অন্তর্হিত কালকূট
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
১৪.
‘এটাই তাহলে রুদ্র আমের?’
স্তব্ধ কন্ঠে বলে উঠল তমাল। গুলশান থানায় পৌঁছনোর পরেই ওদের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে রুদ্রর ছবি আর স্কেচ। হ্যাঁ ছবিও পেয়ে গেছে। আজিজ যাওয়ার আগে ফারুককে বলে গিয়েছিল ভালোভাবে খুঁজে দেখতে পুরো অফিসটা। অনেক খোঁজার পর অবশেষে উদ্ধার করা গেছে রুদ্রর ছবিটা। বাদামি বোর্ডে পিন দিয়ে আটকানো রুদ্রর ছবি দেখে তুহিন, তমাল, ফারিয়া তিনজনই থমকেছে। ফারিয়া চোখের পলক অবধি ফেলছে না। তমালের মুখটা হা হয়ে গেছে এক ইঞ্চি। চেহারায় প্রকাশ না পেলেও তুহিনও যথেষ্ট চমকেছে। এই ছেলেটা এতো বড় একজন সন্ত্রাসী? উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, অপূর্ব বাদামি চোখের গভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঘন কালো ভ্রু জোড়া, খাড়া নাক, পাতলা পুরুষালি ঠোঁট যেটার রঙ একসময় হয়তো মৃদু গোলাপি মতন ছিল কিন্তু সিগারেটের কৃপায় সামান্য কালচে ভাব এসেছে, মাথাভর্তি অগোছালো চুল আর গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। প্রথম দর্শনে যে কারো দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম এই পুরুষ। যে চেহারা থেকে এমন সৌন্দর্যের আলো ঠিকরে পড়ে সে কি-না এক ভয়ানক অন্ধকার জগতের রাজপুত্র! কয়েক সেকেন্ড কোন কথা বের হলোনা কারো মুখ দিয়ে। সবার আগে তুহিন-ই সামলে নিল নিজেকে। সামান্য গলা ঝেড়ে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুদ্র?’
হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলেন ইন্সপেক্টর আজিজ। বোর্ডে লাগিয়ে রাখা রুদ্রর ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অবাক হচ্ছেন? সবাই হতো। ওকে প্রথম যে দেখতো সে এমনই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো। কেউ বিশ্বাসই করতে চাইতোনা এই ছেলে নির্বিকারভাবে এতো নির্মম আর নৃশংস হত্যাকাণ্ড করতে পারে। একটা নির্দয়, হৃদয়হীন, অমানুষের এরকম চেহারা কারোরই কাম্য নয়।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘আপনিও কিন্তু খুব সুন্দর স্যার। তবে আপনার কাছে সৌন্দর্যের সাথে সাথে আদর্শও আছে যেটা রুদ্রর ছিলোনা।’
তুহিন কিছু বলল না। তার প্রতি করা প্রশংসার জন্যে কোনরকম সৌজন্যতাও দেখালোনা ইন্সপেক্টরকে। ঠোঁট চেপে ধরে গভীরভাবে রুদ্রর ছবি দেখতে দেখতে ভাবছে কিছু একটা। ফারিয়া এখনো অবাক হয়ে দেখছে রুদ্রকে। ফারিয়ার এই মুগ্ধতা তমাল-ই সবার আগে লক্ষ্য করল। কিছুটা বিরক্ত হল সে। ফারিয়ার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘সুন্দর ছেলে দেখলেই গিলে খেতে ইচ্ছে করে না? এতোদিন তুহিন স্যারের পেছনে পড়ে ছিলে। এখন কী এই সন্ত্রাসীর পেছনে পড়বে না-কি?’
ফারিয়ার ঘোর কাটল। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিল তমালে কটুক্তি। কিন্তু কিছুই বলল না এখন। তুহিন বসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে দ্য সোসাল সিস্টেম গ্রুপের ফাইলগুলো পড়ল। কিছুক্ষণ পড়ার পর তমালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অফিসে ফোন করো। ঐ তিনতলা বিল্ডিং এর মালিক ফিরেছেন কি-না দেখো। যদি না ফেরেতো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ করা শুরু করো। দরকারে ছবি ছেপে দাও খবরের কাগজে। অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে আর করা যাবেনা।’
হঠাৎই কেমন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তুহিন। তমাল দ্রুত ফোন বের করে একটু দূরে চলে গেল কথা বলতে। এরপর ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ফারিয়া, শেখকে ফরেনসিকের যেকোন আপডেট সাথেসাথে তোমাকে জানানোর কথা বলে এসেছো তো?’
‘ ইয়েস স্যার, দেওয়ার কথা। তবুও আমি মহিউদ্দিন স্যারকে একটা কল করে দেখছি।’
ফারিয়াও এবার কল করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। তুহিন এবার ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুদ্রর পর আপনার আর কাউকে সন্দেহ হয়নি?’
‘অন্যকোন দল ছাড়া নয়।’ সোজাভাবে বলল ইন্সপেক্টর। ‘কিন্তু যদি সত্যিই খুনগুলো একজন করে থাকে তাহলে আপনি ভুল পথে এগোচ্ছেন। সে রুদ্র না।’
তুহিন কোন জবাব দিলোনা। এই লোকের সেই এক ঘ্যানঘ্যান ওর ভালো লাগছেনা। এনার সাথে তর্ক করে সময় নষ্ট করতে চায়না ও। একটা চেয়ারে বসে দু হাতে মাথা চেপে বসে রইল চুপচাপ। তমাল এসে বলল, ‘স্যার ঐ লোকটাকে পাওয়া গেছে ফোনে। রংপুর গিয়েছিল সে। ভাগ্নির বিয়েতে। আজ রাতে ফিরবে সে। কাল সকালে অফিসে ডেকেছি।’
কোন উত্তর এলোনা তুহিনের কাছ থেকে। ফারিয়া এসে বলল, ‘মহিউদ্দিন স্যার বললেন এখনো তেমন কিছু পান নি, স্যার। পেলে সঙ্গেসঙ্গে জানাবেন।’
এবারেও জবাব দিলোনা তুহিন। একইভাবে মাথা চেপে ধরে চুপচাপ বসে আছে। এই কেসের কুল-কিনারা কোথায়? কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। এতো বড় একটা আন্ডারওয়ার্ল্ডের দল, একটা বাড়ি, এতোগুলো মানুষ। কোথায় এরা? কী হয়েছিল এদের সাথে? এদের উধাও হওয়ার সাথে বাকি সাতটা খুনের কোন সম্পর্ক আছে? নাকি সত্যিই ভুল পথে হাঁটছে সে। ওর বিদ্যা বলে যেকোন খুনে সবার আগে মোটিভ খুঁজে বের করা জরুরি তাহলে খুনির কাছে পৌঁছনো অনেক সহজ হয়ে যায়। দুটো দিন হয়ে যাচ্ছে অথচ খুনি তো দূরে থাক খুনের কারণ কী সেটাই বুঝতে পারছেনা ও। কেন হল পরপর এই সাতটা খুন? প্রতিশোধ? ক্ষমতা? টাকা? কী কারণ হতে পারে? শায়লা বলেছিল খুনি সাজ্জাদের কাছে শুধুমাত্র কারো ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিল। অর্থাৎ কারো কাছে পৌঁছাতে চাইছে খুনি? কার কাছে? আর কেন? মোবাইলের মেসেজের টোন শুনে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। ইরার মেসেজ। মেসেজটা ওপেন করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল,
খুব বেশি প্রেশার পড়ছে নিশ্চয়ই? ওতো ভেবো না। মাথা ঠান্ডা রাখো। তুমি পারবে । ইউ আর মাই সুপারহিরো। ইউ ক্যান ডু এনিথিং সুইটহার্ট। সবকিছু ভালো হবে।
হাসল তুহিন। সব চাপ, ক্লান্তি, বিরক্তি কেটে গেল নিমেষেই। ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে লিখল, ‘এবার সবকিছু ভালো হতে বাধ্য। ভালোবাসি ইরাবতী।’
ইরার নাম্বারে মেসেজটা পাঠিয়ে হাঁফ ছাড়া শ্বাস ফেলল তুহিন। এরপর আবার ভাবনার সমুদ্রে ডুব দিল। তমাল একটু ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, আজতো আর কিছু করার নেই। আমরা কী তবে আজ ফিরে যাচ্ছি?’
তুহিন উত্তর না দিয়ে একটু চুপ থেকে আরও কয়েক সেকেন্ড ভাবল। হঠাৎই কিছু একটা ভেবে ইন্সপেক্টর আজিজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমের ভিলায় যাব আমি।’
‘আমের ভিলা? কিন্তু আপনাকে তো আমি বলেছি আমের ভিলা এখন ফাঁকা। তালা দেওয়া আছে।’
‘আমার মনে আছে ইন্সপেক্টর। স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয় আমার। তালা ভাঙার ব্যবস্থার অভাব নেই ডিপার্টমেন্টে।’
‘কিন্তু বাড়ির মালিকের পার্মিশন ছাড়া কারো ফাঁকা বাড়িতে এভাবে_’
‘যদি রহস্যময় সাত-সাতটা খুন হয় আর সন্দেহভাজন সেই বাড়ির-ই একজন সদস্য হয়। তাহলে নিশ্চয়ই পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা বিভাগের কোন ইনভেস্টিগেটর গিয়ে ফাঁকা বাড়িটা সার্চ করতে পারে।’ শক্ত গলায় বলল তুহিন।
‘কিন্তু..’ আবার সেই অস্হিরতা আর চিন্তার ভাজ ইন্সপেক্টরের কপালে।
তুহিন সেটা লক্ষ্য করতে করতেই বলল, ‘আপনি রাজি না হলে আমায় এখন হেড অফিসে কল করে পার্মিশন নিতে হবে। ব্যপারটা একই হবে শুধু সময়টা আধঘন্টা পিছিয়ে যাবে। বিশেষ কোন লাভ আছে কী তাতে?’
দমে গেলেন ইন্সপেক্টর। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বললেন, ‘ঠিকাছে চলুন।’
তমালকে রুদ্রর ছবি আর স্কেচটাও সাথে নিতে বলে তুহিন ইন্সপেক্টর আজিজকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তমাল আর ফারিয়া ব্যাগ গোছাচ্ছে। ব্যাগে ল্যাপটপ রাখতে রাখতে ফারিয়া বলল, ‘তখন ওভাবে তাকিয়ে ছিলাম কারণ আমি ভাবতে পারিনি রুদ্র দেখতে এরকম হবে। তাই চমকে গিয়েছিলাম। আমি চরিত্রহীনা নই যে সুন্দর ছেলে দেখলেই গিলে খাবো।’
কথাটা বলে বেরিয়ে গেল ফারিয়া। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে গেল তমাল। এর আগেও ফারিয়াকে জ্বালাতন করেছে সে। কিন্তু এতো শান্ত উত্তর কোনদিন পায়নি। আজ একটু বেশিই বলে ফেলেছে হয়তো। হঠাৎ রেগে গিয়েছিল কেন জানি। ক্ষমা চেয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
*
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই সূর্য ডুব দিয়েছে পশ্চিম আকাশে। চারপাশটা ধীরে ধীরে ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে।আমের ভিলার সামনে তুহিনদের গাড়িটা এসে থামল। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকেই গাড়ি থেকে নামল চারজন। তুহিন স্হির দৃষ্টিতে দেখল বাড়িটাকে। কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বাড়ির সমস্ত রং যেন কেউ শুষে নিয়েছে। গেটের কাছে কোন পাহারা অবধি নেই। এই কী তবে সেই প্রভাবশালী রাশেদ আমেরের স্বপ্নের আমের ভিলা?
সময় নষ্ট না করে ভেতরের দিকে এগোতে নিলেই হঠাৎই সামনে এসে জোরে চিৎকার করে উঠলো এক মলিন কাপড় পরা মহিলা। ভয়ে চিৎকার করে তুহিনকে আকড়ে ধরল ফারিয়া। হঠাৎই এভাবে সামনে এসে পড়াতে সবাই ভয় পেয়ে উঠেছিল কিছুটা। এমনকি তুহিনও। তুহিন ভালো করে তাকিয়ে দেখল এক বৃদ্ধা মহিলা। কাঁচাপাকা জট পাকানো এলোমেলো খোলা চুল। সাদা শাড়িটা ময়লা হয়ে হলদে হয়ে গেছে। কালো ব্লাউজটাও ছেঁড়া দু জায়গায়। ফ্যাকাশে মুখটা কী ভয়ানক! মহিলাটি বিকৃত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘এ বাড়িতে ঢুকছিস তোরা? ঢুকিস না, ঢুকিস না। বিষ আছে, বিষ। বিষ ঢুকেছে এই বাড়িতে। লুকিয়ে আছে। হি হি হি। কেউ বাঁচবেনা, কেউ বাঁচবেনা। এই বিষে মরে যাবি, একদম মরে যাবি। সবাই মরে যাবি। যাস না, এই বিষের বাড়িতে যাস না।’
একই প্রলাপ বকতে বকতে চলে গেল মহিলাটা। তুহিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পাগল মহিলাটার যাওয়ার দিকে। ফারিয়া এখনো আকড়ে ধরে রেখেছে ওকে। তুহিন আস্তে করে বলল, ‘ভয় পেয়ো না ফারিয়া। পাগল ছিল।’
ফারিয়া ঝট করেই তুহিনকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণ করা এই বেহায়াপনার জন্যে নিজেই লজ্জিত হল মেয়েটা। এতো নির্লজ্জ কবে থেকে হল ও? মিনমিনে গলায় বলল, ‘সরি স্যার।’
তুহিন কিছু বলল না। ফারিয়ার কাজে ও নিজেও বিরক্ত হয়েছে কিছুটা। প্রথমে গেইটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে যেতে হল ওদের। বাগানের দিকে একবার চোখ বুলালো তুহিন। অর্ধেকর বেশি গাছই মরে গেছে, ফুলের চিহ্নমাত্র নেই। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। বাড়ির দরজার তালা ভেঙ্গে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকল ওরা চারজন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তারওপর প্রচন্ড অন্ধকার ভেতরে। মুখে পেন্সিল টর্চটা নিয়ে পেছন থেকে নিজের ‘বেরেটা এম নাইন’ পিস্তলটা বের করে হাতে নিল তুহিন। বাকিদেরও ইশারা করল যার যার পিস্তল নিয়ে সতর্ক থাকতে। সবাই ওর কথামতো বের করে নিল পিস্তল, মুখে ধরা পেন্সিল টর্চ। বাড়ি তালা মারা ছিল তারমানে এই নয় যে ওরা নিরাপদ। পেছনে আরেকটা দরজা আছে। আর বাইরে থেকে দেয়াল টপকেও ঢোকা যায়। কাজেই সাবধান থাকতে হবে। পিস্তলের ট্রিগারে হাত রেখে ডানে শরীর বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে প্রতিটা রুমে ঢুকছে ওরা। একেকজন একেকটা রুম সার্চ করছে। ইন্সপেক্টরকে বলা হয়েছে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কারণ ইন্সপেক্টরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেনা তুহিন। সেটা মুখে না বলে পাহারার কথা বলেই করিডরেই দাঁড় করিয়ে রেখেছে তাকে। একটা ঘরে ঢুকে তুহিন চারপাশটা ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝল এটা রাশেদ আমেরের ঘর। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে খুঁজেও বিশেষ কিছু পেলোনা। এদিকে ধুলোয় অবস্থা বেশ খারাপ ওর। কিছু একটা চিন্তা করে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গেল ও। রাশেদ আমেরের ব্যবহার করা একটা চিরুনী দেখতে পেল সেখানে। পেন্সিল টর্চটা ভালোভাবে ধরে খেয়াল করল দুই-তিনটে গুড়ো চুল রয়েছে সেখানে। কিছু না ভেবেই চিরুনিটা এভিডেন্স ব্যাগে ভরে ফেলল তুহিন। বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল তমাল, ফারিয়া ফিরে এসেছে। টর্চটা মুখ থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে বলল, ‘ কিছু পেয়েছো?’
তমাল বলল, ‘ না স্যার, তেমন অস্বাভাবিক কিছু পাইনি আমরা।’
‘ রুদ্রর ঘরটা পেয়েছো?’
‘ জ্বি স্যার। কিন্তু কিছু পাইনি। তবে সব জায়গা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে নিয়েছি, অন্যান্য ঘর থেকেও টুকিটাকি কিছু ভরে নিয়েছি ব্যাগে।’ বলল ফারিয়া।
‘ গুড। কিন্তু রুদ্রর ঘরে কিছু পেলেনা? হেয়ার ব্রাশ বা ওর ব্যবহার করা কিছু। কিছুই না?’
‘ না স্যার। প্রায় ফাঁকা ছিল ঘরটা। এমনকি পোশাকগুলো ভালোভাবে দেখেছি।’
কিছু বলল না তুহিন। তারমানে ঘরটা হঠাৎই ফাঁকা হয়নি নাকি? কী হচ্ছে কী? সব মিলেও মিলতে চাইছেনা। মাথা ঝাঁকিয়ে উল্টাপাল্টা ভাবনা আপাতত বাদ দিল তুহিন। এটার জন্যে রাত আছে। এখন কাজের কাজ করতে হবে। আশেপাশে একবার তাকিয়ে পূর্ব দিকটা চোখে পড়তেই বলল, ‘ওদিকে কোন ঘর আছে মনে হচ্ছে?’
‘ হ্যাঁ আছে।’ এতক্ষণে কথা বলল আজিজ। এতক্ষণ শুধু দেখছিল এদের কাজ।
তুহিন অপেক্ষা না করে আবার পিস্তলটা ঠিকভাবে ধরে এগিয়ে গেল সেদিকে। পূর্ব দিকে গিয়েই বড় একটা ঘর পেল তুহিন। একই কৌশলে ঢুকে গেল ভেতরে। পেছনে পেছনে বাকিরাও এলো। মুখে ধরে রাখা পেন্সিল টর্চটা সামনে পড়তেই থমকে গেল কিছু মুহূর্তের জন্যে। একটা বেটে, কালো, টাকমাথা ওয়ালা লোক খুঁজছে কিছু। তুহিনকে দেখে লোকটাও থমকেছে। তার হাতে ধরা টর্চটা পড়ে গেল অসাবধানতাবশত। কিছু না ভেবেই গুলি চালাতে যাচ্ছিল লোকটা। কিন্তু তুহিন বুঝে ফেলল ওর মতিগতি। সাথেসাথেই ওর বেরেটা এম নাইন থেকে একটা গুলি বেরিয়ে সোজা গিয়ে লাগল লোকটার পিস্তলধরা হাতে। পড়ে গেল পিস্তল। সাথে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ ধ্বনি। ব্যাথায় গাল কুঁচকে গেছে লোকটার। অনেকটা মানকি স্টাইলে লাফিয়ে গিয়ে পিস্তলটা হাতিয়ে নিল তুহিন। লোকটার বের হওয়ার আর উপায় নেই। কারণ দরজা একটাই। আর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে বাকি তিনজন। হঠাৎই ঢলে ফ্লোরে পড়ে গেল লোকটা। অবাক হল তুহিন। কী হল? হাতে গুলি লাগায় তো জ্ঞান হারাবার কথা নয়। ভান করছে না তো ব্যাটা? পুরো ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটল যে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বাকি তিনজন। কিন্তু এতক্ষণে সামলে নিয়েছে। ইন্সপেক্টর বলল, ‘আমি দেখব?’
তুহিন বলল, ‘ না, আমি যাচ্ছি।’
আস্তে আস্তে পিস্তলটা লোকটার দিকে তাক করেই এগিয়ে গেল তুহিন। আস্তে করে হাঁটু ভেঙ্গে বসল তার পাশে। চেক করার পর পাঁচসেকেন্ড মূর্তির মতো বসে রইল তুহিন। মারা গেছে লোকটা। কিন্তু হাতে গুলি লেগে তো মরবেনা। তাহলে? এক সেকেন্ডেই কীভা_ পটাশিয়াম সায়ানাইড! শীট! তমাল বলল, ‘কী হয়েছে স্যার?’
‘ মুখের মধ্যে সম্ভবত পটাশিয়াম সায়ানাইড ভর্তি বল রাখা ছিল। ধরা পড়লেই সেটা ফাটিয়ে ফেলার হুকুম ছিল হয়তো। ধরা পড়লে ভেতরের খবর বেরিয়ে আসতো।’
ব্যপারটা বুঝতে সময় লাগল না কারোরই। ইন্সপেক্টর আজিজ বলল, ‘ আমি থানায়_’
সে কথা শেষ করার আগেই তুহিন বলল, ‘ না, বডিটা গোয়েন্দা বিভাগের ফরেন্সিকে যাবে। তমাল, অফিসে ফোন লাগাও।’
তমাল তাই করল। আজিজ আর কিছু বলল না। অফিসে কল করে আবার কাজে লেগে পড়ল ওরা। লাশটা পড়ে রইল ওখানেই। একে নিয়ে আপাতত ভাবা বাদ দিয়েছে তুহিন। কেন এসেছিল? কী উদ্দেশ্য ছিল সেসব এখন ভেবে কোন লাভ নেই। পরে ভাবা যাবে। ঘরের প্রতিটা বই, ফাইল, কাগজ চেক করল তুহিন। কিন্তু এমন কিছুই পেলোনা যেটা এই কেসের জন্যে প্রয়োজন হতে পারে। এবার লম্বা টেবিলটার ওপরে চোখ পড়ল তুহিনের। পুরো টেবিলটাই ফাঁকা কিন্তু বড় চেয়ারটার সামনের দিকে দুটো বইয়ের মতো কিছু একটা রাখা। তুহিন সেখানে গেল। টর্চটা ভালোভাবে ধরে রেখে দেখল, ওপরে রাখা ছিল একটা ডায়েরি। ভেতরে তেমন কিছুই নেই কয়েকটা নাম্বার আর হিসেব ছাড়া। আরেকটা যা পেল তাতে আবার অবাক হল তুহিন। একটা ফটো অ্যালবাম। প্রথম কভারটা উল্টে ফেলতেই তুহিন দেখল একজন মধ্যবয়স্ক লোকের ছবি। চাপ দাড়ি, উল্টে ব্রাশ করে রাখা ঘন কালো চুল, কী অসাধারণ জৌলুস চেহারায়। কী আশ্চর্য তেজ! আপনাআপনি ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘রাশেদ বাবা?’
কেন জানি আমের না বেরিয়ে বাবাটাই বের হল তুহিনের মুখ দিয়ে। এগিয়ে এলেন ইন্সপেক্টর আজিজ। ছবিটা একবার দেখে বললেন, ‘ হ্যাঁ ইনিই রাশেদ আমের।’
‘ এই লোকটা রুদ্রর বাবা? চেহারাতো তাই বলে কিন্তু বয়স_’ অবাক কন্ঠে বলল তমাল।
হেসে ফেলল আজিজ। বলল, ‘ ওনার বয়স এমনিতে প্রায় পঞ্চান্ন। কিন্তু দেখে মনে হয় না। পয়তাল্লিশেই যেন আটকে গেছিল লোকটা।’
তুহিন কিছু না বলে অ্যালবামের পাতা উল্টালো। আজিজ পরিচয় বলছে সবার। একজন অল্প বয়সী রমনীর ছবি। বেশ সুন্দরী। আজিজ না বললেও তুহিন বুঝল এটা রাশেদের স্ত্রী ছিলেন। রুদ্রর এতো সুন্দর হওয়ার রহস্য ভেদ হল এবার। আরেকবার উল্টে রুদ্রর ছবি দেখতে পেল সে। বারো-তেরো বছর বয়সের ছবি। দেখেই বুঝেছে এটা রুদ্র। হাসছে ছেলেটা। কেন জানিনা তুহিনও হাসল ছবিটা দেখে। পরেরটাও রুদ্রর ছবি তবে যুবক বয়সের। কুহুর ছবিটা সামনে আসতেই ফারিয়া বলে উঠল, ‘বাহ! খুব মিষ্টি তো।’
‘ হ্যাঁ, ভীষণ মিষ্টি।’ বলে আবার পাতা উল্টালো তুহিন। জ্যোতির ছবিটা দেখে তিনজনই অবাক হল। এমন সুন্দরী একটা মেয়ে সারাক্ষণ প্রেম নিবেদন করে বেড়াতো, সবটা উজাড় করে দিতে চাইতো অথচ রুদ্র পাত্তা দিতো না? অদ্ভুত! উচ্ছ্বাসের ছবিটা আসতেই কয়েক সেকেন্ড মৌন রইল ওরা সবাই। এরপর জাফর আমেরের ছবিও পেল। এরমধ্যেই ইন্সপেক্টরের কল চলে এলো। সে তুহিনকে বলে করিডরে চলে গেল কথা বলতে। আরেকবার অ্যালবামের পাতা উল্টে শেষ ছবিটা দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তুহিনের। ছবিটা নষ্ট হয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে না কার। তবে এটা যে একটা মেয়ের ছবি সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু উপরিভাগ নষ্ট হয়ে গেছে বলে মুখ চেনা যাচ্ছেনা। সব ছবি ভালো ছিল শুধু এটাই নষ্ট হয়ে গেল? আশ্চর্য! ছবিটা বের করে নষ্ট অংশটা নাকের কাছে নিয়ে শুকলো তুহিন। কেমন চা চা গন্ধ মনে হচ্ছে। দাগটাও চায়ের দাগের মতো। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছেনা কিছুতেই। তমাল আর ফারিয়াকে দেখাল ওরাও কিছু বলতে পারল না। ঠোঁট চেপে ওখানকার ধুলো মাখা একটা চেয়ারেই বসে পড়ল তুহিন। ওই অ্যালবামে রাশেদ ওর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর একটা করে ছবি রাখত সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু এই ছবিটা কার? এটা কী জ্যোতি না-কি কুহু? ওরা ছাড়া আর কে ছিল রাশেদ আমেরের প্রিয় পাত্রি? কে এই মেয়ে?
#চলবে…