অন্তর্হিত কালকূট .
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
১৫.
তুহিন এমন গভীর চিন্তিত অবস্থায় ময়লা চেয়ারে বসে থাকতে দেখে ফারিয়া খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার আমি চেয়ারটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। আপনি কষ্ট করে একটু উঠলে..’
আর কিছু বলতে পারল না ফারিয়া। কারণ ততক্ষণে তুহিন নিজের ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলেছে। যা কোন শব্দ ছাড়াই ফারিয়ার গালে একপ্রকার চড় মেরে বলছে, আমায় নিয়ে এতো ভাবতে এসোনা। ব্যাপারটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি ফারিয়ার। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মুখ কালো কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা। তমাল খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল ব্যপারটা। কেন জানিনা প্রতিবারের মতো এবার ব্যাপারটায় মজা পেলোনা ও। বরং খানিকটা খারাপ-ই লাগল। তুহিন ভ্রু কুঁচকে রেখে-ই ধুলো পড়া টেবিলে তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে অযথা আঁকিবুকি করতে করতে গভীর ভাবনায় মগ্ন। এই ফাঁকে তমাল গিয়ে দাঁড়াল ফারিয়ার পাশে। দুইহাত সামনে একত্রিত করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এরপর একদম ধীর কন্ঠে বলল, ‘ সরি।’
ফারিয়া থমকালো। কিন্তু তাকাল না তমালের দিকে। কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে স্বাভাবিক করে সামনের দিকে যান্ত্রিক দৃষ্টি রেখে বলল, ‘কেন?’
‘ থানায় রুদ্রর ছবির ব্যপারটা নিয়ে ওভাবে বলার জন্যে।’
ফারিয়া কোন জবাব দিল না। দিতে ইচ্ছে হলোনা তার। তুহিনে কথা ভাবছে ও। ছেলেটাকে ভীষণ পছন্দ করে ফারিয়া। প্রেমে পড়ে গেছে এই সুদর্শন, দুর্ধর্ষ, আদর্শবান ইনভেস্টিগেটরের। কিন্তু তুহিন ওর দিকে সেই দৃষ্টিতে কোনদিন তাকায়ও না। কেনো?
তুহিন টেবিলের দিকে তাকিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই বলল, ‘তমাল?’
তুহিনের হঠাৎ ডাকে তমাল চমকে উঠল। ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘জ্ব- জ্বি স্যার?’
‘ ইন্সপেক্টর বারবার বলছেন যে খুনগুলো একজন ব্যক্তি করে থাকলে রুদ্র খুনি নয়। কারণ তার ধারণা গুলশানের দ্বিতীয় খুন আর মীরপুরের খুনটা কোনভাবেই রুদ্র করতে পারেনা। তোমার কী মনে হয়?’
তমাল একটু ভাবল। তুহিনের সামনে যুক্তিহীন কোন কথা বললেই বিশাল ধমক খেতে হবে সেটা নিশ্চিত। তাই একটু ভেবে চিন্তে সাজিয়ে নিল নিজের কথাগুলো। তারপর বলল, ‘আমার এবারেও মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে স্যার। ইন্সপেক্টরের কথাটা কিন্তু পুরোপুরি ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কারণ গুলশানে দ্বিতীয় খুনটা তো_’
কথাটা শেষ করার আগে আজিজ চলে এলো। থেমে গেল তমাল। আজিজ ফোনে কথা বলে ভেতরে এসে দেখে তুহিন বেশ গম্ভীরভাবে বসে আছে ধুলোমাখা চেয়ারটাতে। ওর দৃষ্টি অ্যালবামে স্হির। তমাল আর ফারিয়াও দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। আজিজ ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘কোন সমস্যা হয়েছে, স্যার?’
তুহিন কয়েক সেকেন্ড কোন জবাব দিলোনা। তাকালোও না আজিজের দিকে। না তাকিয়েই ছবিটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘মেয়েটা কে?’
তুহিনের ইশারা করা ছবিটার দিকে তাকালো আজিজ। নষ্ট হয়ে যাওয়া ছবি দেখে বলল, ‘চেহারা তো চেনা যাচ্ছেনা। তবে আমার মনে হচ্ছে আমি চিনতে পেরেছি।’
তুহিন এবার তাকাল আজিজের দিকে। স্হির চোখজোড়া চঞ্চল হয়ে উঠল মুহূর্তের মধ্যেই। তমাল আর ফারিয়াও উৎসাহি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ রইল অন্ধকার ঘরটা। নিরবতা কাটিয়ে তুহিন বলল, ‘কে এই অন্তর্হিত রমনী?’
*______
অতীত_
কেটে গেছে দুটো মাস। মাঘ মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে। আমের ভিলার সকল সদস্য একসঙ্গে খেতে বসেছে। দুপুরের খাবার। টেবিলের মাথার চেয়ারে রাশেদ আমের, তার দুপাশের দুই চেয়ারে রুদ্র আর জাফর, রুদ্রর পাশের চেয়ারে উচ্ছ্বাস বসেছে। জ্যোতি খাবার দিচ্ছে সকলকে। কুহু নেই এখানে। ও এখন ইউনিভার্সিটিতে আছে। সবাইকে খাবার বেরে দিয়ে জ্যোতি নিজেও বসে পড়ল খেতে। অদ্ভুতরকমের নিরবতা চলছে খাবার ঘরটায়। কারো মুখে কোন শব্দ আসছেনা। প্রত্যেকের মুখ চিন্তিত, গম্ভীর। আঁধার নেমে আছে সকলের চেহারায়। একমাত্র রাশেদ আমেরের চেহারা একদম স্বাভাবিক। সে সম্পূর্ণ নির্বিকার। কিন্তু উপস্থিত সকলে খুব ভালোভাবে জানে যে রাশেদ নিজেও ভেতর ভেতর ভীষণ অস্হির হয়ে আছে। শান্তি পাচ্ছেনা সেও। মনের ভাব খুব দক্ষভাবে মনেই লুকিয়ে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই জ্যোতির্বাণ লোকটার মধ্যে। খাওয়ার মাঝেই জাফর বলল, ‘তুই সত্যি একাই যেতে চাইছিস রুদ্র? ওটা কিন্তু গুলশান নয়। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বিপদ থাকবে। তুই একা কীকরে_’
জাফরকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রুদ্র বলল, ‘যে কাজে আমি যাচ্ছি সেখানে আমাকে একাই যেতে হবে কাকা। দল বেঁধে গেলে কিছুই হবেনা। কাজটা সফলভাবে করতে চাইলে রিস্ক নিতেই হবে।’
‘ বুঝেছি আমি। তবে সাবধান!’ পুনরায় খাওয়াতে মন দিল জাফর।
‘ আমি যতদিন ওদিকে আছি ততদিন এদিকে কোন চাপ নেই। এই সুযোগে তুমি সিঙ্গাপুর গিয়ে কাকির কাছে ক’দিন থেকে আসতে পারো।’
বলে হাসল রুদ্র। জাফরও হাসল। উচ্ছ্বাস আর জ্যোতি নিরব। এতক্ষণ পর রাশেদ আমের নিজের সেই দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল, ‘ও ভুল কিছু বলেনি জাফর। অনেকদিন হল যাসনা। এবার গিয়ে ক’দিন থেকে আয়।’
‘ আচ্ছা ভাইজান।’ খানিকটা লজ্জিত কন্ঠে বলল জাফর।
উচ্ছাস বলল, ‘আর আমিতো আছিই। রাশেদ বাবার সাথেই থাকব একয়েকটা দিন। সমস্যা হবেনা।’
মাথা দোলাল জাফর। খাওয়া-দাওয়া শেষে রাশেদ উঠে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে চলে যেতে নিয়েও থেমে গেল। ঘুরে রুদ্রর দিকে তাকাতেই রুদ্র উঠে দাঁড়াল। ওরও খাওয়া হয়ে গেছে। রাশেদ একটু এগিয়ে এসে আলতো করে রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘নিজের খেয়াল রেখো। অতিরিক্ত সাহসিকতা দেখানোর প্রয়োজন নেই। ওরা সবসময়ই অপেক্ষা করেছে তোমাকে একা, ক্ষমতাহীনভাবে পাওয়ার জন্যে। এবার সেই সুযোগটা তুমি নিজেই দিচ্ছো ওদের। সাবধানে থাকবে।’
‘ থাকবো বাবা।’ স্হির কন্ঠে বলল রুদ্র।
‘ আর হ্যাঁ, ওখানে ছুটি কাটাতে যাচ্ছোনা। মাথার ওপর সবসময়ই খাড়া ঝুলে আছে। তাই যতটা পারো একা ঘুমানোর চেষ্টা করাই ভালো। এটাও একপ্রকার সাবধানতা।’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে মাথা নিচু করে ফেলল রুদ্র। কান লালচে হয়ে গেল খানিকটা। সেই খবরটাও আছে বাবার কাছে! কীভাবে জেনে ফেলে লোকটা সব? রাশেদের দিকে চোখ তোলার আর সাহসই হলো না ওর। জাফর গলা ঝেড়ে পা বাড়ালো নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে। উচ্ছ্বাস রুদ্রর লাল হওয়া মুখটা দেখে মুখ টিপে হাসছে। ব্যাপারটা উপভোগ্য। জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে রুদ্রর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে গেল নিজের কাজে। আর কোন কথা না বাড়িয়ে হনহনে পায়ে রাশেদ আমের চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। হাঁফ ছাড়ল রুদ্র। উচ্ছ্বাসের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ঠোঁট কামড়ে হাসছে ও। রুদ্র ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল, ‘কী সমস্যা? বলদের মতো একা একা হাসছিস কেন?’
উচ্ছ্বাস মুখে হাসি ধরে রেখেই টিটকারি মেরে বলল, ‘ওখানে গিয়ে একাই ঘুমিয়ো খোকা। ঘুমাবে তো?’
রুদ্র কুনুই দিয়ে জোরে একটা গুতো মারল উচ্ছ্বাসের পেটে। উচ্ছ্বাস ‘আউচ’ শব্দ করে পিছিয়ে গেল দুটো পা। কিন্তু হাসি থামলোনা, উল্টে বেরে গেল। উচ্ছ্বাসের ওমন প্রাণখোলা হাসি দেখে রুদ্রও হেসে ফেলল। করিডরের জয়েন্ট বারান্দায় গিয়ে দুজনেই দুটো সিগারেট ধরালো। রেলিং হেলান দিয়ে মন ভরে ধোঁয়া ছাড়ল রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। হঠাৎ উচ্ছ্বাসের হাসিমাখা মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। ঠোঁট থেকে সিগারেটটা নামিয়ে বেশ চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘তুই সত্যিই চট্টগ্রাম একাই যাবি? আমি সাথে গেলে কী সমস্যা? দেখ রুদ্র, আমি কিন্তু বিপদকে ভয় পাইনা। হলে একসাথেই হবে তাতে_’
কথাটা শেষ করার আগেই রুদ্র বলে উঠল, ‘তোকে কে বলল তোকে আমি তোর বিপদের কথা ভেবে আমার সাথে নিচ্ছিনা? আমি অতোটা মহান নই। আমি যা করতে চাইছি তাতে সঙ্গে কেউ গেলে আমার অসুবিধা হবে। তাছাড়াও যেকোন প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্যেও এখানে লোক থাকা চাই। তাই তোকে নিচ্ছিনা। তোর সেইফটির জন্যে নয়। আমি নিজের ছাড়া কারো কথা ভাবিনা। প্রয়োজনে তোকে খুন করতেও আমার হাত কাঁপবেনা।’
উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে আয়েশি ভঙ্গিতে টান দিল সিগারেটে। এরপর তৃপ্তি নিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ভাবল, ছেলেটা কত অনায়াসে মিথ্যে বলতে পারে।
জ্যোতি খুব যত্ন নিয়ে রুদ্রর লাগেজটা গুছিয়ে দিচ্ছে আর কিছুক্ষণ বাদে বাদে আড়চোখে দেখছে রুদ্রকে। রুদ্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছে। তৈরী হয়ে নিয়েছে বের হবার জন্যে। কালো টিশার্ট আর ব্লু জিন্স পড়েছে। জ্যোতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে রুদ্রকে। ইচ্ছে না থাকা সত্যেও চোখদুটো বারবার রুদ্রর ওপর গিয়েই পড়ছে। অদ্ভুত বিষয়! সাধারণত ছেলেরা মেয়েদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তাদের প্রতিটা চলন একদৃষ্টিতে লক্ষ্য করে, অনেকে তো নারী দেহের প্রতিটা ভাঁজে তাদের নিখুঁত দৃষ্টি বুলায়। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে একপ্রকার উল্টোটাই হয়। ও নিজেই সারাক্ষণ মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে রুদ্রকে, প্রতিটা চলন খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে। ও কী তাহলে সত্যিই বেহায়া হয়ে গেছে রুদ্র নামক এই নিষ্ঠুর পুরুষের প্রেমে? আপন মনেই হাসল জ্যোতি। কফি কালারের লেদার জ্যাকেটটা নিয়ে এগিয়ে গেল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর পেছন গিয়ে দাঁড়িয়ে আয়না দিয়ে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্রও আয়না দিয়েই জ্যোতির প্রতিবম্বের দিকে তাকিয়ে দু হাত উঁচু করে ধরল। জ্যোতি জ্যাকেটটা পরিয়ে দিতে দিতে প্রায় আধঘন্টার নিরবতা ভেঙ্গে বলল, ‘একা একা ওখানে যাওয়াটা কী খুব প্রয়োজন?’
‘প্রয়োজন ছাড়া কিছু করিনা আমি।’ জ্যাকেটের গলার অংশটা ঠিক করে বলল রুদ্র। এরপর জ্যোতিকে পাশ কাটিয়ে বিছানার কাছে গিয়ে লাগেজের মধ্যে একটা রিভলবার রাখল। এম.টি 608 পিস্তলটা হাতে নিয়ে খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখল ঠিক আছে। ম্যাগাজিনটা চেক করে প্যান্টে লাগানো হ্যান্ডগান হোলস্টারে পিস্তলটা রেখে দিল। জ্যাকেটের তলায় পরে আড়াল হয়ে গেল সেই পিস্তল। জ্যোতি এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল রুদ্রর কাজগুলো। এবার এগিয়ে গিয়ে রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে গেলে কী হয়?’
রুদ্র কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল জ্যোতির চোখের দিকে। এক ঝটকায় হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে ফেলল। শাড়ির আঁচলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা উন্মুক্ত কোমরে পিস্তলটা চেপে ধরে বলল, ‘আমার ভালোবাসার স্পর্শগুলো এইরকমই হয়। গুলিটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে যাবে। লাগবে?’
জ্যোতি হাসল। নির্ভীক সে হাসি। হাত দিয়ে রুদ্রর চুলগুলো আরেকটু ভালোভাবে ঠিক করতে করতে বলল, ‘আগের উত্তরটাই দেব?’
রুদ্র দুচোখ ভর্তি বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল জ্যোতির হাস্যজ্জ্বল সুন্দর মুখটার দিকে। সেটা দেখে জ্যোতি ক্লিষ্ঠ হাসি হেসে বলল, ‘একটা সত্যি কথা বলবে?’
‘কথা দিতে পারছিনা।’ পিস্তলটা আবার হোলস্টারে রাখতে রাখতে বলল রুদ্র। জ্যোতি এখনো ওর গলা ছাড়েনি।
জ্যোতি বলল, ‘আমাকে এভাবে দূর দূর করার কারণটা কী শুধুই ভালোবাসো না বলে? নাকি আমি একজন পতিতার মেয়ে বলে?’
নিজের দুহাত দিয়ে জ্যোতির হাতদুটো নিজের গলা থেকে সরিয়ে ফেলল রুদ্র। এরপর লাগেজের জিপ লাগাতে লাগাতে বলল, ‘তোর মা কী করতো সেটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। থাকার প্রয়োজনও নেই। আর আমি যে শুদ্ধ পুরুষ নই সেটা তুইও জানিস। তাই সেকারণে তোকে দূরে রাখাটা হাস্যকর হবেনা?’
‘ সমাজের চোখে পুরুষ কখনও অশুদ্ধ হয়না।’
রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘কেন? পুরুষরা সর্বাঙ্গে ডেটল মেখে ঘোরে নাকি? আমিতো মাখিনা।’
জ্যোতি হেসে ফেলল। গম্ভীর ভাবেও যে রসিকতা করা যায় সেটা রুদ্রকে দেখেই বুঝেছে ও।
*
মাঝারি শব্দে হিন্দি গান ‘পানি পানি’ বেজে চলেছে। লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি আলোর খেলা চলছে চারপাশে। তারসাথে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে নেচে চলেছে তিনজন তরুণী। নাচছে কম তাদের শারীরিক ভঙ্গিমায় উপস্থিত পুরুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টাটাই বেশি করছে। তিনজনই যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে কত বেশি পুরুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। মাঝেমাঝে স্টেজ থেকে নেমে এসে ঢলে পড়ছে একেকজন মাতাল পুরুষদের গায়ে। তারাও যথেষ্ট সাড়া দিচ্ছে। পাঁচ মিনিট হলো হোটেল এর ড্রিংক বারটায় এসে বসেছে রুদ্র। এইটুকু সময়ে এতোটা দৃশ্যই চোখে পড়ল ওর। পছন্দসই হুইস্কি ওর্ডার করে দু হাত একত্রিত করে দেখছে চারপাশে। চট্টগ্রামে পৌঁছে হোটেলে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেছে। পাঁচ তলার আলিশান এক ঘর বুক করে নিয়েছিল নিজের নামে। সেখানে গিয়ে এটাচ বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চেঞ্জ করে বের হওয়ার সময় পিস্তলটা আর সঙ্গে নিলোনা রুদ্র। তার কারণ আছে। রিস্কি হলেও এখন এই পথেই এগোতে হবে ওকে। ডিনার করার সময় রুদ্র খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে যে একজন-দুজন নয়, মোট তিনজন ফলো করছে ওকে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রুদ্র হাসল। সেটা নিয়ে মাথাই ঘামালোনা আর। ডিনার সেড়ে নিয়ে আর রুমে যায়নি ও চলে এসছে হোটেলের বারটাতে। ড্রিংক করে নিজের ঘরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে ও। আজ ফুল রেস্ট। এসব ভাবতে ভাবতেই হুইস্কি চলে এসছে। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আশেপাশে বসা বেশ কয়েকটা মেয়ের চোখে চোখ পড়ল রুদ্রর। তারা উৎসাহি। কিন্তু রুদ্র তাদের কোন উৎসাহ দেখালো না। রুদ্র জানে যাকে ওর দরকার সে নিজেই আসবে এই টেবিলে। ডান্সার তিনজনই একবার করে ঘুরে গেছে রুদ্রর টেবিল থেকে। বিশেষ কোন পাত্তা পায়নি। হঠাৎ একটা মেয়ের দিকে চোখ পড়তেই রুদ্রর দৃষ্টি স্হির হল। মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। রুদ্রকে তাকাতে দেখে ঠোঁট কামড়ে ধরল নিজের। রুদ্র চোখ নামিয়ে হেসে ফেলল। তারপর আবার তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে এলো রুদ্রর কাছে। রুদ্রর অনুমতির অপেক্ষা না করেই ওর পাশের চেয়ার টেনে বসল। গালে হাত রেখে তাকাল রুদ্রর দিকে। রুদ্র একবার ভালো করে পরখ করল মেয়েটাকে। একটা লম্বা স্কার্ট আর পাতলা টিশার্ট গায়ে। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, মুখে হালকা প্রসাধনী। নিজেকে তথাকথিত আধুনিক সাজে সাজিয়ে রাখলেও স্বাভাবিক আধুনিকতা যে এর মধ্যে নেই বুঝে ফেলল সাথেসাথেই। মেয়েটা বলল, ‘সঙ্গিনী খুঁজছো বুঝি?’
‘কীকরে বুঝলে?’ গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে জানতে চাইল রুদ্র।
‘ বুঝলাম। কিন্তু মনমতো কাউকে পাচ্ছোনা, তাইনা?’
‘পেতে হলো কই? মনমতো জিনিস তো নিজেই হেঁটে চলে এলো।’
‘ ফ্লার্ট করছো?’
‘ আমি ফ্লার্ট করিনা, বেবি। অন্যকিছু করি।’ বাঁ চোখ টিপে বলল রুদ্র।
‘ যাহ্ ফাজিল!’
কৃত্রিম লজ্জা দেখাল মেয়েটি। হাসল রুদ্র। বলল, ‘তোমার নাম?’
‘আমাদের লাইনে কারো নাম থাকেনা সোনা। তবে তুমি আজ রাতের জন্যে আমাকে টুম্পা বলে ডাকতেই পারো।’
রুদ্র ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তোমাদের লাইনে কী টুম্পা, চুমকি এসব ছাড়া আর কোন নাম হয়না?’
মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। রুদ্রর গালে নিজের আঙুল ছুঁইয়ে বলল, ‘নাম দিয়ে কী হবে? তোমার নিশ্চয়ই নাম চাইনা আমার কাছে?’ এরপর ধীর কন্ঠে বলল, ‘সাথে আসবে না-কি সাথে নিয়ে যাবে?’
‘এতো তাড়া কীসের?’ টুম্পার সেই ধীর কন্ঠকে অনুকরণ করে বলল রুদ্র।
টুম্পা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘তোমাকে কী বিশ্বাস? এখন আমাকে পছন্দ হয়েছে একটু পর যদি আরও সুন্দরী কাউকে পেয়ে যাও তাহলে? সবগুলো তো হা করে আছে তোমার কাছে আসার জন্যে। থাকারই কথা। এমন সুন্দর পুরুষ আগে দেখেনি। আমি নিজেই দেখিনি।’
রুদ্র টুম্পার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলল, ‘যদি বলি যাবোনা?’
‘সত্যি বলছো?’
‘না।’
‘বদ লোক।’
আবার হাসল রুদ্র। টুম্পা এবার আরেকটু এগিয়ে এলো রুদ্রর দিকে। আলতো করে গালে হাত রেখে বলল, ‘ বিশ্বাস করো, তোমার মতো সুন্দর পুরুষ আমি এর আগে সত্যিই দেখিনি।’
বলে গভীরভাবে রুদ্রর অধরোষ্ঠে চুম্বন করল। কিন্তু রুদ্র তাতে সাড়া দিলোনা। চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো কেবল।
রাত তিনটে বেজে ছত্রিশ। হালকা ভর দিয়ে উঠে বসল রুদ্র। বিছানায় হেলান দিল নির্বিকার ছন্দে। হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে সেটা থেকে একটা সিগারেট বের করল। লাইটার দিয়ে সিগারেট টা জ্বালিয়ে পাশে ঘুমিয়ে থাকা টুম্পার দিকে তাকাল একবার। উন্মুক্ত শরীর সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা মেয়েটার। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল রুদ্র। চোখ সরিয়ে নিল মেয়েটার থেকে। সবটাই প্রয়োজন আর কামনা। ভালোবেসে কোনদিন কাউকে ছোঁয়নি রুদ্র। আর শুরু থেকেই ওর দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতেও ছোঁবেনা। কারণ ওর জীবনে প্রেম আসবেনা। ও আসতে দেবেনা। টি-টেবিলে রাখা ড্রিংকের গ্লাসটার দিকে চোখ পড়ল ওর। ঘুমোনোর আগে রুদ্রর জন্যে বানিয়ে রেখেছে টুম্পা। ঘড়িতে সময়টা একবার দেখল রুদ্র। এরপর হেসে হাতে নিল গ্লাসটা। কয়েকঢোকেই শেষ করে ফেলল। এবার ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল থেকে শুরু হবে আসল কাজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল রুদ্র। সে জানেও না তার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু আসতে চলেছে। হয়তো সেটা কালকেই।
#চলবে…
[ কাল দেব বলেও দিতে না পারার জন্যে দুঃখিত। উপন্যাসটা যারা যারা পড়বেন সকলেই রেসপন্স করবেন। বড় পর্ব দিয়েছি সুতরাং মন্তব্যগুলো গঠনমূলক না হলে কিন্তু রাগ করব। ]