#তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর
পর্ব ১৪
আজ টিউশনিতে নবনীর প্রথম দিন।নবনীর হঠাৎ করেই ভীষণ নার্ভাস লাগছে।বিয়ের আগে ও নবনী টিউশনি করেছে,তখন এতো নার্ভাস লাগে নি।
নবনী একটা সাদা রঙের থ্রিপিস পরে বের হয়েছে বাসা থেকে।বিকেল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত পড়াবে নীড়কে।বিকেলের উত্তাপহীন রোদেও নবনী ঘামছে।
রিকশা না নিয়ে নবনী হেটে গেলো।
যেতে যেতে ভাবতে লাগলো টিউশনি করিয়ে কতো টাকা পাবে?
শিমলা যদিও বেতনের কথা বলে নি তবুও নবনী ধরে নিয়েছে ২ থেকে ২.৫ হাজার টাকার বেশি হবে না।অথচ ফ্ল্যাট ভাড়াই মাসে ৩৫ হাজার টাকা।
মাথায় এক রাজ্যের চিন্তা নিয়ে নবনী হাটতে লাগলো।
শান্তির নীড় বাসার সামনে এসে নবনী একটু জিরিয়ে নিলো।গেইটের দারোয়ানকে নবনী নিজের পরিচয় দিতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিলো।ভেতরে ঢুকে নবনী চমকে গেলো। ডুপ্লেক্স বাড়িটি বাহিরে থেকে দেখা না গেলেও ভেতরে ঢুকে দেখলে মাথা ঘুরে যাবে ফুল বাগান দেখে।সামনে ফুলের বাগান। অন্যপাশে একটা জলপরীর মূর্তি।
বাগানে বসার জন্য চেয়ার টেবিল রাখা আছে।
ফুলের বাগানের দিকে তাকিয়ে নবনীর ভীষণ ভালো লাগলো। এতো ঝোপালো গোলাপ নবনী আগে দেখে নি।বাহারি রঙের গোলাপ দেখে নবনীর ইচ্ছে হলো গিয়ে জড়িয়ে ধরতে।
শিমলা মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। নবনীকে দেখে উচ্ছল কিশোরীর মতো ছুটে এলো। এসেই নবনীকে জড়িয়ে ধরলো। যেনো দুজন কতোদিনের চেনা কেউ।
নিজে থেকেই বলতে লাগলো,”আরে আমি সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। দিন কাটছে না যেনো।এতো দেরিতে এলে কেনো?আরো আগে আসতে।”
নবনী বুঝতে পারলো না শিমলা এতো উচ্ছ্বসিত কেনো নবনীকে দেখে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে নবনী বুঝতে পারলো এরা বেশ ধনী। দেয়ালে বিভিন্ন পেইন্টিং লাগানো আছে,যা এদের আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ। ধবধবে সাদা রঙের সোফা,দেখেই নবনীর মনে হলো ভীষণ আরামদায়ক এই সোফা।
সিড়ি বেয়ে দোতলায় চলে এলো। নীড় বসে আছে পড়ার টেবিলে। দেখে মনে হচ্ছে যেনো ভীষণ সিরিয়াস লেখাপড়া নিয়ে।
শিমলা ফিসফিস করে বললো,”এর এই ভোলা ভালা চেহারা দেখে কনফিউজড হয়ে যেও না।পড়াতে গেলে বুঝবে দুষ্টের শিরোমণি। “
নবনী মুচকি হেসে চেয়ারে বসলো।শিমলা চলে গেলো ভেতরের দিকে।
নবনী বসেই নীড়কে বললো,”বাবু,আজকে যদি তুমি সুন্দর করে সব পড়ো আমার সাথে তবে পড়া শেষ হলে আমি তোমাকে একটা চকলেট দিবো,রাজি?”
নীড় এক মাথা ঝাকড়া চুল নাড়িয়ে বললো,”হ্যাঁ মিস রাজি,তবে শোনো,চকলেট কিন্তু চুপিচুপি দিও আমাকে।মাম্মাম দেখলে আমাকে না দিয়ে খেয়ে ফেলবে,মাম্মাম একটু ছোঁচা তো।কাউকে বলো না যেনো,এটা একটা সিক্রেট। “
নবনী হেসে ফিসফিস করে বললো,”ওকে বাবু,বলবো না।”
নীড় আবারও ফিসফিস করে বললো,”আমাকে বাবু বলো না,বাবু তো মাম্মাম বাবাকে বলে। “
নবনীর ভীষণ হাসি পেলো এই কথা শুনে।
নবনী বললো,”আচ্ছা আর বলবো না। এবার বলো তুমি কিসে পড়ো?”
নীড় বললো,”আমি তো পড়ি না মিস,আমি পড়াই আমার মিসদের।”
নবনী জিজ্ঞেস করলো,”তাই না-কি? কিভাবে পড়াও তুমি? “
নীড় গলা খাদে নামিয়ে বললো,”আমাদের মিসেরা কেউ কোনো পড়া পারে না।আমি বাসা থেকে যা পড়ে যাই তাই গিয়ে মিসদের বলি।মিসেরা সবসময় আমাকে জিজ্ঞেস করে নীড় এটা বলো,ওটা বলো,এটা পারো,ওটা পারো?”
নবনী হাসি চেপে বললো,”বুঝেছি তো তুমি অনেক কিছু জানো।আসো এবার আমরা পড়ি।”
নীড় সবে মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে। নবনী একটা খাতায় ইংরেজি বর্ণমালা লিখে বললো,”এগুলো পড়ো তো।”
নীড় বিরক্ত হয়ে বললো,”মিস এগুলো তো আমি পড়বো না।আমি তো এগুলো সব জানি।এগুলো তো ছোট বাচ্চারা পড়ে। আমি এসব পড়ে কি করবো,আমি তো বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবো।আমাদের ছাদে অনেকগুলো কমলা গাছ আছে। আমি নিয়মিত বিকেলে এক ঘন্টা ছাদে গিয়ে বসে থাকি।মাথায় আপেল পড়লে না-কি বিজ্ঞানী হওয়া যায়। আমি কমলা গাছ তলায় বসে আরো বড় বিজ্ঞানী হবো।”
নবনী বলল,”আচ্ছা পড়া শেষ করে তারপর গিয়ে বসো,আমি নিজে দিয়ে আসবো তোমাকে।”
নীড় অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে।নবনী আবারও বললো,”এবার বলো। “
নীড় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে A থেকে E পর্যন্ত বললো।তারপর বললো,”আচ্ছা মিস আমি এখন একটু চিন্তা করতে বসবো।আপনি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।আমাকে বিজ্ঞানী হতে হবে তো।তাই বেশি বেশি ভাবনা চিন্তা করতে হয়।”
নবনী হতাশ হয়ে বললো,”কি নিয়ে চিন্তা করছো?”
নীড় বললো,”মাম্মাম আমাকে খালি পায়ে হাটতে দেয় না।বলে নীড়,খালি পায়ে থেকো না,কাদা গায়ে লাগিও না।সবখানে জীবানু। আমি ভাবছি আমাদের বাগানে যেই পাখিরা আসে ওরা কেনো জুতা পায়ে দেয় না।ঠান্ডার সময় আমি মোজা পায়ে দিই নয়তো মাম্মাম রাগ করে। ওরা কেনো মোজা পরে না মিস?”
নবনী টেবিলে মাথা রেখে বললো,”আমি জানি না বাবা।”
নীড় বললো,”আসো,আমরা একসাথে ভাবি এসব নিয়ে।”
নবনী বললো,”আগে পড়া শেষ করে তারপর ভাববো।এবার বলো,এটার নাম হচ্ছে F। “
নীড় কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,”কেনো মিস,এটার নাম F হবে কেনো?কে রেখেছে এর নাম F?আমি একে F বলবো না।আমার এই নাম পছন্দ না মিস।”
নবনী বললো,”কি নামে বলবে?”
নীড় বললো, “তা তো এখন বলতে পারবো না।কমলা গাছের নিচে বসে ভেবে বের করতে হবে।এটাও তো একটা ভাবনার বিষয় মিস।”
নবনীর মনে হলো,যুদ্ধ করাও এর চাইতে সহজ।
শিমলা এলো নাশতার ট্রে নিয়ে।হরেক রকম নাশতা ট্রে তে।চা,রসমালাই,লাড্ডু,চমচম,নুডলস।
নবনী ভীষণ আনইজি ফিল করলো।শিমলার দিকে তাকিয়ে বললো,”এক গ্লাস পানি ছাড়া আমি আর কিছুই খাবো না।প্লিজ আপনি নেক্সট টাইম থেকে আর এসব করবেন না।”
শিমলা মুখ বাঁকা করে বললো,”তা বললে কি হবে না-কি? আমি তো প্রতিদিন এই সময় নাশতা করি।প্রতিদিন তুমি আর আমি একসাথে নাশতা করবো এই সময়।
আসলে কি জানো তো,এতো বড় বাসায় সারাদিন একা থাকি,কারো সাথে যে কথা বলবো সেই সুযোগ ও নেই।তুমি এলে ভীষণ ভালো লাগলো আমার।ছেলের পড়া না হলেও আমি তো একটু কথা বলার সুযোগ পাবো।মন খুলে কথা বলার মতো একজন মানুষের বড্ড অভাব আমার।নীড়ের বাবা তো সারাদিন ব্যস্ত থাকে তার কাজে,তাছাড়া আমাদের দিন যখন ওদের তখন রাত,তাই সবসময় কথাও বলা সম্ভব হয় না।আমার না দমবন্ধ লাগে। “
নবনী হাসলো মনেমনে। মানুষের কতো অভাব?তার অভাবে টাকাপয়সার। আবার কেউ অঢেল টাকাপয়সার মধ্যে থেকে মন খুলে কথা বলার মানুষের অভাবে ভুগছে।
————–
বিকেলে নিতু রেডি হয়ে বললো, “মা আমরা একটু আমার বাবার বাসা থেকে ঘুরে আসি।”
তাহেরা বেগম গম্ভীর হয়ে বললো,”হু।”তার মনে এখনো রাগ জমে আছে সব।
নিতু আর কিছু না বলে বের হলো তামিমকে নিয়ে।বাবার বাসায় গিয়ে মা বাবার সাথে দেখা করে নিতুরা সন্ধ্যায় বের হলো। তারপর কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে একটা রেস্টুরেন্টে বসলো দুজন মিলে।
নিতু দুজনের জন্য দুটো বার্গার আর ড্রিংক অর্ডার দিলো।বাহিরে বের হবার পর তামিমের মুড কিছুটা ভালো হয়েছে।রিকশায় নিতুর হাত ধরে বসেছে তামিম।এটুকুতেই নিতুর চোখে জল চলে এলো। অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছে নিলো নিতু।
নিজেরা খাওয়ার ফাঁকে নিতু বাসার জন্য খাবার অর্ডার দিলো। ফ্রায়েড রাইসের তিনটা সেট মেন্যু পছন্দ করে অর্ডার করে দিলো।
বাসায় যেতে যেতে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেলো। নিতু নিজে গিয়ে খাবার গরম করে দিশা,লুবনা,তাহেরা বেগমকে ডাকলো খেতে আসার জন্য।
মুখ কালো করে তাহেরা বেগম আসলেন খেতে।তারপর খাবার দেখে নাক সিঁটকে বললেন,”নিজেরা তো খেয়ে এসেছো আরো ভালো ভালো খাবার। আমাদের জন্য নিয়ে এসেছো এসব সান্ত্বনা দেয়ার জন্য না-কি? “
নিতু চরম অবাক হয়ে তামিমের দিকে তাকালো। তামিম মা’কে কিছু বলতে গিয়েও বললো না,কেননা এখন সে কথা বললে মা আরো রেগে যাবেন।
তাহেরা বেগম ভেতরে ক্ষোভ পুষে রেখেছেন গত রাত থেকে।এখন সুযোগ পেয়ে তা প্রকাশ করে দিলেন।
লুবনার ভীষণ ইচ্ছে করলো খেতে বসতে।কিন্তু মায়ের অনুমতির জন্য এখনো বসতে পারছে না।
তাহেরা বেগম রাগী স্বরে বললো,”এসব খাবার নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দাও দিশা।”
দিশা খাবার ফেলার জন্য এগিয়ে যেতেই নিতু হাত ধরে থামিয়ে দিলো।তারপর বললো,”মাফ করবেন মা।আপনাদের রুচিতে যদি এসব খাবার খেতে ভালো না লাগে তো খাবেন না।এসব খাবার আমার টাকায় কেনা,অফিসে আমার চেহারা দেখে স্যালারি দেয় না।কাজ দেখে দেয়।আমি কষ্ট করে উপার্জন করি।সেই উপার্জনের টাকায় কেনা খাবার আমি ফেলতে দিবো না।”
এই বলে নিতু এক প্লেট খাবার নিজের জন্য রুমে নিয়ে রেখে বাকি দুই প্লেট নিয়ে বের হয়ে গেলো।
এক প্লেট নিয়ে লিফট ম্যানকে দিলো,আরেক প্লেট নিচে নেমে গিয়ে দারোয়ানকে দিয়ে এলো।
বাসায় এসে কারো সাথে কোনো কথা না বলে নিজের খাবার নিজে খেতে লাগলো।
তাহেরা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন নিতুর এই ব্যবহার দেখে।
তামিম কে গিয়ে বললেন,”এতো বড় বেয়াদব এই বউ,আমাকে একবার অনুরোধ ও করলো না?দেখলি তুই,চুপ করে থাকবি তুই এর পরেও?”
নিতু বললো,”আমি যদি অপরাধ করতাম তবে আপনার ছেলে কিছু বলতে পারতো। যদি বলা দরকার হয় তবে আপনাকে বলবে।আমি এই বাসায় আসার পর থেকে আপনি আমার সাথে এরকম করছেন।অযথা আমার সাথে লাগতে আসছেন।তাই আপনাকে ও আমি বলে দিচ্ছি, আমি আবার চুপ করে অন্যায় সহ্য করতে পারি না।”
খাবার শেষ করে নিতু রুমে চলে গেলো। তামিম কি করবে ভেবে না পেয়ে নিতুর পিছনে পিছনে চলে গেলো রুমে।
এসব যুদ্ধ দেখতে দেখতে সে এবার ক্লান্ত। আর ভালো লাগছে না তার এসব।
চলবে….
রাজিয়া রহমান