অন্তর্হিত কালকূট .
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২.
ইরার সিক্সথ সেন্স মিথ্যা বলছিল না। সত্যিই আজ সকাল সকালই অফিস থেকে ফোন চলে এসেছে তুহিনের। ফোনটা করেছে ওর সহকারী। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু। গতপরশু-ই এতো ভয়ানক একটা স্মাগলিং কেসের সমাধান করে আজই আবার এতো সিরিয়াস একটা কেসের জন্যে ডাক পড়ে যাবে ভাবেনি সে। ইরা ভেবেছিল। হয়তো দীর্ঘ তিন বছরের সম্পর্কের অভিজ্ঞতা এটা। পোশাক পড়তে পড়তে কথাটা ভেবে হাসলো তুহিন। একদম রেডি হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দ্রুত গতিতে টাইপিং করল সে।
‘ অফিস থেকে ফোন চলে এসেছে। তোমার সিক্সথ সেন্স ভীষণ স্ট্রং। তবে পরের ছুটিতে আমরা নিশ্চিত বাইরে যাচ্ছি। এবার দূরে কোথাও যাবো, পাক্কা। লাভ ইউ।’
কথাটা টাইপ করে ইরার নাম্বারে পাঠিয়ে দিয়ে হাসল তুহিন। ও জানে আজ আর রিপ্লে আসবেনা। হয়তো দু’দিনের জন্যে ওর নাম্বার ব্লক লিস্টেও থাকতে পারে। এসব নতুন কিছুই না। সবকিছু ঠিকঠাক চেক করে দরজা ভালোভাবে লক করে বেরিয়ে পড়ল নিজের গন্তব্যে।
গোয়েন্দা বিভাগের অফিসের এক করিডরে কফির মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সহকারী ইনভেস্টিগেটর তমাল আহমেদ। সে আজ খুব উত্তেজনার মধ্যে আছে। ডিজি স্যারকে বেশ চিন্তিত মনে হল দেখে। আর ডিজি স্যার কপালে চিন্তার রেখা ফেলে চিফ ইনভেস্টিগেটর তুহিনকে ডাকা মানেই আবার একটা রোমাঞ্চকর কোন তদন্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে ও। ভাবতেই উত্তেজনায় বসে থাকা দ্বায় হচ্ছে।
তুহিন অফিসে ঢুকতেই করিডরে তমালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে কেনো ছেলেটা? ও এগিয়ে যেতে যেতে তমালও ওকে দেখে ফেলল। দেখেই দ্রুতপদে ওর সামনে এসে বলল, ‘স্যার চলে এসেছেন?’
তুহিন হাঁটা না থামিয়ে এগোতে এগোতে বলল, ‘ফোন করার পর থেকে এখানেই দাঁড়িয়ে আছো নাকি?’
তমাল তুহিনের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ঝোঁকের মধ্যে বলে ফেলল, ‘হ্যাঁ স্যার।’
তুহিন একবার তাকাতেই তমাল থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, ‘না মানে, না স্যার।’
তুহিন উত্তরে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘স্যার বলেছেন কী ব্যাপারে ডেকেছেন?’
তমাল মুখ ছোট করে বলল, ‘না স্যার। আপনাকেই বলবেন।’
‘তুমি একটু আমার রুমে যাও। ওখানে থার্ড ড্রয়ারে একটা পেনড্রাইভ আছে। ওটা ইনসার্ট করো, আমি আসছি।’
তমাল দাঁড়িয়ে গেল। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। তমাল চলে যেতেই তুহিন মুচকি হাসল। নতুন নতুনই জয়েন করেছে ছেলেটা। দুটো কেসই ভাগে পেয়েছে সে। বয়স খুব বেশি নয়, তারওপর নতুন, তাই এতো উত্তেজনা। ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগে তুহিনের। কিন্তু সেটা তমালের সামনে প্রকাশ করেনা। জুনিয়রদের সামনে নিজের ইমেজ যতটা গম্ভীর আর রাগী করা যায় ততই ভালো বলে ধারণা তুহিনের। এসব চিন্তা করতে করতেই ডিজির রুমের সামনে চলে এলো তুহিন। নক করে বলল, ‘স্যার আসব?’
বেশ গভীর ভাবনায় মগ্ন ছিলে ডিরেক্টর জেনারেল শাফায়াত হুসাইন। নিজের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে চৌকস আর সাহসী ইনভেস্টিগেটরের আসার অপেক্ষা করতে করতে কেসটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবছিল সে। এরমধ্যেই পরিচিত সেই কন্ঠস্বর শুনে ভাবনায় ছেদ ঘটল তার। দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘এসো।’
তুহিন ভদ্রভাবে ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল। শাফায়াত এবারেও ওর দিকে না তাকিয়ে ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল, ‘বসো।’
তুহিন বসল। ডিরেক্টর জেনারেল এখনো ল্যাপটপে মগ্ন। তুহিনও সোজা হয়ে বসে আছে। অপেক্ষা করছে ওর স্যারের কিছু বলার। কিছুক্ষণ পর ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সোজা কাজের কথাতেই আসি?’
তুহিন দ্রুত সোজা হয়ে বসে মনোযোগী হয়ে বলল, ‘জি স্যার। আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কোন সমস্যা হয়েছে?’
শাফায়াত দুই হাত একত্রিত করে তুহিনের দিকে ভালোভাবে নিজের দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘গত পরশু রাতে বনানীর একটা ফ্ল্যাটে খু’ন হয়েছে। খু’নি খু’ন করে জায়গা ছেড়ে চলে গেছে। তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।’
তুহিন কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল শাফায়াতের দিকে হয়তো পরের কথা শোনার অপেক্ষা করছে। শাফায়াত একটু থেমে বলল, ‘এই হ’ত্যার ঠিক এক সপ্তাহ আগে কিশোরগঞ্জের এক গোডাউনে একটা লা’শ পাওয়া যায়। তার ঠিক একদিন আগে মীরপুরের একটা ছোট্ট বাংলোতে আরো একটা খু’ন হয়েছিল। তার ঠিক দু-দিন আগে একই দিনে দুটো খুন হয় গুলশানে। তার একদিন আগে গুলশানেই আরেকটা খুন হয়। অর্থাৎ বারো দিনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে মোট ছ’টা খুন। কিন্তু কোন থানার পুলিশ এখনো অবধি এই ছয়টা কেসের একটা কেসও সল্ভ করতে পারেনি।’
তুহিন এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল ডিজির কথাগুলো। সবটা শুনে একটু ভাবল তুহিন। এরপর শাফায়াতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু স্যার, খুনগুলো সব আলাদা আলাদা জায়গায় আলাদা আলাদা সময়ে হয়েছে। সবগুলো কেস একসঙ্গে বলার কারণ কী?’
‘কারণ প্রতিটা থানা থেকে যতগুলো রিপোর্ট এসেছে তার থেকে পুলিশের মনে হয়েছে খুনগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক থাকতে পারে।’
‘এমনটা মনে হওয়ার কারণ স্যার?’
মুখে জবাব দিলো না শাফায়াত। ল্যাপটপটা তুহিনের দিকে ঘুরিয়ে দিল। অর্থাৎ পড়ে দেখো। এরপর টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে দু ঢোকের মতো গিলল সে। তুহিন বেশ সময় নিয়ে দেখল কেসের ডিটেইলসগুলো। দেখা শেষে ডিজির দিকে তাকাতেই সে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিছু বুঝলে?’
তুহিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছিল। শাফায়াতের কথা শুনে হালকা চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কিন্তু স্যার এমনও তো হতে পারে ব্যপারটা কাকতালীয়?’
মাথা ঝাঁকালেন ডিরেক্টর জেনারেল। এরপর বললেন, ‘হুম হতেই পারে। কিন্তু নাও তো হতে পারে? আমাদের কাজটা কী বুঝেছো?
‘জ্বি স্যার’ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল তুহিন। ‘আমাদের কাজ হল এই খু’নগুলোর মধ্যে কোন কানেকশন আদৌও আছে, নাকি এটা শুধুই একটা ধারণা এটা খুঁজে বের করা।’
মৃদু হাসলেন শাফায়াত। আবার খানিকটা মাথা দুলিয়ে বলল, ‘গুড। আর কাজটা তোমাকে করতে হবে।’
তুহিন এবার একটু চুপ করে রইল। খুনের জায়গাগুলো আর সময়গুলো নিজের মনের মধ্যে একবার আওড়ে নিয়ে বলল, ‘স্যার, আমার মনে হয় আমাদের আজই কাজে নেমে পড়া উচিৎ। কারণ যদি খু’নগুলোর পরস্পরের সাথে সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে আমার ধারণা এখানেই শেষ নয়। আরও খু’ন হতে চলেছে।’
জেনারেল আবার ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল, ‘আমিও সেটাই ভাবছি। এইজন্যই সকাল সকালই ডেকে পাঠালাম তোমাকে। আজই বেরিয়ে পড়। আশা রাখছি খুব দ্রুতই ভালো খবর পাব। তোমায় এই ছ’টা খু’নের ডিটেইলস পাঠিয়ে দিয়েছি। বেস্ট অফ লাক।’
মাথা নাড়ালো তুহিন। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘থ্যাংকস স্যার। আসছি?’
কোন জবাব দিলো না ডিরেক্টর-জেনারেল। ওনার চোখ টেবিলে রাখা ল্যাপটপে। এর অর্থ ‘ হ্যাঁ যেতে পারো’। সেটা ভালোভাবেই জানে তুহিন। তাই আর কিছু না বলে উঠে সোজা নিজের কেবিনে চলে গেল। শাফায়াত হুসাইন ডিপার্টমেন্টের মধ্যবয়স্ক গম্ভীর ডিরেক্টর-জেনারেল। তবে এই কঠিন মানুষটি বাইরে প্রকাশ না করলেও মনে মনে যে তুহিনকে খুব স্নেহ করে সেটা বোঝে তুহিন।
রুমে ইনভেস্টিগেটর তুহিন আসতেই দাঁড়িয়ে গেল তার সহকারী তমাল। এতক্ষণ স্যারের অপেক্ষাই করছিল সে। নতুন কেসটা সম্পর্কে জানার জন্যে মনটা যে ছটফট করছে। তুহিন গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে বলল, ‘নতুন কেসের সব ডিটেইলস পাঠিয়ে দিয়েছে ল্যাপটপে। দ্রুত পড়ে নাও।’
তমাল যেন এই আদেশটারই অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ যাবত। তুহিন কথাটা শেষ করতেই তমাল দ্রুত ডিটেইলস চেক করতে শুরু করল। তুহিন হালকা হাসল। তবে সেটা তমালের আড়ালে। বেশ সময় নিয়ে বুঝে বুঝে পড়ে নিল তমাল। পড়া শেষ করে তুহিনের দিকে তাকাতেই তুহিন তমালের দিকে তাকিয়ে কাগজ ঠিক করতে করতে বলল, ‘কিছু বুঝতে পারলে?’
তমাল ঠিকঠাক হয়ে বসে বলল, ‘স্যার! আপনার কী মনে হয় কেসগুলো কানেক্টেড? আমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।’
তুহিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এটাই তো কাজ এখন। চলো!’
তমাল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কোথায়?’
‘বনানী। কারণ শেষ খুনটা ওখানেই হয়েছে।’
–
মৃদু হাওয়া বইছে চারপাশে। মাঘের শীতের মধ্যে এই মৃদু হাওয়া ঠান্ডায় শরীর জমিয়ে দিচ্ছে যেন। আকাশে পূর্ণ চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। গাছের পাতা থেকে মাঝেমাঝে শিশিরের ফোঁটা পড়ার শব্দ হচ্ছে। নিজের বুকে প্রেয়সীকে আগলে নিয়ে বসে আছে যুবক। মাঝেমাঝে চুলে নাক ডুবিয়ে তার চুল থেকে আসা হালকা সুগন্ধ উপভোগ করছে সে। রমনীও এই যুবকের বুকে যেন স্বর্গসুখ খুঁজে পায়। তাই পরম নিশ্চিন্তে লেপটে আছে নিজের প্রেমিকপুরুষের বুকে। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ বন্ধ রেখে রমনী বলল, ‘সারাজীবন এভাবে বুকে আগলে রাখবেন আমায়?’
‘তোমার কী মনে হয়?’
মৃদু হেসে জানতে চাইল যুবক। রমনী চোখ খুলে মাথা হালকা ওপরে তুলে বলল, ‘আপনাদের কোন ভরসা নেই। এই বিষয়ে তো একদমই না। আপনারা তো হৃদয়হীন হন।’
আবারও হাসল যুবক। রমনীর খোলা চুলে নিজের আঙ্গুল গলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আগে ছিলাম। হৃদয়হীন-ই ছিলাম। কিন্তু এই হৃদয়হীনের হৃদয় হয়ে এসেছো তুমি।’
লজ্জা পেয়ে আবারও যুবকের সাথে লেপ্টে গেলো রমনী। যুবকও পরম শান্তিতে প্রেয়সীকে আগলে নিল নিজের সাথে। হঠাৎই খেয়াল করল ওর বুকে কেউ নেই। শূন্য হয়ে গেছে বক্ষ। দ্রুত পাশে তাকিয়ে দেখল পাশেও নেই তার প্রেয়সী। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। আকাশের সেই পূর্ণ গোল চাঁদ আর নেই। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পূর্ণিমা রাত যেন মূহুর্তেই আমাবস্যা রাতে পরিণত হল। চারপাশে এতো সুন্দর গাছপালা আর নেই। দূর দূর পর্যন্ত শুধুই অন্ধকার। চারপাশে কোথাও খুঁজে পেলোনা সে তার প্রেয়সীকে। পাগলের মতো চারপাশে খুঁজেও পেলোনা তার প্রাণকে। খুঁজতে খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল সে। নিঃস্ব মনে হল নিজেকে। একদম নিঃস্ব।
একপ্রকার লাফিয়ে উঠে বসল লক্ষ্মীবাজারের একটা পুরোনো বিল্ডিং এর তিনতলার একটা রুমে ঘুমিয়ে থাকা যুবক। কাল প্রায় সারারাত জেগে নিজের পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল সে। শেষরাতেই হয়তো চোখ লেগে এসেছিল। এই শীতেও ঘেমে গেছে সে। পাশের পানির বোতলটা হাতে নিয়ে একবারেই বোতল অর্ধেক খালি করে ফেলল। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে মুহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলল সে। না দুর্বল হলে চলবে না। এখন তার অনেক কাজ। ঘুমোনোর সময় নেই। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল সে। তার দৃষ্টি এখন পাশের সেই পাঁচতলা বিল্ডিং এর দিকে। পরবর্তী লক্ষ্য তো সেখানেই!
_
বিকেল চারটা পনেরো। বনানী থানার ওসির সাথে কথা বলে নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে একসঙ্গে লাঞ্চ করে নেয় তুহিন আর তমাল। এরপর চলে আসে খুন হওয়া সাজ্জাদের স্ত্রী শায়লার কাছে। পুলিশ যদিও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু তার নিজেরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে তুহিন আর ঠিক তার মুখোমুখি বসে আছে সাজ্জাদের তৃতীয় স্ত্রী শায়লা। সাজ্জাদের খু’নের একমাত্র সাক্ষী। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তমাল। তুহিন খুব গভীরভাবে দেখছে শায়লাকে। শায়লার চোখে-মুখে ভয় স্পষ্ট। তুহিন বলল, ‘লোকটা ঠিক রাত সাড়ে বারোটায় আসে ফ্ল্যাটে। তাইতো?’
শায়লা মাথা নাড়ল। তুহিন আবার বলল, ‘আপনি কিছু শুনেছেন? আই মিন আপনার স্বামীকে খুন করার সময় ঐ লোকটা কিছু বলেছে? কেন মারছে? কোন জায়গা? কোন নাম? এনিথিং?’
শায়লা মাথা নেড়ে না করল। তুহিন চোখ ছোট ছোট করে তাকাল তার দিকে। শায়লা একটা ঢোক গিলে বলল, ‘আমি ভয় পেয়ে পাশের রুমে চলে গিয়েছিলাম। তেমন কিছুই শুনতে পাইনি। তবে আমি এপাশ থেকে শুধু শুনছিলাম লোকটা কারো ঠিকানা জানতে চাইছিল।’
তুহিন আর তমাল দুজনেই চমকে উঠল। তুহিন একটু উত্তেজিত কন্ঠে বলল, ‘কার ঠিকানা? কোন নাম বলেছে?’
‘না। শুধু আমার স্বামীকে একবার লক্ষ্মীবাজার বলতে শুনেছিলাম।’
মাথা নাড়ল তুহিন। তমাল কিছু একটা ভেবে বলল,
‘আপনি জানতেন আপনার স্বামীর তৃতীয় স্ত্রী আপনি?’
শায়লা মাথা নিচু করে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। তুহিন বলল, ‘খুনির চেহারা দেখেছেন নিশ্চয়ই?’
শায়লা চমকে তাকাল। মনে পড়ে গেল খুনির সেই ভয়াবহ হুমকি। জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে শায়লা বলল,
‘দেখেছি। কিন্তু চেহারাটা আমার পুরোপুরি মনে নেই।’
তুহিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ একটুও মনে নেই?’
না বোধক মাথা নাড়ল শায়লা। তুহিনের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা সে। তুহিন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে শায়লার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ধন্যবাদ। প্রয়োজনে আমরা আপনাকে আবার ডাকব। আসছি।’
কথাটা বলে উঠে চলে এলো তুহিন। পেছন পেছন তমালও এলো। বাইরে এসে লিফ্ট ব্যবহার না করে সিঁড়ির দিকে এগোলো তুহিন। পেছনে হাঁটতে হাঁটতে তমাল বলল, ‘স্যার, আমার মনে হয়না মহিলা পুরোপুরি সত্য বলল।’
তুহিন হেসে বলল, ‘আমি নিশ্চিত সে পুরোপুরি সত্যি বলেনি।’
তমাল অবাক হল। কিছু একটা ভেবে তমাল বলল, ‘এমন তো নয় স্যার যে মহিলা নিজেই নিজের স্বামীকে খুন করেছে?’
তুহিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, ‘হতে পারে। তবে সেটা হলে ওনার সাথে কেউ অবশ্যই ছিল। কানে আর ঠোঁটে শক্ত কিছু দিয়ে জোরে আঘাত করা হয়েছে। সাজ্জাদের সাথে গায়ের জোরে উনি পেরে উঠবেন না সেটা নিশ্চিত। তবে স্বামীর মৃত্যুতে মহিলা বিন্দুমাত্র কষ্ট পাননি।’
তমাল মাথা নেড়ে বলল, ‘প্রেমিক হতে পারে স্যার? হয়তো পরকীয়ার কেস?’
তুহিন বলল, ‘কিছুই অসম্ভব না তমাল। যা কিছু হতে পারে। তুমি _’
এরমধ্যেই তুহিনের ফোন বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ইরার ফোন। কিছুটা ভয় পেল তুহিন। প্রেমিকার বকুনী হজম করার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে ইরা বলল, ‘কোথায় আছো?’
তুহিন ইতস্তত করে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, ‘এখন বনানীতে আছি। সকালের মেসেজ দেখেছো তো?’
ইরা কঠিন গলায় বলল, ‘না দেখিনি। দেখতে চাইও না। আর দেখবোও না। থাকো যেখানে খুশি। শুধু আমার কাছে না আসলেই হল। আসলে তোমাকে আমি খু’ন করব তুহিন। মাথায় রেখো।’
তুহিন কিছু বলার আগেই ইরা ফোন কেটে দিল। তুহিন মুখ কাচুমাচু করে কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখল। তমাল নিজের স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। একমাত্র এই নারীর ফোন এলেই তুহিনের এমন মুখ দেখার সৌভাগ্য হয় তার। তুহিন তমালকে হাসতে দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই তমাল অনেক কষ্টে নিজের মুখ স্বাভাবিক করে ফেলল। তুহিন গলা ঝেড়ে বলল, ‘ হ্যাঁ, যা বলছিলাম। তুমি কেসের ডিটেইলস চেক করে দেখেছ? সাজ্জাদ আন্ডারওয়ার্ল্ডের ‘ ব্লাকহোল গ্রুপের’ একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী।’
তমাল মাথা নেড়ে বলল, ‘জ্বি স্যার। এই গ্রুপটা সম্পর্কে কমবেশি সবাই শুনেছে। কিন্তু আজ অবধি এর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। না কাউকে ধরা গেছে।’
নিচে নেমে গাড়িতে উঠতে উঠতে তুহিন বলল,
‘এক্সাক্টলি! আর বাকি যে খুনগুলো হয়েছে প্রত্যেকের মধ্যে একটাই মিল। সবার ব্যাকগ্রাউন্ড একটাই। আন্ডারগ্রাউন্ড। আর এটাই আমায় ভাবতে বাধ্য করছে যে সবগুলো মার্ডার হয়তো কানেক্টেড। কিন্তু সমস্যা হল ছ-জনেই আলাদা আলাদা দুটো গ্যাং এর সন্ত্রাসী। যেকোনো একটা পক্ষ হলে বোঝা যেতো আরেকপক্ষ কাজটা করছে। কিন্ত শিকার দুই পক্ষ থেকেই হচ্ছে। তাহলে শিকারী টা কে? ‘
তমাল ফ্রন্ট সিটে বসে বলল, ‘তৃতীয় পক্ষ?’
‘ হতে পারে। তবে অন্যকিছুও হতে পারে।’
‘ কী স্যার?’
তুহিন বাইরে তাকিয়ে কিছু ভাবতে ভাবতে বলল,
‘সর্ষের মধ্যে ভূত। কথাটা শোননি তমাল?’
তমাল বুঝল ব্যাপারটা। ও নিজে কিছুটা চিন্তা করে বলল, ‘স্যার যদি খুনগুলো কানেক্টেড হয়। তাহলে?’
তুহিন কিছু একটা ভেবে বলল, ‘তাহলে পরবর্তী খুন খুব তাড়াতাড়ি হতে চলেছে। অথবা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কোথায়?’
হঠাৎ করেই তুহিনের মাথায় এল শায়লার বলা কথাটা। ঐ আগন্তুককে সাজ্জাদ লক্ষ্মীবাজারের কথা বলছিল। ‘লক্ষ্মীবাজার!’ কথাটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল তুহিন। মনে মনে কিছু একটা ক্যালকুলেট করে হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, শীট!
#চলবে…
[ রি-চেক করিনি। কেন্দ্রীয় চরিত্র কে সেটা নিয়ে আপাতত না ভেবে কাহিনীতে ফোকাস করুন। কেন্দ্রীয় চরিত্র আপনাআপনি বুঝে যাবেন দ্রুত। যেহেতু থ্রিলার। দুই তিন পর্বেই কাহিনী কিছুই বুঝবেন না এটাই স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে সবটাই বুঝবেন। তাই সকলে গঠনমূলক মন্তব্য করুন। যাদের কাছে উপন্যাস পৌঁছাবে অবশ্যই রিঅ্যাক্ট করবেন। হ্যাপি রিডিং। ]