উঠলাম। স্ক্রিনে আদ্রিয়ান ভাইয়ের নাম। ওনাদের বাড়ি থেকে আসার পর তো আর ফোন-টোন করেনি। তাহলে আজ হঠাৎ মনে পড়ল কেন আমায়? এতো রাতে আমার সাথে তার কী কাজ? আমি আর বেশি কিছু চিন্তা না করেই ফোনটা রিসিভ করলাম। রিসিভ করে নরম কন্ঠে বললাম,
‘ হ্যালো?’
ওপাশ থেকে আদ্রিয়ান ভাই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ ফোন রিসিভ করেছিস যখন নিশ্চয়ই ফোনটা হাতেই ছিল?’
আমি ইতস্তত কন্ঠে বললাম,
‘ জ্বি’
‘ তাহলে আমার দেওয়া মেসেজটা এখনো সিন করিসনি কেনো?’
আদ্রিয়ান ভাইয়ের গম্ভীর কন্ঠে বলা কথাটা শুনে বেশ অবাক হলাম। মেসেজ করেছেন উনি। করতে পারেন। আমিতো আজ সারাদিনে মেসেজ-টেসেজ চেক করিনি। আমি এবারও নিচু কন্ঠে বললাম,
‘ আমি চেক করিনি।’
ওপাশ থেকে আদ্রিয়ান ভাই বুক কাঁপানো ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ সারাদিন ইউটিউব ঘাঁটা, ফেসবুকে নাচানাচি করার সময় আছে। কিন্তু মেসেজ চেক করার সময় নেই। মানুষ যত বড় হয় তত আদব জ্ঞান বাড়ে আর তুই দিন দিন বেয়াদব হচ্ছিস। এই, কমনসেন্স বলে কোন বস্তু আছে তোর মধ্যে? ইউ আর__ ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।’
আমি চুপ করে আছি। উনি আবার একই স্বরে বললেন,
‘ তোকে কল করাটাই ভুল হয়েছে। নিজের ভালো চাইলে নেক্সট টাইম আমার সামনে আর আসবি না তুই। আমার সামনে পড়লে আমি কী করব নিজেই জানিনা।’
ওপাশ থেকে ‘টুট টুট টুট’ আওয়াজ এল। কল কেটে দিয়েছেন। আমি নিরব শ্রোতার মতো শুধু শুনলাম ওনার অভিযোগগুলো। ফোনটা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দুটো খুলে দিলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি আকাশটা অন্ধকার। মেঘ ডাকছে। হয়তো রাতে বৃষ্টি হবে। শূণ্য দৃষ্টিতে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম বর্ষণের অপেক্ষায়।
.
.
[ রি-চেইক করা হয়নি। পেইজের রিচ কিছুটা কমে গেছে। তাই যার যার কাছে লেখাটা পৌঁছাবে সবাই কষ্ট হলেও রিঅ্যাক্টটুকু করে যাবেন। পারলে শেয়ারও করবেন।
নতুন উপন্যাস কবে আসবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিনা তবে দেরী হবেনা। দ্রুতই পাবেন। ]